গোপন ইবাদতে অভ্যস্ত হওয়ার উপায়

ভূমিকা :

গোপন ইবাদত খাঁটি ঈমানের পরিচায়ক। যিনি গোপন আমলে অভ্যস্ত, তিনি আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে অন্যদের তুলনায় অধিক হেফাযতে থাকেন। তাছাড়া রিয়া থেকে মুক্ত থাকার একটি বড় মাধ্যম হ’ল গোপন আমল। এজন্য সালাফগণ সর্বদা নিজের সৎ আমল সবার কাছ থেকে আড়াল করার চেষ্টা করতেন। জুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রাঃ) বলেন, مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمْ أَنْ تَكُونَ لَهُ خَبِيئَةٌ مِنْ عَمَلٍ صَالِحٍ، فَلْيَفْعَلْ، ‘তোমাদের কেউ যদি কোন গোপন নেক আমল করতে সক্ষম হয়, তবে সে যেন তা করে’।[1] আবূ হাযেম (রহঃ) বলেন, اُكْتُمْ حَسَنَاتِكَ أَشَدَّ مِمَّا تَكْتُمُ سَيِّئَاتِكَ، ‘তুমি যত সতর্কতার সাতে তোমার খারাপ কাজগুলো ঢেকে রাখার চেষ্টা কর, তার চেয়েও অধিক সচেতন হয়ে তোমার নেক আমলগুলোকে গোপন করে রাখ’।[2] তবে ইসলামের নিদর্শনমূলক প্রকাশ্য ইবাদতগুলো প্রকাশ্যেই আদায় করা শরী‘আতের নির্দেশ। কিন্তু নফল ইবাদতগুলো গোপন করা মুস্তাহাব, যা বান্দার খুলূছিয়াতের প্রমাণ বহন করে। নিমেণ গোপন ইবাদতে অভ্যস্ত হওয়ার উপায় সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।-

১. অন্তরের ইবাদতে অধিক মনোনিবেশ করা :

ধরণগত দিক থেকে ইবাদত মূলতঃ তিন প্রকার। অন্তরের ইবাদত, জিহবার ইবাদত এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ইবাদত। এগুলোর মাধ্যে অন্তরের ইবাদতের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী। কেননা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও মৌখিক ইবাদতগুলো সর্বদা অন্তরের ইবাদতের অনুগামী হয়ে থাকে। অন্তরের ইবাদত হ’ল, মনের গভীর থেকে তাওহীদের স্বীকৃতি দেওয়া, অন্তরজগতে ঈমানী ভাবগাম্ভীর্য ও তাক্বওয়া বজায় রাখা, আল্লাহ ও তঁার রাসূলের প্রতি মহাববত পোষণ করা, ইখলাছ অর্জন করা, নেক আমলের নিয়ত করা, আল্লাহর নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করা, আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টিরাজি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা, কুরআন অনুধাবন করা, অল্পেতুষ্ট থাকা, তাক্বদীরের ফায়ছালার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করা, সকল কাজে আল্লাহর উপর ভরসা করা, নেকীর কাজে আগ্রহী হওয়া, আল্লাহর রহমতের আশা করা, পাপকে ঘৃণা করা ইত্যাদি। হাযার লোকের ভিড়েও সবার অজান্তে এই আমলগুলো করা যায়। তবে বান্দা যখন গোপন আমলের প্রতি যত্নশীল হন, আল্লাহ তার বাহ্যিক আমলগুলোকে সুন্দর করে দেন। ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহঃ) খুৎবার মিম্বারে দঁাড়িয়ে বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَصْلِحُوا آخِرَتَكُمْ يُصْلِحِ اللهُ لَكُمْ دُنْيَاكُمْ، وَأَصْلِحُوا سَرَائِرَكُمْ يُصْلِحِ اللهُ لَكُمْ عَلَانِيَتَكُمْ، ‘হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের আখেরাতকে সংশোধন কর, তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের দুনিয়াবী জীবনকে সংশোধন করে দিবেন। তোমাদের গোপন বিষয়গুলোকে শুধরে নাও, তাহ’লে তোমাদের প্রকাশ্য বিষয়গুলোকে আল্লাহ পরিপাটি করে দিবেন’।[3]

তাছাড়া সকল ইবাদতের উৎস হ’ল তাক্বওয়া। তাক্বওয়ার ঝর্ণা থেকে অন্য সব ইবাদত উৎসারিত হয়। আর এই তাক্বওয়া বা আল্লাহভীরুতা হ’ল অন্তরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন,أَشَدُّ الأَعْمَالِ ثَلاثَةٌ: الْجُودُ مِنْ قِلَّةٍ، وَالْوَرَعُ فِي خَلْوَةٍ وَكَلِمَةُ حَقٍّ عِنْدَ مَنْ يُرْجَى وَيُخَافُ، ‘সবচেয়ে কঠিন কাজ তিনটি- (১) কম (সম্পদ) থাকা সত্ত্বেও দান-ছাদাক্বাহ করা, (২) নির্জনে আল্লাহকে ভয় করা এবং (৩) যার কাছে কিছু প্রত্যাশা করা হয় ও যাকে দেখলে ভীতি সঞ্চার হয়, তার সামনে হক্ব কথা বলা’।[4]

২. সৎ আমলের নিয়ত করা :

সকল ইবাদত নিয়তের উপরে নির্ভরশীল। এই নিয়ত একটি গোপনীয় বিষয়। মহান আল্লাহ তঁার বান্দাকে নিয়তের উপর ভিত্তি করেই নেকী প্রদান করে থাকেন। আল্লাহ কখনো কখনো বান্দার মনের সুপ্ত বাসনার কারণে আমল না করা সত্ত্বেও সেই আমলের পূর্ণ নেকী প্রদান করে থাকেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ سَأَلَ اللهَ الشَّهَادَةَ بِصِدْقٍ، بَلَّغَهُ اللهُ مَنَازِلَ الشُّهَدَاءِ، وَإِنْ مَاتَ عَلَى فِرَاشِهِ، ‘যে ব্যক্তি সত্য নিয়তে আল্লাহর কাছে শাহাদত প্রার্থনা করবে, আল্লাহ তাকে শহীদদের মর্যাদায় পৌঁছিয়ে দিবেন, যদিও সে নিজ বিছানায় মৃত্যুবরণ করে’।[5] অর্থাৎ স্রেফ সৎ নিয়তের কারণে জিহাদ না করেও বান্দা শহীদের মর্যাদা লাভ করতে পারে। তাইতো আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, ‌نِيَّة ‌الْمُؤمن ‌خير ‌من ‌عمله ‌وَإِن ‌الله عز وَجل ليعطي العَبْد على نِيَّته مَا لَا يُعْطِيهِ على عمله وَذَلِكَ إِن النِّيَّة لَا رِيَاء فِيهَا وَالْعَمَل يخالطه الرِّيَاء، ‘মুমিনের আমলের তুলনায় তার নিয়ত উত্তম। মহান আল্লাহ বান্দাকে তার নিয়তের কারণে যত দান করেন, আমলের কারণে ততটুকু প্রদান করেন না। এর কারণ হচ্ছে, (খালেছ) নিয়তের মাঝে রিয়া থাকে না; কিন্তু আমলের সাথে রিয়া মিশ্রিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে’।[6]

হাদীছে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ আমল লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে বলেন,إِذَا أَرَادَ عَبْدِي أَنْ يَعْمَلَ سَيِّئَةً، فَلاَ تَكْتُبُوهَا عَلَيْهِ حَتَّى يَعْمَلَهَا، فَإِنْ عَمِلَهَا فَاكْتُبُوهَا بِمِثْلِهَا، وَإِنْ تَرَكَهَا مِنْ أَجْلِي فَاكْتُبُوهَا لَهُ حَسَنَةً، وَإِذَا أَرَادَ أَنْ يَعْمَلَ حَسَنَةً فَلَمْ يَعْمَلْهَا فَاكْتُبُوهَا لَهُ حَسَنَةً، فَإِنْ عَمِلَهَا فَاكْتُبُوهَا لَهُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ، ‘আমার বান্দা যখন কোন পাপ করার ইচ্ছা করে, সেই পাপ না করা পর্যন্ত তোমরা তার গুনাহ লেখ না। আর যদি তা করেই ফেলে, তাহ’লে এর সমপরিমাণ গুনাহ লেখ। আর যদি আমার (মাহাত্ম্যের) কারণে তা ত্যাগ করে, তাহ’লে তার জন্য একটি নেকী লিপিবদ্ধ কর। আর বান্দা যদি কোন ভাল কাজের ইচ্ছা পোষণ করে কিন্তু তা না করে, তবুও তোমরা তার জন্য একটি নেকী লেখ। তারপর যদি সেই ভালো কাজটি করে ফেলে, তবে তোমরা তার জন্য কাজটির ছওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত লেখ’।[7]

কখনো কখনো আল্লাহ তঁার বান্দার মনের নেক আশা বাস্তবে রূপদান করেন। শাদ্দাদ ইবনুল হাদী (রাঃ) বলেন, এক মরুবাসী বেদুঈন নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এসে ঈমান আনল এবং তঁার অনুসরণ করতে লাগল। কিছুদিন পর সে নবী করীম (ছাঃ)-কে বলল, আমি আপনার কাছে হিজরত করে আসতে চাই। ফলে নবী করীম (ছাঃ) তঁার একজন ছাহাবীকে তার সম্পর্কে কিছু নির্দেশনা দিলেন। ইতিমধ্যে একটি যুদ্ধে নবী করীম (ছাঃ) কিছু বন্দীকে গণীমত হিসাবে পেলেন। তিনি বন্দীদেরকে ভাগ করে দিলেন। ঐ বেদুঈন ছাহাবীকেও এক ভাগ দিলেন। তার ভাগটা তিনি তার সাথীদের হাতে দিলেন। লোকটি পশুপাল চরাত। পশুপাল চরিয়ে ফিরে এলে তারা গণীমতের সম্পদ (বন্দী) তাকে দিল। সে বলল, এসব কি? তারা বলল, তোমার গণীমতের ভাগ, নবী করীম (ছাঃ) তোমাকে দিয়েছেন। সে তা নিয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, এসব কি? তিনি বললেন, আমি তোমাকে ভাগ হিসাবে দিয়েছি। সে বলল, আমি তো এগুলোর জন্য আপনার অনুসরণ করছি না। সে তার কণ্ঠনালীর দিকে ইশারা করে বলল, আমি বরং এজন্য আপনার অনুসরণ করছি যে, আমার এখানে তীরবিদ্ধ হয়ে আমি মারা যাব, তারপর জান্নাতে প্রবেশ করব। তিনি বললেন, যদি তুমি আল্লাহকে সত্য বলে থাক তাহ’লে তিনি তোমার ইচ্ছা সত্যে পরিণত করবেন। এভাবে অল্প কিছুদিন গেল। তারপর মুসলিম বাহিনী একটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হ’ল। যুদ্ধে ঐ মরুচারী বেদুঈন ছাহাবী নিহত হলেন। তাকে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট নিয়ে আসা হ’ল। সে যে জায়গায় ইশারা করেছিল ঠিক সেখানেই তীর লেগেছিল। নবী করীম (ছাঃ) দেখে বললেন, এই কি সেই? তারা বলল, হ্যঁা। তিনি বললেন, সে আল্লাহকে সত্য বলেছিল, তাই আল্লাহ তাকে সত্যে পরিণত করেছেন। তারপর নবী করীম (ছাঃ) নিজের জামা দিয়ে তাকে কাফন দেন এবং তার জানাযার ছালাতে ইমামতি করেন। তার ছালাতে যেটুকু তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন তন্মধ্যে এ দো‘আ ছিল,اللَّهُمَّ هَذَا عَبْدُكَ خَرَجَ مُهَاجِرًا فِىْ سَبِيْلِكَ فَقُتِلَ شَهِيْدًا أَنَا شَهِيْدٌ عَلَى ذَلِكَ- ‘হে আল্লাহ! এ তোমার বান্দা। মুহাজির হয়ে এসে তোমার রাস্তায় বের হয়েছিল। অতঃপর শহীদ হিসাবে সে নিহত হয়েছে। আমি এ ঘটনার সাক্ষী’।[8]

৩. নির্জনে দো‘আ করা :

দো‘আ একটি বড় মাপের ইবাদত। এই ইবাদত গোপনে হওয়াই কর্তব্য। অনেকে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে আল্লাহর কাছে নিজের ব্যক্তিগত আর্জি পেশ করে দো‘আ করে। এভাবে দো‘আ করলে দো‘আ গোপন থাকে না; বরং সবার সামনে প্রকাশ হয়ে যায়। ফলে সেই দো‘আ কবুল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় এবং দো‘আতে রিয়া মিশ্রিত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। তার মানে এই না যে, ফেইসবুকে দো‘আ করা বা চাওয়া নাজায়েয; বরং ব্যক্তিকে তার মনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তারপর পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ দো‘আর ব্যাপারটা কেবল আল্লাহ ও তঁার বান্দার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাই কেউ যদি চায় যে, তার দো‘আ দ্রুত কবুল হোক তবে তাকে গোপনে দো‘আ করা উচিত। আল্লাহ তঁার বান্দাকে গোপনে দো‘আ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ادْعُوا ‌رَبَّكُمْ ‌تَضَرُّعًا ‌وَخُفْيَةً إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ، ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ডাক বিনীতভাবে ও চুপে চুপে। নিশ্চয়ই তিনি সীমালংঘনকারীদের ভালবাসেন না’ (আ‘রাফ ৭/৫৫)। তাই তো ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় স্ত্রী হাজেরা ও ইসমাঈলকে মক্কার নির্জন মরুভূতিতে রেখে তাদের অন্তরালে গিয়ে আল্লাহর কাছে কাতর কণ্ঠে প্রার্থনা করেছিলেন। যাকারিয়া (আঃ) সন্তান লাভের জন্য আল্লাহর কাছে গোপনে দো‘আ করেছিলেন। আল্লাহ এই গোপন দো‘আটি এতো পসন্দ করেছেন যে, উম্মতে মুহাম্মাদীকে দো‘আর আদব শিক্ষা দেওয়ার জন্য পবিত্র কুরআনে সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। তিনি যাকারিয়া (আঃ)-এর প্রশংসা করে বলেন, ‌إِذْ ‌نَادَى ‌رَبَّهُ ‌نِدَاءً ‌خَفِيًّا ‘যখন সে তার প্রতিপালককে আহবান করেছিল চুপে চুপে’ (মারিয়াম ১৯/৩)। মুফাসসিরগণ বলেন,إِنَّمَا أَخْفَاهُ لِأَنَّهُ أَحَبُّ إِلَى اللهِ ‘যাকারিয়া (আঃ) চুপিসারে দো‘আ করেছিলেন এজন্য যে, এটা আল্লাহর কাছে অধিক পসন্দনীয়’।[9] মুসলিম ইবনে দীনার (রহঃ) বলেন,مَا تَلَذَّذَ الْمُتَلَذِّذُوْنَ بِمِثْلِ الْخَلْوَةِ بِمُنَاجَاةِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، ‘ঈমানের স্বাদ আস্বাদনকারী বান্দারা নির্জনে যাওয়া ছাড়া আল্লাহর কাছে মুনাজাত করার প্রকৃত স্বাদ উপভোগ করতে পারে না’।[10] সুতরাং আমাদের জীবনে যাবতীয় চাওয়া-পাওয়া যেহেতু আল্লাহর কাছে, সেহেতু তার কাছে বলা মনের কথাগুলো গোপনীয়ই হওয়া উচিত।

৪. গোপন যিকিরে অভ্যস্ত হওয়া :

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি বড় মাধ্যম হ’ল যিকির। মহান আল্লাহ তঁার বান্দাকে সকাল-সন্ধ্যা যিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,وَاذْكُرْ رَبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيفَةً وَدُونَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ وَلَا تَكُنْ مِنَ الْغَافِلِينَ- ‘তোমার প্রতিপালককে স্মরণ কর মনে মনে কাকুতি-মিনতি ও ভীতি সহকারে অনুচ্চস্বরে সকালে ও সন্ধ্যায়। আর তুমি উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (আ‘রাফ ৭/২০৫)। হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, ‘মুসলিম ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য হ’ল তারা দো‘আ-প্রার্থনাতে পরিশ্রম করে। কিন্তু কেউ তাদের আওয়াজ শুনতে পায় না; বরং দো‘আ ও যিকিরের ফিসফিসানী শব্দ কেবল তার প্রতিপালক ও তার মধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকে’।[11]

আব্দুর রহমান আস-সা‘দী (রহঃ) বলেন, ‘যিকর অন্তর দিয়েও করা যায়, জিহবা দিয়েও করা যায়; তবে অন্তরের যিকির অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে নির্দেশ দিয়েছেন মনে মনে যিকর করার, যাতে যিকির খুলূছিয়াতপূর্ণ হয়’।[12] মহান আল্লাহ জান্নাতী বান্দাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন, ‌وَالْمُسْتَغْفِرِينَ ‌بِالْأَسْحَارِ ‘যারা শেষ রাতে ক্ষমা প্রার্থনাকারী’ (আলে ইমরান ৩/১৭)। আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, আমরা এক সফরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে ছিলাম। যখন আমরা কোন উপত্যকায় আরোহণ করতাম, তখন ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ এবং ‘আল্লাহু আকবার’ বলতাম। আর আমাদের আওয়াজ অতি উঁচু হয়ে যেত। নবী কারীম (ছাঃ) আমাদেরকে বললেন,أَيُّهَا النَّاسُ ارْبَعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ، إِنَّكُمْ لَيْسَ تَدْعُونَ أَصَمَّ وَلَا غَائِبًا، إِنَّكُمْ تَدْعُونَ سَمِيعًا قَرِيبًا، وَهُوَ مَعَكُمْ، ‘হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের প্রতি সদয় হও। তোমরা বধির বা অনুপস্থিত কাউকে ডাকছ না; বরং তোমরা এমন সত্তাকে ডাকছ যিনি শ্রবণকারী এবং অতি নিকটবর্তী। আর তিনি সর্বদা তোমাদের সাথেই আছেন’।[13] নবী করীম (ছাঃ) বলেন, সাত শ্রেণীর ব্যক্তি ক্বিয়ামতের ময়দানে আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবে, তন্মেধ্যে এক শ্রেণী হ’ল,رَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ، ‘সে ব্যক্তি, যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে, ফলে তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হয়’।[14]

তবে ফরয ইবাদত বাদ দিয়ে শুধু আল্লাহর নাম জপার নাম যিকির নয়; বরং আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে তঁাকে স্মরণ করার জন্য যে ইবাদত করা হয়, সেটাও যিকিরের অন্তর্ভুক্ত। প্রখ্যাত তাবেঈ সাঈদ ইবনে জুবাইর (রহঃ) বলেন, إِنَّ الْخَشْيَةَ أَنْ تَخْشَى اللهَ تَعَالَى حَتَّى تَحُولَ خَشْيَتُكَ بَيْنَكَ وَبَيْنَ مَعْصِيَتِكَ، فَتِلْكَ الْخَشْيَةُ، وَالذِّكْرُ طَاعَةُ اللهِ، فَمَنْ أَطَاعَ اللهَ فَقَدْ ذَكَرَهُ، وَمَنْ لَمْ يُطِعْهُ فَلَيْسَ بِذَاكِرٍ وَإِنْ أَكْثَرَ التَّسْبِيحَ وَقِرَاءَةَ الْقُرْآنِ، ‘যদি আল্লাহর ভয় তোমার এবং গুনাহের মাঝে অন্তরায় হয়ে দঁাড়ায়, তবে সেটাই প্রকৃত ভয়। যিকির হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য। যে আল্লাহর আনুগত্য করল, সে তঁার যিকির করল। আর যে আল্লাহর আনুগত্য করল না, সে তঁার যিকির করল না; যদিও সে অধিক তাসবীহ পড়ে এবং কুরআন তেলাওয়াত করে’।[15]

আল্লাহ্কে স্মরণ করার জন্য তাসবীহ, তাহমীদ, তাকবীর ও তাহলীলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে তাহলীল বা ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’কে সর্বোকৃষ্ট যিকির হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।[16] ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘অনেক সালাফ ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ কালেমার মাধ্যমে বেশী যিকির করতেন। কারণ এই যিকির শুধু জিহবার মাধ্যমে করা যায়। এখানে ঠেঁাটের কোন অংশগ্রহণ নেই। তাই এই যিকির অধিক গোপন করা যায়। বান্দা তার ঠেঁাট বন্ধ করে সবার অগোচরে আল্লাহর যিকিরে ব্যস্ত থাকতে পারেন’।[17] এটা খুবই বাস্তবসম্মত কথা। কেননা ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’ প্রভৃতি বাক্য পাঠের সময় ঠেঁাট নড়াচড়া করে। কিন্তু ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলার সময় একদম ঠেঁাট নড়ানোর প্রয়োজন হয় না। বরং ভরা মজলিসে বসেও ঠেঁাট বন্ধ রেখে গোপন গোপনে এই যিকির করা যায়। সুতরাং রাস্তা-ঘাটে, গাড়িতে-বাড়িতে, চলতে ফিরতে আমরা যেন এই বাক্যের মাধ্যমে সাবার অজান্তে আল্লাহর যিকরে বিভোর থাকতে পারি। আল্লাহ সেই তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

৫. কুরআন তেলাওয়াত করা :

গোপন আমলকারীদের জন্য কুরআন তেলাওয়াত একটি উৎকৃষ্ট ইবাদত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الْجَاهِرُ بِالْقُرْآنِ، كَالْجَاهِرِ بِالصَّدَقَةِ، وَالْمُسِرُّ بِالْقُرْآنِ، كَالْمُسِرِّ بِالصَّدَقَةِ، ‘প্রকাশ্যে কুরআন তেলাওয়াতকারী প্রকাশ্যে দানকারীর মতো। আর গোপনে কুরআন পাঠকারী গোপনে দানকারীর মতো’।[18] অত্র হাদীছে কুরআন তেলওয়াতকে দান-ছাদাক্বাহর সাথে তুলনা করা হয়েছে। গোপনে তেলাওয়াতকে গোপন দানের মতো ফযীলতপূর্ণ হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কেননা গোপন তেলাওয়াতে রিয়া বা লৌকিকতার সংমিশ্রণ থাকে না। তবে রিয়ার আশংকা না থাকলে কয়েকটি শর্তে প্রকাশ্যে তেলাওয়াত করা উত্তম হবে। প্রকাশ্য তেওলাওয়াত যেন কোন মুছল্লী, ঘুমন্ত ও অসুস্থ ব্যক্তির জন্য বিরক্তির কারণ না হয়। তেলওয়াতের মাধ্যমে অপরকে শিক্ষা দেওয়া ও অন্তর জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে করা হয়। কেননা সরবে তেলাওয়াত করলে সেই স্বর তেলাওয়াতকারী ও শ্রবণকারীর শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করতে এবং তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রভাবিত করতে পারে’।[19]

তবে সালাফে ছালেহীন যখন নেক আমলের উদ্দেশ্যে বা অনুধাবণ করার জন্য কুরআন তেলাওয়াত করতেন তখন সেটা সবার অগোচরে এবং গোপনে করার চেষ্টা করতেন। যেমন রাবী‘ ইবনে খুছাইম (রহঃ) তার ইবাদতগুলো গোপন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন। কুরআন তেলাওয়াতের সময় যদি বুঝতে পারতেন যে, কেউ তার কাছে আসছে, তবে সাথে সাথে কাপড় দিয়ে মুছহাফ ঢেকে রাখতেন। যেন আগন্তুক কোনভাবেই বুঝতে না পারে যে, তিনি এতক্ষণ কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। তিনি মসজিদে শুধু ফরয ছালাত আদায় করতেন। আর নফল ছালাতগুলো বাসায় লোকচক্ষুর অন্তরালে আদায় করতেন। নুসাইর (রহঃ) বলেন, তিনি তার মহল্লার মসজিদে মাত্র একবার নফল ছালাত পড়েছিলেন।[20] আবূত তাইয়্যাহ (রহঃ) বলেন, ‘আমাদের মহল্লার এক ব্যক্তি ২০ বছর ধরে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। কিন্তু তার প্রতিবেশী সেটা কোনভাবেই টের পায়নি’।[21]

আ‘মাশ (রহঃ) বলেন, আমি ইবরাহীমের কাছে ছিলাম। তিনি তখন কুরআন পড়ছিলেন। এরপর একজন লোক তার সাথে দেখা করার অনুমতি চাইল। তিনি সাথে সাথে গিলাফে কুরআন ঢেকে ফেললেন আর বললেন, ‘লোকটি আমাকে এই অবস্থায় দেখলে মনে করবে, আমি সবসময় কুরআন পড়ি’।[22] এভাবে সালাফগণ তাদের তেলাওয়াত গোপন করার চেষ্টা করতেন। তারা স্ত্রীর সাথে একই বালিশে শুয়ে তেলাওয়াত করতেন অথচ তাদের স্ত্রী সেটা কোন ভাবেই টের পেত না। সুতরাং আমাদের জীবনেও কুরআন তেলাওয়াতের এমন আমল থাকা উচিত, যেন একমাত্র আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ সেটা বুঝতে না পারে।

৬. নির্জনে নফল ছালাত আদায় করা :

গোপন ইবাদতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হ’ল নফল ছালাত। ফরয ছালাতগুলো জামা‘আতের সাথে আদায় করা অপরিহার্য। তবে নফল ছালাতগুলো সঙ্গোপনে আদায় করা উত্তম এবং অধিক ফযীলতপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‌صَلَاةُ ‌الرَّجُلِ ‌تَطَوُّعًا ‌حَيْثُ ‌لَا ‌يَرَاهُ ‌النَّاسُ ‌تَعْدِلُ ‌صَلَاتَهُ ‌عَلَى ‌أَعْيُنِ ‌النَّاسِ ‌خَمْسًا ‌وَعِشْرِينَ، ‘কোন ব্যক্তি যদি এমনভাবে নফল ছালাত আদায় করে যে, সেটা মানুষ দেখতে পায়নি, তবে তার সেই ছালাত মানুষের সামনে পঁাচিশবার আদায় করার মতো মর্যাদাপূর্ণ’।[23]

নফল ছালাতসমূহের মধ্যে রাতের তাহাজ্জুদ ছালাত অধিক গোপন করা যায়। তাছাড়া এই সময় মহান আল্লাহ প্রথম আকাশে নেমে আসেন এবং বান্দার প্রার্থনা কবুল করে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الرَّبُّ مِنَ العَبْدِ فِي جَوْفِ اللَّيْلِ الآخِرِ، فَإِنْ اسْتَطَعْتَ أَنْ تَكُونَ مِمَّنْ يَذْكُرُ اللهَ فِي تِلْكَ السَّاعَةِ فَكُنْ، ‘মহান প্রতিপালক শেষ রাতে তঁার বান্দার সর্বাধিক নিকটবর্তী হন। অতএব যারা এ সময় আল্লাহর যিকর করে (তাহাজ্জুদ ও দো‘আ করে), তুমি পারলে তাদের দলভুক্ত হয়ে যাও’।[24] হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, ‘পূর্বসূরী মনীষীর কাছে মেহমান থাকত। রাতের বেলা তিনি দীর্ঘ সময় ধরে ছালাত আদায় করতেন; অথচ তার মেহমান তা জানতেও পারত না’।[25] আবূ তামীম ইবনে মালেক বলেন, ‘মানছূর ইবনে মু‘তামির ফজর ছালাত পড়ে ছাত্রদের সামনে নিজেকে প্রাণবন্ত দেখাতেন এবং তাদের কাছে বেশি করে হাদীছ বর্ণনা করতেন। মূলতঃ তিনি রাতের বেলা ইবাদতে কাটিয়েছেন এ বিষয়টা গোপন রাখার জন্য নিজেকে এভাবে যাহির করতেন’।[26]

হাস্সান ইবনে সিনান (রহঃ)-এর স্ত্রী নিজ স্বামী সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি বাড়ি এসে আমার সঙ্গে বিছানায় প্রবেশ করতেন। যখন তিনি বুঝতে পাড়তেন আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, তখন বিছানা থেকে উঠতেন। তারপর মা যেমন দুধের শিশুকে রেখে সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে চলে যায়, ঠিক তেমনি তিনি আমাকে বুঝতে না দিয়ে বিছানা ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে পড়তেন এবং ছালাতে দঁাড়িয়ে যেতেন। একদিন আমি তাকে বললাম, হে আব্দুল্লাহর পিতা! নিজের নফসকে আর কত শাস্তি দিবেন! জীবনের প্রতি একটু দয়া করুন! তখন তিনি বললেন, ‘আহ! চুপ কর! অচিরেই আমি হয়ত এমন ঘুম ঘুমাব, সেখান থেকে আর কোনদিন উঠব না’।[27] মহান আল্লাহ আমাদেরকে হাস্সান ইবনু সীনানের মত হওয়ার তাওফীক্ব দিন।

তবে তাহাজ্জুদগুযার বান্দাদের জন্য শয়তানের একটি ধেঁাকা রয়েছে, যা থেকে সর্তক থাকা যরূরী। ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, قد لبس إبليس عَلَى جماعة من قوام الليل فتحدثوا بذلك بالنهار فربما قَالَ أحدهم فلان المؤذن أذن بوقت ليعلم الناس أنه كان منتبها فأقل مَا فِي هَذَا إن سلم من الرياء أن ينقل من ديوان السر إِلَى ديوان العلانية فيقل الثواب، ‘যারা রাতে ইবাদত করে, শয়তান তাদের জন্য এমন ফাঁদ পেতে রাখে যে, তারা রাতব্যাপী ইবাদত করে দিনের বেলা তা মানুষের নিকট বলে বেড়ায়। (তাদের বলার কৌশল হয় চমকপ্রদ) যেমন তাদের কেউ বলে- আজ অমুক মুওয়াযযিন ফজরের আযান দিয়েছে। এতে তার উদ্দেশ্য হ’ল- মানুষ যাতে বুঝতে পারে, আযানের সময় সে জাগ্রত ছিল। যদি ধরেও নেই- তার এই আচরণটি রিয়ামুক্ত ছিল, তবুও আমলের কথা প্রকাশ করার জন্য তার গোপন ইবদতটি প্রকাশ্য ইবাদতে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে তার ছাওয়াবের পরিমাণ কিছুটা হ’লেও হ্রাস পেয়েছে বলে বিবেচিত হবে’।[28]

৭. ছিয়াম পালন করা :

সালাফে ছালেহীন অন্যান্য নফল ইবাদতের মতো নফল ছিয়ামকেও গোপন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন। কেননা ছিয়াম গোপন করা তুলনামূলক সহজ। আবূত তাইয়্যাহ (রহঃ) বলেন, ‘আমি আমার আববা এবং মহল্লার মুরবিবদের দেখেছি যে, যখন তাদের কেউ ছিয়াম রাখতেন, তখন তিনি তেল লাগাতেন এবং উত্তম পোশাক পরিধান করতেন, যাতে তাদের কেউ ছিয়াম রাখার ব্যাপারটি কোনভাবেই বুঝতে না পারে’।[29] মুহাম্মাদ ইবনে মুহায্যাম (রহঃ) বলেন, ‘মুহাম্মাদ ইবনে ওয়াসে‘ সবার কাছ থেকে ছিয়াম গোপন রাখতেন। তিনি বছরের পর বছর ছিয়াম রাখতেন, কিন্তু কেউ সেটা জানতে পারত না’।[30]

দাঊদ ইবনে আবী হিন্দ (রহঃ) চল্লিশ বছর যাবৎ ছিয়াম রেখেছেন, কিন্তু কেউ সেটা বুঝতে পারেনি। তিনি কাপড়ের ব্যবসা করতেন। বাজারে যাওয়ার সময় বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে বের হ’তেন এবং রাস্তার মাঝে সেগুলো ছাদাক্বাহ করে দিতেন। বাজারের লোকজন ভাবত, তিনি বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছেন। আর বাড়ির লোকজন ভাবত, তিনি বাজারে খাবার খেয়ে নিয়েছেন।[31] ছিয়ামের মাধ্যমে বান্দার শরীর ও মন উভয়টিই প্রভাবিত ও পরিশুদ্ধ হয়। বান্দা এর মাধ্যমে সবার অন্তরালে আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করতে পারে। এজন্য ওলামায়ে কেরাম ছিয়ামকে গোপন ইবাদত হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকেন।[32]

৮. আল্লাহর ভয়ে কঁাদা :

কান্না মানুষের একটি স্বভাবজাত বিষয় এবং অন্তরের লালিত আবেগের বহিঃপ্রকাশ। কান্নার বিভিন্ন কারণ ও উপলক্ষ থাকে। কখনো আনন্দ-বেদনায়, কখনো প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথায়, কখনো শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রনায়, আবার কখনো স্বীয় সৃষ্টিকর্তার স্মরণে মুমিন বান্দার গন্ড বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে। আবার কখনো কুরআনের অমিয় বাণীর সুমধুর মূর্ছনা তার হৃদয়জগতকে আন্দোলিত করে চক্ষুযুগলকে সিক্ত করে তোলে। বান্দা যখন স্বীয় পাপের কথা মনে করে অনুতপ্ত হয়, মৃত্যু-কবর-জান্নাত-জাহান্নাম ও আল্লাহর আযাবের কথা স্মরণ করে অশ্রু বর্ষণ করে, তখন সেই অশ্রুধারা তার জীবনকে সিণগ্ধ করে তোলে। তবে আল্লাহর জন্য কান্নার অনুভূতিটা সবার মাঝে জাগ্রত হয় না। কিন্তু আল্লাহর ভয়ে কারো দু’চোখ থেকে যদি এক ফোটা অশ্রুও বর্ষিত হয় এবং তিনি যদি সেটা গোপন করতে পারেন, তবে তিনি পৃথিবীর সফল বান্দাদের একজন গণ্য হবেন। কেননা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, সেই ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশে নীচে ছায়া পাবে, যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে, ফলে তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা প্রবাহিত হয়’।[33]

সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, البكاء عشرة أجزاء ‌تسعة ‌لغير ‌الله. وواحد لله، فإذا جاء الذي لله في السنة مرة فهو كثير ‘কান্নার দশটি ধরন রয়েছে। তন্মধ্যে নয় ধরনের কান্না আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কারণে হয়। আর মাত্র এক ধরনের কান্না আল্লাহর জন্য হয়ে থাকে। সুতরাং বছরে একবারও যদি আল্লাহর জন্য কান্না আসে, তবে সেটাই অনেক বেশী’।[34]

মুহাম্মাদ বিন ওয়াসে‘ (রহঃ) বলেন, ‘আমি এমন মানুষদের পেয়েছি যে, তিনি ও তার স্ত্রী একই বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমাতেন। তিনি কঁাদতে কঁাদতে বালিশের তার দিকের অংশটা ভিজিয়ে ফেলতেন; অথচ তার স্ত্রী সেটা টেরও পেত না। আল্লাহর কসম! আমি এমন মানুষকে পেয়েছি যে, ছালাতের কাতারে দঁাড়ানো অবস্থায় তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ত; কিন্তু তার পাশের মুছল্লী সেটা কোনভাবে বুঝতে পারতেন না’।[35]

হাম্মাদ ইবনে যায়েদ (রহঃ) বলেন, ‘আইয়ূব সাখতিয়ানী হাদীছ বর্ণনা করতে গিয়ে প্রায়শই ব্যথিত হয়ে পড়তেন। তখন তার দু’চোখে অশ্রু দেখা দিত আর কান্না ঠেলে বের হয়ে আসতে চাইত। কিন্তু তিনি সর্দি ঝাড়তেন আর বলতেন, কী কঠিন সর্দিরে। কান্না গোপন করতে গিয়ে তিনি সর্দির কথা প্রকাশ করতেন’।[36] আর যখন আশঙ্কা করতেন যে, তার কান্নার শব্দ চেপে রাখতে পারবেন না, তখন সেখান থেকে উঠে যেতেন।[37]

সুফিয়ান ইবনে উয়ায়না (রহঃ) বলেন, ‘একদিন আমার মন খুব নরম ছিল। ফলে ইবাদতে খুব কান্নাকটি করলাম। পরে মনে মনে বললাম, যদি আমার সাথে আমার কোন সাথী থাকত, তাহ’লে তারও অন্তর নরম হ’ত, সেও কঁাদতে পারত। এরপর আমার দু’চোখ জুড়ে ঘুম নেমে এলো। স্বপ্নে দেখি এক লোক আমাকে পদাঘাত করে বলছে, সুফিয়ান! তোমার প্রতিদান তার কাছ থেকে নেবে, যাকে তোমার আমল দেখাতে পসন্দ কর’।[38]

৯. দান-ছাদাক্বাহ করা :

গোপন ইবাদতের আরেকটি বড় মাধ্যম হ’ল গোপন দান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, صَدَقَةُ السِّرِّ تُطْفِئُ غَضَبَ الرَّبِّ، ‘গোপন ছাদাক্বাহ প্রতিপালকের রাগকে প্রশমিত করে’।[39] তিনি আরো বলেন,سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ فِي ظِلِّهِ، يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ:...، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ، أَخْفَى حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، ‘সেদিন সাত শ্রেণীর ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দিবেন, যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। ...(তন্মধ্যে অন্যতম হ’ল) সেই ব্যক্তি, যে এমন গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত কি ব্যয় করে বাম হাত সেটা জানতে পারে না’।[40]

এজন্য সালাফগণ সবসময় গোপন দান-ছাদাক্বাহ করার চেষ্টা করতেন। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ জার্রাদ বলেন, ‘হাস্সান ইবনে আবূ সিনান প্রায়ই দাস-দাসী কিনতে গেলে পুরো একটা পরিবারকে কিনে নিতেন, এরপর তাদের সবাইকে আযাদ করে দিতেন। অথচ তারা জানতেও পারত না যে, কে তাদের কিনেছে এবং কে তাদের আযাদ করেছে’।[41] যায়নুল আবেদীন আলী ইবনুল হুসাইন (রহঃ) রাতের অন্ধকারে আটার বস্তা পিঠে নিয়ে গরীব-মিসকীনদের তালাশ করতেন। তিনি বলতেন, রাতের অঁাধারের দান প্রভুর রাগকে স্তিমিত করে। মদীনার এমন অনেক লোক ছিল, যাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা কোথা থেকে হ’ত তারা জানত না। আলী ইবনুল হুসাইনের মৃত্যুর পরে ঐ লোকদের রাতের পাওয়া খাদ্য-খানা বন্ধ হয়ে গেল, তখন তারা বুঝতে পারল কোত্থেকে তার খাবার আসত। তিনি এভাবে একশ’ পরিবারের ব্যয় বহন করতেন। মারা যাওয়ার পর লোকেরা আলী ইবনুল হুসাইন (রহঃ)-এর পিঠে কড়া পড়ার চিহ্ণ দেখতে পায়। রাতে রুটির আটা বহন করতে করতে তার পিঠে কড়া পড়ে গিয়েছিল।[42]

১০. বিধবা ও অসহায় মানুষের সেবা করা :

গরীব-মিসকীন, বিধবা ও অসহায় মানুষের সেবা করার বিনিমিয়ে রয়েছে অপরিমেয় পুরস্কার। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,السَّاعِي عَلَى الأَرْمَلَةِ وَالمِسْكِينِ كَالـمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللهِ أَوْ كَالَّذِي يَصُومُ النَّهَارَ وَيَقُومُ اللَّيْلَ، ‘বিধবা ও মিসকীনদের ভরণ-পোষণের জন্য চেষ্টারত ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদ অথবা সারাদিন ছিয়াম পালনকারী ও সারারাত (তাহাজ্জুদ) ছালাত আদায়কারীর সমান ছওয়াবের অধিকারী’।[43]

দূর অতীতে আবুবকর ও ওমর (রাঃ) মুসলিম জাহানের খলীফা হওয়া সত্ত্বেও মিসকীন ও বিধবা মহিলাদেরকে কায়িক শ্রমের মাধ্যমে সহযোগিতা করতেন। একদা ছাহাবী ত্বালহা (রাঃ) ওমর ফারূক (রাঃ)-কে এক মহিলার বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখলেন। এরপর দিনের বেলায় ত্বালহা (রাঃ) ঐ বাড়ীতে প্রবেশ করে এক অন্ধ, পঙ্গু মহিলাকে দেখতে পান। তখন তিনি ঐ মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ লোকটি (ওমর রাঃ) তোমার এখানে কি করেন? মহিলাটি বললেন, সে অমুক অমুক দিন থেকে আমার সেবা করে আসছে, আমার যা যা প্রয়োজন তা নিয়ে আসে, আমার কষ্ট হয় এমন সবকিছু দূর করে দেয়। এরপর ত্বালহা (রাঃ) নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে বললেন, হে ত্বালহা! তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক, তুমি ওমরের সামান্য দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছ?[44]

[ক্রমশঃ]

আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ

এম.ফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


[1]. মুসনাদে ইবনিল জা‘দ, পৃ. ১১৩; আবূদাঊদ, আয-যুহদ, পৃ. ১১৯।

[2]. আবূ নু‘আইম ইস্ফাহানী, হিলয়াতুল আউলিয়া, ৩/২৪০।

[3]. ইবনু আবিদ্দুনয়া, আল-ইখলাছ ওয়ান নিইয়াহ, পৃ: ৭০।

[4]. ইবনুল জাওযী, আত-তাবছিরাহ ২/৩০৪; ঐ, ছিফাতুছ ছাফওয়া ১/৪৩৫।

[5]. মুসলিম হা/১৯০৯; নাসাঈ হা/২৭৯৭; মিশকাত হা/৩৮০৮।

[6]. দায়লামী, আল-ফিরদাউস, ৪/২৮৬।

[7]. বুখারী হা/৭৫০১; ছহীহ ইবনে হিববান হা/৩৮২; ছহীহুত তারগীব হা/১৮।

[8]. তাবারাণী, মু‘জামুল কাবীর হা/৭১০৮; নাসাঈ হা/১৯৫৩; ছহীহুত তারগীব হা/১৩৩৬, সনদ ছহীহ।

[9]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৫/২১১।

[10]. ইবনু রজব হাম্বলী, জামে‘উল উলূম ওয়াল হিকাম ১/১৩৩; হিলয়াতুল আওলিয়া, ২/২৯৪।

[11]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৩/২৪৮।

[12]. তাফসীরে সা‘দী, পৃ. ৩১৪।

[13]. মুসলিম হা/২৭০৪।

[14]. বুখারী হা/৬৬০; মুসলিম হা/১০৩১; মিশকাত হা/৭০১।

[15]. আবূ নু‘আইম, হিলয়াতুল আওলিয়া ৪/২৭৬; ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া ২/৪৫।

[16]. তিরমিযী হা/৩৩৮৩; ইবনু মাজাহ হা/৩৩৮৩, সনদ হাসান।

[17]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন, ৩/২৮৭।

[18]. তিরমিযী হা/১৩৩৩; নাসাঈ হা/২৫৬১, সনদ ছহীহ।

[19]. ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী, মির‘আতুল মাফাতীহ ৭/২৮৪।

[20]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৪/২৬১।

[21]. আবূ নু‘আইম, হিলয়াতুল আওলিয়া, ৩/৮৩।

[22]. হিলয়াতুল আওলিয়া ৪/২২০; ছিফাতুছ ছাফওয়া ২/৪৯।

[23]. ছহীহুল জামে‘ হা/৩৮২১, সনদ ছহীহ।

[24]. তিরমিযী হা/৩৫৭৯; নাসাঈ হা/৫৭২; মিশকাত হা/১২২৯, সনদ ছহীহ।

[25]. ইবনু আবীদ্দুনইয়া, আল-ইখলাছ ওয়ান নিইয়াহ, পৃ. ৪৩।

[26]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া ২/৬৬।

[27]. হিলয়াতুল আওলিয়া ৩/১৭৭; ছিফাতুছ ছাফওয়া ৩/৩৩৯।

[28]. ইবনুল জাওযী, তালবীসু ইবলীস, পৃ. ১২৭।

[29]. হিলয়াতুল আওলিয়া, ৩/৮৩; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৬/১১৯।

[30]. ছিফাতুছ ছাফওয়া ২/১৬০; তারীখুল ইসলাম ৮/২৬৩।

[31]. তারীখুল ইসলাম, ৮/৪১৫; ইবনুল জাওযী, আল-মুদহিশ, পৃ. ৪২০।

[32]. ছহীহুল আছার, পৃ. ১৮৪।

[33]. বুখারী হা/৬৬০; মুসলিম হা/১০৩১; মিশকাত হা/৭০১।

[34]. হিলয়াতুল আওলিয়া ৭/১১।

[35]. আল-ইখলাছু ওয়ান নিইয়াহ, পৃ. ৩৪।

[36]. মুসনাদে ইবনুল জা‘দ হা/১২৪৬; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৬/২০।

[37]. ইবনু আবীদ্দুনয়া, আর-রিক্কাহ ওয়াল বুকা, পৃ. ১৩৪।

[38]. ইবনু রজব হাম্বলী, লাত্বাইফুল মা‘আরিফ, পৃ. ৪২০।

[39]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৩১৬৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৭৬০, সনদ ছহীহ।

[40]. বুখারী হা/৬৬০; মুসলিম হা/১০৩১; মিশকাত হা/৭০১।

[41]. ইবনু আবীদ্দুনইয়া, আল-ইখলাছ ওয়ান নিইয়াহ, পৃ. ৪৬।

[42]. হাফেয মিয্যী, তাহযীবুল কামাল ২০/৩৯২; ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশক্ব ৪১/৩৮৩-৩৮৪।

[43]. তিরমিযী হা/১৯৬৯; নাসাঈ হা/২৫৭৭; ইবনু মাজাহ হা/২১৪০, সনদ ছহীহ।

[44]. ইবনু জাওযী, আত-তাবছিরাহ, ১/৪২৭; ছিফাতুছ ছাফওয়া ১/১০৬।






বিষয়সমূহ: আমল
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (৯ম কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
শারঈ জ্ঞানার্জনের বাধ্যবাধকতা ও বর্তমান সমাজ বাস্তবতা - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ (১ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আল্লামা আলবানী সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্বের সমালোচনার জবাব (২য় কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
হকের পথে বাধা : মুমিনের করণীয় (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ওয়াহ্হাবী আন্দোলন : উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব (২য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
দো‘আর আদব বা শিষ্টাচার সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
রোহিঙ্গারা বাঁচতে চায় - লিলবর আল-বারাদী - যশপুর, তানোর, রাজশাহী
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম (২য় কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
মানুষের দো‘আয় শামিল হওয়ার উপায় - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
মানব সৃষ্টি : ইসলাম ও বিজ্ঞানের আলোকে - লিলবর আল-বারাদী - যশপুর, তানোর, রাজশাহী
মানবাধিকার ও ইসলাম (৩য় কিস্তি) - শামসুল আলম
আরও
আরও
.