পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ ।
মৃত্যুর পর যেসব আমলের ফল স্থায়ী থাকবে
মৃত্যুর পর ব্যক্তির জীবনের এমন অনেক আমল বাকী থেকে যায়, যার ফল মৃত্যুর পরও সে পায়। এমন কিছু আমল এখানে তুলে ধরা হ’ল।-
১. ঈমান ও সৎকর্ম :
বান্দার মৃত্যুর পর তার ঈমান ও সৎকর্মের প্রভাব বাকী থেকে যায়। মৃত্যুর পরও সে তার ফল পেতে থাকে। এখানে দু’টি ফল উল্লেখ করা হ’ল।
ক. ফেরেশতা ও মুমিনদের দো‘আ লাভ :
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যারা আরশ বহন করে এবং যারা তার চারপাশে আছে, তারা তাদের পালনকর্তার প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা করে ও তাঁর প্রতি ঈমান রাখে। আর তারা মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার অনুগ্রহ ও জ্ঞান সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত। অতএব যারা তওবা করে ও তোমার রাস্তায় চলে তাদেরকে তুমি ক্ষমা করো এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে তাদের রক্ষা কর! হে আমাদের প্রতিপালক! আর তুমি তাদের প্রবেশ করাও চিরস্থায়ী বসবাসের জান্নাতসমূহে, যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাদের দান করেছ। আর তাদের বাপ-দাদা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তাদেরকেও। নিশ্চয়ই তুমিই তো মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়। আর তুমি তাদেরকে সকল মন্দ কাজ হ’তে রক্ষা কর। আর যাকে তুমি মন্দ কাজ সমূহ থেকে রক্ষা করবে তাকেই তো তুমি ক্বিয়ামতের দিন অনুগ্রহ করবে (জান্নাতে প্রবেশ করানোর মাধ্যমে)। আর সেটাই তো মহা সফলতা’ (মুমিন ৪০/৭-৯)।
তিনি আরো বলেছেন, ‘আর (এই সম্পদ তাদের জন্য) যারা তাদের পরে এসেছে। যারা বলে হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের এবং আমাদের ভাইদের ক্ষমা কর, যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে। আর ঈমানদারগণের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয়ই তুমি স্নেহশীল ও পরম দয়ালু’ (হাশর ৫৯/১০)।
মুসলিমরা তো প্রত্যেক ছালাতে,السَّلاَمُ عَلَيْنَا وَعَلَى عِبَادِ اللهِ الصَّالِحِينَ، ‘আসসালা-মু ‘আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লা-হিছ ছালেহীন’[1] বলে আল্লাহ্র নিকট তার নেককার বান্দাদের শান্তি লাভ ও যাবতীয় অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকার জন্য দো‘আ করে।
খ. সন্তানদের সুরক্ষা লাভ :
এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা মূসা ও খিযির (আঃ)-এর কথোপকথনে বিনা পারিশ্রমিকে কেন খিযির (আঃ) প্রাচীর সোজা করে দিয়েছিলেন তার কারণ ব্যাখ্যায় বলেছেন,وَأَمَّا الْجِدَارُ فَكَانَ لِغُلَامَيْنِ يَتِيمَيْنِ فِي الْمَدِينَةِ وَكَانَ تَحْتَهُ كَنْزٌ لَّهُمَا وَكَانَ أَبُوهُمَا صَالِحًا ‘অতঃপর ঐ প্রাচীরটি, যা ছিল শহরের দু’টি ইয়াতীম বালকের। ওটির নীচে ছিল ওদের জন্য কিছু গুপ্তধন। ওদের পিতা ছিলেন একজন সৎকর্মশীল ব্যক্তি’ (কাহাফ ১৮/৮২)। এই দুই বালকের সম্পদ আল্লাহ হেফাযত করলেন তাদের পিতার সৎকর্মের কারণে।
২. সুন্দর সুন্নাত বা কাজের প্রচলন করা :
জারীর বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোন সুন্দর সুন্নাত বা কাজ চালু করল এবং পরবর্তীতে সে অনুসারে আমল করা হ’ল তাহ’লে আমলকারীদের প্রতিদানের সমান প্রতিদান তার জন্য লেখা হবে। এতে আমলকারীদের প্রতিদান থেকে কিছু কমিয়ে দেওয়া হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোন মন্দ সুন্নাত বা কাজ চালু করল এবং পরবর্তীতে সে অনুসারে আমল করা হ’ল তাহ’লে আমলকারীদের গুনাহের সমান গুনাহ তার জন্য লেখা হবে। এতে আমলকারীদের গুনাহ থেকে কিছু কমিয়ে দেওয়া হবে না’।[2]
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى، كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ، لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا، وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ، كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الْإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ، لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا- ‘যে ব্যক্তি হেদায়াত তথা সঠিক পথের দিকে ডাকে তাতে তার অনুসরণকারীদের যে ছওয়াব মিলবে তারও সে পরিমাণ ছওয়াব মিলবে। অনুসরণকারীদের ছওয়াব তাতে কিছুই কমে যাবে না। আর যে ভুল পথের দিকে ডাকে তাতে তার অনুসরণকারীদের যে গুনাহ মিলবে তারও সে পরিমাণ গুনাহ মিলবে। অনুসরণকারীদের গুনাহ তাতে কিছুই কমে যাবে না’।[3]
ইমাম নববী (রহঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্তি مَنْ سَنَّ سُنَّةً حَسَنَةً ‘যে ব্যক্তি কোন সুন্দর সুন্নাত বা কাজ চালু করল’ ও مَنْ سَنَّ سُنَّةً سَيِّئَةً ‘যে ব্যক্তি কোন মন্দ সুন্নাত বা কাজ চালু করল’ এবং অন্য হাদীছে مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى (যে ব্যক্তি সঠিক পথের দিকে ডাকে), وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلَالَةٍ ‘যে ভুল পথের দিকে ডাকে’ হাদীছ দু’টিতে ভালো কাজের প্রচলন ঘটানো মুস্তাহাব এবং মন্দ কাজের প্রচলন ঘটানো হারাম হওয়ার উপর স্পষ্টত জোর দেওয়া হয়েছে।
একথাও বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি কোন ভালো কাজ চালু করবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ সেই কাজ করবে তাদের প্রাপ্ত ছওয়াবের সমান ছওয়াব সে পাবে। আর যে ব্যক্তি কোন মন্দ কাজ চালু করবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ সেই কাজ করবে তাদের অর্জিত গুনাহের সমান গুনাহ সেও পাবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি হেদায়াত তথা সঠিক পথের দিকে ডাকে তার সে ডাকে যারা সাড়া দেবে তাদের যে প্রতিদান মিলবে তারও সে পরিমাণ প্রতিদান মিলবে। সাড়াদানকারীদের প্রতিদান তাতে কিছুই কমে যাবে না। আর যে ভুল পথের দিকে ডাকে তাতে তার অনুসরণকারীদের যে গুনাহ মিলবে তারও সে পরিমাণ গুনাহ মিলবে। এসব ভালো কিংবা মন্দ কাজ চাই সে প্রথম চালু করুক অথবা আগে থেকে চালু থাকুক, চাই তা বিদ্যা শিক্ষাদান বিষয়ক হোক কিংবা ইবাদত বিষয়ক হোক অথবা আদব বা আচরণগত হোক কিংবা অনুরূপ কিছু হোক।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্তি فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ -এর অর্থ, যে লোক কোন ভালো কাজ চালু করে সে কাজ তার জীবদ্দশায় কেউ করুক কিংবা মৃত্যুর পর করুক তার ভালো ফল ঐ লোক অবিরাম পেতে থাকবে।[4]
মন্দ কাজ চালু করলেও অবস্থা একই হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لِيَحْمِلُوا أَوْزَارَهُمْ كَامِلَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمِنْ أَوْزَارِ الَّذِينَ يُضِلُّونَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ أَلَا سَاءَ مَا يَزِرُونَ ‘ফলে ক্বিয়ামতের দিন ওরা পূর্ণমাত্রায় বহন করবে ওদের পাপভার এবং যাদেরকে ওরা অজ্ঞতা বশে বিভ্রান্ত করেছে তাদের পাপভার। দেখ কতই না নিকৃষ্ট ভার, যা তারা বহন করবে’ (নাহল ১৬/২৫)।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, কোন জীবন অন্যায়ভাবে হত্যার শিকার হ’লে আদমের প্রথম সন্তানের উপর তার রক্তের একটা অংশ গিয়ে বর্তাবে। কারণ সেই প্রথম ব্যক্তি, যে হত্যাকান্ড চালু করেছিল’।[5]
৩. উপকারী বিদ্যা, ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ এবং মাতা-পিতার জন্য সৎ সন্তানের দো‘আ :
উপকারী বিদ্যা, ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ এবং মাতা-পিতার জন্য সৎ সন্তানের দো‘আ মৃত্যুর পরেও ব্যক্তির জন্য ছওয়াব বয়ে আনে। সুতরাং এ তিনটি কাজে তৎপর হওয়ার সাধ্য যাদের থাকবে তাদের এক্ষেত্রে অবহেলা করা সমীচীন হবে না।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ: إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ- ‘মানুষ যখন মারা যায় তখন তার থেকে তার সকল আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল বিচ্ছিন্ন হয় না। ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ বা চলমান দান, উপকার লাভ করা যায় এমন বিদ্যা এবং নেক সন্তান যে তার জন্য দো‘আ করে।[6]
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত হাদীছের মর্ম সম্পর্কে আলেমগণ বলেছেন, মৃত ব্যক্তির আমল করার ক্ষমতা তার মৃত্যুর সাথেই শেষ হয়ে যায়, একই সাথে তার আমলের প্রতিফলের নবায়নও থেমে যায়। কিন্তু উক্ত হাদীছে উল্লেখিত তার তিনটি আমলের প্রতিফল নিরবধি নবায়ন হ’তে থাকবে। কারণ আমলগুলোর উৎস তো ঐ ব্যক্তি থেকে ফুরিয়ে যাচ্ছে না। সন্তান তার উপার্জনের অংশ, যে বিদ্যা সে শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষাদান কিংবা লিখিত পুস্তক আকারে রেখে যায় তার উৎসও সে এবং ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ যা কি-না ওয়াকফ, তাও তার রেখে যাওয়া স্থায়ী দান। তার মৃত্যুর পরও যেহেতু এগুলো দুনিয়াতে চলমান থাকছে, তাই মৃত্যুর পরেও তার ছওয়াব চলতে থাকবে। এ হাদীছে নেক সন্তান লাভের নিয়তে বিবাহের ফযীলত ফুটে উঠেছে। বিবাহ বিষয়ে যৌন চাহিদা ও আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে তারতম্য রয়েছে। বিবাহ অধ্যায়ে আমরা ইতিপূর্বে তা বর্ণনা করেছি। ওয়াকফের ছহীহ-শুদ্ধতা এবং তার বিরাট ছওয়াবের কথাও হাদীছে বিবৃত হয়েছে। হাদীছটিতে বিদ্যার ফযীলত ও মাহাত্ম্যও বর্ণিত হয়েছে।
এখানে বেশী বেশী ইলম অর্জন করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। অন্যদের শিক্ষাদান, বই-পুস্তক রচনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ইত্যাদির মাধ্যমে নিজের বিদ্যার উত্তরাধিকার রেখে যাওয়ার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে উপকারী থেকে উপকারী বিদ্যা বেছে নেওয়া সমীচীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বিদ্যাজনিত ছওয়াব বেশী পরিমাণে অর্জিত হবে। হাদীছ থেকে একথাও বুঝা যায় যে, দো‘আ ও ছাদাক্বার ছওয়াব মৃত ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছে। বিষয় দু’টি সর্বসম্মত। মৃত ব্যক্তির পক্ষে ঋণ পরিশোধ করলে তা দ্বারা মৃত ঋণী ব্যক্তি ঋণমুক্ত হয়ে যায় বলেও হাদীছে নির্দেশনা মেলে।[7]
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বিদ্যার ফযীলত বিষয়ে তার এক আলোচনায় বলেছেন, ‘আমি একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থে বিদ্যা ও বিদ্বানদের মাহাত্ম্য সম্পর্কে দু’শত প্রমাণ তুলে ধরেছি। সেই মানুষটা কতই না মহৎ ও উজ্জ্বল গৌরবের অধিকারী এবং তার মর্যাদা কতই না উঁচুতে যে দুনিয়াতে বিদ্যা বিষয়ক কিছু কাজ করেছে, তারপর কবরে গিয়ে তার দেহ পচে-গলে নিঃশেষ হয়ে গেছে, তারপরও তার আমলনামায় নেকী দিন দিন বেড়ে চলেছে। প্রতিটি মুহূর্তে তার আমলনামা ছওয়াবে ভরে উঠছে, ভালো ভালো কাজের উপহারের ডালি তার নিকট কোত্থেকে যে অবিরত আসছে তা সে বুঝে উঠতে পারছে না। আল্লাহ্র কসম! এ হ’ল তার দান ও গণীমতের সম্পদ। প্রতিযোগিতাকারীরা যেন এসব লাভের জন্য প্রতিযোগিতা করে এবং ঈর্ষাপরায়ণরা যেন এজন্য ঈর্ষা করে। এটা তো আল্লাহ্র অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন, আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল। আসলে কোন মর্যাদার দাবী তো এই যে, তা লাভের জন্য দামী থেকে দামী জিনিস ব্যয় করতে হবে, তার জন্য যথাসাধ্য সময় দিতে হবে, তার পানে সকল চাওয়া-পাওয়া নিবদ্ধ করতে হবে ইত্যাদি।
মহান আল্লাহ যাঁর হাতে সকল কল্যাণের চাবি, তাঁর নিকট আমাদের সকাতর প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের জন্য তাঁর রহমতের ভান্ডারগুলো খুলে দেন, তাঁর দয়া ও অনুগ্রহে আমাদেরকে উক্ত গুণাবলীর অধিকারী করেন। এমন মর্যাদার যারা অধিকারী আকাশরাজ্যে তাদেরকে ‘মহাপুরুষ’ বা ‘উযামা’ নামে ডাকা হয়। যেমন জনৈক পূর্বসূরী বলেছেন, ‘যে বিদ্যা শিখে, আমল করে এবং শেখায় তাকে আকাশরাজ্যে ‘মহাপুরুষ’ বা ‘আযীম’ নামে ডাকা হয়’।[8]
আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক নবী করীম (ছাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, إِنَّ الرَّجُلَ لَتُرْفَعُ دَرَجَتُهُ فِي الْجَنَّةِ فَيَقُولُ: أَنَّى هَذَا؟ فَيُقَالُ: بِاسْتِغْفَارِ وَلَدِكَ لَكَ- ‘নিশ্চয়ই জান্নাতে ব্যক্তি বিশেষের পদমর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে। তা দেখে সে বলবে, এটা কিভাবে হ’ল? বলা হবে, তোমার জন্য তোমার ছেলে-মেয়ের ক্ষমা প্রার্থনার বদৌলতে’।[9]
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ঈমানদার ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার যেসব আমল ও যেসব ছওয়াব তার সাথে যুক্ত হয় তন্মধ্যে রয়েছে ঐ বিদ্যা যা সে অন্যদের শিখিয়েছে এবং তার প্রচার-প্রসার ঘটিয়েছে, নেক সন্তান যাকে সে ছেড়ে গিয়েছে, কুরআন মাজীদ যা সে উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে গেছে অথবা যে মসজিদ সে তৈরী করে গেছে অথবা পথিকদের থাকার জন্য যে সরাইখানা (হোটেল) সে বানিয়ে রেখে গেছে অথবা পানির কোন নহর বা খাল চালু করে গেছে অথবা তার জীবদ্দশায় সুস্থ অবস্থায় তার ধন-সম্পদ থেকে যে দান সে করে গেছে তার মৃত্যুর পরও তা তার সাথে যুক্ত হ’তে থাকবে’।[10]
হাদীছটির কিছু শব্দের ব্যাখ্যা :
(وَنَشَرَهُ)শব্দটি তা‘লীম বা শিক্ষাদান অপেক্ষা বিস্তৃত অর্থ বহন করে। ‘নাশর’ এর বাংলা অর্থ প্রচার ও প্রসার ঘটানো। এ শব্দের মধ্যে গ্রন্থ প্রণয়ন, সংকলন, বই ওয়াকফ করা, মাকতাবাহ বা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি শামিল রয়েছে।
আল্লামা সিন্ধী (রহঃ) বলেছেন, (وَوَلَدًا) সন্তানকে সৎ হিসাবে গড়ে তোলা এবং তার তা‘লীম-তারবিয়াতের ব্যবস্থা করা সুন্দর আমল হিসাবে গণ্য। কেননা সন্তানের অস্তিত্ব লাভের মাধ্যম তো মাতা-পিতা। মাতাপিতাই তো সন্তানকে সঠিক পথের দিশা দিয়ে সৎপথে চলার যোগ্য করে তোলেন। ফলে সন্তান মাতা-পিতার আমলভুক্ত। যেমন খোদ সন্তানকে কুরআনে আমল বলা হয়েছে। إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ ‘সে এমন আমল যা সঠিক নয়’ (হূদ ১১/৪৬)।
(وَمُصْحَفًا وَرَّثَهُ) ওয়াররাছাহু ‘তাওরীছ’ শব্দ থেকে নিষ্পন্ন। এ কথার অর্থ, সে ওয়ারিছী সূত্রে কুরআন রেখে গেছে। এটি এবং এর পরের বিষয়গুলো ছাদাক্বায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত, চাই তা প্রকৃত অর্থে হোক অথবা অপকৃত অর্থে হোক। এ হাদীছটা যেন অপর হাদীছ (انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ)-এর ব্যাখ্যা।
(وَرَّثَهُ) অর্থাৎ সে কুরআন রেখে গেছে তার ওয়ারিছদের জন্য- যদিও তা মালিকানা স্বরূপ হোক না কেন। শারঈ বিদ্যা সংক্রান্ত বই-পুস্তকও এ শ্রেণীভুক্ত। এই বইগুলোর উপলক্ষ হওয়ার কারণে বইয়ের মালিক ছওয়াবের ভাগিদার হবে।
(أَوْ مَسْجِدًا بَنَاهُ) অর্থাৎ যে মসজিদ সে তৈরী করে গেছে। এই একই অর্থে পড়ে আলেম ও সৎলোকদের মাদ্রাসা বা কর্মস্থল।
(أَوْ بَيْتًا لِابْنِ السَّبِيلِ) তথা পথিকদের থাকার জন্য ঘর। এখানে ইবনুস সাবীল অর্থ মুসাফির ও ভিনদেশী।
(أَوْ نَهْرًا أَجْرَاهُ) নহর বা খাল চালু করে গেছে। অর্থাৎ নহর বা খাল খনন করে কিংবা শুকিয়ে যাওয়া খাল সংস্কার করে তাতে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করেছে। যার ফলে প্রাণীকুল উপকৃত হ’তে পারছে।
(فِي صِحَّتِهِ وَحَيَاتِهِ) তার জীবদ্দশায় সুস্থ অবস্থায়। কথাটির অর্থ, যখন সে পূর্ণ বয়সে উপনীত, যখন সম্পদের বেশীমাত্রায় সে মুখাপেক্ষী এবং সম্পদকে কাজে লাগিয়ে উপকৃত হ’তে যখন সে খুব বেশী সক্ষম তখন সে দান-ছাদাক্বা করছে। হাদীছে এ সময়ে দান করতে উৎসাহিত করা হয়েছে, যাতে তা উত্তম দান হ’তে পারে। জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ছওয়াবের দিক দিয়ে কোন দান উত্তম? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, أَنْ تَصَدَّقَ وَأَنْتَ صَحِيحٌ شَحِيحٌ تَخْشَى الْفَقْرَ وَتَأْمُلُ الْغِنَى ‘সুস্থ ও সম্পদের প্রতি আগ্রহী অবস্থায় তুমি যে দান করবে তাই উত্তম’।[11] নতুবা কোন দানের ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ হওয়া দাতার সুস্থ-সবল অবস্থার উপর নির্ভর করে না।[12]
আবু উমামা আল-বাহেলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَرْبَعَةٌ تَجْرِى عَلَيْهِمْ أُجُورُهُمْ بَعْدَ الْمَوْتِ مُرَابِطٌ فِى سَبِيلِ اللهِ وَمَنْ عَمِلَ عَمَلاً أُجْرِىَ لَهُ مِثْلُ مَا عَمِلَ وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَجْرُهَا لَهُ مَا جَرَتْ وَرَجُلٌ تَرَكَ وَلَداً صَالِحاً فَهُوَ يَدْعُو لَهُ- ‘চার ব্যক্তি এমন যাদের মৃত্যুর পরও তাদের আমলের ছওয়াব জারী থাকে। এক. আল্লাহ্র পথে যুদ্ধে সেনাঘাঁটি পাহারারত অবস্থায় যে মারা গেছে। দুই. যে ইলম বা বিদ্যা শিক্ষা দেয়, তার শেখানো ইলম অনুযায়ী যত আমল হবে তার ছওয়াব তার জন্য জারী থাকবে। তিন. যে কোন কিছু দান করে, যতকাল সে দান চালু থাকবে ততকাল তার ছওয়াব সে পেতে থাকবে। চার. যে এমন সৎ সন্তান রেখে যায়, যে তার জন্য দো‘আ করে’।[13](ক্রমশঃ)
মূল (আরবী) : মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
[1]. বুখারী হা/৮৩৫; মুসলিম হা/৪০২; মিশকাত হা/৯০৯।
[2]. মুসলিম হা/১০১৭।
[3]. মুসলিম হা/২৬৭৪; মিশকাত হা/১৫৮।
[4]. নববী, শরহ মুসলিম ১৬/২২৬।
[5]. বুখারী হা/৩৩৩৫; মুসলিম হা/১৬৭৭; মিশকাত হা/২১১।
[6]. মুসলিম হা/১৬৩১; মিশকাত হা/২০৩।
[7]. নববী, শরহ মুসলিম ১১/৮৫।
[8]. তরীকুল হিজরাতাইন, পৃ. ৫২১।
[9]. ইবনু মাজাহ হা/৩৬৬০; ছহীহুল জামে‘ হা/১৬১৭।
[10]. ইবনু মাজাহ হা/২৪২; ছহীহুত তারগীব হা/৭৭; মিশকাত হা/২৫৪।
[11]. বুখারী হা/১৪১৯; মুসলিম হা/১০৩২।
[12]. মিরক্বাতুল মাফাতীহ ১/৪৪২।
[13]. আহমাদ হা/২২৩০১; ছহীহুত তারগীব হা/১১৪।