পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । শেষ পর্ব ।
সঊদী আরব গমন :
মাওলানা আহমাদ দেহলভী মসজিদে নববীর পার্শ্বে ‘দারুল হাদীছ’ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিরোধীরা সরকারের কাছে এ মাদরাসার ব্যাপারে অভিযোগ পেশ করার কারণে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সরকারী কর্তৃপক্ষ মাদরাসাটি বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আহমাদ দেহলভী ‘মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ হিন্দ’[1] নেতৃবৃন্দকে এ বিষয়ে অবগত করান এবং মাদরাসাটি পুনরায় চালু করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করার অনুরোধ করেন। জমঈয়ত নেতৃবৃন্দ মাদরাসাটি পুনরায় খোলার ব্যাপারে আলোচনার জন্য শায়খ খলীল আরব বিন মুহাম্মাদ আরব ও ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরীকে প্রতিনিধি হিসাবে তৎকালীন সঊদী বাদশাহ আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৫ আগষ্ট ১৯৪৭/২২ শা‘বান ১৩৬৬ হিজরীতে তাঁরা সঊদী আরবের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। ১৬ রামাযান রিয়াদে পৌঁছেন। সঊদী সরকারের পক্ষ থেকে জমঈয়তের প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানানো হয় এবং সেখানে অবস্থানকালীন সময়ে তাদের থাকা-খাওয়া ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়।
১৬ রামাযান প্রতিনিধি দলটি সঊদী বাদশাহর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পান। বাদশাহ তাদের সঊদী আরব আগমনের কারণ জানতে চান। শায়খ খলীল আরব তাদের সঊদী আসার উদ্দেশ্য বাদশাহকে অবগত করালে বাদশাহ বলেন, মাদরাসার বিরুদ্ধে অভিযোগের স্তূপ জমা পড়েছে। অতঃপর বাদশাহ তৎক্ষণাৎ তায়েফের তদানীন্তন আমীর (পরবর্তীতে বাদশাহ) স্বীয় সন্তান ফায়ছালের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন। মাদরাসা সংক্রান্ত ফাইল তার কাছে ছিল। বাদশাহ তাকে এ সংক্রান্ত ফাইল দ্রুত পাঠাতে বলেন। অবশেষে বাদশাহ উক্ত মাদরাসাটি পুনরায় খুলে দেয়ার ব্যাপারে সম্মত হন।
ঈদুল ফিতরের দিন প্রতিনিধি দলটি আমীর ফায়ছালের সাথে তায়েফে সাক্ষাৎ করেন। অনুরূপভাবে তাঁরা মক্কা মুকাররমা ও মদীনা মুনাওয়ারা যিয়ারত এবং সেখানকার বড় বড় শায়খদের সাথে সাক্ষাত করেন। দ্বিতীয় বার বাদশাহর সাথে সাক্ষাতের সময় প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে বাদশাহকে ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ উপহার দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালের ৪ নভেম্বর (যুলকা‘দা ১৩৬৬ হিঃ) প্রতিনিধি দলটি দেশে ফিরে আসে।
উল্লেখ্য, হজ্জের সময় নিকটবর্তী হওয়ায় বাদশাহ প্রতিনিধি দলকে হজ্জ করে দেশে ফেরার জন্য বললে ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছের খরচে আমরা এখানে এসেছি। নিজেদের নয়। নিজেরা সামর্থ্য হ’লে আগামীতে হজ্জ আদায় করব ইনশাআল্লাহ’।[2]
জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তন :
১৯৪৭ সালে রহমানিয়া মাদরাসা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি মুবারকপুরে ফিরে এসে ‘মির‘আতুল মাফাতীহ’ রচনায় নিমগ্ন হন। এ সময় সঊদী আরব, পাকিস্তান ও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে হাদীছের দরস দানের জন্য তাঁর নিকট প্রস্তাব পেশ করা হয়। কিন্তু তিনি সেসব প্রস্তাবে সাড়া দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং বস্ত্তগত যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পরিত্যাগ করে মিশকাতের উক্ত ভাষ্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। এ সময় তাঁর দৈনন্দিন রুটিন ছিল এরূপ- ভোর ৩/৪ টার দিকে ঘুম থেকে উঠতেন। ফজরের ছালাত জামা‘আতে আদায়ের পর একটু হাঁটাহাঁটি করে নাশতার পর অধ্যয়ন এবং গ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ করতেন। যোহর পর্যন্ত এভাবে অবিরাম জ্ঞানসাগরে ডুবে থাকতেন। দুপুরে খাওয়ার পর আবার গবেষণার জগতে হারিয়ে যেতেন। এভাবে গভীর রাত পর্যন্ত লেখালেখি চলত। অত্যধিক অধ্যয়ন এবং পরিশ্রমের কারণে দুবর্লতা অনুভব করলে কখনো কখনো দুপুরের খাবারের পর খানিক বিশ্রাম নিতেন।[3]
জামে‘আ সালাফিয়ায় শিক্ষকতার প্রস্তাব :
১৯৬৩ সালে ‘জামে‘আ সালাফিয়া বেনারস’ প্রতিষ্ঠিত হ’লে ‘মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ হিন্দ’ নেতৃবৃন্দ মুবারকপুরীকে সেখানে একটি বিষয়ের জন্য হ’লেও শিক্ষকতা করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে শিক্ষকতার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে না পারার আশংকায় তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। ১৯৬৫ সালে আব্দুস সালাম রহমানীকে লেখা এক পত্রে তিনি বলেন, ‘সর্বাবস্থায় আমি সহস্র বার আল্লাহর প্রশংসা করি। আমি স্বীকার করতে মোটেই কুণ্ঠিত হচ্ছি না যে, ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে একটি বিষয়ের জন্য হ’লেও পাঠদানের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা এবং বাড়ী থেকে দূরে অবস্থান করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়’।[4]
১৯৬৬ সালেও জামে‘আ সালাফিয়ার দায়িত্বশীলদের এক মিটিংয়ে মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব আরাভী মুবারকপুরীকে সেখানে প্রত্যেক দিন ছহীহ বুখারীর দরস দেয়ার জন্য অন্তত এক ঘণ্টা ক্লাশ নিতে বলেন। তখন মুবারকপুরী জবাব দেন, ‘আমি আপনার ছাত্রত্ব গ্রহণ করে ধন্য ও গর্বিত। আপনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার মতো দুঃসাহস আমার নেই। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা জানেন যে, আমি রোগাক্রান্ত হবার কারণে ছহীহ বুখারী পড়ানোর দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হব না। আর আমি আশংকা করি যে, এজন্য আল্লাহর কাছে খিয়ানতকারী হিসাবে পরিগণিত হব। একথা বলার পর তাঁর চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়।[5]
অনেকের কাছে হয়তো ব্যাপারটি অন্য রকম ঠেকতে পারে। কিন্তু পাঠদানের জন্য তিনি যে অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন, সেদিকে লক্ষ্য করলে তার উক্ত অনুরোধে সাড়া না দেয়ার কারণ সহজেই অনুমেয়। যেমন তিনি বলতেন, ‘শিক্ষকতার দিনগুলিতে পাঠদানের প্রস্ত্ততি গ্রহণের জন্য এতই পরিশ্রম করতাম যে, অনেক সময় আমাদের ওযন কমে যেত এবং মুখমন্ডল হলুদ হয়ে যেত’। তিনি আরো বলতেন, ‘ফজরের আযান হওয়া পর্যন্ত অনেক সময় পাঠ দানের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতাম। অতঃপর ছালাতের পর পরই দরস শুরু করতাম’।[6]
হজ্জ আদায় :
মুবারকপুরী (রহঃ) জীবনে মোট তিনবার হজ্জ আদায় করেন। প্রথমবার ১৩৭৫ হিঃ/১৯৫৬ সালে। এ যাত্রায় তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন ড. রিযাউল্লাহ মুবারকপুরীর বাবা আলহাজ মুহাম্মাদ ইদরীস।[7] দ্বিতীয়বার ১৩৮৩ হিঃ/১৯৬৩ সালে তিনি স্ত্রীসহ বদলী হজ্জ আদায় করেন।[8] ১৩৯১ হিঃ/১৯৭২ সালে তিনি ‘মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ হিন্দ’-এর সাবেক সভাপতি মাওলানা মুখতার আহমাদ নাদভীর[9] সাথে বদলী হজ্জ আদায় করেন।
বিশ্ববরেণ্য দুই আহলেহাদীছ আলেমের মহামিলন :
১৯৭২ সালে শায়খ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (১৯১৪-২/১০/১৯৯৯) ও ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) দু’জনেই হজ্জ করতে গিয়েছিলেন। মাওলানা মুখতার আহমাদ নাদভী মিনা-তে শায়খ আলবানীর তাঁবুতে মুবারকপুরীকে নিয়ে যান। পরিচয় করিয়ে দেয়ার সাথে সাথে আলবানী তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। মুখতার আহমাদ নাদভী (১৯৩০-২০০৭) বলেন, ‘ইসলামী দুনিয়ার এই দুই শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছের সেই মহামিলন দৃশ্য দেখে উপস্থিত সকলের সেদিন আনন্দে চোখে পানি এসে গিয়েছিল’।[10]
মুবারকপুরীর জীবনের বিভিন্ন দিক :
অল্পে তুষ্টি : রহমানিয়া মাদরাসায় তিনি ১০০ রূপী বেতনে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। পরে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ২৫ রূপী বেতন বাড়াতে চাইলে তিনি তা গ্রহণ না করে জানান, ১০০ রূপীই তার জন্য যথেষ্ট। অতিরিক্ত অংকের কোন প্রয়োজন নেই।[11] মির‘আতুল মাফাতীহ রচনার জন্য তার মাসিক সম্মানী ভাতা নির্ধারণ করা হয় ১৫০ রূপী। কিন্তু ১২৫ রূপী যথেষ্ট বলে তিনি জানান।[12] উল্লেখ্য, এ সামান্য টাকা দিয়েই তিনি পরিবারের ও কয়েকজন ইয়াতীমের খরচ যোগাতেন।[13]
[চলবে]
[1]. তখন জমঈয়তের নাম ছিল ‘অল ইন্ডিয়া আহলেহাদীছ কনফারেন্স’। ১৯৭০ সালের পর জমঈয়তের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ হিন্দ’। বর্তমানে দিল্লীতে ৪১১৬ উর্দূ বাজার ‘আহলেহাদীছ মনযিল’-এ জমঈয়তের নিজস্ব ভবনে কেন্দ্রীয় অফিস অবস্থিত। পাক্ষিক ‘তারজুমান’ এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় মুখপত্র হিসাবে প্রকাশিত হচ্ছে। দ্র. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৩৬৮-৬৯; আরো বিস্তারিত জানার জন্য লগ অন করুন :www. ahlehadees.orgই-মেইল : Jamiatahlehadeeshind@ hotmail.com.
[2]. ফাওয়ায আব্দুল আযীয, শায়খুল হাদীছ ওবায়দুল্লাহ রহমানী মুবারকপুরী : হায়াত ওয়া খিদমাত ১/৬৪-৭৫; মির‘আতুল মাফাতীহ ১/১০; মুহাদ্দিছ, সেপ্টেম্বর ১৯৮৩, পৃঃ ১২-১৪; ছাওতুল উম্মাহ, খন্ড ৪১, সংখ্যা ৪, এপ্রিল ২০০৯, পৃঃ ৩১-৩৩।
[3]. আল-বালাগ, মার্চ ’৯৪, পৃঃ ৩৫।
[4]. মাকাতীবে হযরত শায়খুল হাদীছ, পৃঃ ৫৬, পত্র নং- ৩০, তাং ২৬/৮/১৯৬৫।
[5]. মুহাদ্দিছ, জানু-ফেব্রুঃ ’৯৭, পৃঃ ৩০৮।
[6]. ঐ, পৃঃ ২৩১।
[7]. আল-বালাগ, জুলাই ১৯৯৪, পৃঃ ৪১-৪২।
[8]. মুহাদ্দিছ, জানু-ফেব্রুঃ ’৯৭, পৃঃ ১৯৭।
[9]. ভারতের প্রখ্যাত আহলেহাদীছ আলেম মাওলানা মুখতার আহমাদ বিন আলহাজ যমীর আহমাদ উত্তর প্রদেশের আযমগড় যেলার মৌনাথভঞ্জন নগরীতে ১৯৩০ সালে আহলেহাদীছ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় ‘দারুল উলূম’ মাদরাসায় তাঁর আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু হয়। এরপর ‘জামে‘আ আলিয়া আরাবিয়া, মৌ’, ‘দারুল হাদীছ রহমানিয়া’ ও ‘নাদওয়াতুল ওলামা লক্ষ্ণৌ এবং ‘জামে‘আ ইসলামিয়া ফয়যে আম’ মাদরাসায় পড়াশুনা করেন। শেষোক্ত মাদরাসা থেকে তিনি ফারেগ হন। কলকাতার একটি মসজিদে ইমামতির মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। পরে তিনি মুম্বায়ে এসে বসতি গাড়েন। তিনি জামে‘আ সালাফিয়ার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ হিন্দ’-এর আমীর ছিলেন। তিনি জামে‘আ মুহাম্মাদিয়া, মুহাম্মাদী কল্যাণ ট্রাষ্ট, বিহারী প্রেস, আদ-দারুস সালাফিয়া এবং দারুল মা‘আরিফ লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন। ৭৭ বছর বয়সে তিনি ২০০৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। দ্রঃ সাপ্তাহিক আল-ফুরকান, কুয়েত, সংখ্যা ৪৬১, ২৪/৯/২০০৭, পৃঃ ১৯; জুহূদ মুখলিছাহ, পৃঃ ৩৩১-৩২।
[10]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, মাসিক আত-তাহরীক, বর্ষ ৩, সংখ্যা ৩, ডিসেম্বর ১৯৯৯, পৃঃ ৩১।
[11]. মুহাদ্দিছ, জানু-ফেব্রুঃ ’৯৭, পৃঃ ১৯৬।
[12]. ঐ, পৃঃ ১১৭, ২১৮।
[13]. ছাওতুল উম্মাহ, বর্ষ ৪১, সংখ্যা ৩, মার্চ ’০৯, পৃঃ ৩১।