পর্ব ১পর্ব ২ । 

ভূমিকা :

মাওলানা মুহাম্মাদ আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী (১৮৯০-১৯৪৯) ভারতবর্ষের একজন শীর্ষস্থানীয় আলেম, উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন মুহাদ্দিছ, বাগ্মী, মুনাযির (তার্কিক), শিক্ষক ও লেখক ছিলেন। কাদিয়ানী, আর্যসমাজী, খ্রিস্টান মিশনারী এবং শিরক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে তিনি যুগপৎ উচ্চকণ্ঠ ও সোচ্চার ছিলেন। এদের সাথে বাহাছ-মুনাযারায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদানের কারণে তিনি কয়েকবার কারাবন্দী হন। হাদীছ অস্বীকারকারী ও হাদীছে সন্দেহ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী ছিল লা-জওয়াব। বিশেষত ছহীহুল বুখারীর প্রতিরক্ষায় তাঁর অমূল্য গ্রন্থগুলি কালোত্তীর্ণ। মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভী (১৮০৫-১৯০২) ও শামসুল হক আযীমাবাদীর (১৮৫৭-১৯১১) এই যোগ্য শিষ্য লেখনী, বক্তব্য, বাহাছ-মুনাযারা ও সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে ভারতবর্ষে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার-প্রসারে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। তিনি সর্বভারতীয় আহলেহাদীছ সংগঠন ‘অল ইন্ডিয়া আহলেহাদীছ কনফারেন্স’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ভারতের সর্বশ্রেণীর আলেমদের ঐক্যবদ্ধ সংগঠন ‘জমঈয়তে ওলামায়ে হিন্দ’-এর সদস্য ছিলেন। ভারতবর্ষের প্রায় সর্বত্রই  তাঁর দাওয়াতী ও তাবলীগী পদচারণা অব্যাহত ছিল। ৪০ বছর যাবৎ পিতার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা সাঈদিয়াহ ইসলামিয়াহ, বেনারসে হাদীছের দরস প্রদান তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি।

জন্ম, নাম ও উপনাম :

মাওলানা বেনারসী ১৩০৭হিঃ/১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে বেনারসের দারানগর মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন।[1] তাঁর নাম মুহাম্মাদ, উপনাম আবুল কাসেম এবং উপাধি সায়ফুল ইসলাম (ইসলামের তরবারি)।[2] ছাত্রজীবনে তাঁকে শুধু মুহাম্মাদ নামেই ডাকা হ’ত। ১৩১৯ হিজরীতে মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভী (১৮০৫-১৯০২) সনদ প্রদানের সময় মুহাম্মাদ নামের সাথে আবুল কাসেম উপনাম যুক্ত করার পরামর্শ দেন। এ প্রসঙ্গে বেনারসী গর্বভরে বলেন, ‘আমার উপনাম তো স্বয়ং মিয়াঁ ছাহেব নির্বাচন করেছিলেন। আমাকে তো সে সময় শুধু মুহাম্মাদ নামেই ডাকা হ’ত। যখন সনদে আমার নাম শুধু মুহাম্মাদ লেখা হয় তখন মিয়াঁ ছাহেব বলেন, আরে শুধু মুহাম্মাদ আবার কি? উপনাম আবুল কাসেম বৃদ্ধি করে নাও’।[3] তাঁর পিতার নাম মাওলানা মুহাম্মাদ সাঈদ বেনারসী (১৮৫৩-১৯০৪)। ইনি বেনারসের একজন খ্যাতিমান মুহাদ্দিছ ছিলেন।

শিক্ষাজীবন :

মাওলানা বেনারসীর শিক্ষা জীবনের সূচনা  হয় মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভীর নিকট। তিনি তাবার্রুকান (বরকত স্বরূপ) তাঁর শিক্ষার সূচনা করেন। মজার ব্যাপার হল, বেনারসীর শিক্ষা জীবনের শেষও তাঁর নিকটেই হয়েছিল। মাওলানা সায়েফ বেনারসী লিখেছেন, ‘আমার শিক্ষার শুরু ও শেষ দু’টোই তাঁর নিকটেই হয়েছে। তিনি ছয় মাস পূর্বে ১৩১৯ হিজরীর যিলহজ্জ মাসে আমাকে হাদীছের সনদ প্রদান করেছিলেন। আল্লাহ তাঁর উপর রহমতের বারিধারা বর্ষণ করুন’।[4] তবে পিতার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা ইসলামিয়াহ দারানগর, বেনারসে তাঁর নিয়মতান্ত্রিক লেখাপড়া শুরু হয়। ৭ বছর বয়সে কুরআন মাজীদ নাযেরাহ খতম করার পর হিফয করা শুরু করেন। সেই বছরেই কাযী শায়খ মুহাম্মাদ মিছলী শহরীর (মৃঃ ১৩২৪ হিঃ) নিকট থেকে ‘মুসালসাল বিল আওয়ালিয়াহ’ সনদ হাছিল করেন।[5] মাওলানা সাইয়িদ আব্দুল কাবীর বিহারী বেনারসী (মৃঃ ১৯১৩ খ্রিঃ)-এর নিকট তিনি নাহু, ছরফ, ফার্সী ও অন্যান্য প্রাথমিক গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করেন। মাওলানা সায়েফ বেনারসী তাঁর এই শিক্ষক সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমাদের বাড়ির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাঁর উপরেই ন্যস্ত ছিল। আমাদের সব ভাইয়ের প্রতিপালন এবং প্রাথমিক শিক্ষার তিনিই তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। আমরা সবাই তাঁকে চাচাজান বলে ডাকতাম’।[6]

মাওলানা সাইয়িদ নাযীরুদ্দীন জা‘ফরী হাশেমী বেনারসী (১২৮৪-১৩৫২ হিঃ)-এর নিকটে তিনি সাহিত্য, বালাগাত ও ইলমে মা‘আনীর পাঠ গ্রহণ করেন। মাওলানা হাকীম আব্দুল মজীদ বেনারসীর (১৮৬১-১৯৩৭) নিকট ফিক্বহ, উছূলে ফিক্বহ, মানতিক (যুক্তিবিদ্যা), দর্শন প্রভৃতি অধ্যয়ন করেন। পিতা মাওলানা মুহাম্মাদ সাঈদ বেনারসীর (১৮৫৩-১৯০৪) নিকট তাফসীর ও হাদীছের গ্রন্থ সমূহ অধ্যয়ন করেন এবং মাওলানা আবু ইদরীস মীরাঠীর নিকট কবিতা বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। ১৩২২ হিজরীতে পিতার কাছে কুতুবে সিত্তাহর দাওরা করে মাত্র ১৫ বছর বয়সে সনদ লাভ করেন।[7]

মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভীর সান্নিধ্যে :

পিতার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা ইসলামিয়াহ, দারানগর, বেনারসে জ্ঞানার্জনের পর ১৩১৯ হিজরীতে তিনি দিল্লী যাত্রা করেন। তখন ইলমে দ্বীন হাছিলের কেন্দ্র হিসাবে দিল্লীর খ্যাতি ছিল জগৎজোড়া। দিল্লীর মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভী। তাঁর হাদীছ পাঠদানের সুখ্যাতি দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। আবুল কাসেম বেনারসীর পিতা মাওলানা মুহাম্মাদ সাঈদ বেনারসী মিয়াঁ ছাহেবের অন্যতম ছাত্র ছিলেন।[8] পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনিও মিয়াঁ ছাহেবের নিকট ইলমে হাদীছের উচ্চতর জ্ঞানার্জন করে ‘ইজাযাহ’ বা সনদ লাভ করেন। মিয়াঁ ছাহেবের জীবনের শেষ সময়ের ছাত্র ছিলেন তিনি। মিয়াঁ ছাহেবের অত্যন্ত কম বয়সী ছাত্রদের মধ্যে বেনারসীকে গণ্য করা হয়।[9]

শামসুল হক ডিয়ানবী আযীমাবাদীর খিদমতে বেনারসী :

দিল্লীতে মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভীর নিকট হাদীছের সনদ লাভের পর তিনি আবূদাঊদের বিশ্ববিখ্যাত ভাষ্যকার ‘আওনুল মা‘বূদ’ প্রণেতা আল্লামা শামসুল হক আযীমাবাদীর (১৮৫৭-১৯১১) খিদমতে হাযির হন। গবেষক তানযীল ছিদ্দীক্বী বলেন, ‘যদিও প্রবল ধারণা এই যে, এর পূর্বেও মাওলানা বেনারসী আল্লামা আযীমাবাদীর নিকট থেকে কিছু জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। আল্লামা সায়েফ বেনারসীকে আল্লামা আযীমাবাদীর বিশিষ্ট ছাত্রদের মধ্যে গণ্য করা হয়। স্বীয় সম্মানিত পিতার পর সবচেয়ে বেশী জ্ঞানার্জনের সুযোগও তিনি মুহাদ্দিছ ডিয়ানবীর কাছেই পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর শিক্ষকের অত্যন্ত স্নেহভাজন ও অনুগত ছিলেন’।[10]

পাটনার গোঁড়া হানাফী মৌলভী ওমর করীম ইমাম বুখারী (রহঃ) ও ছহীহুল বুখারীর বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করলে স্বীয় শিক্ষক  আযীমাবাদীর উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় তার জবাবে তিনি মূল্যবান গ্রন্থসমূহ লিপিবদ্ধ করেন। আযীমাবাদী এসব গ্রন্থ লেখার জন্য বেনারসীকে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করেন, গ্রন্থ প্রকাশের জন্য আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন এবং কতিপয় গ্রন্থের অত্যন্ত মূল্যবান অভিমত লিখে দিয়ে প্রিয় শিষ্যের সাহসের পারদ বৃদ্ধি করেন। এমনকি অনেক সময় জবাব লেখার পর তাকে পুরস্কার প্রদানের অঙ্গীকার পর্যন্ত করেন। মাওলানা সায়েফ বেনারসী লিখেছেন, ‘মাওলানা আযীমাবাদী অধমের হাদীছের অন্যতম শায়খ ছিলেন এবং অক্ষমের উপর অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন। বিশেষ  করে আমার রিসালাগুলি দেখে তিনি খুবই খুশী হতেন, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেগুলি নিরীক্ষণ করে অভিমত লিখে দিতেন এবং এজন্য সব রকমের সহযোগিতা প্রদান করতেন’।[11]

অন্যান্য শিক্ষকমন্ডলী :

শায়খ হুসাইন বিন মুহসিন আনছারী ইয়েমেনী (মৃঃ ১৩২৭ হিঃ) এবং মাওলানা হাফেয আব্দুল মান্নান মুহাদ্দিছ ওয়াযীরাবাদীর (১৮৫১-১৯১৫) নিকট থেকেও তিনি হাদীছের সনদ লাভ করেন।[12]

শিক্ষকতা :

দাওরা ফারেগ হওয়ার পর মাত্র ১৬ বছর বয়সে পিতার প্রতিষ্ঠিত  মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি কর্মজীবনে পদার্পণ করেন। ১৩৩০ হিজরী থেকে নিয়মিতভাবে ছহীহায়েন ও তাফসীরের দরস প্রদান শুরু করে দেন। ১৩৩১ হিজরীতে মাদরাসা সাঈদিয়াহ ইসলামিয়ার শায়খুল হাদীছ পদে বরিত হন। ১৩৬৮ হিজরী পর্যন্ত তিনি মোট ৩৯ বার ছাত্রদেরকে ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমের দরস প্রদান করেন। ৪০তম দরস চলাকালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।[13] এটিই মাওলানার জীবনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।

হাদীছ পাঠদান পদ্ধতি :

হাদীছ শাস্ত্রে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ছিল। তিনি স্বীয় যুগে ইলমুর রিজাল-এর ইমাম ছিলেন। পাঠদানের সময় খন্ড, পৃষ্ঠা, প্রকাশকাল সহ হাদীছের মতন পেশ করতেন। আক্বলী ও নাক্বলী দলীল সহ প্রত্যেক প্রশ্নের জবাব এমনভাবে দিতেন যে, প্রশ্নকারীর নিকট কোন সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ থাকত না। বিশেষত কিতাবুল ইলম ও কিতাবুল ঈমান-এর উপর তাঁর দরস হ’ত অসাধারণ।[14]

সায়েফ বেনারসীর যোগ্য ছাত্র মাওলানা ফায়যুর রহমান ছাওরী (মুফতী, দারুল হাদীছ, মউ) বলেন, ‘আজ আল্লামা আলবানীর গ্রন্থ সমূহ এবং তার তাহক্বীক্বগুলি যখন দেখি তখন সায়েফ বেনারসী (রহঃ)-এর দরসের দৃশ্য মানসপটে জেগে ওঠে। মাওলানা সায়েফ বেনারসী দলীল-প্রমাণ সহ এমন সুন্দরভাবে তাঁর মতামত উপস্থাপন করতেন যে, শ্রোতা সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট হয়ে যেত। বুঝানোর দক্ষতায় তাঁর সমতুল্য দ্বিতীয় কেউ ছিল না’।[15]

জামে‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারস-এর সাবেক শায়খুল জামে‘আহ মাওলানা মুহাম্মাদ মুস্তাক্বীম সালাফী বলেন, ‘তাঁর অস্তিত্ব ও দরসে হাদীছ উম্মতের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত একটি নে‘মত ছিল। তিনি ঐ সকল সম্মানিত শায়খুল হাদীছের স্মৃতি জাগরুক করে দিয়েছিলেন, যারা তাদের আল্লাহ প্রদত্ত স্মৃতিশক্তি এবং হাদীছ ও রিজালের গ্রন্থ সমূহের উপর পূর্ণ দক্ষতার ফলে এক জীবন্ত লাইব্রেরীতে পরিণত হয়েছিলেন। আশপাশ ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে অগণিত ছাত্র এসে তাঁর হাদীছের দরসে অংশগ্রহণ করত। তিনি পূর্ণ ৪০ বছর যাবৎ ধারাবাহিকভাবে বুখারী ও মুসলিমের দরস দিতে থাকেন।[16]

হজ্জব্রত পালন :

মাওলানা আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী জীবনে দু’বার হজ্জ সম্পাদন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৩৩০ হিজরীতে তিনি প্রথম হজ্জ পালন করেন। এ সফরে হজ্জ শেষে মুসলিম দেশ সমূহ, মিসর, বায়তুল মুক্বাদ্দাস প্রভৃতি স্থানে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। কিন্তু ৯ই যিলহজ্জ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে মদীনা মুনাওয়ারা যিয়ারত করার সুযোগ হয়নি। এর ১৪ বছর পর ১৩৪৪ হিজরীতে তিনি দ্বিতীয়বার হজ্জ পালন করেন। এবার তাঁর মদীনা যিয়ারতের স্বপ্ন পূরণ হয়। মাওলানা বেনারসীর এই দ্বিতীয় হজ্জ সফর তাঁর জীবনের স্মৃতিময় সফর ছিল। মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (১৮৬৯-১৯১৫) ও মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ীর (১৮৯০-১৯৪১) মতো খ্যাতিমান আহলেহাদীছ ব্যক্তিত্ব তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন। হেজাযের আলেমগণ তাঁর দরস ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা এক বাক্যে তাঁর ইলমী গভীরতার স্বীকৃতি প্রদান করেন। মক্কা মুকাররমার কাযী শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বালহীদ, মদীনার শাসক শায়খ ইবরাহীম আলে সাবহান, শায়খ মুহাম্মাদ বিন আলী তুর্কী, কাযী শায়খ মাহমূদ আলী মিসরী প্রমুখের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মতবিনিময় হয়। মদীনার শাসক শায়খ ইবরাহীম বেনারসীর জ্ঞান-গরিমায় এতটাই প্রভাবিত ও মুগ্ধ হন যে, অনেক পীড়াপীড়ি করে তাঁকে মসজিদে নববীতে জুম‘আর খুৎবা দিয়ে প্রদান করান। এই সফরে তিনি বিভিন্ন আলেম ও মাশায়েখ-এর কাছ থেকে ইলমী ফায়েদা হাছিল করেন এবং অনেক ছাত্র তাঁর ইলমী সুধা পান করে পরিতৃপ্ত হয়। বিশেষত বিপ্লবী সমাজ সংস্কারক শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব নাজদী (রহঃ)-এর প্রপৌত্র শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল লতীফ (১৩১৫-১৩৮৬ হিঃ) ছুলাছিয়াতে বুখারী শুনিয়ে তাঁর কাছ থেকে হাদীছর সনদ গ্রহণ করেন।[17]

দাওয়াত ও তাবলীগ :

ইসলামের প্রচার-প্রসারে মাওলানা সায়েফ বেনারসী অত্যন্ত তৎপর ছিলেন। ১৯০৪ সালে তিনি কুরআন-সুন্নাহর প্রচার-প্রসার এবং শিরক-বিদ‘আত ও কুসংস্কার দূরীকরণের নিমিত্তে তা’য়ীদুল ইসলাম নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। আলাবীপুরার (বর্তমান নাম আলীপুরা) বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে বড়হিয়াদাঈ মসজিদে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন। দীর্ঘ ৩০ বছর যাবৎ ধারাবাহিকভাবে তিনি উক্ত মসজিদে আলোচনা পেশ করেন। কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে ‘আঞ্জুমানে হেমায়েতে ইসলাম’-এর পক্ষ থেকে আয়োজিত অধিকাংশ জালসার তিনি রওনক ছিলেন। বেনারসে কাদিয়ানীরা তাদের অপতৎপরতা শুরু করলে ১৯৩০ সালে বেনারসের মদনপুরা মহল্লায় ‘ইশা‘আতুল ইসলাম’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। মাওলানা বেনারসী এই সংগঠনের প্লাটফর্ম থেকে বক্তব্য ও লেখনীর মাধ্যমে কাদিয়ানীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেন।[18] ১৯৩১ সালের ২৯শে ডিসেম্বর দিল্লীর রহমানিয়া মাদরাসার ১০ম বার্ষিক জালসায় তিনি বক্তব্য প্রদান করেন।[19]

১৯৩৬-৪০ সাল পর্যন্ত তাঁর দাওয়াতী প্রোগ্রাম বন্ধ ছিল। ব্রিটিশ সরকার তাঁর জন্য গোয়েন্দা নিযুক্ত করেছিল। এমনকি মসজিদেও তাঁর পিছে গোয়েন্দা লেগে থাকত। তাছাড়া বেনারসের যেলাগুলিতে বক্তব্য প্রদানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সাথে সাথেই পাড়া মহল্লায় তাঁর বক্তৃতা শুরু হয়ে যায়। ১৯৪১-৪৪ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক সপ্তাহে বেনারসে তাঁর বক্তৃতা হ’ত। শুধু  মুসলমানদের মধ্যেই তাঁর বক্তৃতা সীমিত থাকত না। বরং আর্য সমাজীদের বার্ষিক আলোচনা সভাতেও (কীর্তন) তিনি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হ’তেন।

বেনারস ছাড়া ইউপি (উত্তর প্রদেশ), সিপি (মধ্য প্রদেশ), বিহার ও বাংলায় আহলেহাদীছদের বার্ষিক জালসা সমূহে তিনি অংশগ্রহণ করতেন। একটা সময় ছিল যখন  ভারতবর্ষে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটী (১৮৭৪-১৯৫৬) ও মাওলানা আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী ছাড়া আহলেহাদীছদের কোন জালসা জমত না। ভারতের অধিকাংশ স্থানে মাওলানা সায়েফ বেনারসী আহলেহাদীছ জামা‘আতের জালসা সমূহে বক্তা হিসাবে অংশগ্রহণ করতেন। ইউপির সম্ভবত এমন কোন শহর বাকী ছিল না যেখানে তিনি বক্তৃতা দেননি। তাঁর বক্তব্যের জাদুকরী শক্তি সকল মাযহাব ও শ্রেণীর মানুষকে আকর্ষণ করত। সাধারণ মানুষ ও বিশিষ্ট ব্যক্তি সবার কাছেই তিনি সমানভাবে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ছিলেন। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী আখবারে আহলেহাদীছ পত্রিকায় লিখেছেন, ‘আশ্চর্যের বিষয় হল যে, মাওলানা আবুল কাসেম বেনারসীর অনুপস্থিতি শ্রোতামন্ডলীর কাছে বেশ কষ্টকর মনে হ’ত। তারা জিজ্ঞাসা করত, তিনি কেন আসেননি? পাঞ্জাবে মৌলভী ছাহেবের এই গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে যতই ঈর্ষা করা হৌক না কেন তা কমই হবে’।[20]

তিনি কোন মসলিসে উপস্থিত হ’লে সেখানকার পরিবেশ কেমন হ’ত তা জনৈক কবির নিম্নোক্ত পংক্তিতে খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে-একদিকে সায়েফও বসে আছেন সুযোগের অপেক্ষায় আজ তাঁর হাতে কর্তিত হবে কুফুরীর গর্দান’।[21]

পিতার মৃত্যুর পর বেনারসে ঈদায়নের নিয়মিত ইমাম হিসাবে তিনি যোগ্যতার সাথে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেন। বেনারসের আহলেহাদীছ জামা‘আত পিতার যোগ্য উত্তরসুরী হিসাবে তাকে বেনারসের  ইমাম হিসাবে বরণ করে নেয়।[22] বেনারসে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনে’র প্রচার-প্রসারে পিতা-পুত্রের অবদান চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবে।

রাজনৈতিক জীবন :

রাজনৈতিক দিক থেকে তিনি ‘অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসে’র সাথে জড়িত ছিলেন এবং দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিরোধী ছিলেন।[23] বেনারসীর ভাতিজা মাওলানা আব্দুল হান্নান বেনারসীর (১৯২৫-১৯৯৬) ভাষ্য মতে তিনি ১৯৩৬-৪০ সাল পর্যন্ত ‘বেনারস কংগ্রেস কমিটি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।[24] তিনি ইংরেজ সরকারের ঘোর বিরোধী ছিলেন। সরকার বিরোধী জ্বালাময়ী ভাষণের কারণে তাঁকে কয়েকবার জেলের ঘানি টানতে হয়েছে।[25]

গবেষক মুহাম্মাদ উযাইর শামস বলেছেন, وله مساهمة فعالة في تحرير الهند من أيدى الإنجليز، فقد خطب مرات ضد الحكم الإنجليزى ... وقد ساهم فى حركة الخلافة أيضا- ‘ইংরেজদের হাত থেকে ভারতকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রে তাঁর কার্যকর অবদান রয়েছে। তিনি অনেকবার ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন।... তিনি খেলাফত আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেছিলেন’।[26]

অল ইন্ডিয়া আহলেহাদীছ কনফারেন্স ও বেনারসী :

মাওলানা আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী ‘অল ইন্ডিয়া আহলেহাদীছ কনফারেন্স’ শীর্ষক সর্বভারতীয় আহলেহাদীছ সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।[27] তিনি এর প্রতিষ্ঠা এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের প্রতি জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করে বলেন, ‘অল ইন্ডিয়া আহলেহাদীছ কনফারেন্স সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত  গৃহীত হয়েছে তার সাথে আমিও ঐক্যমত পোষণ করছি এবং দো‘আ করছি, আল্লাহ তা‘আলা যেন এর সুফল দান করেন। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হ’ল, আরাহ-এর বার্ষিক জালসা সন্নিকটে। এই আহলেহাদীছ কনফারেন্সের প্রতিষ্ঠা অবশ্যই যেন সেই জালসাতে হয়’।[28] বস্ত্ততঃ সাংগঠনিকভাবে আহলেহাদীছ আন্দোলন পরিচালনার নিমিত্তে ১৯০৬ সালের ২২শে ডিসেম্বর বিহারের আরাহ যেলায় অবস্থিত ‘মাদরাসা আহমাদিয়াহ’-এর বার্ষিক জালসায় উক্ত সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে।[29]

তিনি উক্ত সংগঠনের অনেক বড় খাদেম  ছিলেন। সারাজীবন এই সংগঠনের উন্নতি-অগ্রগতির জন্য তিনি চেষ্টা করেছেন। মাওলানা ইমাম খান নওশাহরাবী (১৮৯০-১৯৬৬) লিখেছেন, ‘উত্তর প্রদেশ বরং সমগ্র দেশে আহলেহাদীছদের জালসা সমূহে তাঁর অংশগ্রহণ যেন ফরযে কেফায়াহ-এর রূপ পরিগ্রহ করেছিল। আহলেহাদীছ কনফারেন্সের তিনি প্রথম পারিশ্রমিক বিহীন মুখপাত্র ও বক্তা (بلا تنخواه سفير وواعظ) এবং অদ্যাবধি জালসা সমূহের প্রাণস্পন্দন। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ইলমের মাধ্যমে আহলেহাদীছ জামা‘আতের সেরূপ উপকার হয়েছিল, যেরূপ উপকার তার মরহূম পিতার ইলম ও বৈশিষ্ট্যের কারণে হয়েছিল। তার খান্দানের কারণে বেনারস আহলেহাদীছ জামা‘আতের স্বয়ং একটি মারকায (কেন্দ্র)। আর এই মারকাযের কারণে ইউপি, অযোধ্যা, বিহার ও বাংলার আহলেহাদীছ ভাইয়েরা সঞ্জীবনীশক্তি লাভ করেছিল’।[30]

অল ইন্ডিয়া আহলেহাদীছ কনফারেন্সের উদ্যোগে প্রত্যেক বছর সাধারণত ৩ দিন ব্যাপী সর্বভারতীয় বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হ’ত।[31] মাওলানা সায়েফ বেনারসী কনফারেন্সের তৃতীয় জালসায় (পেশাওয়ার, ২৭-২৯শে মার্চ ১৯১৪) রচনা, অনুবাদ, প্রচার ও  প্রকাশনা বিভাগের সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। ১৯১৬ সালের ২৫-২৭শে ফেব্রুয়ারী বেনারসে অনুষ্ঠিত ৫ম বার্ষিক জালসার আহবায়ক তিনি নিজেই ছিলেন। যেটি সবদিক থেকে সফল এবং পূর্বের জালসাগুলোর তুলনায় বড় ও ভবিষ্যতের জন্য নমুনা ছিল।[32] কনফারেন্সের ষষ্ঠ জালসায় (কলকাতা, ৯-১১ই মার্চ ১৯১৭) তিনি ‘বেদ কা ইলহামী হোনা’ বিষয়ে সারগর্ভ বক্তব্য প্রদান করেন। দলীল ও যুক্তি ভিত্তিক এই বক্তব্যটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসিত হয়েছিল। ১৯১৯ সালের কানপুর জালসায় (১১-১৩ই এপ্রিল) তিনি ‘বেদ আওর কুরআন’ (বেদ ও কুরআন) বিষয়ে বক্তব্য দেন। এর প্রত্যুত্তরমূলক বক্তব্য দেওয়ার জন্য আর্য সমাজীরা আবেদন জানালে জালসার সময়সীমা আরো দুই দিন বৃদ্ধি করা হয়। ফলে জালসাটি বিতর্কসভায় পরিণত হয়। আল-হামদুল্লিাহ, এতে তিনি বিজয়ী হন।[33] ১৯৩১ সালের ৬-৮ই নভেম্বর পাটনায় অনুষ্ঠিত ১৭তম জালসায় এবং ১৯৪৩ সালের ২-৪ঠা এপ্রিল মৌ ঈমায় (যেলা আযমগড়) অনুষ্ঠিত জালসায় তিনি সভাপতির আসন অলংকৃত করেন।[34]

বাংলাদেশে বেনারসী :

বাংলাদেশের রংপুর যেলার হারাগাছ বন্দরে ১৯৪৬ সালের ২০শে এপ্রিল মাওলানা আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কোরায়শীর (১৯০০-১৯৬০) সভাপতিত্বে তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত আহলেহাদীছ কনফারেন্সে বাংলার বাহির হ’তে মাওলানা ইসমাঈল সালাফী (গুজরানওয়ালা), মাওলানা আব্দুল্লাহ আরাভী (বিহার), মাওলানা আবুল কাসেম বেনারসী (বেনারস) প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন। উক্ত কনফারেন্সে কাফী ছাহেবকে সভাপতি করে ‘নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহলেহাদিছ’ গঠিত হয়।[35]

অল ইন্ডিয়া আহলেহাদীছ লীগ ও বেনারসী :

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গতি সঞ্চারের জন্য আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম আহলেহাদীছ জামা‘আতের একটি রাজনৈতিক শাখার তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন। যদিও মাওলানা আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী, মাওলানা আবু মাসঊদ ক্বামার বেনারসী (১৮৯৫-১৯৭২), মাওলানা মুহাম্মাদ দাঊদ গযনভী (১৮৯৫-১৯৬৩), মাওলানা আব্দুল মজীদ হারীরী বেনারসী (১৮৯৪-১৯৭২) প্রমুখ আহলেহাদীছ ব্যক্তিত্ব ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক ময়দানে সক্রিয় ছিলেন। মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী দূরদৃষ্টি দিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতঃ তাঁর আখবারে আহলেহাদীছ পত্রিকায় এ বিষয়ে আলেমদের মতামত জানতে চান।[36] অনেকে এর বিরোধিতা করলেও অধিকাংশ আহলেহাদীছ আলেম-ওলামা এর পক্ষে মত দেন। অবশেষে ১৯৩২ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত জমঈয়তে তাবলীগে আহলেহাদীছ কনফারেন্সে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, মাওলানা আহমাদুল্লাহ প্রতাপগড়ী (মৃঃ ১৯৪৩),  ডা.  সাঈদ ফরীদ (দারভাঙ্গা), মাওলানা আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী ও মাওলানা ক্বামার বেনারসীর উপস্থিতিতে ‘অল ইন্ডিয়া আহলেহাদীছ লীগ’ গঠিত হয়। উক্ত জালসায় লীগের নিম্নোক্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও নীতিমালা গৃহীত হয়। (১) সংগঠনের নাম ‘অল ইন্ডিয়া আহলেহাদীছ লীগ’ (২) রাজনৈতিক বিষয়ে মতামত প্রদান (৩) শুধু আহলেহাদীছরাই এ সংগঠনের সদস্য হবে (৪) লীগের তিনটি মজলিস বা পরিষদ থাকবে। (ক) মজলিসে ‘আম্মাহ (সাধারণ পরিষদ) : যেকোন আহলেহাদীছ ব্যক্তি এর সদস্য হ’তে পারবেন। (খ) মজলিসে মুনতাযিমাহ (ব্যবস্থাপনা পরিষদ) : এর সদস্যরা মজলিসে ‘আম্মাহ কর্তৃক নির্বাচিত  হবেন এবং এ পরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা হবে ২৪। ৫ সদস্যে কোরাম হবে। (গ) মজলিসে আমেলা (কার্যনির্বাহী পরিষদ) : এটি মজলিসে মুনতাযিমাহ কর্তৃক নির্বাচিত হবে এবং এর সদস্য সংখ্যা হবে ১১ জন। সারা বছর সাধারণ পরিষদের বৈঠক হবে এবং তিন মাস পরপর ব্যবস্থাপনা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। তবে প্রয়োজনানুপাতে মজলিসে আমেলার নির্বাচন হবে।[37]

মাওলানা আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী উক্ত কনফারেন্সে তিন মাসের জন্য মাসয়িকভাবে সভাপতি নির্বাচিত হন। পুনরায় ১৯৩৩ সালের ১০ই ডিসেম্বর (২১শে শা‘বান ১৩৫২ হিঃ) ছাপরায় ডা. সাইয়িদ মুহাম্মাদ আব্দুল কাদের জীলানীর (মাদ্রাজ) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত লীগের দ্বিতীয় কনফারেন্সে  তিনি সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি এবং তাঁর ভাই মাওলানা ক্বারী আহমাদ সাঈদ বেনারসী (১৮৯১-১৯৬৪) সেক্রেটারী নির্বাচিত হন।[38] ব্যবস্থাপনা পরিষদের জন্য মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল সালাফী (গুজরানওয়ালা), মাওলানা মুহাম্মাদ দাঊদ গযনভী (লাহোর), মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (দিল্লী), হাকীম আব্দুল হান্নান (সম্পাদক, মুসলিম আহলেহাদীছ গেজেট), আব্দুল খাবীর (পাটনা), আব্দুল ওয়াহ্হাব আরাভী (আরাহ, বিহার),  মুনীরুদ্দীন আনওয়ারী (কলকাতা), খায়রুল আনাম (ঐ), আব্দুল জাববার (ঢাকা) প্রমুখকে মনোনীত করা হয়।[39]

জমঈয়তে ওলামায়ে হিন্দের সাথে সম্পৃক্ততা :

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মাওলানা সায়েফ বেনারসী ‘জমঈয়তে ওলামায়ে হিন্দ’-এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯১৯ সালের ২৮শে ডিসেম্বর আছরের ছালাতের পরে অমৃতসরের ইসলামিয়া হাইস্কুলের প্রশস্ত কক্ষসমূহে জমঈয়তের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মাওলানা সায়েফ বেনারসী অংশগ্রহণ করেন।[40]

পত্রিকা  প্রকাশ ও প্রবন্ধ লিখন :

তরুণ বয়সেই মাওলানা সায়েফ বেনারসী প্রবন্ধ লেখা শুরু করেছিলেন। মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী সম্পাদিত আখবারে আহলেহাদীছ পত্রিকায় তাঁর অধিকাংশ প্রবন্ধ প্রকাশিত হ’ত। তিনি ১৩৩০ হিজরীতে কুরআন ও সুন্নাহর প্রচার-প্রসার, শিরক ও বিদ‘আতের খন্ডন এবং তাক্বলীদে শাখছীর মূলোৎপাটনের জন্য ‘আস-সাঈদ’ নামে দারানগর, বেনারস থেকে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন।[41] কিন্তু কিছুদিন পর এটি বন্ধ হয়ে যায়। সবদিক থেকেই এটি একটি অনন্য পত্রিকা ছিল। পত্রিকাটি প্রকাশের জন্য কোন দিন-তারিখ নির্ধারিত ছিল না। প্রত্যেক সংখ্যা স্বতন্ত্র পুস্তিকা আকারে বের হ’ত। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ১৬। এটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি আখবারে আহলেহাদীছ (অমৃতসর), মুসলিম আহলেহাদীছ গেজেট, আখবারে মুহাম্মাদী (দিল্লী) ছাড়াও, মুনীর, মদীনা, আল-হুদা প্রভৃতি পত্রিকায় তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ লিখতেন।[42]                                                       [চলবে]


[1]. ইমাম খান নওশাহরাবী, তারাজিমে ওলামায়ে হাদীছ হিন্দ (লায়ালপুর, পাকিস্তান : ২য় সংস্করণ, ১৩৯১ হিঃ/১৯৮১ খ্রি.), পৃঃ ২৯১, ক্রমিক ৯৫

[2]. মুহাম্মাদ ইউনুস মাদানী, তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস (প্রকাশক : হাফেয ব্রাদারান, মালতীবাগ, মদনপুরা, বেনারস, মার্চ ২০১৬), পৃঃ ৩১৯

[3]. মাওলানা আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী, আয-যাহরুল বাসিম, পৃঃ ১৬

[4]. মাওলানা মুহাম্মাদ আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী, মাসলাকে আহলেহাদীছ পর এক নযর, সম্পাদনা : ড. আব্দুল গফূর রাশেদ, (জামপুর, পাঞ্জাব : ইদারায়ে তাবলীগে ইসলাম, তা.বি), পৃঃ ৪১

[5]. মুহাম্মাদ তানযীল ছিদ্দীকী হুসাইনী, ‘মুহাদ্দিছে কাবীর আল্লামা মুহাম্মাদ আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী (রহঃ)’, দিফায়ে ছহীহ বুখারী, তাহক্বীক্ব : হাফেয শাহেদ মাহমূদ (গুজরানওয়ালা, পাকিস্তান : উম্মুল কুরা পাবলিকেশন্স, সেপ্টেম্বর ২০০৯), পৃঃ ৪২

[6]. তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ১৯২

[7]. তারাজিমে ওলামায়ে হাদীছ হিন্দ, পৃঃ ২৯১; দিফায়ে ছহীহ বুখারী, পৃঃ ৪২

[8]. মাওলানা ফযল হুসাইন বিহারী, আল-হায়াত বা‘দাল মামাত (দিল্লী : আল-কিতাব ইন্টারন্যাশনাল, তা.বি), পৃঃ ৪০৩

[9]. দিফায়ে ছহীহ বুখারী, পৃঃ ৪৩; মাসলাকে আহলেহাদীছ পর এক নযর, পৃঃ ৪১

[10]. দিফায়ে ছহীহ বুখারী, পৃঃ ৪৩

[11]. দিফায়ে ছহীহ বুখারী, পৃঃ ৩৪-৩৫, ৪৩, ৭০২

[12]. তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩২১

[13]. মাওলানা মুহাম্মাদ মুক্তাদী আছারী উমারী, তাযকিরাতুল মুনাযিরীন (লাহোর : দারুন নাওয়াদির, ২০০৭), ১ম খন্ড, পৃঃ ৩২১

[14]. ঐ, ১/৩২১

[15]. তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩২৩

[16]. মাওলানা মুহাম্মাদ মুস্তাকীম সালাফী, ‘আল্লামা মুহাম্মাদ আবুল কাসেম ছাহেব সায়েফ বেনারসী এবং উন কী তাছানীফ’, মাসিক মুহাদ্দিছ (উর্দূ), বেনারস, ভারত, সেপ্টেম্বর ১৯৮৫

[17]. তাযকিরাতুল মুনাযিরীন ১/৩২২; দিফায়ে ছহীহ বুখারী, পৃঃ ৪৫-৪৬

[18]. তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩২৫

[19]. আস‘আদ আ‘যমী, তারীখ ওয়া তা‘আরুফ মাদরাসা দারুল হাদীছ রহমানিয়া দিল্লী (মৌনাথভঞ্জন : মাকতাবাতুল ফাহীম, ফেব্রুয়ারী ২০১৩), পৃঃ ২৩৮

[20]. তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩২৫-৩২৬

[21]. ঐ, পৃঃ ৩২৬

[22]. তাযকিরাতুল মুনাযিরীন ১/৩২৩

[23]. আব্দুর রশীদ ইরাকী, চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ (নয়াদিল্লী : ফরীদ বুক ডিপো, তা.বি.), পৃঃ ২১৬

[24]. তাযকিরাতুল মুনাযিরীন ১/৩২৫

[25]. দিফায়ে ছহীহ বুখারী, পৃঃ ৪৭; আব্দুর রশীদ ইরাকী, হায়াতে নাযীর (লাহোর : নাশরিয়াত, ২০০৭), পৃঃ ১৭৮

[26]. মুহাম্মাদ উযাইর শামস, হায়াতুল মুহাদ্দিছ শামসুল হক ওয়া আ‘মালুহু (বেনারস : জামে‘আ সালাফিইয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৩৯৯ হিঃ/১৯৭৯ খ্রিঃ), পৃঃ ২৭০

[27]. প্রফেসর ড. আব্দুল গফূর রাশেদ, আহলেহাদীছ মনযিল বহ্ মনযিল (লাহোর : মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান, ১ম প্রকাশ, মে ২০০১), পৃঃ ১২০

[28]. তাযকিরাতুল মুনাযিরীন ১/৩২৪; তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩২৭

[29]. মুহাম্মাদ ইসহাক ভাট্টী, বার্রে ছাগীর মেঁ আহলেহাদীছ কী সারগুযাশত (লাহোর : আল-মাকতাবাতুস সালাফিইয়াহ, ১ম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারী ২০১২), পৃঃ ১৪; আব্দুল মজীদ খাদেম সোহদারাভী, সীরাতে ছানাঈ (দিল্লী : আল-কিতাব ইন্টারন্যাশনাল, ১ম প্রকাশ, মে ১৯৮৯), পৃঃ ৩০৬-৩১০

[30]. নওশাহরাবী, তারাজিম, পৃঃ ২৯১-২৯২

[31]. মাওলানা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত আওর মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (লাহোর : মাকতাবা মুহাম্মাদিয়াহ, ৩য় মুদ্রণ, মার্চ ২০১১), পৃঃ ৬৮

[32]. তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩২৭; ভাট্টী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫-১৬; হায়াতুল মুহাদ্দিছ, পৃঃ ২৭০

[33]. তাযকিরাতুল মুনাযিরীন ১/৩২৪

[34]. ভাট্টী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭, ২০৫-২০৬।

[35]. ভাট্টী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২; মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৩৮৬, ৪৭০

[36]. আখবারে আহলেহাদীছ, অমৃতসর, ২৪শে জুলাই ১৯৩১ সংখ্যা দ্রঃ।

[37]. তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৪৬-৪৮, ৩২৭

[38]. ড. মুহাম্মাদ বাহাউদ্দীন, তারীখে আহলেহাদীছ (লাহোর : মাকতাবা ইসলামিয়াহ, মে ২০১১), ১ম খন্ড, পৃঃ ৬২৪-৬২৫; তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩২৭

[39]. তারীখে আহলেহাদীছ ১/৬২৫। গৃহীত : মুসলিম আহলেহাদীছ গেজেট, বর্ষ ১, সংখ্যা ৬, ফেব্রুয়ারী ১৯৩৪, পৃঃ ৪

[40]. দিফায়ে ছহীহ বুখারী, পৃঃ ৪৮-৪৯; ভারতীয় উপমহাদেশের আহলেহাদীছগণের অগ্রণী ভূমিকা, পৃঃ ১৩০-১৩২, টীকা ৮১ দ্রঃ

[41]. মাওলানা মুহাম্মাদ মুস্তাকীম সালাফী,  জামা‘আতে আহলেহাদীছ কী ছিহাফাতী খিদমাত (বেনারস : আল-ইয্যাহ ইউনিভার্সাল, জানুয়ারী ২০১৪), পৃঃ ৩০; আব্দুর রশীদ ইরাকী, তাযকিরাতুন নুবালা ফী তারাজুমিল ওলামা (লাহোর : বায়তুল হিকমাহ, ২০১৪), পৃঃ ৯৭

[42]. তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩২৮-২৯; তাযকিরাতুল মুনাযিরীন ১/৩২৫-২৬





ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) (৪র্থ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর (৩য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) (৩য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) (২য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা আব্দুল্লাহ গযনভী - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা আব্দুস সালাম মুবারকপুরী : মুবারকপুরের এক ইলমী নক্ষত্র - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) (জুলাই’১৮ সংখ্যার পর) - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) (২য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব মুহাদ্দিছ দেহলভী (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. নূরুল ইসলাম
আরও
আরও
.