নৈতিক
অবক্ষয় প্রতিরোধের জন্য যথাযথ অনুশাসন ও কড়া শাসন দু’টিই সমভাবে প্রযোজ্য।
অনুশাসন তিনভাবে হ’তে পারে : (১) পিতা-মাতা ও পরিবারের অনুশাসন (২) শিক্ষক
ও গুরুজনদের অনুশাসন এবং (৩) আল্লাহ ও আখেরাতভীতির অনুশাসন। যে সন্তানের
ভাগ্যে এ তিনটি নে‘মত একসাথে জুটেছে, সে সন্তান ভাগ্যবান। সে জীবনের
সর্বত্র সফলতা লাভ করবে ইনশাআল্লাহ। উক্ত তিনটি অনুশাসনের মধ্যে সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ হ’ল তৃতীয়টি। কেননা বাপ-মা ও শিক্ষক-গুরুজন সর্বদা সঙ্গে
থাকেন না। কিন্তু আল্লাহ সর্বদা সঙ্গে থাকেন। তাঁর দৃষ্টিকে এড়িয়ে কিছুই
করার ক্ষমতা মানুষের নেই। সর্বোপরি আখেরাতে জাহান্নামের কঠিন শাস্তির ভয়ে
সে সর্বদা ভীত থাকবে ও অন্যায় থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। এরপরেও যদি শয়তানী
কুহকে পড়ে সে অপকর্ম করে বসে, তাহলে পরকালে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার
জন্য সে তওবা করবে এবং কড়া দুনিয়াবী শাসন তথা আল্লাহ প্রেরিত দণ্ডবিধি
হাসিমুখে বরণ করে নেবে। বরং নিজে এসে ধরা দিয়ে দণ্ড চেয়ে নেবে। মাদানী
রাষ্ট্রে মা‘এয আসলামী ও গামেদী মহিলার ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে অম্লান স্মৃতি
হয়ে আছে। বস্তুতঃ ইসলাম জাহেলী আরবের ছন্নছাড়া মানুষগুলিকে মূলতঃ তৃতীয়
অনুশাসনটি দিয়েই পরিবর্তন করেছিল। দণ্ডবিধি নাযিল হয়েছিল অনেক পরে মাদানী
জীবনের শেষ দিকে।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা জাহেলী আরবকেও ছাড়িয়ে গেছে।
তার কারণ অনুসন্ধান করলে সহজেই বলা যাবে যে, বর্ণিত তিনটি অনুশাসনের
কোনটিই যথার্থভাবে এদেশে নেই। অথচ সমাজ পরিবর্তনে এগুলির কোন বিকল্প নেই।
এখানে আরেকটি বিষয় স্মর্তব্য যে, পিতা-মাতা, শিক্ষক ও গুরুজন যেসব উপদেশ
দেন, তা মান্য করা অবশ্যই যরূরী হলেও তাঁরা মানুষ। তাই অনেক ক্ষেত্রে
তাঁদের উপদেশে ও নির্দেশে ভুল থাকতে পারে। কিন্তু আল্লাহ প্রেরিত
উপদেশমালায় কোন ভুল বা ত্র“টি থাকার অবকাশ নেই। তাই সর্বদা কুরআন ও হাদীছে
বর্ণিত হেদায়াতকে সামনে রাখতে হবে ও তাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
অতঃপর
আমরা যদি নিম্নোক্ত উপদেশগুলি মেনে চলি, তাহ’লে নৈতিক অবক্ষয়ের স্রোতধারা
বন্ধ না হলেও কমে যাবে বলে আশা করি। পারিবারিক জীবনকে নৈতিক শিক্ষার দুর্গ
হিসাবে গড়ে তুলুন। এজন্য নিম্নের হাদীছগুলি পরিবারের সবাইকে মুখস্ত করিয়ে
দিন।-
(১) ব্যক্তি জীবনে : (ক) আল্লাহ বলেন, তোমাদের
মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু (হুজুরাত
১৩)। (খ) তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি, যে চরিত্রের দিক দিয়ে
সর্বোত্তম (বু:মু:)। (গ) রাসূল (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন মীযানের
পাল্লায় সবচেয়ে ভারী হবে বান্দার সচ্চরিত্রতা এবং আল্লাহর সবচেয়ে ক্রোধের
শিকার ঐ ব্যক্তি, যে অশ্লীলভাষী ও দুশ্চরিত্র (তিরমিযী)।
(২) পারিবারিক
জীবনে : রাসূল (ছাঃ) বলেন, (ক) স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরে পোষাক সদৃশ’
(বাক্বারাহ ১৮৭)। (খ) পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি। পিতার
অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি’ (তিরমিযী)। (গ) সন্তানের জন্য পিতার দো‘আ
আল্লাহ অবশ্যই কবুল করেন নিঃসন্দেহে’ (আবুদাঊদ)। (ঘ) মায়ের পদতলে সন্তানের
জান্নাত’ (নাসাঈ)। (ঙ) বৃদ্ধকালে পিতা-মাতা উভয়কে কিংবা একজনকে পেল, অথচ
যে সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করল না, সে হতভাগা’ (মুসলিম)। (চ) যে ব্যক্তি
কন্যা সন্তানকে সুন্দরভাবে মানুষ করবে, ঐ সন্তান তার জন্য জাহান্নামের
পর্দা হবে’ (বুখারী, মুসলিম)। (ছ) সন্তান যাতে সৎবন্ধু তালাশ করে সেজন্য
রাসূল (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের নীচে ছায়া পাবে ঐ দুই
বন্ধু, যারা স্রেফ আল্লাহকে খুশী করার জন্য পরস্পরে বন্ধুত্ব করেছে’
(বু:মু:)। (জ) দ্বীনী শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয (ইবনু মাজাহ)।
(৩) সামাজিক জীবনে : (ক)
ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অনিষ্টকারিতা হ’তে তার প্রতিবেশী
মুক্ত থাকে না’ (বুখারী, মুসলিম)। (খ) যে ব্যক্তি পেট ভরে খায় ও তার
প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে, সে ব্যক্তি মুমিন নয়’ (বায়হাক্বী- শো‘আব)। (গ)
আল্লাহ ঐ ব্যক্তির উপর দয়া করেন না, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না’
(বু: মু:)। (ঘ) যে ব্যক্তি বিধবা ও অভাবগ্রস্তকে সাহায্য করবে, সে ব্যক্তি
আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর ন্যায় ছওয়াব পাবে’ (বু: মু:)। (ঙ) নিজের বা
অন্যের ইয়াতীম প্রতিপালনকারী ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে
পাশাপাশি থাকবে’ (বুখারী)। (চ) তোমরা যমীনবাসীর উপর দয়া কর, আসমানবাসী
তোমাদের উপর দয়া করবেন’ (আবুদাঊদ)। (ছ) পরস্পরের জন্য তিনটি বস্তু হারাম :
তার রক্ত, সম্পদ ও ইযযত’ (মুসলিম)। (জ) যে ব্যক্তি ছোটকে স্নেহ করে না ও
বড়কে সম্মান করে না, সে মুসলমানের দলভুক্ত নয়’ (আবুদাঊদ, তিরমিযী)। (ঝ) যে
ব্যক্তি আমাদের প্রতি অস্ত্র উত্তোলন করল, সে আমাদের দলভুক্ত নয়’ (বু:মু:)।
(ঞ) যে ব্যক্তি প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়’ (মুসলিম)। (ট)
জামা‘আতবদ্ধ জীবন রহমতস্বরূপ এবং বিচ্ছিন্ন জীবন আযাব স্বরূপ (আহমাদ)। (ঠ)
দ্বীন হ’ল নছীহত’ (মুসলিম)। অতএব পরস্পরকে সর্বদা উপদেশ দাও।
(৪) আত্মীয়তার সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য : (ক)
যে ব্যক্তি তার রূযী ও আয়ু বৃদ্ধি করতে চায়, সে যেন তার আত্মীয়দের সাথে
সম্পর্ক বৃদ্ধি করে (বু:মু:)। (খ) আত্মীয়তার সম্পর্ক আল্লাহর আরশের সাথে
ঝুলন্ত থাকে। যে তা যুক্ত রাখে, আল্লাহ তার সাথে যুক্ত থাকেন। আর যে তা
ছিন্ন করে, আল্লাহ তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন’ (বু:মু:)।
(৫) নারী ও পুরুষের পরস্পর সম্পর্ক : আল্লাহ
বলেন, পুরুষেরা যেন দৃষ্টিকে অবনত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে।
.. নারী যেন তার দৃষ্টিকে অবনত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। তারা
যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে..। তারা যেন তাদের বুকের উপর চাদর দিয়ে
রাখে..। তারা যেন এমনভাবে চলাফেরা না করে যাতে তাদের গোপন সৌন্দর্য
প্রকাশিত হয়ে যায়’ (নূর ৩০-৩১)।
(৬) সরকার ও সমাজনেতাদের জন্য : (ক)
তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং তোমরা প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে
ক্বিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে’ (বু:মু:)। (খ) যাকে আল্লাহ জনগণের নেতৃত্ব
দান করেন। অতঃপর সে নাগরিকদের প্রতি খেয়ানতকারী হিসাবে মৃত্যুবরণ করে,
আল্লাহ তার উপরে জান্নাতকে হারাম করে দেন’ (মুসলিম)। দেশকে আল্লাহর বিধান
অনুযায়ী পরিচালিত না করাই সবচেয়ে বড় খেয়ানত। (গ) আল্লাহ বলেন, তোমরা আল্লাহ
ও তাঁর রাসূলের আগে বেড়োনা। আল্লাহকে ভয় কর’ (হুজুরাত ১)। (ঘ) তিনি বলেন,
তোমরা জেনেশুনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে খেয়ানত করো না এবং তোমাদের
পরস্পরের আমানতের খেয়ানত করো না’ (আনফাল ২৭)। (ঙ) তিনি বলেন, আল্লাহ ও তাঁর
রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা দিলে সে বিষয়ে কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর অন্য কোন
সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা
করবে, সে স্পষ্ট ভ্রষ্টতায় নিপতিত হবে’ (আহযাব ৩৬)। (চ) তিনি বলেন, রাসূলের
আহ্বানকে তোমরা অন্যদের আহ্বানের মত মনে করো না। তোমাদের মধ্যে যারা চুপি
চুপি সরে পড়ে, তাদেরকে আল্লাহ জানেন। অতএব যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ
করে, তারা এ ব্যাপারে সতর্ক হৌক যে, (দুনিয়ায়) তাদের নানাবিধ ফিৎনা
গ্রেফতার করবে এবং (আখেরাতে) তাদেরকে পাকড়াও করবে মর্মান্তিক শাস্তি’ (নূর
৬৩)। (ছ) পক্ষান্তরে কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের নীচে ছায়াপ্রাপ্ত সাত
শ্রেণীর মানুষের মধ্যে প্রথম হবেন ন্যায়পরায়ণ শাসক ও বিচারক (বু:মু:)।
অতএব
সমাজের নৈতিক ধস থামাতে গেলে প্রথমে নিজ পরিবারে, অতঃপর শিক্ষা ও
প্রশাসনের সর্বস্তরে ইসলামী অনুশাসন বাধ্যতামূলকভাবে পালন করতে হবে। সাথে
সাথে আদালতের মাধ্যমে ইসলামী দণ্ডবিধি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রনেতাগণ যদি অন্ততঃ ছয়মাসের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে এটা
চালু করেন, তাহ’লে দেশের চেহারা পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং দেশ সত্যিকার অর্থে
সোনার বাংলায় পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!
(স.স.)।