মানুষের প্রতি আল্লাহর
সর্বশেষ আহবান ‘তোমরা ভয় কর সেই দিনকে, যেদিন তোমরা সকলে ফিরে যাবে
আল্লাহর কাছে। অতঃপর প্রত্যেকে পাবে তার স্ব স্ব কর্মফল। আর তারা কেউ সেদিন
অত্যাচারিত হবে না (বাক্বারাহ ২৮১)। বস্ত্ততঃ এটাই ছিল কুরআনের
সর্বশেষ আয়াত, যা রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর ৭ বা ২১দিন পূর্বে নাযিল হয়েছিল।
দেশে ক্রমেই রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দলাদলির মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের
রাজনীতির এটাই হ’ল তিক্ত পরিণতি। এখানে বিবেক ভোঁতা, হিংসা প্রবল। এখানে
মিথ্যা সুন্দর, সত্য অসুন্দর। এখানে বিচার অচল, উচ্ছ্বাস মুখ্য। অথচ সত্য
চিরদিন সত্য। তা কখনোই সংখ্যার মুখাপেক্ষী নয়। দেড় হাযার বছর পূর্বেই
আল্লাহ আমাদেরকে সেকথা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘তোমার প্রভুর বাণী সত্য ও ন্যায়
দ্বারা পূর্ণ। তাঁর বাণীর পরিবর্তনকারী কেউ নেই। তিনি সবকিছু শোনেন ও
জানেন’। ‘অতএব যদি তুমি জনপদের অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চলো, তাহ’লে ওরা
তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে। কারণ ওরা কেবল ধারণার অনুসরণ
করে এবং ওরা কেবল অনুমানভিত্তিক কথা বলে’। ‘তোমার প্রভু ভালভাবেই জানেন কে
তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তিনি ভালভাবেই জানেন কে সুপথপ্রাপ্ত’ (আন‘আম ১১৫-১১৭)। অতএব রাস্তা যদি সবকিছুর নিয়ামক হয়, তাহ’লে ইলেকশন, সংসদ, আদালত এসব কি দরকার? ফিরে চলুন সেই আদিম যুগে? মাইট ইজ রাইট-এর যুগে?
বিশ্বব্যাপী হিংসা-হানাহানির মূলে রয়েছে শয়তানের তাবেদারী। আল্লাহ বলেন, স্থলে ও সাগরে সর্বত্র বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে, যা মানুষের কৃতকর্মের ফল। এটা এজন্য যে, আল্লাহ চান তাদের কৃতকর্মের কিছু স্বাদ আস্বাদন করাতে। যাতে তারা ফিরে আসে’ (রূম ৪১)। এর মন্দ পরিণতি বাস্তবে জানার জন্য তিনি মানুষকে আহবান করে বলেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ পূর্ববর্তীদের পরিণাম কি হয়েছিল। তাদের অধিকাংশ মুশরিক ছিল’ (রূম ৪২)। তারা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর প্রতি আনুগত্যকে অস্বীকার করে নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও নফসের প্রতি আনুগত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। ফলে নিজেরা নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনেছিল।
দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সীমান্ত অরক্ষিত। সর্বত্র লুটপাট ও দুর্নীতি স্পষ্ট। নদীমাতৃক বাংলাদেশ আজ মরুভূমি। মানুষের জান-মাল ও ইযযত এখন সবচেয়ে সস্তা সামগ্রী। অথচ সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে হঠাৎ কার ইশারায় আমরা ফিরে গেলাম এমন একটি ইস্যুতে যাতে জাতির কোন মঙ্গল নেই। বরং আছে কেবলই অকল্যাণ আর অকল্যাণ। যার নিদর্শন ইতিমধ্যে পরিস্ফূট। ষড়যন্ত্রকারীরা দূরে বসে মুখ টিপে হাসছে। অতএব হে জাতি! সাবধান হও! ফিরে এসো এমন অবস্থায় পেঁŠছনোর আগে, যেখানে পৌছে গেলে আর ফিরতে পারবে না। তখন ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়বে। আর সেটাই সুঁড়সুড়ি দাতাদের একান্ত কাম্য ও বড়ই আরাধ্য।
বিশ্ব ইতিহাসে সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত ৬টি জাতির কথা আল্লাহ কুরআনে বর্ণনা করেছেন। তারা হ’ল কওমে নূহ, ‘আদ, ছামূদ, লূত, মাদিয়ান ও কওমে ফেরাঊন। এইসব জাতির নেতারা নবীগণের অবাধ্য হয়েছিল এবং তাদের দোষেই পূরা জাতি ধ্বংস হয়েছিল। তাই নেতাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সর্বাধিক। যাকে বিমানের পাইলট ও বাসের ড্রাইভারের সাথে তুলনা করা যায়। অতএব নেতাদের কর্তব্য হ’ল জনগণের আক্বীদা ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। কিন্তু ইংরেজ শাসকরা যতটুকু করত, এখন সেটুকুও দেখা যাচ্ছে না। দিল্লীতে মাত্র একজন মুসলিম নাগরিক, যিনি অমিত সাহস নিয়ে গরু কুরবানী করেছিলেন। তার প্রতি সম্মান জানিয়ে সংখ্যাগরিষ্টের প্রবল চাপকে উপেক্ষা করে ইংরেজ সরকার সেদিন ভারতবর্ষে গরু কুরবানী নিষিদ্ধ করেনি। অথচ এখন এই মুসলিম দেশে প্রকাশ্যে ইসলাম ও ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে ও কুরআনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হচ্ছে। আর নেতারা তাতে সমর্থন দিচ্ছেন। আল্লাহ বলেন, তুমি তোমার চেহারাকে আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি একনিষ্ঠ কর। আল্লাহর পক্ষ হ’তে সেই দিন আসার পূর্বে, যা অনিবার্য এবং যেদিন সবাই বিভক্ত হয়ে পড়বে’। ‘অতএব যে ব্যক্তি অবিশ্বাস করবে, তার অবিশ্বাসের শাস্তি তার উপরে বর্তাবে। আর যারা (বিশ্বাসী হবে ও সে অনুযায়ী) সৎকর্ম সম্পাদন করবে, তারা নিজেদের জন্য (জান্নাতে) সুখশয্যা রচনা করবে’ (রূম ৪৩-৪৪)।
সমাজে শান্তি ও স্থিতি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব সবার। তবে প্রধান দায়িত্ব হ’ল সরকারের। জনগণের পক্ষে সরকারই এজন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সরকার, প্রশাসন ও আদালত তাই কোন দলের নয়, বরং জনগণের। জনগণই তাদের বেতন-ভাতা প্রদান করে থাকে। অতএব তাদেরকে অবশ্যই দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থাকতে হবে ও সকলের প্রতি নিরপেক্ষ আচরণ করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা ন্যায়বিচার কর, যা আল্লাহভীরুতার সর্বাধিক নিকটবর্তী। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে ওয়াকিফহাল’ (মায়েদাহ ৮)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যখন মানুষ কোন অন্যায় হ’তে দেখে, অথচ তা প্রতিরোধ করে না, আল্লাহ সত্বর তাদের উপর ব্যাপক গযব নামিয়ে দিবেন (তিরমিযী)। নিঃসন্দেহে পাপ-পুণ্য সেটাই যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল নির্ধারণ করেছেন। মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা কখনো ন্যায়-অন্যায় ও পাপ-পুণ্যের মানদন্ড নয়। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি বলে দাও যে, সত্য কেবল তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ হতে আসে। অতঃপর যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে তাতে বিশ্বাস স্থাপন করুক। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে তা অবিশ্বাস করুক। আমরা যালেমদের জন্য জাহান্নাম প্রস্ত্তত করে রেখেছি’ (কাহফ ২৯)। একদল ধর্মনেতা ও সমাজনেতা নিজেদের কথা ও কাজকে সর্বোত্তম ও চূড়ান্ত বলে মনে করেন। অথচ আল্লাহ বলেন, ‘তুমি বলে দাও, আমি কি তোমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের সম্পর্কে খবর দিব না’? ‘যাদের পার্থিব জীবনের সকল কর্ম বরবাদ হয়েছে। অথচ তারা ভাবে যে, তারা সুন্দর কর্মসমূহ সম্পাদন করেছে’। ‘এরা হ’ল তারাই যারা তাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহকে ও তাঁর সাক্ষাৎকে অবিশ্বাস করেছে। ফলে তাদের সকল কর্ম বিনষ্ট হয়েছে। অতএব ক্বিয়ামতের দিন আমরা তাদের আমলসমূহ ওযনের জন্য দাঁড়িপাল্লা খাড়া করব না’ (কাহফ ১০৩-০৫)। অর্থাৎ তাদের প্রতি কোনরূপ দৃকপাত করা হবে না।
উচ্ছ্বাস কোন বাধা মানে না। তা সাধারণতঃ চরমপন্থী হয়ে থাকে। যা একদিন হযরত ওছমান ও হযরত আলী (রাঃ)-কে হত্যা করেছিল। সেদিন ইহুদী চক্রান্ত তাদের পিছনে কাজ করেছিল। সম্প্রতি ‘আরব বসন্ত’ নামে যে ঢেউ তোলা হয়েছিল। এখন যা সিরিয়ায় চলছে; তা সেসব দেশের গণমানুষের কোন কাজে আসেনি। বরং যাদের মদদে এটা হয়েছিল, তাদেরই লুণ্ঠনের পথ সুগম হয়েছে। এই উচ্ছ্বাস একদিন শেখ মুজিবের পাহাড়সম জনপ্রিয়তাকে নিমেষে ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছিল এবং তাঁর অনুসারীদের মধ্য থেকেই দেশে প্রথম বিরোধীদল খাড়া হয়েছিল। কারা সেই উচ্ছ্বাসের পিছনে সেদিন ইন্ধন যুগিয়েছিল আশা করি মুজিবকন্যার তা অজানা নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমরা তরুণদের ও বোকাদের নেতৃত্ব থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাও (আহমাদ, তিরমিযী)। তিনি বলেন, আল্লাহ যাকে জনগণের নেতৃত্ব দান করেন, অথচ সে তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল এবং ঐ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল, আল্লাহ তার উপর জান্নাতকে হারাম করে দেন (বুখারী, মুসলিম)। তিনি বলেন, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের নীচে সাত শ্রেণীর মানুষ ছায়া পাবে। তাদের মধ্যে প্রথম হ’ল ন্যায়পরায়ণ শাসক ও বিচারক। দ্বিতীয় হ’ল ঐ যুবক, যে আল্লাহর দাসত্বে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে... (বুখারী, মুসলিম)।
পরিশেষে বলব, আল্লাহ ও তাঁর বিধানই কেবল সত্য ও সুন্দর। সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠা দানের জন্য সত্যসেবীদের এগিয়ে আসা কর্তব্য। রাষ্ট্র ও সমাজনেতাগণ সেই সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে দেশে আল্লাহর গযব অনিবার্য হয়ে পড়বে। অতএব হে মানুষ আল্লাহকে ভয় কর! (স.স.)।