(১)
রাজশাহী যেলার পবা উপযেলার হরিপুর ইউনিয়নের মাঝেরদিয়া গ্রামের হুমায়ূন
কবীর। সীমান্ত এলাকার এই যুবক বি.এ পাস করার পর চাকুরী না পেয়ে ঋণ নিয়ে
বাইক কিনে মানুষ আনা-নেয়াকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু করোনায় লকডাউনের
কারণে মানুষের যাতায়াত কমে যাওয়ায় অনেকদিন ঘরে বসে থাকায় আয় রোজগার বন্ধ
ছিল। ফলে ঋণের টাকা দূরের কথা নিয়মিত সূদের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায়
স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ী মাস্তান দিয়ে তাকে ধরে নিয়ে যায়। অতঃপর জমি বন্ধক
রেখে সূদের টাকা পরিশোধ করে। ভুক্তভোগীরা বলেন, পদ্মার চরের সর্বত্রই সূদের
ব্যবসা চলছে। আগে গ্রামে কারো ১ থেকে ২ লাখ টাকা হ’লে ধান-পাটের ব্যবসা
করত। এখন করে সূদের ব্যবসা। দাদন ব্যবসায়ীরা সূদের হার স্থান কাল পাত্র
অনুযায়ী ঋণের পরিমাণ এবং ব্যক্তির চাহিদার ওপর নির্ভর করে নির্ধারণ করে। ১
হাযার টাকা নিলে সূদের হার এলাকাভেদে মাসিক ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে
থাকে। গ্রহীতাদের যদি হঠাৎ টাকার প্রয়োজন হয়, তাহ’লে সূদের হার বেড়ে যায়।
আবার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা গ্রামের হাটে পণ্য বেচা-কেনার প্রয়োজনে কয়েক
ঘণ্টার জন্য দাদনে টাকা নিলে সূদের হার বেড়ে যায়। হাটে পণ্য কেনা-বেচার
জন্য কোনো ব্যবসায়ী ১০ হাযার টাকা ঋণ নিলে হাযারে ৩০০ টাকা পর্যন্ত সূদ
পরিশোধ করতে হয়।
(২) নওগাঁর মহাদেবপুর উপযেলার অর্জুন গ্রামের আপেল মাহমূদ নামে এক মৎস্যচাষী এক বছর আগে শালগ্রাম এলাকার দাদন ব্যবসায়ী বিপ্লবের কাছ থেকে মাসিক সূদে ৫ লাখ টাকা ঋণ নেয়। প্রতি মাসে বিপ্লবকে শোধ করতে হয় ৩০ হাযার টাকা। আপেল মাহমূদ তার ৫ বিঘা জমি বিক্রি করে সূদে-আসলে ১৫ লাখ টাকা দাদন ব্যবসায়ীকে দিয়েছে।
(৩) জয়পুরহাটের মাদারগঞ্জ বামনপুর মহল্লার রতন কুমার দম্পতি প্রতিবেশী কল্পনা রাণীর কাছ থেকে চড়া সূদে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিল। বাড়তি কোন আয়রোজগার না থাকায় সংসার পরিচালনা ও সূদের টাকা দিতে গিয়ে ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। ঋণ পরিশোধ করতে ঐ দম্পতি একে একে ছয়জনের কাছ থেকে আরও ঋণ নেন। পাঁচ বছরের মাথায় ১ লাখ টাকার ঋণ ১১ লাখ টাকায় গিয়ে ঠেকে। ঋণ শোধ করতে গিয়ে গত পাঁচ বছরে পৈতৃক আট বিঘা জমি বিক্রি করেছে রতন। বর্তমানে তাদের ৩ শতক বসতবাড়ি ছাড়া কিছুই নেই এখন। তারা নিঃস্ব হ’লেও এখনো ঋণের টাকা পরিশোধ হয়নি। সূদের ব্যবসায়ীরা তাদের মাথা গোঁজার একমাত্র ঠাঁই বসতবাড়িটি এখন দখল করতে চাইছে। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা এখন আশ্রয় নিয়েছে প্রশাসনের।
(৪) নাটোর সদরের বাসিন্দা গোপাল মন্ডল। মাত্র ৬০ হাযার টাকা ঋণ নিলে এক বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখে। তার পক্ষে এই টাকা পরিশোধ করা ছিল অসম্ভব। তাই হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আত্মহত্যা করে গোপাল মন্ডল। তার স্ত্রী জানান, সূদের টাকা চাইতে প্রায়ই বাড়িতে আসতো ঐ দাদন ব্যবসায়ী। টাকা দিতে না পারায় অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করত। এর মধ্যেই একদিন তাকে ধরে মারধর করা হয়। এই অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন গোপাল।
(৫) নাটোরের বড়াইগ্রাম উপযেলার ভ্যান চালক রেযাউল। সে দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চড়া সূদে ৩০ হাযার টাকা ঋণ নেয়। কিছু টাকা পরিশোধ করলেও অল্প দিনেই তা সূদে-আসলে ৮০ হাযার টাকায় দাঁড়ায়। টাকা দিতে না পারায় তারা তার একমাত্র অবলম্বন ভ্যানটি কেড়ে নেয়। তাতেও ঋণ শোধ না হওয়ায় নিরুপায় রেযাউল আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে নিজ স্ত্রীর কাছ থেকে ২২ দিনের শিশু সন্তানকে নিয়ে বিক্রি করে দেয়।
(৬) গাইবান্ধা সদর উপযেলার কয়েকজন দাদন ব্যবসায়ী মৌসুমী ধান বাবদ এবং মাসিক, সাপ্তাহিক, দৈনিক ও হাটরা সূদের ভিত্তিতে সূদের ব্যবসা করে। মাসিক ভিত্তিতে ১০ হাযার টাকায় ১ হাযার টাকা সূদ দিতে হয়। ফলে বার্ষিক সূদের হার দাঁড়ায় ১২০ শতাংশ। এছাড়া ‘কারেন্ট’ সূদের ওপর নিলে ১ হাযার টাকায় দিনে ১০০ টাকা সূদ দিতে হয়। ‘হাটরা’য় প্রতি সপ্তাহে হাটে ১ হাযার টাকায় সূদ দিতে হয় ১৬০ টাকা। কাগজপত্রের ঝামেলা ও হয়রানির কারণে কৃষকদের ব্যাংক ঋণ নিতে আগ্রহ কম।
করোনার কারণে গত দেড়-দুই বছরে কৃষকদের একটি বড় অংশ গভীর সংকটে পড়েছে। তারা টিকে থাকার জন্য চড়া সূদে ঋণ নিচ্ছে। ফলে আত্মহত্যা, হামলা-মামলা এমনকি খুনের মতো ঘটনাও ঘটছে। ব্যক্তিগতভাবে সূদের কারবারসহ গ্রামে-গঞ্জে নামে-বেনামে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সমিতির মাধ্যমেও এই সূদের ব্যবসা করছে প্রভাবশালীরা। এসব সূদের ব্যবসায়ীরা রাতারাতি হয়ে যায় বিরাট ধন-সম্পদের মালিক। আর অসহায় দরিদ্র মানুষগুলো আরও নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।
[স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও কি সরকার ইসলামী বিধান মেনে দেশ থেকে সূদ নিঃশেষ করবে না? (স.স.)]