পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ ।

হাদীছ সম্বন্ধে মুক্বাল্লিদদের অবস্থান এবং তার কিছু দৃষ্টান্ত :

(১৯) তার থেকেও বিস্ময়কর যে, যখন কোন হাদীছ, চাই তা মুসনাদ কিংবা মুরসাল হোক, তোমাদের ইমামের রায় মাফিক হওয়ায় তোমরা তা গ্রহণ করছ, তারপর ঐ একই হাদীছে এমন কোন বিধান থাকে যা তার রায়ের বিপরীত, তখন ঐ বিধানের ক্ষেত্রে তোমরা উক্ত হাদীছ বর্জন করছ। অথচ হাদীছ কিন্তু একটাই। মনে হয় যেন হাদীছ তোমাদের তাক্বলীদকৃত ইমামের মত মাফিক হলে দলীল গণ্য হবে; আর তার মতের বিপরীত হলে তা কোন দলীল পদবাচ্য হবে না। আমরা এর কিছু নমুনা তুলে ধরছি। কেননা এটা তাদের আজব তামাশার অংশ।

সুন্নাতের একাংশ গ্রহণ ও অন্য অংশ বর্জনে মুক্বাল্লিদদের হোঁচট খাওয়ার কিয়দংশ :

একদল মুক্বাল্লিদ ব্যবহৃত পানির অপবিত্রতা দূরীকরণ ক্ষমতা রদ করতে এই দলীল পেশ করেছেন যে, নবী করীম (ছাঃ) মহিলার ওযূর অবশিষ্ট পানি দ্বারা পুরুষের ওযূ করতে এবং পুরুষের ওযূর অবশিষ্ট পানি দ্বারা মহিলার ওযূ করতে নিষেধ করেছেন।[1] তারা বলেছেন, ওযূর সময় দু’জনের অঙ্গ থেকে ব্যবহৃত যে পানি গড়িয়ে পড়ে তাই উভয়ের অবশিষ্ট পানি। (আর তাদের একে অপরের ব্যবহৃত এই অবশিষ্ট পানি দ্বারা ওযূ করতে হাদীছটিতে নিষেধ করা হয়েছে)। আবার তারা নিজেরাই খোদ হাদীছটির বিরোধিতা করে তাদের উভয়ের জন্য অন্যের ওযূর অবশিষ্ট পানি দ্বারা ওযূ বৈধ বলে রায় দিয়েছেন। অথচ এই নিষেধাজ্ঞাই ছিল উক্ত হাদীছের মূল উদ্দেশ্য। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মহিলার ওযূর অবশিষ্ট পানি দ্বারা পুরুষের ওযূ করতে নিষেধ করেছেন, যখন মহিলা একাকী পানি ব্যবহার করবে। এক্ষণে তাদের নিকট না তার একাকীত্বের বিষয়ে কোন চিহ্ন আছে, না ঐ অবশিষ্ট পানি মহিলার অবশিষ্ট পানি হওয়ার বিষয়ে কোন চিহ্ন আছে। তাই তারা নিজেদের দলীল হিসাবে প্রদত্ত হাদীছের নিজেরাই বিরোধিতা করেছেন এবং হাদীছটিকে তার প্রয়োগক্ষেত্রের বাইরে প্রয়োগ করেছেন। কেননা ওযূর অবশিষ্ট পানি বলতে নিশ্চিতভাবেই ওযূ শেষে ওযূকারীর পাত্রে থেকে যাওয়া অবশিষ্ট পানিকে বুঝায়; যে পানি দিয়ে ওযূ করা হয়েছে তাকে নয়। ব্যবহৃত ঐ পানিকে তো ওযূর অবশিষ্ট পানি বলা হয় না। সুতরাং হাদীছ দ্বারা যা বুঝানো হয়নি তারা তার পক্ষে দলীল দিয়েছে এবং যা বুঝানো হয়েছে তারা তা বাতিল করে দিয়েছে।[2]

আরেকটি দৃষ্টান্ত তারা কেউ কেউ বলেছেন, ‘পানি নাপাকীযুক্ত হলে রং বিগড়ে না গেলেও অপবিত্র হয়ে যাবে’। দলীল হিসাবে তারা বলেছেন, ‘নবী (ছঃ) বদ্ধ পানিতে পেশাব করতে নিষেধ করেছেন’।[3]

আবার তারা বলেছেন, ‘যদি কেউ বদ্ধ পানিতে পেশাব করে তবে ঐ পানি দুই কুল্লা পরিমাণের কম না হ’লে অপবিত্র হবে না’।

পানির অপবিত্রতার পক্ষে তারা রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর নিমেণাক্ত বাণী দ্বারাও দলীল দিয়েছেন,إذَا اسْتَيْقَظَ أَحَدُكُمْ مِنْ نَوْمِهِ فَلَا يَغْمِسْ يَدَهُ فِي الْإِنَاءِ حَتَّى يَغْسِلَهَا ثَلَاثًا ‘তোমাদের কেউ যখন ঘুম থেকে জাগবে তখন সে যেন তিনবার না ধোয়া পর্যন্ত তার হাত পানির পাত্রে না ঢুকায়’।[4]

তারপর তারা বলেছেন, ‘না ধুয়ে হাত ঢুকালে পানি অপবিত্র হবে না এবং তার উপর হাত ধোয়া ফরয হবে না। সে হাত ধোয়ার আগে পাত্রে হাত ঢুকাতে চাইলে তা পারবে’। এ মাসআলায় তারা দলীল দিয়েছেন যে, ‘নবী (ছাঃ) জনৈক পেশাবকারীর পেশাবের জায়গা খুঁড়ে তথাকার মাটি তুলে ফেলতে বলেছিলেন’।[5]

অতঃপর তারা বলেছেন, ‘মাটি খোঁড়াও ফরয নয়; বরং ঐ পেশাবের জায়গা যথাবস্থায় থেকে গেলে তা সূর্যের আলো ও বাতাসে শুকিয়ে পবিত্র হয়ে যাবে।

ব্যবহৃত পানি দ্বারা ওযূ নিষেধের সপক্ষে তারা নিমেণর হাদীছ দিয়েও দলীল দিয়েছেন, يَا بَنِي عَبْدِ الْمُطَّلِبِ إنَّ اللَّهَ كَرِهَ لَكُمْ غُسَالَةَ أَيْدِي النَّاسِ ‘হে আবদুল মুত্তালিবের সন্তানেরা! নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের জন্য মানুষের হাত ধোয়া পানি অর্থাৎ যাকাত অপসন্দ গণ্য করেছেন’।[6]

আবার তারা বলেছেন, ‘আবদুল মুত্তালিবের সন্তানদের জন্য যাকাত হারাম নয়’।

তারা বলেন যে, ‘পানিতে মরে ভেসে ওঠা মাছের দরুন পানি নাপাক হয় না; পক্ষান্তরে ডাঙার প্রাণী মরে পানিতে পড়লে তাতে পানি নাপাক হয়ে যায়’। দলীল হিসাবে তারা রাসূল (ছাঃ)-এর সমুদ্র বিষয়ক হাদীছ পেশ করেন। তাতে তিনি বলেছেন, هُوَ الطَّهُورُ مَاؤُهُ الْحِلُّ مَيْتَتُه ‘উহার (সমুদ্রের) পানি পাক এবং উহার মরা প্রাণী হালাল’।[7] 

তারপর তারা খোদ হাদীছের কথার বিরোধিতা করে বলেছেন, ‘সমুদ্রস্থিত মাছ মরে উঠলে তা খাওয়া হালাল নয় এবং মাছ ছাড়া সমুদ্রস্থিত আর কোন প্রাণীও হালাল নয়’।

রায়পন্থী যুক্তিবাদীরা কুকুরের অপবিত্রতা ও তার পান করা পাত্রের বিধান সম্পর্কে দলীল হিসাবে বলেন যে, নবী (ছঃ) বলেছেন,إِذَا وَلَغَ الْكَلْبُ فِي إِنَاءِ أَحَدِكُمْ فَلْيَغْسِلْهُ سَبْعَ مَرَّات ‘যখন তোমাদের কারো পাত্র থেকে কুকুর পানি পান করে তখন সে যেন তা সাতবার ধুয়ে ফেলে’।[8]

তারপর তারা বলেছেন, ‘ঐ পাত্র সাত বার ধোয়া ফরয নয়, বরং সে একবার ধোবে’। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, ‘তিনবার ধোবে’।[9]

এক দিরহাম[10] বা তার কম-বেশী স্থান পরিমাণ নাজাসাতে গালীযা বা কঠিন নাপাক দ্রব্য কাপড়ে লাগলে ঐ কাপড়ে ছালাত আদায়ের শুদ্ধতা সম্পর্কে তাদের মতের বিভিন্নতায় তারা একটি অশুদ্ধ হাদীছ দিয়ে দলীল দিয়েছেন, যা গুতাইফের সনদে যুহ্রী ও আবূ সালামা হয়ে আবূ হুরায়রার নামে মারফূ‘ সূত্রে অর্থাৎ নবী (ছাঃ)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণিত হয়েছে।  ঐ অশুদ্ধ হাদীছটি হল, تُعَادُ الصَّلَاةُ مِنْ قَدْرِ الدِّرْهَمِ ‘এক দিরহাম হেতু ছালাত পুনরায় আদায় করতে হবে’।[11]

তারপর তারা বলেছেন, ‘দিরহাম পরিমাণ নাপাকীর কারণে ছালাত পুনরায় আদায় করতে হবে না’।[12]

উটের যাকাতে উটের সংখ্যা ১২০-এর ঊর্ধ্বে হ’লে তারা আলী ইবনু আবী ত্বালিব (রাঃ)-এর হাদীছের ভিত্তিতে একেবারে প্রথম নির্ধারণী থেকে হিসাব কষার কথা বলেছেন। এতে প্রতি পাঁচটি উটে একটি ছাগল দিতে হবে।[13]

তারপর ১২ স্থানে তারা ঐ একই বর্ণনার বিরোধিতা করেছেন। পুনরায় তারা আমর ইবনু হাযমের হাদীছ দ্বারা দলীল দিয়েছেন যে, أَنَّ مَا زَادَ عَلَى مِائَتَيْ دِرْهَمٍ فَلَا شَيْءَ فِيهِ حَتَّى يَبْلُغَ أَرْبَعِينَ فَيَكُونُ فِيهَا دِرْهَمٌ ‘দু’শ দিরহামের উপর যা কিছু বেশী হবে তাতে কিছুই দিতে হবে না, যতক্ষণ না ৪০ দিরহাম পর্যন্ত পৌঁছাবে। ৪০ দিরহাম হ’লে এক দিরহাম দিতে হবে।[14] তারপর তারা পনেররও বেশী জায়গায় হাদীছটির সরাসরি বিরোধিতা করেছেন।

ক্রয়চুক্তি রদ করার এখতিয়ার তিন দিনের বেশী না হওয়ার দলীল হিসাবে তারা মুছাররাতের হাদীছ উল্লেখ করেছেন।[15]

এটি অন্যতম বিস্ময়কর যে, তারা ভয়ংকরভাবে মুছাররাতের হাদীছ অস্বীকার করে, কিন্তু এর প্রবক্তার নয়। যদি হাদীছটি হক হয় তবে তার অনুসরণ হবে আবশ্যক; নচেৎ তা দ্বারা তিন দিন এখতিয়ার প্রদানের দলীল প্রদান বৈধ হবে না। অথচ হাদীছটিতে শর্তজনিত এখতিয়ারের কোন কথা বলা হয়নি। হাদীছটি দ্বারা যা বুঝানো উদ্দেশ্য এবং হাদীছটি যা নির্দেশ করে তারা তার বিরোধিতা করে। আর তারা হাদীছটি দ্বারা যা প্রমাণ করতে চাচ্ছে তা তাকে নির্দেশ করে না। 

এ মাসআলায় তারা হিববান বিন মুনকিয (রাঃ)-এর হাদীছ দ্বারাও দলীল দিয়েছেন, যিনি কিনা কেনা-বেচায় প্রতারণার শিকার হ’তেন। ফলে নবী (ছাঃ) তাঁর জন্য তিন দিনের এখতিয়ার দিয়েছিলেন।[16]

কিন্তু তারা পুরোপুরিই হাদীছটির বিরোধিতা করেছেন। বেচা-কেনায় প্রতারণার দরুণ তারা কোন এখতিয়ারের স্বীকৃতি দেননি। চাই সে প্রতারণা তার খরচের এক দশমাংশের সমান হৌক কিংবা ক্রেতা বিক্রেতাকে কোন প্রতারণা নেই বলুক অথবা না বলুক। চাই সে কম প্রতারিত হৌক কিংবা বেশী, কোন অবস্থাতেই তার এখতিয়ার মিলবে না।

রামাযানে দিনে ছিয়াম ভেঙ্গে ফেললে তার উপর কাফফারা ওয়াজিব হওয়ার বিষয়ে তারা দলীল হিসাবে বলেছেন, ‘হাদীছের কিছু শব্দে এসেছে, জনৈক ব্যক্তি ছিয়াম ভেঙ্গে ফেলে। ফলে নবী (ছাঃ) তাকে কাফফারা দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন’।[17] তারপর তারা খোদ হাদীছের বিরোধিতা করে বলেছেন, ‘ছায়েম আটা ইস্তিফাফ করলে কিংবা ছানা আটা, আহলিলাজ অথবা ওষুধ গিলে ফেললে ছওম ভেঙ্গে যাবে, তবে তার উপর কাফফারা ফরয হবে না’।

তারা আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ দ্বারা[18] ইচ্ছা করে যে বমি করে তার উপর ছিয়াম ক্বাযা ফরয হওয়ার দলীল দিয়ে থাকেন। তারপর আবার হাদীছের বিরোধিতা করে তারা বলেন, ‘ভরামুখের কমে বমি করলে তার উপর ক্বাযা আবশ্যিক হবে না’।

যে দূরত্বে গেলে ছিয়াম না রাখা যাবে এবং ছালাত ক্বছর করা যাবে তার সীমারেখা সম্পর্কে দলীল দিতে গিয়ে তারা বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَا يَحِلُّ لِامْرَأَةٍ تُؤْمِنُ بِاَللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ أَنْ تُسَافِرَ مَسِيرَةَ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ إلَّا مَعَ زَوْجٍ أَوْ ذِي مَحْرَم ‘যে মহিলা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী তার জন্য তিন দিনের দূরত্বের পথে সফর করা জায়েয হবে না যদি না তার সাথে তার স্বামী অথবা বিবাহ হারাম এমন কোনো আত্মীয় না থাকে’।[19]

যদিও হাদীছটিতে তাদের দাবীর অনুকূলে কোন প্রমাণ নেই। আবার তারাই হাদীছটির বিরোধিতা করে বলেছেন, ‘দাসী, চুক্তিবদ্ধ দাসী ও উম্মুল ওয়ালাদের জন্য স্বামী অথবা বিবাহ হারাম এমন কোন আত্মীয় ছাড়াই সফর করা বৈধ’।

তারা হজ্জে মুহরিমের মুখমন্ডল ঢাকা নিষেধের উপর ইবনু আববাসের হাদীছ দ্বারা দলীল দিয়েছেন। তাতে আছে, একজন মুহরিম উটের পদাঘাতে মারা যায়। তখন নবী (ছাঃ) বললেন,لَا تُخَمِّرُوا رَأْسَهُ وَلَا وَجْهَهُ فَإِنَّهُ يُبْعَثُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مُلَبِّيًا- ‘তোমরা তার মাথা ও মুখমন্ডল ঢেকে দিও না, কেননা, ক্বিয়ামতের দিন সে তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় উঠবে’।[20]

অথচ বড়ই আশ্চর্য যে, তারা বলেছেন, ‘মুহরিম মারা গেলে তার মাথা ও মুখমন্ডল ঢাকা জায়েয এবং মৃত্যুর সাথেই তার ইহরাম বাতিল হয়ে যায়’।

ইহরাম অবস্থায় কেউ বিজি শিকার করলে সেজন্য তার উপর বদলা ফরয হবে বলে তারা জাবির (রাঃ)-এর হাদীছ দ্বারা দলীল দিয়েছেন। তিনি ঐ বিজি খাওয়া জায়েয হওয়ার ও উহার হত্যাকারীর উপর বদলা আবশ্যিক হওয়ার ফৎওয়া দিয়েছিলেন এবং কথাটি নবী (ছাঃ)-এর বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।[21] কিন্তু তারাই আবার হাদীছের বিরোধিতা করে বলছেন, ‘বিজি খাওয়া হালাল নয়’।

তারা বলেন, ‘যে যাকাতদাতার উপর বিনতে মাখায আবশ্যিক হয়েছে সে যদি একটি বিনতে লাবূনের দুই তৃতীয়াংশ দেয়, যা একটি বিনতে মাখাযের সমতুল্য অথবা তার সমতুল্য একটি গাধা দেয় তাতেই যাকাত আদায় হয়ে যাবে। প্রমাণ আনাস (রাঃ) বর্ণিত ছহীহ হাদীছ, তাতে আছে, مَنْ وَجَبَتْ عَلَيْهِ ابْنَةُ مَخَاضٍ وَلَيْسَتْ عِنْدَهُ، وَعِنْدَهُ ابْنَةُ لَبُونٍ؛ فَإِنَّهَا تُؤْخَذُ مِنْهُ، وَيَرُدُّ عَلَيْهِ السَّاعِي شَاتَيْنِ أَوْ عِشْرِينَ دِرْهَمًا- ‘যার উপর বিনতে মাখায আবশ্যিক হয়েছে অথচ তার নিকট তা নেই, বরং একটি বিনতে লাবূন আছে সেক্ষেত্রে সেটাই তার থেকে নিতে হবে এবং যাকাত সংগ্রহকারী তাকে দু’টো ছাগল অথবা বিশ দিরহাম ফেরত দিবে’।[22]

এটাও বড় আশ্চর্যজনক ব্যাপার যে, হাদীছ যেভাবে বিষয়টি নির্ধারণ করেছে তারা কিন্তু সেভাবে বলেনি; আর তারা হাদীছটি দ্বারা যা প্রমাণ করতে চেয়েছেন হাদীছটি কিন্তু বিন্দুমাত্রও তা প্রমাণ করে না, তার মর্মও তা নয়।

তারা বলেন, ‘কোন মুসলিম যদি দারুল হারবে হদ বা দন্ড আরোপযোগ্য কোন অপরাধ করে তাহ’লে (দারুল ইসলামে) তার উপর দন্ড বলবৎ হবে না’। প্রমাণ নিম্নের হাদীছ, لَا تُقْطَعُ الْأَيْدِيْ فِي الْغَزْوِ ‘যুদ্ধে হাত কাটা যাবে না’। আরেক বর্ণনায় যুদ্ধের স্থলে হাত শব্দ এসেছে।[23]

কিন্তু হাদীছটির মূলকথার ধারে কাছেও তারা যাননি। কেননা এক্ষেত্রে তাদের নিকট না যুদ্ধের কোন ভূমিকা আছে, না সফরের।[24]

তারা একটি হাদীছের ভিত্তিতে কুরবানী ওয়াজিব বলেছেন। তাতে আছে, أَمَرَ بِالْأُضْحِيَّةِ، وَأَنْ يُطْعَمَ مِنْهَا الْجَارُ وَالسَّائِلُ ‘নবী করীম (ছাঃ) কুরবানী করতে এবং তার থেকে প্রতিবেশী ও প্রার্থীদের খাওয়াতে আদেশ দিয়েছেন’।[25] হাদীছে থাকলেও তারা বলেছেন, ‘তার থেকে প্রতিবেশী ও প্রার্থীদের খাওয়ানো ওয়াজিব নয়’।

যদি ছিনতাইকারী কিংবা চোর কোন পশু ছিনতাই কিংবা চুরি করে যবাই করে তবে তা খাওয়া মুবাহ বলে তারা রায় দিয়েছেন একটি হাদীছের ভিত্তিতে। তাতে আছে,

 دُعِيَ إلَى الطَّعَامِ مَعَ رَهْطٍ مِنْ أَصْحَابِهِ، فَلَمَّا أَخَذَ لُقْمَةً قَالَ: إنِّي أَجِدُ لَحْمَ شَاةٍ أُخِذَتْ بِغَيْرِ حَقٍّ فَقَالَتْ الْمَرْأَةُ: يَا رَسُولَ اللهِ، إنِّي أَخَذْتُهَا مِنْ امْرَأَةِ فُلَانٍ بِغَيْرِ عِلْمِ زَوْجِهَا، فَأَمَرَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ تُطْعَمَ الْأَسَارَى-

‘নবী (ছাঃ)-কে তাঁর একদল ছাহাবীসহ খাবারের দাওয়াত দেওয়া হয়। যখন তিনি এক লোকমা মুখে দিতে গেছেন অমনি বলে ওঠেন, আমি নিশ্চয়ই অবৈধ ছাগলের গোশতের গন্ধ পাচ্ছি। তখন বাড়ির মহিলা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি ছাগলটা অমুকের স্ত্রীর থেকে তার স্বামীর অজ্ঞাতে নিয়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন ঐ গোশত (অমুসলিম) কয়েদীদের খাওয়ানোর হুকুম দিলেন’।[26]

হাদীছটিতে অন্যায়ভাবে সংগৃহীত পশুর গোশত মুসলমানদের জন্য হারাম বলা হ’লেও তারা বলছেন, ‘ছিনতাইকারীর ছিনতাইয়ের মাধ্যমে যবাই করা পশু হালাল, মুসলমানদের জন্য তা হারাম নয়’।

তারা রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী- جَرْحُ الْعَجْمَاءِ جُبَارٌ ‘চতুষ্পদ প্রাণী দ্বারা সংঘটিত ক্ষতি দন্ডমুক্ত’[27] দ্বারা গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণী কর্তৃক সংঘটিত ক্ষতি দন্ডমুক্ত বলে প্রমাণ দিয়েছেন।[28] তারপর তারাই আবার হাদীছটির উদ্দেশ্য ও মর্মার্থের বিরোধিতা করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন প্রাণীর পিঠে চড়ল, কিংবা সামনে থেকে টেনে নিয়ে গেল, কিংবা পিছন থেকে খেদিয়ে নিয়ে গেল, আর এমতাবস্থায় প্রাণীটি কাউকে

তার মুখ দিয়ে কামড়ে দিল তাহ’লে ঐ ব্যক্তি তার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে। তবে যদি প্রাণীটি পা দিয়ে কোন ক্ষতি করে তাহ’লে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না’।

তারা আহত ব্যক্তির সুস্থতা লাভ পর্যন্ত ক্বিছাছ বিলম্বিত করতে একটি মশহূর হাদীছ দিয়ে দলীল দিয়েছেন,أَنَّ رَجُلًا طَعَنَ آخَرَ فِي رُكْبَتِهِ بِقَرْنٍ، فَطَلَبَ الْقَوَدَ، فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى يَبْرَأَ، فَأَبَى، فَأَقَادَهُ قَبْلَ أَنْ يَبْرَأَ ‘জনৈক ব্যক্তির হাঁটুতে অন্য একজন শিং দিয়ে আঘাত করে; ফলে লোকটি ক্বিছাছ দাবী করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন বললেন, ‘সে সুস্থ হৌক, তারপর হবে। কিন্তু সে মানে না। ফলে তিনি তার সুস্থতার আগেই ক্বিছাছ কার্যকর করেন’।[29] (চলবে)

কিন্তু তারা বল্লমের আঘাতে আহতের ক্বিছাছে হাদীছটির বিরোধিতা করে বলেছে, বল্লমের আঘাতে ক্বিছাছ প্রযোজ্য নয়।


[1]. আবূদাঊদ তায়ালিসী হা/১২৫২, আহমাদ ৫/৬৬, আবূদাঊদ হা/৮২।

[2]. তাহযীবুস সুনান, পৃ ৮০-৮২; বাদায়েউল ফাওয়ায়েদ ৫৭১৪।

[3]. বুখারী হা/২৩৮; মুসলিম হা/২৮২।

[4]. বুখারী হা/১৬২; মুসলিম হা/২৭৮।

[5]. তাহকীক দারাকুৎনী হা/৪৭৭, হাদীছটি শক্তিশালী নয়।

[6]. নাছবুর রায়াহ ২/৩, ৪। এ অর্থে ছহীহ মুসলিমে হাদীছ রয়েছে হা/১০৭২।

[7]. মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/১২; আহমাদ হা/৮৭৩৫; তিরমিযী হা/৬৯; আবূদাঊদ হা/৮৩।

[8]. বুখারী হা/১৭২; মুসলিম হা/২৮০।

[9]. বাদায়েউল ফাওয়ায়েদ ৪/৫২; আল-খিলাফিয়াত ৩/২৫। 

[10]. তৎকালীন পারস্য দেশীয় রূপার মুদ্রা। এটি আমাদের দেশীয় ১/২ টাকার কয়েনের মত গোলাকৃতির ছিল। 

[11]. বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর ৩/৩০৮, ৩০৯ ; আত-তারীখুছ ছগীর ১/৩০২; উক্বায়লী, আয-যু‘আফা ২/৫৭; ইবনু আদী, আল-কামিল ৩/৯৯৮। ইমাম বুখারী বলেছেন, ‘এটি একটি বাতিল হাদীছ। আর রাওহ তথা গুতাইফ একজন মুনকারুল হাদীছ’। ইবনু হিববান বলেছেন, ‘এটি নিঃসন্দেহে একটি মাওযূ‘ বা জাল হাদীছ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ কথা বলেননি, বরং কূফাবাসীরা এটি বানিয়েছেন। আর রাওহ ইবনু গুতাইফ নির্ভরযোগ্য লোকদের নামে মাওযূ‘ বা মিথ্যা হাদীছ বর্ণনা করতেন’। 

[12]. ইগাছাতুল লাহফান ১/৬৩, ১৪৪-১৪৭, ১৫০-১৫৯। হানাফীদের আলোচনার জন্য দেখুন : মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, আল-আছল ১/৬৮; আল-মাবসূত ১/৮৬; বাদায়ে‘উছ ছানায়ে‘ ১/১৮; ফাৎহুল ক্বাদীর ১/২০২, ২০৮; আল-বাহরুর রায়েক্ব ১/২৯৩; হাশিয়াহ ইবনে আবেদীন ১/২১৩। 

[13]. ইবনু আবী শায়বা হা/১৯৮৪; আবু উবায়েদ, আল-আমওয়াল হা/৯৪৫; বায়হাক্বী কুবরা হা/৭২৬২।  

[14]. ইবনু হিববান হা/৬৫৫৯। হাদীছটি ‘মুরসাল’ না ‘মুসনাদ’ তা নিয়ে দ্বিমত আছে। আবূদাঊদ ও নাসাঈ ‘ইরসাল’ জোরদারের পক্ষে; হাকেম ‘ইসনাদ’ জোরদারের পক্ষে।-অনুবাদক। 

[15]. ‘মুছাররাত’ এমন পশুকে বলে, যার বাচ্চাকে দীর্ঘ সময় বেঁধে রেখে স্তনে দুধ জমানো হয়; যাতে ক্রেতা তাকে বেশী দুধদাতা হিসাবে কিনে নেয়। পরে দেখা যায়, পশুটি অত দুধ দেয় না। ইমাম বুখারী (রহঃ) তাঁর ছহীহ গ্রন্থের বেচা-কেনা অধ্যায়ের ‘উট, গরু, ছাগলের স্তনে জমিয়ে বেশী দুধদাতা হিসাবে দেখিয়ে বেচা নিষেধ’ অনুচ্ছেদে হাদীছটি উল্লেখ করেছেন। ইমাম মুসলিম (রহঃ) তাঁর ছহীহ গ্রন্থের ‘বেচা-কেনা’ অধ্যায়ের ‘পশুর স্তনে দুধ জমিয়ে রেখে বেচার বিধান’ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছেন হা/১৫২৪-এর উপরে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা উট ও ছাগলের স্তনে দুধ জমিয়ে বিক্রি কর না। তারপরও যদি কেউ এমন পশু কিনে ফেলে তবে সে পশুটির দুধ দোহনের পর দু’টি দিকের যেটি ভাল মনে করবে গ্রহণ করবে। সন্তুষ্ট হ’লে রেখে দিবে; অসন্তুষ্ট হ’লে তা ফেরৎ দিবে, সাথে এক ছা‘ খেজুর দিবে’। মুসলিমের আরেক বর্ণনায় আছে, ‘যে স্তনে দুধ জমানো পশু কিনবে সে তিন দিন পর্যন্ত এখতিয়ার পাবে। যদি সে তা ফেরৎ দেয় তবে সাথে এক ছা‘ খেজুর দেবে, গম নয়’। 

[16]. শাফেঈ হা/১২৫৫; বায়হাক্বী, আল-মারিফাত হা/৩৩২৬; ইবনুল জারুদ আল-মুনতাকা হা/৫৭৬।   

[17]. বুখারী হা/১৯৩৭; মুসলিম হা/১১১১ ‘ছিয়াম’ অধ্যায়।   

[18]. আহমাদ হা/১০৪৬৮; দারেমী হা/১৭৭০; আবুদাঊদ হা/২৩৮০; তিরমিযী হা/৭২০, সনদ ছহীহ।

[19]. বুখারী হা/১০৮৬-১০৮৭; মুসলিম হা/১৩৩৮ ‘হজ্জ’ অধ্যায়।    

[20]. ছহীহ মুসলিম হা/১২০৬।

[21]. ইবনু খুযায়মাহ হা/২৬৪৮; ইরওয়াউল গালীল হা/১০৫০, সনদ ছহীহ।

[22]. বুখারী হা/১৪৪৮।

[23]. আবূদাঊদ হা/৪৪০৮; তিরমিযী হা/১৪৫০।     

[24]. অর্থাৎ দন্ডের ঘটনা যুদ্ধ কিংবা সফরকালে ঘটার কথা হাদীছে থাকলেও তারা তা বলেননি।-অনুবাদক    

[25]. আদ-দুর্রুল মানছূর ৪/৩৬২, ইবনু আবী শায়বার বরাতে ছাহাবী মু‘আয (রাঃ) থেকে।   

[26]. আবূদাঊদ হা/৩৩৩২; আহমাদ হা/২২৫০৯। বিস্তারিত টীকা নং ৩, পৃ. ৫০০।    

[27]. বুখারী হা/১৪৯৯, ২৩৫৫; মুসলিম হা/১৭১০।    

[28]. অর্থাৎ পশুটিও শাস্তি পাবে না, মালিকও ক্ষতিপূরণ দেবে না।-অনুবাদক।

[29]. আহমাদ ২/২১৬?, মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাকের সনদে আমর বিন শু‘আইব কর্তৃক তার পিতার মাধ্যমে তার দাদা থেকে বর্ণিত। হায়ছামী বলেছেন, সনদের বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য ৬/২৯৫-৯৬। আমি (মাশহূর হাসান) বলছি, ‘বাহ্যত সনদটি বিচ্ছিন্ন। কারণ মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক একজন মুদাল্লিস এবং সে আনআনা বর্ণনাকারী’। বিস্তারিত দেখুন : টীকা নং ৩, পৃ. ৫০১।





আল-কুরআনের আলোকে জাহান্নামের বিবরণ (২য় কিস্তি) - বযলুর রশীদ
ছাওম ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞান - শামসুল আলম
মুহাম্মাদ (ছাঃ)-ই সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল (পূর্বে প্রকাশিতের পর) - আব্দুল্লাহ বিন আবদুর রাযযাক
কুরআন ও হাদীছের আলোকে ‘সোনামণি’র ৫টি নীতিবাক্য - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের বিধান (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ইসলামে ভ্রাতৃত্ব (২য় কিস্তি) - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
কাদেসিয়া যুদ্ধ - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব ও ফযীলত - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ইখলাছ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
নারী-পুরুষের ছালাতের পার্থক্য : বিভ্রান্তি নিরসন - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
আল-কুরআনে বিজ্ঞানের নিদর্শন (২য় কিস্তি) - ইঞ্জিনিয়ার আসীফুল ইসলাম চৌধুরী
ফৎওয়া : গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও বিকাশ - ড. শিহাবুদ্দীন আহমাদ, শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, রাজশাহী
আরও
আরও
.