গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বপল্লী গড়ার স্বপ্ন নিয়ে সাম্প্রতিক কালের বিশ্বায়ন তত্ত্ব বর্তমান সময়ের একটি অতি আলোচিত বিষয়বস্ত্ত। এ তত্ত্বের অন্তর্নিহিত বক্তব্য হ’ল সারা বিশ্বকে একই মোহনায় জমায়েত করা। আপাত মধুর এই তত্ত্বটি এসেছে পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বের কাছ থেকে। ইতিপূর্বে গণতন্ত্রের নোসখা পেশ করে তারা যেমন দেশে দেশে দলাদলি সৃষ্টির মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য ছিন্নভিন্ন করেছে এবং এর মাধ্যমে অন্য দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিজেদের কব্জায় নিয়েছে, এবারে বিশ্বায়ন তত্ত্ব পেশ করে তাদের উদ্ভাবিত নব নব প্রযুক্তির আগ্রাসন, অর্থনৈতিক আগ্রাসন ও অপসংস্কৃতির আগ্রাসনকে বিশ্বায়ন করার মাধ্যমে ফেলে আসা সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণকে পুনরায় চালু ও পাকাপোক্ত করতে চলেছে। অবশ্য এর একটা ভাল দিক আছে এই যে, সংকীর্ণ আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনার বদলে কিছুটা হ’লেও উদারতাবাদের প্রসার ঘটে। ধর্মান্ধ ও গোষ্ঠীগত অসহিষ্ণুতার বদলে মানুষ একে অপরকে বনু আদম হিসাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ হয়। একে অপরের সভ্যতা ও অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হয়। এভাবে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সৃষ্টি ও তা ক্রমে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এগুলি হ’ল মূলতঃ হাতির বাইরের দাঁতের মত। এই সুন্দর সুন্দর কথামালার আড়ালে লুকিয়ে আছে কুটিলতার ক্রূর হাসি। যার বাস্তব ফল ছোট্ট পৃথিবী নামক এই গ্রহপৃষ্ঠে বসবাসরত শতকরা ৮০ ভাগ দরিদ্র জনগোষ্ঠী ইতিমধ্যে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে ধনী দেশ সমূহের কলোনীতে পরিণত হয়েছে আজ গরীব দেশগুলো। উন্নত বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তির ও তুলনামূলকভাবে সস্তা পণ্যের বিপরীতে তাদের নিজস্ব পণ্য ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় শেষ হ’তে চলেছে। ফলে তারা এখন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রভৃতি পুঁজিবাদী বিশ্বের গড়া অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী হ’তে বাধ্য হচ্ছে। এক সময়ের সোনালী অাঁশ বাংলাদেশের পাট সম্পদ আজ চাষীর গলার ফাঁসে পরিণত হয়েছে। অমনিভাবে হ’তে চলেছে অধুনা সম্ভাবনাময় চিংড়ী ও গার্মেন্টস শিল্পের ভাগ্যে। এখন আবার নযর পড়েছে আমাদের বিপুল সম্ভাবনাময় তৈল ও গ্যাস মওজূদের দিকে। মুক্তবাজার অর্থনীতি ও অবাধ বাণিজ্যের ধুয়া তুলে তারা দরিদ্র বিশ্বের কাঁচামাল ও সম্পদ অবাধে লুণ্ঠনের সুযোগ পেয়েছে। অবাধ প্রতিযোগিতায় সবলের কাছে দুর্বলের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। আর তা হ’তে চলেছে আজ তথাকথিত বিশ্বায়নের নামে।
নব নব প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক আগ্রাসন ছাড়াও বিশ্বায়নের তৃতীয় কুফল হ’ল সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। আধুনিক স্যাটেলাইট-এর মাধ্যমে টিভি পর্দায় ভেসে ওঠে পশ্চিমা নগ্ন ও মারদাঙ্গা ছবি। আমাদের দেশের লোকেরা তা ক্ষুধার্তের মত গিলতে শুরু করেছে। ফলে ধর্ষণ, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি সহ নানাবিধ সমাজ বিরোধী কর্ম আজ নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির দুর্নিবার আগ্রাসন, অর্থনীতির বিশ্বায়ন ও সংস্কৃতির বিজাতীয়করণ আজ আমাদের সমাজ জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
বিশ্বায়নের বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সর্বত্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মিঠাবুলি আওড়ালেও তার নিজ দেশের খবর এই যে, ‘সারা পৃথিবীতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে যে পরিমাণ অপরাধ হয়, শুধুমাত্র আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যেই হয় তার অর্ধেক অপরাধ। ১০ মিনিট বিদ্যুৎ না থাকলে লাখ লাখ ধর্ষণ হয়। হয় ছিনতাই ও অপহরণ। রাস্তায় রাস্তায় ছিন্নমূল মানুষের ঢল। ক্ষুধার্ত এসব সর্বহারা বনু আদমের জন্য একমুঠো ভাতের ব্যবস্থা কিংবা একটু মাথা গোঁজার ঠাই মার্কিন গণতন্ত্র গত তিন শতাব্দীকালেও নিশ্চিত করতে পারেনি। বর্ণবাদী ধ্যান-ধারণা মার্কিন সমাজে প্রবল প্রতাপে এখনও বিরাজমান। আইন ও বিচার ব্যবস্থা উচ্চবিত্তদের প্রভাব মুক্ত নয়’। চিরন্তন মানবিক নৈতিকতার ন্যূনতম নিরাপত্তাও সেদেশে নেই। নিজ মেয়ের বয়সী ১১ জন মেয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করেও সেদেশের প্রেসিডেন্টের (বিল ক্লিনটন) বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয় না। বরং এতে তার জনপ্রিয়তা নাকি পূর্বের চেয়ে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বুভুক্ষ মানবতাকে পুঁজিবাদী বিশ্বের সর্বগ্রাসী থাবা হ’তে রক্ষা করা ও বিশ্বব্যাপী ইহূদী-খ্রিষ্টান চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দায়িত্ব ছিল মুসলমানদের। কিন্তু তারা সোচ্চার হয়নি। ফলে রাশিয়া থেকে বিতাড়িত ইহূদীদের এনে জমা করা হ’ল মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা বায়তুল মুক্বাদ্দাসের পুণ্যভূমি যেরুযালেমে। উদ্দেশ্য, তৈল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলা এবং মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলির উপরে ছড়ি ঘুরানো।
অতঃপর গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্বঘোষিত নেতা ও বিশ্বায়ন তত্ত্বের উদ্গাতা এই অপশক্তিগুলি একত্রিত হয়ে তাদের সৃষ্ট জারজ রাষ্ট্র ইসরাঈলকে দিয়ে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মে‘রাজ ধন্য পবিত্র বায়তুল আক্বছা জামে মসজিদে তারা ১৯৬৯ সালের ২১শে আগস্ট তারিখে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে সে আগুনে জেগে ওঠে ঘুমন্ত মুসলিম বিশ্ব। মাত্র এক মাসের মধ্যেই মরক্কোর রাজধানী রাবাতে বৈঠকে বসেন ২৪টি মুসলিম দেশের রাষ্ট্র প্রধানগণ। ২২ হ’তে ২৫শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৈঠকে গঠিত হয় ‘অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কান্ট্রিজ’ (ওআইসি) বা ইসলামী সম্মেলন সংস্থা। মুসলিম দেশগুলির সাধারণ সমস্যা, অভিন্ন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য ঐক্যবদ্ধ ব্যবস্থা গ্রহণ করাই ছিল এই সংস্থা গঠনের মূল লক্ষ্য। বাদশাহ ফায়ছাল স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, ওআইসি গঠিত হলে আল-আক্বছা মুক্ত হবে এবং একদিন সেখানে গিয়ে ছালাত আদায় করবেন তিনি। কিন্তু ওআইসি-র রূপকার ও মধ্যপ্রাচ্যের তৈল অস্ত্র প্রয়োগ তত্ত্বের উদ্গাতা এই দুঃসাহসী নেতাকে সে স্বপ্ন পূরণ হ’তে দেয়নি ঐ ইহূদী-খ্রিষ্টান চক্র। ১৯৭৫-এর ২৫শে মার্চ তাঁকে তাঁর প্রাসাদেই হত্যা করা হয় আমেরিকায় পড়ুয়া তাঁরই ভাতিজাকে দিয়ে। এভাবে শেষ করে দেওয়া হয় ওআইসি-র প্রাণপুরুষকে। অতঃপর খুঁড়িয়ে চলা ওআইসি এখন কেবল একটি নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান মাত্র। কিন্তু এটাই কি শেষ কথা?...
বিশ্বায়নের কপট বলয় থেকে বেরিয়ে এসে মুসলিম উম্মাহকে তার আদর্শিক স্বাতন্ত্র্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ফেলে আসা খেলাফতের আদলে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া এখন সময়ের একান্ত দাবী। ওআইসি-কে এখন পূর্ণ ইসলামী স্বাতন্ত্র্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক জোট হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে। ১৯৪৯ সালে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো ‘ন্যাটো’ জোট গঠন করলে ১৯৫৩ সালে কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রগুলো তার পাল্টা ‘ওয়ারশ’ জোট গঠন করে। দু’টি পরস্পর বিরোধী সামরিক জোট থাকায় শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। ফলে ৩য় বিশ্বযুদ্ধের বদলে শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ। যা চলে ’৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়া পর্যন্ত। ‘ওয়ারশ’ জোটের কম্যুনিস্টরাও এখন পুঁজিবাদী ব্লকে ভিড় করেছে। অতএব এখন মুখোমুখি হয়ে গেছে ইহূদী-খ্রিষ্টান ও হিন্দু সহ তাবৎ পুঁুজিবাদী বিশ্ব এবং তাবৎ মুসলিম বিশ্ব। ‘মৌলবাদ’-এর নামে সকল অমুসলিম শক্তির অভিন্ন টার্গেট হ’ল ইসলাম। ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ। অতএব মুসলিম উম্মাহর একক প্লাটফরম হিসাবে ৫৬ (এখন ৫৭) জাতির ওআইসি-কে যত শীঘ্র সম্ভব শক্তিশালী সামরিক জোট হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা আশু যরূরী। এটা সম্ভব হ’লেই তবে সম্ভব হবে চেচনিয়া, সোমালিয়া, পূর্ব তিমূর, আফগানিস্তান, কাশ্মীর, ফিলিস্তীন সহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলিম নিধন যজ্ঞের অবসান ঘটানো। আমরা সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম।
বর্ষশেষের নিবেদন
আল্লাহর রহমতে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাসিক ‘আত-তাহরীক’ তার ৩য় বর্ষ শেষ করল। যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে আত-তাহরীক পদযাত্রা শুরু করেছিল, বিগত তিন বছরে তা কতটুকু সফল হয়েছে, তার মূল্যায়ন করবেন সুধী পাঠকবৃন্দ। তবে ইতিমধ্যেই যেসব মন্তব্য আমরা পেয়েছি, তার আলোকে এতটুকু বলা চলে যে, আমরা আমাদের লক্ষ্যপথে এগিয়েছি, লক্ষ্যচ্যুত হইনি। হতাশ নই, আশান্বিত হয়েছি। যারা ভাবতেন প্রচলিত কোন একটি মাযহাব ও তরীকা ভিন্ন মুসলমান থাকা যায় না, মাযহাবী ফিক্বহ ব্যতীত ফৎওয়া হয় না, তারা নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছেন যে, এসব ধারণা অলীক মাত্র। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসরণই হ’ল প্রকৃত মাযহাব বা চলার পথ। এর বাইরে মুসলমানের জন্য কোন চলার পথ নেই। দুনিয়ার কল্যাণ ও আখেরাতে মুক্তি কেবল এ পথেই সম্ভব, একথাটি জাতির সম্মুখে পেশ করে আত-তাহরীক যে একটি নীরব বিপ্লব সৃষ্টি করে চলেছে, সেটা এখন অনেক সুধীজনের কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।
আত-তাহরীক-এর গ্রাহক-এজেন্ট, পাঠক-পাঠিকা, লেখক-লেখিকা ও শুভানুধ্যায়ী সকলের প্রতি বর্ষশেষে রইল আমাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন। কামনা রইল নিষ্কাম দো‘আ ও অটুট সহযোগিতার। আল্লাহ আমাদের এই ক্ষুদ্র খেদমতটুকু কবুল করুন-আমীন!