দেশের তরুণ সমাজ বিদেশমুখী হচ্ছে কেন?

তরুণ সমাজ, যাদেরকে জাতির মেরুদন্ড বলা হয়, তাদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেন আমাদের প্রাণপ্রিয় সন্তানেরা বাপ-মায়ের কোল ছেড়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে জীবন কাটাতে চায়? লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে যাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য অধিক অর্থোপার্জন। অথচ সে টাকা ব্যয় করে দেশেই তারা কিছু করতে পারে। এর মাধ্যমে তারা সমাজের ও দেশের উন্নতিতে অবদান রাখতে পারে। অল্পে তুষ্ট থাকার ও আল্লাহ্র উপর ভরসা করার ঈমান ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আর এজন্য অনেকে সাগরে ডুবে মরছে অথবা সেখানে গিয়ে নির্যাতনে মরছে। অনেকে খালি হাতে ফিরে আসছে। অনেকে আবার বিদেশের নাগরিক হয়ে যাচ্ছে। অথচ তাক্বদীরের বাইরে সে কিছুই পায় না। আল্লাহ বলেন, ‘অধিক পাওয়ার আকাংখা তোমাদের (পরকাল থেকে) গাফেল রাখে, ‘যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে উপনীত হও’ (তাকাছুর ১০২/১-২)

এক হিসাবে জানা যায় যে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছে দেশের ২৬ লাখ ১৪ হাযার ৯৪ জন নাগরিক। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে ৩য়। প্রতি বছর সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রায় ৫০০ বাংলাদেশীর মৃত্যু হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন-এর তথ্য অনুসারে প্রতি বছর আনুমানিক ৭ লাখ বাংলাদেশী বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হ’তে গিয়ে এই ঝুঁকির মুখোমুখি হন। যাদের অধিকাংশের বয়স ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, অবৈধ অভিবাসনকে সরকার সমর্থন করে না। অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া ব্যক্তিরা দেশকেই বিপদে ফেলছে এবং দেশের সুনাম নষ্ট করছে’(১৮ ও ১৯ শে সেপ্টেম্বর’২৩, দৈনিক ইনকিলাব)

দেশ ছাড়ার প্রধান কারণ সমূহ : (১) দেশে বৈধ কর্মসংস্থানের অভাব : ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, নারী ধর্ষণ সব দিক দিয়ে দেশ তলানিতে চলে গেছে। যার জন্য দেশের ১৮ ভাগ প্রাপ্ত বয়স্ক ও ১২ ভাগ শিশু-কিশোর মানসিক সমস্যায় ভুগছে (২৩শে সেপ্টেম্বর’২৩, দৈনিক ইনকিলাব)। বিগত দলীয় সরকারগুলির আমলে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে দু’বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। (২) নিরাপত্তার অভাব : লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১ সালে নিরাপদ শহরের সূচকে ঢাকা ছিল ৭ম ঝুঁকিপূর্ণ শহ্র। দলীয় ক্যাডার ও চাঁদাবাজদের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ। রাস্তা-ঘাটে তো বটেই, নিজের বাড়ীতেও কারও নিরাপত্তা নেই। যদিও যুক্তরাজ্যের মত উন্নত দেশের রাস্তায় একা চলতে ভয় পায় ৪৪ শতাংশ মেয়ে (২১শে সেপ্টেম্বর’২৩, দৈনিক ইনকিলাব)(৩) পাহাড় প্রমাণ আয় বৈষম্য : বর্তমানে দেশে ধনী ও গরীবের আয় বৈষম্যের অনুপাত ১+ থেকে ৪১। সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ কুক্ষিগত। খাদ্য মূল্যস্ফীতি গত সাড়ে ১১ বছরে সর্বোচ্চ। সূদ-ঘুষ, মুনাফাখোরী, মওজুদদারী ইত্যাদি পুঁজিবাদী অর্থনীতির নির্দয় শোষণে মানুষ জর্জরিত। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলিতে ২০২১ সালে ২০ হাযার বাংলাদেশী নাগরিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছে। এবার এ সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। যাদের ৯০ শতাংশের বয়স ২০ থেকে ৪০ বছর। (৪) বেকারত্ব : আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (আইএলও) ২০২২-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি ১০০জন স্নাতক ডিগ্রীধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। তাই অনেকের মতে, কয়েক লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে দারোয়ানের চাকুরী নেওয়ার চাইতে ঐ টাকায় বিদেশে গিয়ে ট্যাক্সি চালানো বা সুইপারী করাও অনেক ভাল। আন্তর্জাতিক চাকুরীর বাজারগুলি প্রায়ই উচ্চতর পারিশ্রমিক প্যাকেজ ও ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা এবং পেশাগত অগ্রগতির সুযোগ দিয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। ফলে দেশের যোগ্য চাকুরীজীবীরাও বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এতে দেশের দক্ষ জনশক্তির অভাব প্রকট হচ্ছে। (৫) উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ যাত্রা : স্টুডেন্ট ভিসায় বিদেশ যাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও মানসম্মত শিক্ষার অভাব, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের রাজনৈতিক দলাদলি, যে কোন চাকুরীতে দলীয় দৃষ্টিকোণ, কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের অভাব, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, আইন-শৃংখলার অবনতি, নিজের ও পরিবারের ভবিষৎ নিয়ে উদ্বেগ এবং বিদেশী সংস্থাগুলির লোভনীয় অফার প্রভৃতি কারণে শিক্ষার্থীরা বিদেশে যেতে প্রলুব্ধ হচ্ছে। এভাবে যদি মেধাবীরা ব্যাপকহারে বিদেশে পাড়ি জমায়, তাহ’লে দেশ এক সময় মেধাশূন্য হয়ে যাবে। ২০২২ সালে প্রকাশিত ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৪৯,১৫১ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী বিশ্বের ৫৮টি দেশে পড়াশোনার জন্য গিয়েছে। অনেকে অবৈধভাবেও চলে যাচ্ছে। অনেকে সেখানে স্থায়ী হচ্ছে।

(৬) রাজনীতি সচেতন তরুণরা নেতাদের পারস্পরিক হানাহানি দেখে রাজনীতি থেকে দূরে থাকছে। দেশের উন্নতির জন্য উন্নত চিন্তা থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বিদেশে তরুণদের সংখ্যা কম। তাই তারা এদেশের তরুণদের বিভিন্নভাবে আকৃষ্ট করছে। এমনকি তাদেরকে সেদেশের রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছে। তারাই আবার বিদেশের প্রতিনিধি হয়ে দেশে আসছে ও আমাদের নেতাদের উপদেশ দিচ্ছে। (৭)দ্বৈত নাগরিকত্ব : আগে ইউরোপ-আমেরিকা সহ ৫৭টি দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা ছিল। বর্তমান সরকারের আমলে আরও ৪৪টি দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত রয়েছে। তবে এর ফলে ধনিক শ্রেণী আইনী প্রক্রিয়াতেই দেশের অর্থ বিদেশে গচ্ছিত রাখতে পারেন (৯ই সেপ্টেম্বর’২৩ দৈনিক ইত্তেফাক)

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় : (১) সরকার ও প্রশাসনকে সকলের প্রতি নিরপেক্ষ আচরণ করতে হবে। যোগ্য ও মেধাবীদের অগ্রাধিকার ও সম্মানীদের যথাযথ সম্মান দিতে হবে। (২) সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনজীবী, চিকিৎসক এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলাদলি নিষিদ্ধ করতে হবে। (৪) আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরপেক্ষ রাখতে হবে এবং তাদেরকে সর্বদা নৈতিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেই সাথে মিথ্যা মামলা দায়েরকারীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির বিধান করতে হবে। (৫) বিচার ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার করতে হবে। আদালতের চৌকাঠও ঘুষ খায়, এই দুর্নাম ঘুচাতে হবে। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণগুলি দূর করতে হবে। এজন্য হাইকোর্টে বিচারাধীন অপেক্ষমান লাখ লাখ কারাবন্দী, যাদের অপেক্ষার মেয়াদ কমপক্ষে ৩ বছর হয়ে গেছে, তাদেরকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। সেই সাথে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের অমানবিক বিধান বাতিল করা আবশ্যক। নিম্ন আদালতে হাজতের মেয়াদ ১মাসে নির্ধারণ করা যেতে পারে। তাতে নিউজিল্যান্ডের ন্যায় আমাদের কারাগারগুলি প্রায় খালি থাকবে এবং কারাবন্দী ও তাদের পরিবার স্বস্তি পাবে (এই সাথে দ্রষ্টব্য সম্পাদকীয় : ‘কারা সংস্কারে আমাদের প্রস্তাব সমূহ’ (১৯/৮ সংখ্যা, মে ২০১৬)। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)






বিষয়সমূহ: যুবসমাজ
ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প চালু - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
যুলুমের পরিণাম ভয়াবহ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জশনে জুলূস ও আমরা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হকিং-এর পরকাল তত্তব - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বন্দী ফিলিস্তীন : জবাব সশস্ত্র জিহাদ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে পরামর্শ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
গাযায় গণহত্যা ইহূদীবাদীদের পতনঘণ্টা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বাংলাদেশের সংবিধান হৌক ইসলাম - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কোয়ান্টাম মেথড : একটি শয়তানী ফাঁদ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আহলেহাদীছ তাবলীগী ইজতেমা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইস্রায়েল কি অপরাজেয়? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.