গত ৮ই নভেম্বর সদ্যসমাপ্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হয়েছেন। তের লক্ষাধিক পপুলার ভোটে বিজয়ী হয়েও ডেমোক্রাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন ৫৮টি ইলেক্টোরাল (২৯০-২৩২) ভোটে হেরে পরাজিত হয়েছেন। মূলতঃ আমেরিকার এই নির্বাচন ব্যবস্থাই ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছে। নিয়মানুযায়ী যে রাজ্যে ইলেক্টোরাল ভোটের অধিকাংশ একজন প্রার্থী পাবেন, সে রাজ্যের সব ইলেক্টোরাল ভোট তার বলে গণ্য হবে। পপুলার ভোট বেশী পেলেও যায় আসে না। যেমন সবচেয়ে বড় রাজ্য ক্যালিফোর্ণিয়ায় রয়েছে ৫৫টি ইলেক্টোরাল ভোট। এখানে যদি কোন প্রার্থী ৫১ শতাংশ অর্থাৎ ২৮টি ভোট পান, তাহ’লে তিনি বাকী সব ইলেক্টোরাল ভোট পেয়েছেন বলে ধরে নেওয়া হবে। সংখ্যালঘু ইলেক্টরদের মতামতের কোন মূল্য নেই। একইভাবে যেসব রাজ্যে যে দল জিতবেন বলে নিশ্চয়তা আছে, সে সব রাজ্যে সাধারণতঃ প্রার্থীরা কোন প্রচারণা চালান না। বরং প্রার্থীর লক্ষ্য থাকে দোদুল্যমান রাজ্য সমূহের ভোটারদের আকর্ষণ করা। ৫০টি রাজ্যের মধ্যে এবারের নির্বাচনে এমন রাজ্যের সংখ্যা ছিল ১১টি। আর তাদের ভোটেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে। আমেরিকার ভোটাররা সরাসরি প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দেন না, বরং তাদের মনোনীত ইলেক্টরদের ভোট দেন। এইসব ইলেক্টররা ১৯শে ডিসেম্বর পুনরায় ভোট দিবেন এবং ৬ই জানুয়ারী ভোট গণনা শেষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন চূড়ান্ত হবে। অতঃপর ২০শে জানুয়ারী নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা গ্রহণ করবেন। মোট ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল ভোটের ২৭০টি যিনি পাবেন, তিনিই জিতবেন। নির্বাচিত ইলেক্টররা দলের মনোনীত হ’লেও তারা তার বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেন। কিন্তু তাতে তারা ফেইথলেস বা বিশ্বাসভঙ্গকারী ইলেক্টর হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যান। ইতিহাসে এ যাবৎ ১৫৭ জনকে এমন পাওয়া গেছে। যদিও তাদের এই বিপরীত ভোট নির্বাচনী ফলাফলকে পরিবর্তন করতে পারে নি। বিগত ২০০০ সালে জর্জ বুশ-এর চাইতে ডেমোক্রাট প্রার্থী আল-গোর ৫ লক্ষাধিক পপুলার ভোট বেশী পেয়েছিলেন। কিন্তু ইলেক্টোরাল ভোট (২৬৬-২৭১) ৫টি কম পাওয়ায় তিনি প্রেসিডেন্ট হ’তে পারেন নি। বাংলাদেশী গণতন্ত্রে একটি ভোটের ব্যবধানেও একজন জিততে পারেন। আজীব এই নির্বাচনী ব্যবস্থার মারপ্যাঁচে জাত ব্যবসায়ী এবং দু’বছর আগেও রাজনীতি না করা এই উচ্চাভিলাষী ধনকুবের ব্যক্তিটি ৫২ তাসের সবচেয়ে পাওয়ারফুল ট্রাম্প কার্ডের মত নিজের নামের তেলেসমাতি দেখিয়েছেন। যা সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। তাঁর যত উদ্ভট বক্তৃতা-বিবৃতি ও ইতরামির কথা এযাবৎ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তাঁকে কোন যুক্তিতেই আমেরিকার মত একটি দেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে কল্পনা করা যায় না। তবুও সেটাই হয়েছে মূলতঃ বর্ণবিদ্বেষ ও জাতিবিদ্বেষ তাড়িত হয়ে। জনৈক গবেষকের হিসাবে ১০টি কারণের মধ্যে আরও যোগ হয়েছে ট্রাম্পের মুসলিম বিদ্বেষী ও অভিবাসী বিরোধী ভূমিকা। তাছাড়া ১৯২০ সালে সেদেশের নারীরা ভোটাধিকার পেলেও কোন নারীকে প্রেসিডেন্ট পদে দেখতে আমেরিকানরা অতটা উদার নয়। ওবামাও সেকথা আগেই বলেছিলেন। যদিও অন্য দেশে তাঁরা নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার। গণতন্ত্রে বিবেকের চেয়ে আবেগ বেশী কাজ করে। আর এটাই কাজে লাগিয়ে থাকেন প্রার্থীরা।
গণতান্ত্রিক বিশ্ব তাই এখন গণতন্ত্র নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। গণতন্ত্র কি তাহ’লে একটি আদর্শহীন হুজুগে ব্যবস্থা? এর সংজ্ঞা কি? এর লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কি? এর জওয়াবে গণতন্ত্রের পূজারীরা এখন বাকহীন। কেননা দেখা গেছে ইতিহাসে যত হুজুগে বক্তা তার জনগণকে মাতাতে পেরেছেন, তিনি দ্রুত জনগণের অবিসংবাদিত (?) নেতা হ’তে পেরেছেন। আবার সেই হুজুগে জনগণ তার হাতেই বেশী নির্যাতিত হয়েছে এবং তাদের হাতেই অবশেষে তার জীবন গেছে। এছাড়া গণতন্ত্র একেক দেশে একেক রকম। চীনে, রাশিয়ায় ও বিশ্বের অনেক দেশে রয়েছে এক দলীয় গণতন্ত্র। অন্যদের টুঁ শব্দটি করার অবকাশ সেখানে নেই। আমেরিকায় রয়েছে মূলতঃ দ্বিদলীয় গণতন্ত্র। আর যেসব দেশে নামকা ওয়াস্তে বহু দলীয় গণতন্ত্র আছে, সেগুলিও মূলতঃ দ্বিদলীয়। দলের নেতা ও সরকারের নেতা যেহেতু একই ব্যক্তি, তাই এসব দেশে বাধাহীন সরকারী নির্যাতনে কাবু হয়ে থাকে কথিত বিরোধী দলগুলি। ফলে পরস্পর হিংসা ও গালাগালি এবং বেশীর বেশী সংসদে গরম গরম বক্তৃতার সুযোগ দেওয়া ছাড়া বিরোধী মতের কোন মূল্যায়ন এসব ব্যবস্থায় নেই। তবে সব দেশের গণতন্ত্র একটি স্থানে এসে মিলিত হয়। সেটি হ’ল এটি ধনিক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী একটি প্রতারণাপূর্ণ নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থা এবং নির্বাচিত অধিকাংশ সরকার লাগামহীন দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা।
১৭৭৬ সালে বৃটিশের কাছ থেকে স্বাধীন হয়ে বিগত ২৪০ বছর ধরে আমেরিকায় এই নির্বাচনী প্রথা চলে আসছে। অনেকেই এর পরিবর্তন চান। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রীট আন্দোলনের নেতাদের ভাষায় সেদেশে ১ শতাংশ ধনিক শ্রেণী বাকী ৯৯ শতাংশ মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে। শান্তিতে নোবেল জয়ী বারাক ওবামা তাদের এই আন্দোলনকে কঠোর হস্তে দমন করেছেন। ফলে এখন আর তাদের কোন শব্দ শোনা যায় না। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে কমবেশী একই অবস্থা বিরাজ করে। মানবিক মূল্যবোধ এসব দেশ থেকে তিরোহিত। দলীয় বিদ্বেষ, দলীয় নির্যাতন, দলীয় শোষণ, এসব দেশের নাগরিকদের পরস্পরে বিভক্ত ও বিদ্বিষ্ট করে রেখেছে। হিংসায় জর্জরিত এইসব দেশের মানুষ সবকিছু দলীয় চোখ দিয়ে দেখে ও দলীয় কান দিয়ে শোনে। আমেরিকার ভোটাররাও তাই ট্রাম্পের মত একজন দলীয় ব্যক্তিকে বেছে নিয়েছেন, যত বিতর্কিতই তিনি হৌন না কেন? তারা তার হাতে যেমন ভেটো ক্ষমতা দিয়েছে। তেমনি নিম্ন কক্ষ ও উচ্চ কক্ষের নিয়ন্ত্রণও তুলে দিয়েছে। এখন তিনি যা বলবেন, তাই-ই হবে। তাঁর স্বেচ্ছাচারকে রুখবার কেউ নেই। জনৈক গবেষকের ভাষায়, আরব বসন্তের পর এবার আমেরিকা বসন্তের (তথা ধ্বংসের) সূচনা হবে’।
সারা পৃথিবীতে তাবৎ অশান্তি ও রক্তস্রোতের জন্য এক নম্বর দায়ী হ’ল আমেরিকা। একথা সবাই বলেন। কিন্তু আবার তাদেরই তাবেদারী করেন সকলে স্রেফ ভয়ে। তাই আল্লাহ হয়ত এবার তাদের দিয়েই তাদের ধ্বংসের ফায়ছালা করেছেন। যেমন ইতিপূর্বে আরেক পরাশক্তি সোভিয়েট রাশিয়াকে আল্লাহ তাদের হাত দিয়েই ১৬ টুকরা করেছেন। ইতিমধ্যে ক্যালিফোর্ণিয়াতে পৃথক রাষ্ট্র হওয়ার শ্লোগান উঠেছে। ২৫টিরও বেশী রাজ্যে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মিটিং-মিছিল চলছে। হেট-ক্রাইম তথা মুসলিম বিদ্বেষের মুখে রাস্তা-ঘাটে মুসলিমরা অপদস্থ হচ্ছেন। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ১৮ বছরের কর না দেওয়ার অপরাধ সহ ৭৫টি মামলা বিচারাধীন। এর দ্বারা তার বিরুদ্ধে ‘অভিসংশন বিল’ আনার চিন্তা-ভাবনাও চলছে। তাকে ১৯শে ডিসেম্বর ভোট না দেওয়ার জন্য ইলেক্টরদের প্রতি আবেদন জানিয়ে লাখ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহের অভিযান চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নির্বাচিত কোন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এগুলি বিরল ঘটনা।
আল্লাহ কোন যালেমকে বরদাশত করেন না। এ পৃথিবীতে যারাই ফাসাদ সৃষ্টি করবে, তাদেরকে তওবা করার জন্য কিছু দিন অবকাশ দেওয়ার পর আল্লাহ তাদের ধ্বংস করে দিবেন, এটাই তাঁর চিরন্তন রীতি। ইতিপূর্বেকার কওমে নূহ, ‘আদ, ছামূদ, ফেরাঊন, কওমে শো‘আয়েব ও লূতের কওমের ধ্বংসযজ্ঞ এবং আধুনিক বিশ্বে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অপমৃত্যু আমাদের সেকথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। অতএব যত তন্ত্রই আমরা বলি, আর যত চেক এন্ড ব্যালান্সের পন্থা আমরা বের করি, মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে জওয়াবদিহিতার ভয়ে ভীত না হবে এবং তাঁর বিধান মানতে স্বীকৃত না হবে, ততক্ষণ তাকে মানুষের ভয় দেখিয়ে সুপথে আনার কোন প্রচেষ্টাই সফল হবে না। সে আল্লাহর বিধান মানবে পরকালে কঠিন আযাব থেকে বাঁচার জন্য এবং জান্নাতে চিরস্থায়ী শান্তি লাভের জন্য। আর তাঁরই বিধান হ’ল দল ও প্রার্থীবিহীন এবং আল্লাহভীরু জ্ঞানীদের পরামর্শ ভিত্তিক নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থা। যেখানে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হবেন আল্লাহ। কোন মানুষের হাতে এই ক্ষমতা থাকবে না। এখানে রাজা-প্রজা, ধনী-গরীব সবাই আল্লাহর গোলাম ও তারই প্রেরিত বিধানের আজ্ঞাবহ। অতএব গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ সবকিছুই ফাঁকা বুলি মাত্র। এসব মন্ত্র-তন্ত্র মানুষকে কেবল ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে মানবতার। একটা মুরগী মারা গেলেও মানুষ দুঃখ পায়। কিন্তু এইসব তন্ত্র-মন্ত্রের নেতারা গুম-খুন-অপহরণ, বোমা হামলা, মিথ্যা মামলার মাধ্যমে মানুষকে সর্বদা যুলুমের শিকার করে রেখেছে। প্রতিদিন এরা মানুষকে রক্ত স্রোতে ভাসাচ্ছে ও চোখের পানিতে ডুবাচ্ছে, তবুও এরা তার স্বরে বলছে আমরা খাঁটি গণতন্ত্রী। আমরাই চূড়ান্ত। আমরাই বিশ্বশান্তির মোড়ল। আসলে এরা শয়তানের সাক্ষাৎ প্রতিভু। অতএব মানব রচিত কোন তন্ত্র নয়, ইসলামই চূড়ান্ত। ফিরে এসো এখানে। আল্লাহ চাইলে ট্রাম্পকে দিয়ে বিশ্বের মঙ্গল করিয়ে নিতে পারেন। আবার আমেরিকাকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছেও দিতে পারেন। যেমনটি দিয়েছেন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে। আমরা সর্বদা আল্লাহর উপর ভরসা করি ও তাঁরই অনুগ্রহ ভিক্ষা করি (স.স.)।