গত ৮ই ডিসেম্বর রবিবার সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের ২৪ বছরের শাসনের পতন ঘটেছে। তিনি পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। দীর্ঘ ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধের আপাত অবসান ঘটেছে ইসলামপন্থীদের ঐতিহাসিক বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে। বাশার আল-আসাদের পতনের সাথে বাংলাদেশের শেখ হাসিনার পতনের অনেকটা মিল দেখা যায়। উভয়ে পালিয়ে স্ব স্ব মদদদাতা দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, দু’জনের স্বৈরাচারী শাসনের মূলে ছিল তাদের আশ্রয়দাতা দু’টি দেশ। যদিও তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রী দেশ হিসাবে পরিচিত। সিরিয়ায় সরকার পতনের পরই খুলে দেওয়া হয়েছে ৫০টিরও অধিক কারাগার ও টর্চার সেল। ফলে ছাড়া পেয়েছেন বছরের পর বছর ধরে বন্দী হয়ে থাকা বিরোধী মতের মযলূম কারাবন্দীরা। রাজধানী দামেশকের কাছে অবস্থিত ‘সেদনায়া’ কারাগারকে বলা হ’ত ‘মানব কসাইখানা’। এখানে প্রতিদিন বন্দীদের উপর চালানো হ’ত এমন অমানবিক অত্যাচার, যা কল্পনাতেও আনা যায় না। ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াইয়ে আসাদ সরকারের খুন গুমের শিকার হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। ফলে কেবল ১ টি গণকবরেই লক্ষাধিক মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।

যালেম ও মযলূমের এ দ্বন্দ্ব চিরন্তন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যুলুম ক্বিয়ামতের দিন ঘন অন্ধকার হয়ে দেখা দিবে’ (মুসলিম)। যালেম শত পূণ্যের কাজ করলেও মযলূমের দাবী পরিশোধ করতে করতে নিঃস্ব হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে (মুসলিম)। তাই যুলুমের মন্দ পরিণতি থেকে কোন যালেমই রক্ষা পায় না। যালেম তার সকল অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অন্যদিকে মযলূম জীবন বাজি রেখে তার প্রতিবাদ করে। কখনো সে দুনিয়াবী বিজয় লাভ করে। কখনো পরকালীন বিজয় লাভে ধন্য হয়।

এটাই বাস্তব যে, প্রকৃত মুমিন সর্বাবস্থায় বিজয়ী থাকে। কেননা তার লক্ষ্য কেবল জান্নাত। তাই নিজেকে সে আল্লাহর পথে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে। তার হায়াত-মউত, রুটি-রূযী, আনন্দ-বেদনা, সম্মান ও অসম্মান সবই থাকে আল্লাহর হাতে। ফলে সে মনের দিক দিয়ে সর্বদা সুখী ও বিজয়ী। ইহকালে বা পরকালে তার কোন পরাজয় নেই। তাদের বিরোধীরা সর্বদা পরাজিত এবং অসুখী। তবে এজন্য মুমিনকে সর্বদা আল্লাহর উপর ভরসা রেখে তাঁরই দেখানো পথে অটুট ধৈর্যের সাথে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতে হয়। পৃথিবীর প্রথম রাসূল নূহ (আঃ) দীর্ঘ সাড়ে নয়শত বছর দাওয়াত দিয়েছেন। নির্মম নির্যাতন সহ্য করেছেন। অবশেষে আল্লাহ তাঁর শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন ও নূহকে বিজয়ী করেছেন। নমরূদ চূড়ান্ত নির্যাতন চালিয়েছিল ইব্রাহীমের উপর। কিন্তু অবশেষে সেই-ই ধ্বংস হয়েছে এবং ইব্রাহীম (আঃ) বিজয়ী হয়েছেন। ফেরাঊন অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়েছিল নিরীহ বনু ইস্রাঈলগণের উপর। কিন্তু অবশেষে সে তার দলবল সহ আল্লাহর হুকুমে সাগরে ডুবে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) স্বগোত্রীয় শত্রুদের অত্যাচারে মক্কা থেকে হিজরত করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু মাত্র ৮ বছরের মাথায় তিনি বিজয়ী বেশে মক্কায় ফিরে আসেন।

(১) তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের সন্ধান পেয়ে মুক্তিকামী ‘ইয়াসির পরিবার’ যখন যালেম আবু জাহলের হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হচ্ছিলেন, তখন সে দৃশ্য দেখে মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাকে সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘ধৈর্য ধর হে ইয়াসির পরিবার! তোমাদের ঠিকানা হ’ল জান্নাত’। (২) কুরায়েশ নেতা উমাইয়া বিন খালাফের হাবশী ক্রীতদাস ছিলেন বেলাল। ইসলাম কবুল করার অপরাধে তাকে তার মনিব দুঃসহ নির্যাতন করে। তার গলায় দড়ি বেঁধে গরু-ছাগলের মত ছেলে-ছোকরাদের দিয়ে পাহাড়ে-প্রান্তরে টেনে-হিঁচড়ে ঘুরানো হ’ত। তাতে তার গলার চামড়া রক্তাক্ত হয়ে যেত। খানাপিনা বন্ধ রেখে তাকে ক্ষুৎ-পিপাসায় কষ্ট দেওয়া হ’ত। কখনো উত্তপ্ত কংকর-বালুর উপরে হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখে ইসলাম ত্যাগের শর্তে বুকে পাথর চাপা দেওয়া হ’ত। কিন্তু বেলাল শুধুই বলতেন ‘আহাদ’ ‘আহাদ’। একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পাশ দিয়ে যাবার সময় এই দৃশ্য দেখে বললেন ‘আহাদ’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ তোমাকে মুক্তি দেবেন’। পরে আবুবকর (রাঃ) তাকে খরীদ করে মুক্ত করে দেন। (৩) উম্মে উবাইস, যিন্নীরাহ, নাহদিয়াহ ও তার কন্যা এবং বনু মুআম্মাল-এর জনৈকা দাসী ইসলাম কবুল করলে তারা সবাই বর্বরতম নির্যাতনের শিকার হন। যিন্নীরাহকে যখন আবুবকর মুক্ত করেন, তখন সে ছিল অন্ধ। কুরায়েশরা বলল, লাত-‘ওয্যার অভিশাপে সে অন্ধ হয়ে গেছে। তখন যিন্নীরাহ বলে উঠেন, আল্লাহর ঘরের কসম! লাত-‘ওয্যা কারু কোন ক্ষতি করতে পারেনা, উপকারও করতে পারেনা’। তখনই আল্লাহ তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন’। (৪) খাববাব ইবনুল আরাত ছিলেন ষষ্ঠ মুসলমান। মুশরিক নেতারা তার উপরে লোমহর্ষক নির্যাতন চালায়। তাকে জ্বলন্ত লোহার উপরে চিৎ করে শুইয়ে বুকের উপরে পাথর চাপা দেওয়া হয়। তাতে তার পিঠের চামড়া ও মাংস গলে লোহার আগুন নিভে যায়। অকথ্য নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি একদিন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে যান ও তাঁকে কাফেরদের বিরুদ্ধে দো‘আ করার আবেদন জানান। তখন রাগতঃস্বরে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের পূর্বেকার জাতিসমূহের লোকদের দ্বীনের কারণে গর্ত খোঁড়া হয়েছে। অতঃপর তাতে নিক্ষেপ করে তাদের মাথার মাঝখানে করাত রেখে দেহকে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে। লোহার চিরুনী দিয়ে মাংস ও শিরাসমূহ হাড্ডি থেকে পৃথক করে ফেলা হয়েছে। তথাপি এগুলি তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। আল্লাহর কসম! অবশ্যই তিনি এই ইসলামী শাসনকে এমনভাবে পূর্ণতা দান করবেন যে, একজন আরোহী (ইয়ামনের রাজধানী) ছান‘আ থেকে হাযরামাউত পর্যন্ত একাকী ভ্রমণ করবে। অথচ সে আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় করবে না। কিন্তু তোমরা বড়ই ব্যস্ততা দেখাচ্ছ’। এ হাদীছ শোনার পর তিনি আশ্বস্ত হন ও তার ঈমান আরও বৃদ্ধি পায়।

ওমর ও ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে খাববাব (রাঃ)-এর জন্য বড় অংকের রাষ্ট্রীয় ভাতা নির্ধারণ করা হয়। এসময় তিনি বাড়ীর একটি কক্ষে অর্থ জমা রাখতেন। যা তার সাথীদের জানিয়ে দিতেন। অতঃপর অভাবগ্রস্তরা সেখানে যেত এবং প্রয়োজনমত নিয়ে নিত।

তিনি বলতেন, ‘আমি যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম, তখন আমি একটি দীনার বা দিরহামেরও মালিক ছিলাম না। আর এখন আমার সিন্দুকের কোণায় চল্লিশ হাযার দীনার রয়েছে। আমি ভয় পাচ্ছি আল্লাহ আমার সকল নেক আমলের ছওয়াব আমার জীবদ্দশায় আমার ঘরেই দিয়ে দেন কি-না!’। মৃত্যুর সময় তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘তোমরা আমাকে এমন ভাইদের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে, যারা তাদের সম্পূর্ণ নেকী নিয়ে বিদায় হয়ে গেছেন। দুনিয়ার কিছুই তারা পাননি’। আর আমরা তাঁদের পরে বেঁচে আছি। অবশেষে দুনিয়ার অনেক কিছু পেয়েছি। অথচ তাঁদের জন্য আমরা মাটি ব্যতীত কিছুই পাইনি।

মদীনায় প্রথম দাঈ ও ওহোদ যুদ্ধের পতাকাবাহী মুছ‘আব বিন ‘ওমায়ের শহীদ হওয়ার পর কিছুই ছেড়ে যায়নি একটি চাদর ব্যতীত। রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা হামযার জন্য কাফনও জুটেনি। মাথা ঢাকলে পা ঢাকেনি। পা ঢাকলে মাথা ঢাকেনি। অতঃপর সেখানে ‘ইযখির’ ঘাস দিয়ে ঢাকা হয়েছিল’ (দ্র. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ)। এভাবে কেবলমাত্র জান্নাত লাভের স্বার্থে ছাহাবীগণ হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করেছেন।

নির্যাতিত মুসলমানদের সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তাদের প্রতিপালক তাদের দো‘আ কবুল করলেন যে, পুরুষ হৌক বা নারী হৌক আমি তোমাদের কোন কর্মীর কর্মফল বিনষ্ট করবনা। তোমরা পরস্পরে (কর্মফলে) সমান। অতঃপর যারা হিজরত করেছে ও স্ব স্ব বাড়ী থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে এবং আমার রাস্তায় নির্যাতিত হয়েছে। যারা যুদ্ধ করেছে ও নিহত হয়েছে, আমি অবশ্যই তাদের ত্রুটিসমূহ মার্জনা করব এবং অবশ্যই আমি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। এটি আল্লাহর নিকট হ’তে প্রতিদান। বস্ত্তত আল্লাহর নিকটেই রয়েছে সর্বোত্তম পুরস্কার’ (আলে ইমরান ৩/১৯৫)

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ : (১) তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের উপরে বিশ্বাস দৃঢ় থাকার কারণেই ছাহাবায়ে কেরাম লোমহর্ষক নির্যাতনসমূহ বরণ করে নিতে সমর্থ হয়েছিলেন। অথচ নির্যাতনকারীরাও এসবে বিশ্বাসী ছিল বলে দাবী করত। প্রকৃত অর্থে তারা ছিল কপট বিশ্বাসী অথবা দুর্বল বিশ্বাসী। এ যুগেও ঐরূপ মুসলমানেরা দৃঢ় বিশ্বাসী খাঁটি মুসলমানদেরকে ক্ষেত্র বিশেষে অনুরূপ নির্যাতন করে থাকে। (২) প্রকৃত ও দৃঢ় বিশ্বাসীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সমাজ বিপ্লব সাধিত হয়। কপট, দুর্বল বিশ্বাসী ও সুবিধাবাদীদের মাধ্যমে নয়। তাদের দুনিয়াবী জৌলুস যতই থাক না কেন। (৩) বিশ্বাস ও কর্মের পরিবর্তন ব্যতীত সমাজের কাংখিত পরিবর্তন সম্ভব নয়। (৪) শুধু নেতা নয়, সাথে সাথে কর্মীদের নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও কুরবানীর মাধ্যমেই একটি মহতী আদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভ করে থাকে। (৫) যুলুম প্রতিরোধের বৈধ কোন পথ খোলা না থাকলে দৃঢ়ভাবে ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহর রহমত কামনা করাই হ’ল মুক্তির একমাত্র পথ। 

আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন সিরিয়ায় ইসলামী শাসনের সুবাতাস বইয়ে দিন। নবীদের স্মৃতিধন্য ও মে‘রাজের পবিত্র ভূমি শামের রক্তাক্ত ও বেদনাময় অধ্যায়ের ইতি হৌক! ইমাম শাফেঈ, ইবনু কুদামাহ, নববী, ত্বাবারাণী, ইবনু তায়মিয়াহ, ইবনুল ক্বাইয়িম, ইবনু কাছীর, যাহাবী, আলবানী, আরনাঊত্বসহ বহু মনীষীর পদচারণায় ধন্য দামেশক, হাল্ব, হিম্ছের মত শামের ইতিহাসখ্যাত শহরগুলো পুনরায় আপন ঐতিহ্যে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠুক!- একান্তভাবে সেই প্রার্থনা করি।- আমীন! (স.স.)






আমরাও আল্লাহকে বলে দেব - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দর্শনীয় স্থানগুলি শিক্ষণীয় স্থান রূপে গড়ে তুলুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পতিতাবৃত্তি বন্ধ করুন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পর্দা নারীর অঙ্গভূষণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মঙ্গল শোভাযাত্রার অমঙ্গল ঠিকানা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিশ্বজিৎ ও আমরা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ধর্মনিরপেক্ষতার ভয়াল রূপ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইস্রায়েল কি অপরাজেয়? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শেয়ার বাজার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সত্যের সন্ধানী - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প চালু - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিব্রত সরকার বিব্রত দেশবাসী - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.