‘পৃথিবীর
ফুসফুস’খ্যাত আমাজনের চিরহরিৎ বনাঞ্চলের ব্রাজিল অংশে ভয়াবহ দাবানলের
সৃষ্টি হয়েছে। বলিভিয়া ও প্যারাগুয়ে অঞ্চলেও আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। মাইলের পর
মাইল বন পুড়ে ছারখার হচ্ছে। ব্রাজিলের মহাকাশ পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইএনপিইর
তথ্য অনুযায়ী, আগস্টের প্রথম ২৬ দিনে ১,১১৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা পুড়ে গেছে।
বন পোড়ার ধোঁয়া আমাজনের আকাশ ছাড়িয়ে আড়াই হাযার মাইল দূরে দক্ষিণ আমেরিকার
সবচেয়ে বড় শহর সাও পাওলোকেও অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছে। ২০১৯ সালে আমাজন
জঙ্গলের ব্রাজিল অংশে এপর্যন্ত ৭৪,১৫৫টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এবারের
মত ভয়াবহ অবস্থা কখনোই সৃষ্টি হয়নি। বর্তমানে সেখানে ২,৫০০-এরও বেশী স্থানে
আগুন জ্বলেছে।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আগুন লাগার কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথম কারণ বন উজাড়। ঘরবাড়ি নির্মাণ, কৃষি কাজের সম্প্রসারণ, খনিজ পদার্থ অনুসন্ধানসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে গাছপালা কেটে বন উজাড় করছে মানুষ। দ্বিতীয় কারণ হ’ল- কৃষি উৎপাদন ও কৃষিভূমি সম্প্রসারণ। কৃষিভূমি ও গবাদিপশুর চারণভূমি তৈরি করতে জঙ্গলে সরাসরি আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে মানুষ। তৃতীয় কারণ- খরা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পানি স্বল্পতায় জঙ্গলের গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। শুষ্ক গাছে আগুন লেগে দাবানল সৃষ্টি হয়ে আরও বৃক্ষনিধন ঘটছে। ফলে বাড়ছে খরার তীব্রতাও।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো এবছরের জানুয়ারী মাসে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমাজনে আগুনের ঘটনা বেড়ে গেছে। ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের ব্যবধানে আগুনের ঘটনা ৮৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এনজিওগুলো বলছে, ব্রাজিলের বর্তমান সরকার অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে জঙ্গল উজাড়ে উৎসাহ দিচ্ছে। অন্যদিকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসোনারো উল্টো এনজিওগুলোকেই বনে আগুনের জন্য দায়ী করছেন।
ফায়ার সার্ভিস ও ব্রাজিলীয় সেনাবাহিনীর অর্ধ লক্ষাধিক সদস্যের তৎপরতায় আগুনের ভয়াবহতা কিছুটা কমানো গেলেও ভারী বৃষ্টিপাতের আগ পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নিভবে না বলে জানিয়েছেন ব্রাজিলের প্রকৃতি বিশেষজ্ঞরা।
উল্লেখ্য যে, আমাজন পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের ২০ শতাংশ সরবরাহ করে এবং এক-চতুর্থাংশ কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে। আমাজন জঙ্গলের প্রয়োজনীয়তা শুধু ব্রাজিল বা দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর জন্য নয়। আমাজন জঙ্গল বিনাশ হ’লে বৈশ্বিক উষ্ণতা চিরতরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
আমাজনের মূল বৈশিষ্ট্য হ’ল এর জীববৈচিত্র্য। ৩০ লাখ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ এবং তিন শতাধিক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ১০ লাখ মানুষের বসবাস এই বনে। যার প্রত্যেকটি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এছাড়া ৪০ হাযার প্রজাতির প্রায় ৩ হাযার ৯০০ কোটি গাছ রয়েছে। আমাজন নদীই আমাজন বনের জীবনীশক্তি, যা বিশ্বের সবচেয়ে প্রশস্ত নদী।
৯টি দেশের প্রায় ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই বনাঞ্চল। আয়তনে বাংলাদেশের তুলনায় ৩৮ গুণ বড়। এ বনের ৬০ শতাংশ ব্রাজিল, ১৩ শতাংশ পেরু, ১০ শতাংশ কলম্বিয়া এবং বাকী ১৭ শতাংশ অন্যান্য ৬টি দেশে (বলিভিয়া, ইকুয়েডর, ভেনেজুয়েলা, গায়ানা, সুরিনাম ও ফরাসী গায়ানা) অবস্থিত। সমগ্র পৃথিবীতে যে পরিমাণ চিরহরিৎ বন বা রেইন ফরেস্ট আছে, তার অর্ধেকই হ’ল আমাজন। ধারণা করা হয়, আমাজনে এখনো এমন ৫০টির বেশী স্থানীয় উপজাতির বাস আছে, যাদের সঙ্গে আধুনিক পৃথিবীর কোন যোগাযোগ নেই।
পশ্চিমা বিশ্বে প্রস্ত্ততকৃত মোট ওষুধের ২৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় চিরহরিৎ এই বন থেকে সংগৃহীত উপাদান দিয়ে। যদিও এপর্যন্ত এই বনের ১ শতাংশের কম গাছগাছড়া বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। আমাজনে ৩ হাযারের বেশী ফল পাওয়া যায়, যার মধ্যে মাত্র ২০০ রকম ফল পশ্চিমা বিশ্বে খাওয়া হয়। ধান, গম, আনারস, টমেটো, আলু, কলা, গোলমরিচ, কফি বীজ, কোকোয়া বীজসহ বিশ্বের ৮০ শতাংশ খাদ্যশস্যের আদি উৎস এই বন।
[দুনিয়ার শাসকরা যখন উৎপীড়ক হয়, তখন আসমানের শাসক আল্লাহ এভাবেই প্রতিশোধ নিয়ে থাকেন। একইভাবে সুন্দরবন হ’ল বাংলাদেশের ফুসফুস। এর পাশেই রামপাল প্রকল্প প্রতিষ্ঠা হবে নিঃসন্দেহে একটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। অতএব কর্তৃপক্ষ সাবধান হৌন (স.স.)]