ভূমিকা :
মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব মুহাদ্দিছ দেহলভী ভারতীয় উপমহাদেশের একজন খ্যাতিমান মুহাদ্দিছ ছিলেন। ইলমে হাদীছের প্রচার-প্রসারে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। মৃত সুন্নাত পুনর্জীবিতকরণে তাঁর অবদান অবিসংবাদিত। তিনি সুদীর্ঘ ৬০ বছর দরস-তাদরীসের মাধ্যমে একদল যোগ্য ছাত্র তৈরি করেন, যারা এ উপমহাদেশে কুরআন ও সুন্নাহর বাণীকে সমুন্নতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দিল্লীতে তাঁর খুৎবা শুনে বহু মানুষ আহলেহাদীছ হয়েছেন। জামা‘আতবদ্ধ জীবন-যাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতঃ তিনি ১৮৯৫ সালে ‘জামা‘আতে গোরাবায়ে আহলেহাদীছ’ প্রতিষ্ঠা করেন। বায়‘আত ও ইমারতভিত্তিক এই সংগঠনটি উপমহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার-প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জন্ম ও বংশ পরিচয় :
তাঁর নাম আব্দুল ওয়াহ্হাব, উপনাম আবু মুহাম্মাদ এবং উপাধি ‘মুহাদ্দিছে হিন্দ’ (ভারতের মুহাদ্দিছ)।[1]
তিনি হীরার জন্য বিখ্যাত পাঞ্জাবের ঝং যেলার ‘ওয়াসুআস্তানা’ (واسوآستانه)
নামক অখ্যাত গ্রামে এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মসন
সঠিকভাবে জানা যায় না। তিনি মৃত্যুর ৩ মাস ১০ দিন পূর্বে ১৩৫১ হিজরীর রবীঊল
আউয়াল মাসের শেষের দিকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘জামা‘আতে গোরাবায়ে আহলেহাদীছ’-কে
যে অছিয়ত করেছিলেন, সেটি একই সনের রবীঊল আখের মাসে ‘ছহীফায়ে আহলেহাদীছ’
(দিল্লী) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘বর্তমানে আমার
বয়স ৭০ বছর হবে’। এই হিসাবে তাঁর জন্মসন ১২৮০ হিঃ/১৮৬৩ খ্রিঃ।[2] তাঁর বংশপরিক্রমা হল- আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন হাজী মুহাম্মাদ বিন মিয়াঁ খোশহাল বিন মিয়াঁ ফাতহ বিন মিয়াঁ কায়েম।[3]
তাঁর পিতৃপুরুষ স্বচ্ছল ও ধার্মিক ছিল। তাদের মধ্যে পরহেযগারিতা ও সৎকর্ম সম্পাদনের মানসিকতা বিদ্যমান ছিল। মাওলানার পিতা মিয়াঁ হাজী মুহাম্মাদ হজ্জ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। সেই সময় হজ্জ করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। স্বচ্ছল ও সৎ ব্যক্তিই কেবল হজ্জ সম্পাদন করার জন্য মক্কায় যেত।
মাওলানার
বয়স ২/৩ বছর হলে তার পিতা ‘ওয়াসুআস্তানা’ থেকে মুলতান যেলার মুবারকাবাদ
গ্রামে হিজরত করেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।[4]
শিক্ষা-দীক্ষা :
৬
বছর বয়সে তাঁর লেখাপড়া শুরু হয়। তিনি গ্রামের মসজিদে কুরআন মাজীদ পড়া
শেখেন এবং নাযেরানা খতম করেন। এরপর ছোট ভাই নূর মুহাম্মাদকে সাথে নিয়ে
ফিরোযপুর যেলার ‘লাক্ষৌকে’তে অবস্থিত হাফেয মুহাম্মাদ লাক্ষাবী প্রতিষ্ঠিত
বিখ্যাত মাদরাসা ‘জামে‘আ মুহাম্মাদিয়া’তে ভর্তি হন। এখানে তিনি সর্বপ্রথম
কুরআন মাজীদ হিফয শুরু করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রখর ধীশক্তির অধিকারী
ছিলেন। একবার যা মুখস্থ করতেন তা ভুলতেন না। এজন্য অল্প সময়ে তিনি কুরআন
মাজীদ মুখস্থ করতে সক্ষম হন। এরপর নাহু-ছরফের বই পড়া শুরু করেন। জামে‘আ
মুহাম্মাদিয়াতে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি প্রখ্যাত আহলেহাদীছ আলেম হাফেয
আব্দুল্লাহ গযনভী প্রতিষ্ঠিত অমৃতসরে অবস্থিত ‘মাদরাসা গযনভিয়াহ’তে ভর্তি
হন। এখানে নাহু-ছরফের গ্রন্থগুলো পড়া শেষ করার পর বুলূগুল মারাম, রিয়াযুছ
ছালেহীন প্রভৃতি হাদীছের প্রাথমিক গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করেন। এ দু’টি
মাদরাসায় অধ্যয়নকালে মাওলানা গযনভী ও হাফেয মুহাম্মাদ লাক্ষাবীর ইলম ও আমল
এবং তাক্বওয়া-পরহেযগারিতা দ্বারা তিনি অত্যন্ত প্রভাবিত হন। তাঁর
চিন্তা-চেতনা ও কর্মে সারাজীবন তাঁদের প্রভাব বিদ্যমান ছিল।[5]
মিয়াঁ নাযীর হুসাইন সকাশে :
পনের
বছর বয়সে তিনি অনেক দ্বীনী গ্রন্থ অধ্যয়ন শেষ করেন। এরপর হাদীছের উচ্চতর
গ্রন্থাবলী পড়ার জন্য ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে দিল্লী যাত্রা করেন। সেখানে
মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভীর মাদরাসায় গিয়ে ভর্তি হয়ে হাদীছ অধ্যয়নে নিমগ্ন
হন। দু’ভাই দিল্লীর হাফীযুল্লাহ খাঁ মসজিদে থাকতেন। দেহলভী উক্ত মসজিদে
পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করাতেন এবং মিশকাতুল মাছাবীহ-এর দরস প্রদান করতেন।
কূয়া থেকে পানি উত্তোলন করে মুছল্লীদের ওযূর ব্যবস্থা করার জন্য দু’ভাই
মাসে ১২ আনা পেতেন। এর দ্বারা তারা খাদ্যদ্রব্য, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং
বইপত্র ক্রয় করতেন। অনেক সময় রুটি-তরকারী ক্রয় করতে না পারলে ছোলা ভাজা
অথবা গাজর-মূলা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতেন।[6]
ইলম অর্জনে কষ্ট স্বীকার :
মিয়াঁ
নাযীর হুসাইন দেহলভী তাঁর ছাত্রের যোগ্যতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন।
দিল্লীর সোরাই হাফেয বান্না (বর্তমানে গান্ধী মার্কেট, সদর বাজার, দিল্লী)
মসজিদের মুছল্লীরা মিয়াঁ ছাহেবের কাছে একজন খতীব দেয়ার অনুরোধ জানালে তিনি
মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাবকে সেখানকার খতীব নিযুক্ত করেন। তিনি সেখানে জুম‘আর
খুৎবা প্রদান ছাড়াও মিশকাতুল মাছাবীহ-এর দরস দেয়া শুরু করেন। অল্প সময়ের
ব্যবধানেই তাঁর দরস ও খুৎবার প্রভাব প্রকাশিত হতে শুরু করে। উক্ত হানাফী
মসজিদের মুছল্লীরা আহলেহাদীছ হতে আরম্ভ করে। এতে হানাফীদের গাত্রদাহ শুরু
হয়ে যায়। তারা মাওলানার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। একদিন রাতে তাঁর
অনুপস্থিতির সুযোগে হানাফীরা তাঁর সংগৃহীত দুর্লভ গ্রন্থ, পান্ডুলিপি ও
অন্যান্য বইপত্র কাপড়ে বেঁধে মসজিদের কূয়াতে ফেলে দেয়। ভোরবেলায় তিনি অবগত
হলে সেগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিছু বই উদ্ধার করতে সমর্থ হলেও অধিকাংশই
পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে যায়।[7] মাওলানার প্রিয় ছাত্র মাওলানা আব্দুল জলীল
সামরূদী এ সম্পর্কে বলেন, ‘একদিন সকাল বেলায় মাওলানার সাথে কিষাণগঞ্জ
যাওয়ার পথে ঐ কূয়া অতিক্রমকালে মাওলানা সেখানে নিয়ে গিয়ে কূয়া দেখিয়ে বলেন,
সোরাইওয়ালারা এর মধ্যে আমার বইপত্র নিক্ষেপ করেছিল। আমি উঁকি মেরে দেখলে
সেখানে বইপত্রগুলোর পৃষ্ঠার উপরে শুধু ময়লা পানি দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। আমার
চক্ষু অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল। আমি তোমাকে কী আর বলব’।[8]
দাওরায়ে হাদীছ সম্পন্ন :
ছাত্রজীবনে
মাওলানা ধৈর্যের সাথে নানান প্রতিকূলতাকে মুকাবিলা করেন এবং নিজেকে দ্বীনী
ইলম হাছিলের পথে ধরে রাখেন। এভাবে ১৪ বছর ধরে ইলমে দ্বীন হাছিল করে ১৯/২০
বছর বয়সে ফারেগ হন। তিনি সেযুগের চারজন সেরা মুহাদ্দিছের নিকট তাফসীর,
কুতুবে সিত্তাহ, আরবী সাহিত্য, নাহু-ছরফ ও অন্যান্য বিভিন্ন গ্রন্থ অধ্যয়ন
করেন। এঁরা হলেন (১) মাওলানা হাফেয মুহাম্মাদ লাক্ষাবী (২) মাওলানা
আব্দুল্লাহ গযনভী (৩) ইমাম শাওকানীর ছাত্র মাওলানা মানছূরুর রহমান (পরে
ঢাকাভী) ও (৪) মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভী।[9]
দরস-তাদরীস :
ফারেগ হওয়ার পর মাওলানা দেহলভী দিল্লীতে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য স্বীয় পিতা হাজী মুহাম্মাদকে দিল্লীতে নিয়ে আসেন। দিল্লীর হাজী নূর ইলাহীর মেয়ে মুহাম্মাদী বেগমের সাথে তাঁর বিবাহ হলে দিল্লীর সাথে সম্পর্ক আরো গভীর হয়।
ফারেগ হওয়ার পর তিনি ১৩০০ হিজরীর প্রথম দিকে দিল্লীর কিষাণগঞ্জ মসজিদে ‘দারুল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ’ নামে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মহান আল্লাহ তাঁকে হাদীছের বুঝ এবং হাদীছ সমূহের মাঝে সমন্বয় সাধন করার অপরিসীম যোগ্যতা দান করেছিলেন। ফলে অল্প সময়ের ব্যবধানে তাঁর বিদ্যাবত্তার খ্যাতি দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ে। অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন স্থান ও অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে ছাত্ররা তাঁর মাদরাসায় এসে জ্ঞানার্জন করে যোগ্য আলেম হিসাবে বের হয়ে কুরআন ও সুন্নাহর ঝান্ডাকে উড্ডীন করতে থাকেন।
তিনি উক্ত মসজিদে জুম‘আর খুৎবা প্রদান করতেন। দিন দিন দরস-তাদরীসের পরিধিও বাড়তে থাকে। কিন্তু এমন এক অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে, মসজিদ ও মাদরাসা স্থানান্তরিত করতে হয়। এ খবর তাঁর ভক্ত হাজী আব্দুল গণী পাঞ্জাবী অবগত হলে দিল্লীর সদর এলাকায় একটা বড় প্লট ক্রয় করে সেখানে ‘মসজিদে কালাঁ’ (বড় মসজিদ) নামে একটি সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করে দেন।[10] মসজিদ নির্মাণের সময় নির্মাতা হাজী আব্দুল গণী মাওলানাকে বলেন, ‘মসজিদের পাথরে আপনার নাম খোদাই করে দেই। যাতে আমার পরে আপনাকে কেউ এই মসজিদ থেকে বের করে দিতে না পারে’। জবাবে তিনি বলেন, ‘মসজিদে আমার নাম লেখার প্রয়োজন নেই। মসজিদ থেকে বের করে দিলে মহান আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা করে দিবেন’। অবশেষে হাজী ছাহেব নিজের নামফলক মসজিদে স্থাপন করেন।[11] তাছাড়া মাওলানার থাকার জন্য একটা সুন্দর বাড়িও হাজী ছাহেব তৈরী করে দেন। ফলে কিষাণগঞ্জ থেকে মাদরাসাটি এ মসজিদে স্থানান্তরিত হয় এবং এখানে ইলমের বৃষ্টি অঝোর ধারায় বর্ষিত হতে থাকে। মাওলানার দরস, ওয়ায-নছীহত ও জুম‘আর খুৎবা শ্রবণ করে লোকজন শিরক ও বিদ‘আত থেকে তওবা করতে থাকে। এতে উক্ত এলাকা তাওহীদের রোশনীতে আলোকিত হয়ে উঠে।
ইত্যবসরে মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব হজ্জ সম্পাদন করতে গেলে হাজী
আব্দুল গণী মৃত্যুবরণ করেন। তদীয় পুত্র মুহাম্মাদ ওমরকে তার স্থলাভিষিক্ত
নিযুক্ত করা হয়। তার চাচা গোঁড়া হানাফী ছিলেন। তিনি মাযহাবী কারণে
মাওলানাকে মোটেই সহ্য করতেন না। মাওলানার হজ্জে যাওয়াকে সুবর্ণ সুযোগ
হিসাবে গ্রহণ করে তিনি ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেন। তিনি ভাতিজাকে মাওলানার
বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলেন এবং এই পরিকল্পনা করেন যে, হজ্জ থেকে ফিরলে
মাওলানাকে মসজিদে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। বাস্তবেই হজ্জ থেকে ফেরার পর
তাঁকে আর মসজিদে ঢুকতে দেয়া হয়নি। মাওলানাও জোর করে মসজিদে প্রবেশ করার
চেষ্টা না করে ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। মসজিদের হুজরা থেকে
নিজের আসবাবপত্র ও বইপুস্তক চেয়ে নিয়ে ঘরে রেখে দেন। বাড়ির নিচের অংশ- যেটি
মেহমানখানা হিসাবে ব্যবহৃত হত, সেটাকে মাদরাসার রূপ দান করে ছাত্রদের
থাকার ব্যবস্থা করেন। এখানে জুম‘আ ও জামা‘আতের ব্যবস্থা করেন এবং পূর্বের
ন্যায় দরস-তাদরীস চলতে থাকে। ১৩২৫ হিজরীর দিকে এ ঘটনা ঘটেছিল। এর কিছুদিন
পর কালাঁ মসজিদের হিতাকাঙ্খীরা মাওলানার কাছে এসে ক্ষমা চেয়ে তাঁকে ও
ছাত্রদেরকে সেখানে নিয়ে যান। এভাবে পূর্বের সেখানে মতো পূর্ণোদ্যমে
দরস-তাদরীস চলতে থাকে।[12]
মাদরাসা প্রতিষ্ঠা :
ঐ সময় কতিপয় আহলেহাদীছ আলেম মাওলানাকে রেঙ্গুনে যাওয়ার দাওয়াত দেন। মাওলানা তাদের আন্তরিক দাওয়াতে সেখানে যান এবং বক্তব্যের মাধ্যমে তাওহীদ ও সুন্নাহর বাণী প্রচার করেন। লোকজন তাঁর বক্তব্যে অত্যন্ত প্রভাবিত হয় এবং তারা মোটা অংকের অর্থ জমা করে মাওলানাকে দেন। রেঙ্গুন থেকে ফিরে এসে তিনি দিল্লীর সদর বাজার এলাকায় ঐ অর্থ দিয়ে জায়গা ক্রয় করে ‘দারুল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ’ নামে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্রদের জন্য রুম ও মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদ ও মাদরাসার ছাদে টিন দেয়া হয়েছিল। টিনের ছাদের নিচে দরস-তাদরীস ও জুম‘আ-জামা‘আতের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
মাওলানার লাগানো তাওহীদ ও
সুন্নাতের এই বাগান আজও সবুজ ও সতেজ রয়েছে। দেশ বিভাগের পরে মাওলানার
পরিবার দিল্লী থেকে হিজরত করে করাচীতে চলে আসেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে
বসবাস শুরু করেন। কিন্তু তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মাওলানা আব্দুল ওয়াহিদ সালাফী
শুভাকাঙ্খীদের জোরাজুরিতে দিল্লীতে থেকে যান এবং মাদরাসা দেখাশুনা করেন।
তিনি ১৯৪৭-১৯৯৮ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাব্দী এ গুরুদায়িত্ব পালন করেন।[13]
অল্প
সময়ের ব্যবধানে এই প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে ভারত ছাড়াও কাশ্মীর,
তিববত, বাংলা প্রভৃতি দেশ থেকে ছাত্ররা এখানে ভর্তি হ’তে থাকে। উক্ত
মাদরাসায় মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব মুহাদ্দিছীনে কেরামের মানহাজ অনুযায়ী
কুরআন ও হাদীছের দরস দিতেন। প্রথম থেকে ফারেগ হওয়া পর্যন্ত এখানে পড়ানো হত।
যেসব দুর্বল ছাত্র কোথাও ভর্তির সুযোগ পেত না তারা এখানে পড়ার সুযোগ পেত।
তাঁর পাঠদান পদ্ধতি সম্পর্কে মাওলানা আব্দুল জলীল সামরূদী বলেন, ‘তাঁর
দরসের এমন সৌন্দর্য ছিল যা তার সমসাময়িকদের দরসে বাতি নিয়ে তালাশ করলেও
খুঁজে পাওয়া যেত না। হানাফী আলেমরা পর্যন্ত দরস পরখ করার জন্য আসতেন। তিনি
দরসে মাসআলাকে গভীরে নিয়ে গিয়ে ছাড়তেন। কোন কথা সূত্রবিহীন বলতেন না। তিনি
হানাফীদের সূক্ষ্ম মূলনীতিগুলো এমনভাবে উল্লেখ করতেন যে, তাঁর উদ্ধৃতি
প্রদান দেখে আমরা ঈর্ষান্বিত হতাম যে, তিনি এসব জিনিস কখন দেখেছেন’।[14]
মাওলানা আব্দুল জলীল আরো বলেন, ফজরের ছালাতের পরে কুরআন মাজীদের তরজমার ‘দরসে আম’ হত। এরপর ছাত্রদেরকে একটি একটি করে আয়াতের অনুবাদ পড়ানো হত। এতে সব ছাত্রকে অংশগ্রহণ করতে হ’ত। এমনকি বুখারী জামা‘আতের ছাত্র হ’লেও। এরপর তাফসীরুল কুরআন তারপর হাদীছের দরস হ’ত। যারা বুলূগুল মারাম পড়ত তাদেরকে তিনি প্রথমে একটি পরে দু’টি শেষে ৪টি হাদীছ এবং মিশকাত জামা‘আতের ছাত্রদেরকে ২/৪টি হাদীছ পড়াতেন। সকাল থেকে এগারটা পর্যন্ত মসজিদে অবস্থান করে তারপর বাড়িতে যেতেন। কখনো সাড়ে এগারোটাও বেজে যেত। অতঃপর যোহরের ছালাতের জন্য মসজিদে আসতেন। ছালাত পর দরস দিতেন। মাগরিবের পর বাড়ি ফিরতেন। রাতের খাবারের পর মসজিদে আসতেন এবং পিতার সেবায় নিয়োজিত হতেন। তাঁর হাত-পা টিপে দিতেন। এশার পরেও পিতার সেবা করতেন। তাঁকে দো‘আ শিখাতেন। তার ঘুমানোর পর বাড়িতে ফিরে আসতেন। পিতার মৃত্যুর পর এশার পরেই বাড়িতে ফিরতেন। এশার পরে ছাত্ররা তাকে ঘিরে ধরত। তারা বিভিন্ন বই পড়ত এবং তিনি মনোযোগ দিয়ে সেগুলো শুনতেন। ছাত্রদের প্রতি তিনি খুব খেয়াল রাখতেন। পিতা তার একমাত্র সন্তানের সাথে যেরূপ আচরণ করে, ছাত্রদের সাথে তিনিও তেমন স্নেহসুলভ আচরণ করতেন।
মাওলানা
আব্দুল ওয়াহ্হাবের প্রিয় ছাত্র মাওলানা আব্দুল জলীল সামরূদী বলেন, এই অধম
১৩২২ হিজরীতে ১১ বছর বয়সে জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে দিল্লী যায়। কিছু উর্দু ও
কুরআন মাজীদ নাযেরানা পড়েছিলাম। অল্প বয়স্ক হওয়ার কারণে মিয়াঁ ছাহেবের
মাদরাসায় আমাকে ভর্তি করা হয়নি। সেখানে গিয়ে মনে হল সদর বাজারে মাওলানা
আব্দুল ওয়াহ্হাবের নিকট যাই। তিনি ছোট-বড় সবাইকে তাঁর মাদরাসায় ভর্তি করে
নেন। ওখানে পৌঁছলে মাওলানা ছাহেব অবস্থা জানার পর ভর্তি করে নেন। তিনি
আমাকে ছাত্রদের সাথে কুরআনের অনুবাদ ক্লাসে শামিল করে নেন। তখন ৩য় পারার
পড়া চলছিল। আমার ইলমী যোগ্যতার এই দৈন্যদশা ছিল যে, যখন আমার পড়ার পালা আসে
তখন তিনি আমাকে একটি একটি শব্দের অনুবাদ করাতেন এবং ছীগাহগুলোরও অনুশীলন
করানো হ’ত। এজন্য ছরফের বাবগুলোও পড়ানো শুরু করে দিয়েছিলেন। নিয়ম ছিল
প্রত্যেকটি শব্দ পড়া শেষ হ’লে তিনি বলতেন, এখন সামনে অগ্রসর হও। ... আজ যে
দু’হরফ জ্ঞান অর্জন করেছি তা তাঁর নিকট থেকেই করেছি। আল্লাহর কসম! দ্বীনী
ইলম হাছিলের জন্য আমি কোন আলেমের কাছে নতজানু হয়ে বসিনি। ইলমে হাদীছে এই
অকিঞ্চন তাঁর চেয়ে যোগ্য কাউকে পায়নি। তা না হলে আমাকে অন্য কারো জুতা বহন
করতে হত’।[15]
ছাত্রবৃন্দ :
মাওলানা
আব্দুল ওয়াহ্হাব দেহলভী কুরআন ও সুন্নাহর পুনরুজ্জীবনের জন্য নিজের জীবন
ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। তিনি প্রায় ৬০ বছর শিক্ষকতা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত
মাদরাসা ‘দারুল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ’ থেকে হাযার হাযার ছাত্র ইলমে দ্বীন
হাছিল করে ফারেগ হন। এদের সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। তাঁর কতিপয় উল্লেখযোগ্য
ছাত্র হলেন- (১) খ্যাতিমান মুহাদ্দিছ মাওলানা আব্দুল জলীল সামরূদী (২)
মাওলানা আব্দুল জাববার খান্ডিলবী (৩) মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (৪) হারাম
শরীফের ইমাম আব্দুয যাহির মাক্কী (৫) মাওলানা মুফতী আব্দুস সাত্তার
কিলানূরী (৬) মাওলানা আব্দুল জলীল খান বালূচ (৭) মাওলানা মুহাম্মাদ
আব্দুল্লাহ উড (৮) মাওলানা আব্দুল্লাহ মুহাদ্দিছ লায়ালপুরী (৯) মাওলানা
আব্দুল হামীদ ঝংগাবী (১০) মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক কোটপুরী (১১) মাওলানা
মুহাম্মাদ সুরাটী (১২) বিশ্ববরেণ্য আরবী সাহিত্যিক, আলীগড় মুসলিম
ইউনিভার্সিটির সাবেক প্রফেসর আল্লামা আব্দুল আযীয মাইমান (১৩) মাওলানা
আব্দুল কাদের হিছারী (১৪) মাওলানা ছূফী মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ (১৫) মাওলানা
আব্দুস সাত্তার দেহলভী (১৬) মাওলানা আব্দুল ওয়াহিদ প্রমুখ।[16]
মৃত সুন্নাত পুনর্জীবিতকরণ :
মৃত সুন্নাত পুনর্জীবিতকরণে তিনি অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করেন। এক্ষেত্রে তাঁর নিম্নোক্ত ভূমিকা প্রাতঃস্মরণীয়।
(১) তিনিই দিল্লীতে প্রথম প্রকাশ্য ময়দানে ১২ তাকবীরে ঈদের জামা‘আত কায়েম করেন (২) তিনিই প্রথম নিজের স্ত্রী-কন্যাদের সাথে নিয়ে পুরুষদের সাথে পর্দার মধ্যে মহিলাদের ঈদের জামা‘আত চালু করেন (৩) তিনিই দিল্লীতে প্রথম মুছল্লীদের জন্য মাতৃভাষায় জুম‘আর খুৎবা চালু করেন (৪) তিনিই প্রথম ‘ছালাতে জানাযা‘র কিরাআত সশব্দে পাঠ করা শুরু করেন (৫) তিনিই প্রথম দুষ্ট স্বামীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মযলূম স্ত্রীদেরকে স্বেচ্ছায় বিবাহ-বিচ্ছেদের অধিকার দিয়ে মযবুত দলীল সহকারে ফৎওয়া প্রকাশ করেন (৬) খতীব মিম্বরে বসার পরে জুম‘আর জন্য একটি মাত্র আযান দেওয়ার সুন্নাতে নববী তিনিই দিল্লীতে পুনঃপ্রবর্তন করেন (৭) লোকেরা কালেমায়ে ত্বাইয়িবার দুই অংশকে একত্রে ‘কালেমায়ে তাওহীদ’ বা ‘একত্ববাদের ঘোষণা’ মনে করত। তিনি পরিষ্কারভাব বুঝিয়ে দেন যে, কালেমায়ে ত্বাইয়িবার প্রথম অংশটি মাত্র ‘কালেমায়ে তাওহীদ’ এবং দ্বিতীয় অংশটি হ’ল ‘কালেমায়ে রিসালাত’ (৮) জীবনমরণ সমস্যা দেখা দিলে হৃদয়ে ঈমান ঠিক রেখে ‘কুফরী কালেমা’ উচ্চারণ করার পক্ষে সূরায়ে নাহ্ল ১০৬ আয়াতের আলোকে তিনি ফৎওয়া প্রদান করেন- যা ছিল সে যুগের হিসাবে বড়ই ঝুঁকিপূর্ণ ফৎওয়া (৯) হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অজুহাতে মাওলানার সময়ে দিল্লীতে মুসলমানেরা গরু কুরবানী এবং সাধারণভাবে গরু যবেহ করত না। গরুর গোশতের ত্রুটি বর্ণনায় মুসলমানেরা বাড়াবাড়ি করতে থাকে। কোন কোন মৌলবী ছাহেব তো গরুর গোশত খাওয়াকে শূকরের গোশত খাওয়ার মত হারাম ফৎওয়া দেওয়া গুরু করেন। মুসলমানদের এই হীনমন্যতা দেখে মাওলানা দারুণ ক্ষুব্ধ হন এবং প্রবল হিম্মত নিয়ে কুরবানীর জন্য গরু ক্রয় করেন। কিন্তু প্রথম গরুটি বিরোধীরা ছিনিয়ে নেয়। পুনরায় ক্রয় করলে মুসলমান কসাইরা তা যবেহ করতে অস্বীকার করলে তিনি নিজে যবেহ করেন। পরে গরুর গাড়ীতে করে গোশত আনার সময় বিরোধীরা রাস্তায় আটকিয়ে গরু দু’টি ছেড়ে দেয় ও গাড়ীর চাকা খুলে নেয়। অবশেষে ছাত্ররা গোশত মাথায় করে বাড়ীতে আনে।
পরবর্তীতে
সুধী ওলামায়ে কেরাম একবাক্যে স্বীকার করেন যে, যদি মাওলানা আব্দুল
ওয়াহ্হাব ঐ সময় ঐ দুঃসাহসিক পদক্ষেপ না নিতেন, তাহ’লে ভারতের বুক থেকে
সম্ভবতঃ গরু কুরবানীর সুন্নাত উঠে যেত। কারণ এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে যখন
হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের নেতারা গরু কুরবানী সরকারীভাবে নিষিদ্ধ করার দাবী
নিয়ে ইংরেজ ভাইসরয়ের নিকটে দরখাস্ত পেশ করেন, তখন ইংরেজ সরকার এই মর্মে
ঘোষণা দেন করেন যে, ‘কোথাও গরু কুরবানী না হওয়ার শর্তে এই বৎসর থেকে গরু
কুরবানী আইনতঃ দন্ডনীয় ঘোষণা করার জন্য আমরা দৃঢ় আশা পোষণ করেছিলাম। কিন্তু
কসাইখানার রেজিস্ট্রারে দেখা গেল যে, মৌলবী আব্দুল ওয়াহ্হাব নামক দিল্লীর
জনৈক মুসলমান এ বছর গরু কুরবানী করেছেন। অতএব মুসলমানদের মধ্যে ভিন্নমত
থাকায় আমরা গরু কুরবানীকে আইনতঃ দন্ডনীয় ঘোষণা করতে পারি না’।[17]
[চলবে]
নূরুল ইসলাম
পিএইচ.ডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব, মুকাম্মাল নামায (করাচী : মাকতাবায়ে ইশা‘আতুল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ, ১৪০৪ হিঃ/১৯৮৪ খ্রিঃ), পৃঃ ৩, আবু মুহাম্মাদ মিয়াঁওয়ালী লিখিত ভূমিকা দ্রঃ।
[2]. মুহাম্মাদ রামাযান ইউসুফ সালাফী, মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব আওর উনকা খান্দান (পাকিস্তান : মারকাযী দারুল ইমারত, জামা‘আতে গোরাবায়ে আহলেহাদীছ, ১ম প্রকাশ, ১৪৩১ হিঃ/২০১০ খ্রিঃ), পৃঃ ২৮।
[3]. ঐ; মুকাম্মাল নামায, পৃঃ ২৮।
[4]. মুহাম্মাদ রামাযান ইউসুফ সালাফী, চার আল্লাহ কে অলি (পাকিস্তান : জামা‘আতে গোরাবায়ে আহলেহাদীছ, ২০০২ খ্রিঃ), পৃঃ ৭।
[5]. মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব আওর উনকা খান্দান, পৃঃ ২৯-৩০।
[6]. মুকাম্মাল নামায, পৃঃ ৬-৭; মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব আওর উনকা খান্দান, পৃঃ ৩০-৩১।
[7]. মুকাম্মাল নামায, পৃঃ ৭; ড. মুহাম্মাদ বাহাউদ্দীন, তাহরীকে খতমে নবুঅত (লাহোর : মাকতাবা কুদ্দূসিয়াহ, ২০০৬), ৩/৪১৪-৪১৫।
[8]. মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব আওর উনকা খান্দান, পৃঃ ৩২-৩৩।
[9]. মুকাম্মাল নামায, পৃঃ ৮।
[10]. মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব আওর উনকা খান্দান, পৃঃ ৫১-৫৩।
[11]. ঐ, পৃঃ ১০৬।
[12]. চার আল্লাহ কে অলি, পৃঃ ১২-১৩।
[13]. মুকাম্মাল নামায, পৃঃ ১১-১২।
[14]. মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব আওর উনকা খান্দান, পৃঃ ৫৪-৫৬।
[15]. ঐ, পৃঃ ১৪০-১০৫।
[16]. মুকাম্মাল নামায, পৃঃ ১৫-১৮; তাহরীকে খতমে নবুঅত ৩/৪১৫; আব্দুর রশীদ ইরাকী, হায়াতে নাযীর, পৃঃ ১৩০।
[17]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৩৯৬-৯৭।