‘উড়ে এল চিল জুড়ে নিল বিল’ বলে বাংলায় একটি প্রবাদ বাক্য চালু আছে। আজকের ফিলিস্তীনের অবস্থা তাই। সংখ্যাগুরু ফিলিস্তীনী আরব মুসলিম জনগণকে বিতাড়িত করে বাহির থেকে আসা মুষ্টিমেয় সংখ্যক ইহূদী ফিলিস্তীনের শতকরা ৮০ ভাগ এলাকা গ্রাস করে সেখানে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করেছে। আর সেখানকার স্থায়ী নাগরিক ফিলিস্তীনী জনগণ এখন সারা মধ্যপ্রাচ্যে উদ্বাস্ত্ত হিসাবে দুর্বিষহ জীবনের ঘানি টেনে চলেছে। ইহূদী কামানের বিরুদ্ধে তাদের ইট-পাটকেল নিক্ষেপকে অভিহিত করা হচ্ছে ‘সন্ত্রাস’ বলে। এটাই হ’ল আজকের নিষ্ঠুর বাস্তবতা। আর এটা করছে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী আমেরিকা-ব্রিটেন-ফ্রান্স-রাশিয়া তথা আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলি।
ফিলিস্তীনের পরিচয় : ফিলিস্তীনের পূর্ব নাম ‘কেন‘আন’। হযরত নূহ (আঃ)-এর পঞ্চম অধঃস্তন পুরুষের নাম ‘ফিলিস্তীন’। ‘ক্রিট’ ও ‘এজিয়ান’ সাগরের দ্বীপপুঞ্জ থেকে আগত ফিলিস্তীনীদের নামানুসারে এই অঞ্চল ‘ফিলিস্তীন’ নামে পরিচিত হয়। খ্রিষ্টানদের আগমনের বহু পূর্বেই এরা এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। ফিলিস্তীনীরা ‘অগনন’ সম্প্রদায়ভুক্ত এবং আরব বংশোদ্ভূত। খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের অভ্যুদয়ের সাথে সাথে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। খলীফা আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর সময়ে ১৩-১৭ হিজরী সনে ফিলিস্তীন পূর্ণভাবে ইসলামী খেলাফতের অধীনস্ত হয়। তখন থেকেই ফিলিস্তীন মুসলিম দেশ হিসাবে পরিচিত। মাঝে ১০৯৬ হ’তে ১১৮৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ৯১ বছর খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা একে দখলে রেখেছিল। তারা ‘মসজিদে আক্বছা’-এর মধ্যে আশ্রয় গ্রহণকারী সত্তুর হাযারের অধিক মুসলমানকে এক সপ্তাহের মধ্যে হত্যা করেছিল। পরে ছালাহুদ্দীন আইয়ূবীর কাছে পরাজিত হয়ে খ্রিষ্টান দস্যুরা এদেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর দীর্ঘ ৪০০ বছর যাবত ফিলিস্তীন ওছমানীয় তুর্কী খেলাফতের শাসনাধীনে একটি প্রাদেশিক রাজ্য ছিল। তাদের নিজস্ব সরকার ছিল, ছিল পৌরসভা এবং রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে ওছমানীয় পার্লামেন্টে ছিল তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি।
এরপর মহাপ্রলয়ের মত বিশ্বব্যাপী ১ম মহাযুদ্ধের দাবানল জ্বলে উঠল ১৯১৪ সালে। যুদ্ধ শেষে ‘ভার্সাই চুক্তি’র বলে ফিলিস্তীনকে নিয়ে নেয় বৃটেন। শুরু হয় বিপর্যয়। ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর বৃটেন কর্তৃক ‘বেলফোর’ ঘোষণার ভিত্তিতে ১৯১৮ সাল থেকে বহিরাগত ইহূদীদের জন্য ফিলিস্তীনের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং সাথে সাথে তাদের যাবতীয় নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণাধিকার নিয়ে আইন প্রণয়ন করা হয়। ফলে বিভিন্ন দেশ থেকে ইহূদীরা এখানে এসে বসতি স্থাপন শুরু করে। ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ১০,১৬২ বর্গমাইল জুড়ে প্রতিষ্ঠিত ফিলিস্তীনে (প্যালেস্টাইন) ১৯১৮ সালে বৃটিশ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে লোকসংখ্যা ছিল ৭০,৮০০। এর মধ্যে আরব ছিল শতকরা ৯৩ ভাগ এবং বাদবাকী ৭ ভাগ ছিল দেশীয় ইহূদী। মাত্র ৩০ বছর পরে ১৯৪৮ সালে ১৪ই মে যখন বৃটেন সেখান থেকে চলে আসে, তখন ফিলিস্তীনের লোকসংখ্যা দাঁড়ায় ১৯,৫০,০০০। যার মধ্যে ২ লাখ দেশীয় ইহূদী, ৪ লাখ বহিরাগত ইহূদী ও বাদবাকী সাড়ে ১৩ লাখ সুন্নী আরব মুসলিম। ফিলিস্তীনের মর্যাদাগত পরিচয় হ’ল এই যে, এর বুকেই রয়েছে মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা ও মি‘রাজের স্মৃতিধন্য ‘বায়তুল আক্বছা’। প্রথমে কা‘বা গৃহ নির্মাণের ৪০ বছর পর এ গৃহ নির্মিত হয়। পরবর্তীতে দাঊদ ও সুলায়মান (আঃ) কর্তৃক নির্মিত এটিই পৃথিবীর সর্ব প্রাচীন ও দ্বিতীয় ইবাদত গৃহ। এখানে ‘বেথেলহামে’ ঈসা (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন এবং এখান থেকেই তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। ক্বিয়ামতের পূর্বে তাঁর হাতেই এখানে ইয়াজূজ-মাজূজ ও দাজ্জাল ধ্বংস হবে। ‘তূর’ পাহাড়ও এখানে অবস্থিত।[1]
উল্লেখ্য যে, পশ্চিমা শক্তিসমূহের চাপ ও প্ররোচনায় ১৯৪৭ সালের ২৯শে নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তীনের বিভক্তি প্রস্তাব গ্রহণ করে। যেখানে ফিলিস্তীনে একটি পৃথক আরব রাষ্ট্র ও একটি পৃথক ইহূদী রাষ্ট্র এবং যেরুযালেমের জন্য একটি আন্তর্জাতিক অঞ্চল গঠনের কথা বলা হয়। অতঃপর ১৯৪৮ সালে বৃটেন ফিলিস্তীন ত্যাগ করার সাথে সাথে ইহূদী নেতারা স্বাধীন ‘ইস্রাঈল’ রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয় এবং তার কয়েক মিনিট পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইস্রাঈলকে স্বীকৃতি দেয়। অতঃপর ১৯৪৯ সালে বৃহৎ শক্তিবর্গ তাকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র করে নেয়। এরপর ইঙ্গ-মার্কিন ও ইস্রাঈলী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে দশ লক্ষ আরব মুসলিম নিজেদের দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী আরব দেশ সমূহে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আর ফিলিস্তীনে থেকে যায় মাত্র ২,৪৭,০০০ নির্যাতিত আরব মুসলিম। ফিলিস্তীনের ৮০% ভূভাগ দখল করে নেয় আগ্রাসী ইস্রাঈলী দখলদাররা। সেদিন থেকে নিয়ে বিগত ৫২ বছর যাবত চলছে এই ফিলিস্তীন ট্রাজেডী। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রের উদ্বাস্ত্ত শিবিরে যাদের জন্ম ও মৃত্যু। ইস্রাঈলের পশ্চিম তীরের ফিলিস্তীনী ভূখন্ডে চলছে তাদের নিয়মিত রক্তের হোলিখেলা। যা আজও অব্যাহত রয়েছে।...
ঘটনার সূত্রপাত : ইস্রাঈলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান কট্টরপন্থী বিরোধী দলীয় লিকুদ পার্টির নেতা এরিয়েল শ্যারন কর্তৃক উস্কানীমূলক ভাবে গত ২৮শে সেপ্টেম্বর যেরুযালেম সফরের পর থেকে বর্বর ইস্রাঈলী বাহিনী নতুন করে তাদের সামরিক হামলা জোরদার করে এবং মাত্র কয়েক সপ্তাহের হামলায় ইতিমধ্যে দু’শতাধিক ফিলিস্তীনী নিহত ও সাত হাযারের অধিক আহত ও পঙ্গু হয়ে গেছে চিরদিনের মত। পশ্চিম তীরে ফিলিস্তীনী পুলিশের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ধ্বংস হয়েছে। রামাল্লায় প্রেসিডেন্ট আরাফাতের সরকারী বাসভবন হয়েছে নিষ্ঠুর রকেট হামলার শিকার। যে ইঙ্গ-মার্কিন খৃষ্টচক্র ও জাতিসংঘ ‘ইস্রাঈল’ নামক অবৈধ রাষ্ট্রের জন্ম দিল, তারাই আবার ১৬ই অক্টোবর মিসরে গিয়ে শার্ম আল-শেখে বসল শান্তি আলোচনার নামে অন্যায় কালক্ষেপণের কূটকৌশল বাস্তবায়নের জন্য। ওদিকে ২৩শে অক্টোবরে কায়রোতে বসল আরব লীগ। কিন্তু সর্বত্র নেতৃপর্যায়ে রয়েছে ইঙ্গ-মার্কিন চক্রের গোপন কালো হাত ও আসুরিক চাপ। ফলে জোড়াতালি দেওয়া একটা চুক্তির নামে পর্বতের মুষিক প্রসব হয়েছে মাত্র। ফিলিস্তীনীরা মার খেয়েই চলেছে। প্রতিদিন সেখানে লাশ পড়ছে। বাড়ছে আহত ও নিহতের সংখ্যা। ধ্বংস হচ্ছে স্থাপনা। সমস্ত আরব রাষ্ট্রে হয়েছে এর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। ইস্রাঈলের বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের জনমত ও সেই সাথে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে তাদের সহানুভূতিশীল বিশ্ব জনমত।
প্রতিরোধ সংগ্রাম : ১৯৬০ সালে আরব রাষ্ট্রসমূহের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত হয় ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ (P.L.O)। ১৯৬৯-এর ফেব্রুয়ারীতে এর নেতৃত্বে আসেন কায়রোর ফিলিস্তীন ছাত্র ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিপ্লবী ছাত্রনেতা ইয়াসির আরাফাত। যিনি ইতিপূর্বেই ‘আল-ফাতাহ’ গেরিলা সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। মার্কসবাদী ‘পপুলার ফ্রন্ট’ ও ইসলামপন্থী ‘হামাস’ গ্রুপ থাকা সত্ত্বেও ফিলিস্তীনী জনগণের নেতৃত্ব রয়েছে মূলতঃ প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতের হাতে।
সমাধান কোন পথে : ইস্রাঈলের বিরুদ্ধে এযাবত যতগুলি যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, ১৯৭৩ সালের যুদ্ধ ব্যতীত বাকী সব ক’টি প্রচলিত যুদ্ধেই আরবরা ও মিসরীয়রা পরাজিত হয়েছে। ফলে ২০০০ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর ফিলিস্তীনীরা শুরু করেছে ‘ইন্তিফাদাহ’ (الانتفاضة) বা ব্যাপক জনযুদ্ধ। যাকে কার্যকর প্রতিরোধ হিসাবে অনেক আরব সামরিক বিশেষজ্ঞ অভিমত প্রকাশ করেছেন। ইনতিফাদায় ইস্রাঈল দারুণভাবে মার খাচ্ছে। ইতিমধ্যে তারা দক্ষিণ লেবানন থেকে ১৬ বছর পরে হিযবুল্লাহ গেরিলাদের হাতে প্রচন্ড মার খেয়ে পালিয়েছে। ট্যাংক-রকেট-কামান ইত্যাদি প্রচলিত অস্ত্র প্রয়োগ করে বেসামরিক জনগণকে হত্যা করলে ইস্রাঈল একদিকে যেমন বিশ্ব জনমত হারাবে, অন্যদিকে তেমনি কাপুরুষোচিত অন্যায় কর্মের জন্য নিজ জনগণের কাছেও নিন্দিত হবে। ইস্রাঈলকে জব্দ করতে তাই ‘ইন্তিফাদা’ বা ব্যাপক জনযুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছে ফিলিস্তীনী জনগণ। তারা সব হারিয়েছে। এখন আর তাদের হারাবার কিছু নেই। তাই কেবল নিয়মিত সামরিক বাহিনী নয়, ফিলিস্তীনের প্রত্যেক নাগরিক এখন সৈনিকে পরিণত হয়েছে। এমনকি মায়েরাও অধিক সন্তান জন্মদানে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। যাতে তাদের সন্তানদের রক্তের বিনিময়ে ফিলিস্তীনের হারানো স্বাধীনতা ফিরে আসে। আর এটা বাস্তব যে, গণ বিস্ফোরণ বোমা বিস্ফোরণের চাইতে অধিকতর শক্তিশালী। এই সশস্ত্র জনযুদ্ধ বা জিহাদের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক আগ্রাসী শক্তির হাতে বন্দী ফিলিস্তীনের মুক্তি আসবে ইনশাআল্লাহ।
সেই সঙ্গে আমরা মুসলিম উম্মাহকে কুরআনী নির্দেশের দিকে ফিরে আসতে আহবান জানাই। তারা যেন ইহূদী-খ্রিষ্টান ও কুফরী শক্তিকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ না করেন এবং তারা যেন অতি দ্রুত ‘ওআইসি’-কে সক্রিয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক জোটে রূপান্তরিত করেন। তাহ’লে শুধু ইস্রাঈল নয়, কাশ্মীর, আফগানিস্তান, কসোভো, চেচনিয়া সহ বিশ্বের সকল স্থান হ’তে মুসলিম নির্যাতন নিমেষে বন্ধ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। মুসলিম রাষ্ট্র সমূহের নেতৃবৃন্দ বিষয়টি যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন, ততই মঙ্গল। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!
[1]. মুসলিম হা/২৯৩৭; মিশকাত হা/৫৪৭৫।