‘মুনাযারা’ অর্থ কোন বিষয়ে পরস্পর বিতর্ক করা। চাই সেটি ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা অন্য কোন বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হোক। মানুষ যখন অস্তিত্ব লাভ করে এবং জ্ঞান-বুদ্ধির সাথে পরিচিত হয়, তখন থেকেই মুনাযারা ও পারস্পরিক বাদানুবাদের সূচনা হয়ে গিয়েছিল। ধর্মীয় বিষয়ে হযরত ইবরাহীম (আঃ) এবং তাঁর যুগের বাদশাহ নমরূদের কথোপকথনকে আমরা মুনাযারা হিসাবে অভিহিত করতে পারি। হযরত ঈসা মাসীহ (আঃ)-এর প্রায় দুই হাযার বছর পূর্বে বাবেল রাজত্ব উন্নতির উচ্চশিখরে আরোহণ করেছিল এবং তার সামরিক ও অর্থনৈতিক ভিত অত্যন্ত মযবুত ছিল। বাবেল বাদশাহ নমরূদ প্রভুত্বের দাবী করে নিজের স্বর্ণনির্মিত মূর্তি মন্দির সমূহে প্রতিস্থাপন করতঃ মানুষকে তার পূজা করার হুকুম দেয়। সেই সময় আল্লাহ তা‘আলা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে নবী হিসাবে মনোনীত করে নমরূদ ও তার দেশের জনগণের নিকট প্রেরণ করেন। তিনি ঘোষণা করেন, সমগ্র সৃষ্টির প্রভু একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করতে হবে। নমরূদ ও তার প্রজাদের জন্য এই ঘোষণাটি তাওহীদের দাওয়াত ছিল। কিন্তু নমরূদ তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে সূরা বাক্বারাহ-এর ২৫৮ নং আয়াতে। মহান আল্লাহ বলেন,

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِيْ حَآجَّ إِبْرَاهِيْمَ فِيْ رَبِّهِ أَنْ آتَاهُ اللهُ الْمُلْكَ إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيْمُ رَبِّيَ الَّذِيْ يُحْيِـيْ وَيُمِيْتُ قَالَ أَنَا أُحْيِـيْ وَأُمِيْتُ قَالَ إِبْرَاهِيْمُ فَإِنَّ اللهَ يَأْتِيْ بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِيْ كَفَرَ وَاللهُ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ-

‘তুমি কি ঐ ব্যক্তিকে দেখনি, যে ইবরাহীমের সাথে তার প্রতিপালক সম্পর্কে বিতর্ক করেছিল, যেহেতু আল্লাহ তাকে রাজত্ব দিয়েছিলেন। যখন ইবরাহীম বলল, তিনি আমার প্রতিপালক যিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। সে বলল, আমিও তো জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই। ইবরাহীম বলল, আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত করান, তুমি তাকে পশ্চিম দিক হতে উদিত করাও তো। অতঃপর যে কুফরী করেছিল সে (অর্থাৎ নমরূদ) হতবুদ্ধি হয়ে গেল। আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না’ (বাক্বারাহ ২৫৮)

কুরআন মাজীদে এ ধরনের আরো অনেক ঘটনা বিদ্যমান রয়েছে, যেগুলোকে কোন না কোনভাবে মুনাযারা হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে ছাহাবায়ে কেরামের কিছু মুনাযারার কথাও বর্ণিত হয়েছে। যে বিতর্কগুলো তাঁরা খারেজী ও অন্যদের সাথে করেছিলেন। মহামতি ইমামদের মুনাযারাগুলোরও হদিস পাওয়া যায়। সূরা আলে ইমরানের ৬১নং আয়াতে মুবাহালার কথাও উল্লিখিত হয়েছে। নবী করীম (ছাঃ) নাজরান থেকে আগত ৬০ সদস্য বিশিষ্ট এক খ্রিস্টান প্রতিনিধি দলকে যে মুবাহালার আহবান জানিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ১৪ জন ছিল তাদের নেতা।

উপমহাদেশে মুনাযারার ইতিবৃত্ত :

মুনাযারার ইতিহাস অনেক লম্বা। অনেক আলেমের সাথে অনেকের মুনাযারা হয়েছে। লোকজন আগ্রহভরে সেসব মুনাযারায় অংশগ্রহণ করেছে এবং তার্কিকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু এখানে উপমহাদেশের কতিপয় তার্কিকের নাম উল্লেখ করা হবে। কেননা এ গ্রন্থের সম্পর্ক উপমহাদেশের সাথে। খ্রিস্টান, হিন্দু (আর্য সমাজ ও সনাতন ধর্মাবলম্বী), কাদিয়ানী, শী‘আ ও হানাফীদের সাথে (ব্রেলভী ও দেওবন্দী) আহলেহাদীছ আলেমদের বিতর্ক হয়েছে। বিতর্কের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদ্ভাসিত হয় এবং মানুষেরা ভুল ও সঠিক বিষয় অবগত হতে পারে। সম্রাট আকবরের সময়ে উপমহাদেশে খ্রিস্টান পাদ্রীদের সাথে বাহাছ-মুনাযারার পরম্পরা শুরু হয়েছিল। আকবরের সময়ের প্রসিদ্ধ তার্কিকদের মধ্যে মাওলানা সা‘দুল্লাহ খান, মাওলানা আব্দুল্লাহ ও কুতুবুদ্দীনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরপর মুনাযারার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে।

শাহ আব্দুল আযীযের যুগ :

শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী (রহঃ)-এর যুগে মুনাযারা বেশ গতি লাভ করেছিল। কারণ ঐ সময় প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। ইংরেজরা ইংল্যান্ড থেকে আসার সময় পাদ্রীদেরকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। যাতে করে এখানে খ্রিস্টান ধর্মের প্রচারের মাধ্যমে মানুষদেরকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার মিশন চালানো যায়। উদ্দেশ্য এটাই ছিল যে, এভাবে খ্রিস্টান ধর্ম প্রসার লাভ করবে এবং ইংরেজ শাসনও সুদৃঢ় হবে। শাহ আব্দুল আযীয এই বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। তিনি খ্রিস্টানদের মুকাবিলা করতেন।

নিম্নে খ্রিস্টানদের সাথে শাহ ছাহেবের কতিপয় বাহাছ-মুনাযারা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের উল্লেখ করা হল-

(১) একদা শাহ আব্দুল আযীয দিল্লীর জামে মসজিদে কুরআন মাজীদের দরস দিচ্ছিলেন। ইত্যবসরে একজন পাদ্রী এসে বললেন, আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিন। প্রশ্নটা হল, মুসলমানদের নবীকে পৃথিবীতে দাফন করা হয়েছে এবং আমাদের নবী ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহ আকাশে স্থান দিয়েছেন। সুতরাং আমাদের নবীর মর্যাদা মুসলমানদের নবীর চেয়ে বেশী বলে প্রতীয়মান হল। শাহ ছাহেব অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত শব্দে উত্তর দিলেন, এই দলীল দ্বারা আমাদের নবী করীম (ছাঃ)-এর চেয়ে ঈসা (আঃ)-এর উচ্চমর্যাদা প্রমাণিত হয় না। কারণ ফেনা সর্বদা সমুদ্রের পানির উপরে থাকে। আর মুক্তা থাকে মাটির নীচে। এই উত্তরে ঈসা (আঃ)-কে ফেনা এবং হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে মুক্তার সাথে তুলনা করা হয়েছে।

(২) এক পাদ্রী শাহ ছাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নবী কি আল্লাহর বন্ধু? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। পাদ্রী বললেন, আপনার নবী কি হযরত হুসাইনকে হত্যার সময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেননি যে, আমার দৌহিত্রকে হত্যা থেকে বাঁচানো হোক? না প্রার্থনা করেছিলেন, কিন্তু আল্লাহ কবুল করেননি? শাহ ছাহেব উত্তর দিলেন, আমাদের নবী আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন, কিন্তু আল্লাহ বলেছিলেন, তোমার নাতিকে লোকেরা শহীদ করেছে। আর শহীদের মর্যাদা অনেক বেশী। কিন্তু এ সময় আমার পুত্র ঈসার কথা মনে পড়ছে। যাকে তার অনুসারীরা শূলে বিদ্ধ করেছিল।

(৩) একবার এক হিন্দু শাহ ছাহেবকে জিজ্ঞেস করল, আল্লাহ হিন্দু না মুসলমান? উত্তরে তিনি বলেন, যদি আল্লাহ হিন্দু হতেন, তাহলে তিনি কখনো গাভী যবেহ হতে দিতেন না।

অন্যান্য আলেমদের মুনাযারা :

শাহ আব্দুল আযীয দেহলভীর পরে অগণিত আহলেহাদীছ আলেমের সাথে অনেক আলেমের বিতর্ক হয়েছে। তন্মধ্যে একজন তার্কিক ছিলেন মাওলানা সালামাতুল্লাহ জয়রাজপুরী। যার সাথে মাওলানা শিবলী নোমানীর লিখিত বিতর্ক হয়েছিল। বিতর্কের বিষয় ছিল তাক্বলীদ পরিত্যাগ, সশব্দে আমীন বলা, ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ প্রভৃতি। মাওলানা শিবলী নোমানী কট্টর প্রকৃতির হানাফী ছিলেন। ‘রিওয়া’ (যেলা আযমগড়) নামক স্থানে একটি মৌখিক বিতর্ক হয়েছিল। এ সকল বিতর্কের ফলশ্রুতিতে খোদ মাওলানা শিবলীর বংশে কুরআন-সুন্নাহ অনুসরণের উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছিল। একটা সময়ে এসে মাওলানা শিবলীর মগজ থেকে মাযহাবী গোঁড়ামি অনেকটাই দূর হয়ে গিয়েছিল।

মাওলানা সাইয়িদ আমীর হাসান মুহাদ্দিছ সাহসোয়ানীও স্বীয় যুগের প্রসিদ্ধ তার্কিক ছিলেন। ইস্কাট নামক অনেক বড় এক ব্রিটিশ পাদ্রীর সাথে তিনি বিতর্ক করেছিলেন। মাওলানার দলীল সমূহের দ্বারা পাদ্রী অত্যন্ত প্রভাবিত হন এবং তাঁর জ্ঞানের গভীরতার স্বীকৃতি প্রদান করেন। মাওলানার সাথে সাক্ষাতের জন্য সাহসোয়ানে তার যাতায়াত ছিল। তিনি নিজ দেশ লন্ডনে চলে গিয়েছিলেন। ১২৯১ হিজরীতে (১৮৭৪ খ্রিঃ) মাওলানার মৃত্যু হয়। পাদ্রী ইস্কাট তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে লন্ডনের পত্র-পত্রিকায় শোক প্রকাশ করে প্রবন্ধ লিখে তাঁর বিদ্যাবত্তার কথা বিশদভাবে প্রকাশ করেছিলেন।[1]

মাওলানা আব্দুল বারী সাহসোয়ানীও অত্যন্ত প্রসিদ্ধ মুনাযির ছিলেন। আগ্রাতে পাদ্রী ইমাদুদ্দীনের সাথে তাঁর বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু গন্ডগোলের আশংকার অজুহাত দেখিয়ে বিতর্ক চলাকালে পাদ্রী ময়দান থেকে প্রস্থান করেন। আগ্রা ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে পাদ্রীদের সাথে তাঁর তর্কযুদ্ধ হয়। আল্লাহর অনুগ্রহে প্রত্যেক বিতর্কে তিনি জয়লাভ করেন। একবার আগ্রাতে ‘তুহফাতুল ইসলাম’ গ্রন্থের লেখক আন্দ্রামান মুরাদাবাদী নামক এক হিন্দু তার্কিকের সাথে বিতর্ক করেন। মাওলানা জনসম্মুখে তাকে পরাজিত করেন। তিনি এটাও প্রমাণ করেন যে, এই গ্রন্থটি ঐ হিন্দুর রচিত নয়।[2]

উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আহলেহাদীছদের অবদান অধ্যায়ে ‘জামা‘আতে মুজাহিদীনের কতিপয় সাহায্যকারী’ উপশিরোনামে মাওলানা আব্দুল আযীয রহীমাবাদীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি মিয়াঁ সাইয়িদ নাযীর হুসাইন দেহলভীর ছাত্র ছিলেন। উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন আলেম, খ্যাতিমান মুহাক্কিক, স্বনামধন্য শিক্ষক ও অভিজ্ঞ তার্কিক ছিলেন। তিনি মাওলানা শিবলী নোমানীর ‘সীরাতুন নু‘মান’ গ্রন্থের জবাবে ‘হুসনুল বায়ান ফীমা ফী সীরাতিন নু‘মান’ (حسن البيان فيما في سيرة النعمان) নামে একটি গ্রন্থ লিখেন। এতে তিনি মাওলানা শিবলীর ঐতিহাসিক ভুলগুলো চিহ্নিত করেছেন। ‘সীরাতুন নু‘মান’-এর ২য় সংস্করণে মাওলানা শিবলী ঐ ভুলগুলো সংশোধন করেন। অতঃপর এ জাতীয় বিষয়ে তিনি আর কোন গ্রন্থ রচনা করেননি।

মাওলানা রহীমাবাদীর মুনাযারাগুলোতে উৎসবের আমেজ ছিল। ১৯০৩ সালের ১৬ই আগস্ট তিনি ‘দিওরিয়া’ নামক স্থানে আর্য সমাজের (হিন্দু) সাথে একটি বিতর্ক করেছিলেন। এটা ছিল সপ্তাহব্যাপী চলমান লিখিত বিতর্ক। প্রত্যেকদিন অগণিত হিন্দু ও মুসলমান অত্যন্ত আগ্রহের সাথে বিতর্ক শুনতেন। সকল মাযহাবের ওলামায়ে কেরাম ঐ বিতর্কে শামিল ছিলেন এবং সকলে সর্বসম্মতিক্রমে মাওলানা রহীমাবাদীকেই তার্কিক নির্বাচন করেছিলেন। মাওলানা রহীমাবাদী ঐ বিতর্কে বিজয়ী হয়েছিলেন। ১৩০৫ হিজরীর জুমাদাল ঊলা মাসে (ফেব্রুয়ারী ১৮৮৮) বাংলার মুর্শিদাবাদ শহরে হানাফী আলেমদের সাথে ‘তাক্বলীদ’ বিষয়ে মাওলানা রহীমাবাদীর বিতর্ক হয়েছিল। পাঁচ দিন বিতর্ক অব্যাহত ছিল। সে যুগের অনেক আহলেহাদীছ ও হানাফী আলেম ঐ বিতর্কে শরীক ছিলেন। হানাফীদের পক্ষ থেকে প্রত্যেক দিন তার্কিক বদলাতে থাকে। কিন্তু আহলেহাদীছদের পক্ষে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মাওলানা রহীমাবাদীই তার্কিক ছিলেন এবং তিনিই বিতর্কে বিজয়ী হয়েছিলেন।

বক্তব্য, লেখনী, অনুবাদ, গ্রন্থ রচনা ও বাহাছ-মুনাযারায় মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (মৃঃ মার্চ ১৯৪১) অত্যন্ত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর অনেক অগ্রগণ্য কৃতিত্ব রয়েছে। তিনিই প্রথম আলেম যিনি তাফসীর ইবনে কাছীরের উর্দূ অনুবাদ করেন। সহজ-সরল ও বোধগম্য ঐ অনুবাদটি অত্যন্ত খ্যাতি অর্জন করেছিল। অনেক প্রকাশক সেটি প্রকাশ করেছে। তিনিই প্রথম আলেম যিনি ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)-এর ‘ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন’ গ্রন্থের উর্দূ অনুবাদ করেন। কুরআন, হাদীছ ও ফিক্বহ বিষয়ে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ। এর অনুবাদ পড়ে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ মাওলানা জুনাগড়ীকে পত্র লিখেন এবং অনুবাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাঁর মুহাম্মাদী সিরিজও দারুণ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল। অর্থাৎ নামাযে মুহাম্মাদী, ছাওমে মুহাম্মাদী, হজ্জে মুহাম্মাদী, যাকাতে মুহাম্মাদী প্রভৃতি নামে তাঁর অনেক গ্রন্থ রয়েছে। যেগুলো লোকজন অত্যন্ত আগ্রহভরে অধ্যয়ন করত। তিনি স্বীয় যুগের সফল তার্কিকও ছিলেন। আল্লাহ তাঁর মধ্যে অনেক গুণের সমাহার ঘটিয়েছিলেন।

অবিভক্ত পাঞ্জাবের শিখ রাজ্য পাটিয়ালায় একটি গ্রামের নাম ছিল ‘পায়েল’। সেখানে একটি হিন্দু পরিবার বসবাস করত। এই পরিবারের ছেলে অনন্ত রাম অল্প বয়সে ইসলামের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার অন্তর ইসলামের নিকটবর্তী হতে থাকে। এখন তিনি হিন্দু ব্রাহ্মণ, শিখ নানক, খ্রিস্টান পাদ্রী এবং মুসলমান আলেমদেরকে তাদের ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করা শুরু করেন এবং বিভিন্ন ধর্মের গ্রন্থাবলী অধ্যয়নকে নিজের অভ্যাসে পরিণত করেন। তিনি মূলত হিন্দু ছিলেন। এজন্য গভীর অভিনিবেশ সহকারে হিন্দু ধর্ম অধ্যয়ন করেন। এই ধর্ম সম্পর্কে দারুণ সব বিস্ময়কর তথ্য অবগত হন। হিন্দু দেব-দেবী সম্পর্কে তিনি যে তথ্য লাভ করেন, তা ছিল রীতিমত আশ্চর্যজনক। বুদ্ধি-বিবেকের সাথে সেগুলোর কোন সম্পর্ক ছিল না। তিনি ১৮৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে (১২৬৪ হিঃ) ঈদুল ফিতরের দিন মালেরকোটলায় (যেটি অবিভক্ত পাঞ্জাবের মুসলিম রাজত্বের রাজধানী ছিল) মুসলমান হন। তিনি ঈদগাহে জনসম্মুখে নিজের ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন এবং নিজেই নিজের নাম ওবায়দুল্লাহ রাখেন।

যোগ্য শিক্ষকদের নিকট অতি দ্রুত তিনি সকল দ্বীনী বিষয় অধ্যয়ন করেন এবং মাওলানা ওবায়দুল্লাহ মালেরকোটলী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি ইসলামের অনেক বড় মুবাল্লিগ ও তার্কিক হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। অসংখ্য হিন্দু ও শিখ তাঁর দাওয়াতে প্রভাবিত হয়ে ইসলামের গন্ডিতে প্রবেশ করে। তিনি ‘তুহফাতুল হিন্দ’ (تحفة الهند) নামে একটি গ্রন্থ লিখেন। এতে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে তাদের ধর্মীয় গ্রন্থাবলীর উদ্ধৃতিতে বিস্ময়কর সব কিচ্ছা-কাহিনী বর্ণনা করেন। হিন্দু ধর্মের বিস্ময়কর ঘটনাবলী সংবলিত উর্দূতে এটিই প্রথম গ্রন্থ। বিভিন্ন জায়গা থেকে এই গ্রন্থটি কয়েকবার প্রকাশিত হয়েছে এবং যে অমুসলিম সেটি পড়েছে সে-ই মুসলমান হয়ে গেছে। মাওলানা ওবায়দুল্লাহ মালেরকোটলী ১৩১০ হিজরীতে (১৮৯৩ খ্রিঃ) মৃত্যুবরণ করেন।

বাহাছ-মুনাযারার আলোচনায় কার কার নাম উল্লেখ করা যায়। অগ্রজ তার্কিকদের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। পরবর্তীদের নাম তো গণনা করাই অসম্ভব। আহলেহাদীছ জামা‘আতের অসংখ্য তার্কিককে এক লম্বা লাইনে দন্ডায়মান দেখা যাচ্ছে। এটাও চিরন্তন সত্য যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বিতর্কে তাদেরকে বিজয় দান করেছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশ তার্কিক মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিতর্কের ময়দানে আবির্ভূত হন।

সকল তার্কিকের নাম লেখাও কঠিন। মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটী অনেক বড় একজন ব্যক্তি। পূর্বে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি কুরআন, হাদীছ, ফিক্বহ, উসূলে ফিক্বহ, দর্শন, মানতিক ও আরবী সাহিত্যে অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি অনেক বড় তার্কিকও ছিলেন।

মাওলানা আহমাদুদ্দীন গোখড়াবী, মাওলানা নূর হুসাইন ঘারজাখী, মাওলানা আব্দুল্লাহ মি‘মার অমৃতসরী, সাইয়িদ আব্দুর রহীম শাহ মাক্ষাবী, মাওলানা মুহাম্মাদ ছিদ্দীক লায়েলপুরী, মাওলানা আব্দুল আযীয মালেক মুলতানী ও অন্যান্য অসংখ্য আলেম রয়েছেন, যারা এক্ষেত্রে বিশাল অবদান রেখেছেন। লোকেরা তাদের মুনাযারা দ্বারা সবিশেষ উপকৃত হয়েছেন। এঁরা ইসলামের অনেক বড় খাদেম ছিলেন।

হাফেয আব্দুল্লাহ রোপড়ী এই বিষয়ে যাদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন তাদের মধ্যে তাঁর দুই ভাতিজা হাফেয মুহাম্মাদ ইসমাঈল রোপড়ী ও হাফেয আব্দুল কাদের রোপড়ীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[3] বিশেষত হাফেয আব্দুল কাদের রোপড়ীকে আল্লাহ এই বিষয়ে অপরিসীম যোগ্যতা দান করেছিলেন। তিনি কাদিয়ানী, ব্রেলভী ও দেওবন্দীদের সাথে অসংখ্য বিতর্ক করেছেন। ‘ফুতূহাতে আহলেহাদীছ (মীযানে মুনাযারা)’ নামে দু’টি বৃহৎ খন্ডে তাঁর প্রায় সকল মুনাযারা সংকলন করা হয়েছে। এই গ্রন্থটি মুহাদ্দিছ রোপড়ী একাডেমী, জামে‘আ আহলেহাদীছ, চক দালগারা, লাহোর প্রকাশ করেছে। এই গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মুহাদ্দিছ রোপড়ী একাডেমীর ব্যবস্থাপকরা ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। গ্রন্থাকারে সংকলিত এই মুনাযারাগুলো থেকে লোকেরা উপকৃত হবেন এবং একাডেমীর সদস্যদের জন্য দো‘আ করবেন।

হাফেয আব্দুল কাদের রোপড়ী যে পদ্ধতিতে বিতর্ক করতেন এবং প্রতিপক্ষকে যেভাবে ধমকি প্রদান করতেন, তা ছিল দারুণ প্রভাব বিস্তারকারী পদ্ধতি। এরই ভিত্তিতে লোকজন তাঁকে ‘সুলতানুল মুনাযিরীন’ (বিতর্ক সম্রাট) উপাধি প্রদান করেন। আর এটা সম্পূর্ণ সঠিক উপাধি।

মাওলানা আরিফ জাবেদ মুহাম্মাদীর (কুয়েত প্রবাসী) অনুরোধে এই গ্রন্থের লেখক মাওলানা আহমাদুদ্দীন গোখড়াবীর জীবনী লেখার তৌফিক লাভ করেছেন। ১৪৩১ হিজরীর রামাযান মাসে আমি এই খিদমত আঞ্জাম দিয়েছি। গ্রন্থটি দেড়শ পৃষ্ঠাব্যাপী। এতে কাদিয়ানী, খ্রিস্টান, শী‘আ ও হানাফীদের সাথে মাওলানা আহমাদুদ্দীন গোখড়াবীকৃত সকল মুনাযারার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হাফেয আব্দুল কাদের রোপড়ী তাঁকে ‘উসতাযুল মুনাযিরীন’ (তার্কিকদের শিক্ষক) বলে অভিহিত করতেন। তিনি বাস্তবেই একজন জাঁদরেল তার্কিক ছিলেন। সম্ভব হলে কোন ব্যক্তি কষ্ট করে মাওলানা নূর হুসাইন ঘারজাখী, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ মি‘মার অমৃতসরী, সাইয়িদ আব্দুর রহীম শাহ মাক্ষাবী, মাওলানা আব্দুল আযীয মালেক মুলতানী, মাওলানা মুহাম্মাদ ছিদ্দীক লায়েলপুরী ও অন্যান্য আলেমদের মুনাযারাগুলো সংকলন করুক। এটা আবশ্যক নয় যে, এই বিষয়ের সব কথাই লিপিবদ্ধ করতে হবে। তবে যতটুকু সম্ভব লেখা উচিত। আল্লাহ কারো উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপান না।

মাওলানা আব্দুল মজীদ সোহদারাভীকে আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দান করুন! তিনি মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর মুনাযারাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ মাওলানার জীবনীগ্রন্থ ‘সীরাতে ছানাঈ’তে বর্ণনা করে দিয়েছেন। তাঁর পরে মাওলানা ফযলুর রহমান আযহারী স্বীয় গ্রন্থ ‘রাঈসুল মুনাযিরীন মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী’তে এই খিদমতই করেছেন।

ভারতীয় আলেম ও গ্রন্থকার, জামে‘আ আছারিয়া, মউ (ইউপি)-এর শিক্ষক মাওলানা মুহাম্মাদ মুকতাদা আছারী উমরী অনেক ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তিনি ‘তাযকিরাতুল মুনাযিরীন’ (تذكرة المناظرين) শীর্ষক আকর্ষণীয় নামে দুই খন্ডে গ্রন্থ লিখেছেন। যেটি ইদারায়ে তাহকীকাতে ইসলামী, জামে‘আ আছারিয়া, মউ (ইউপি)-এর পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ২০০২ সালের জানুয়ারীতে (শাওয়াল ১৪২২ হিঃ) ১ম খন্ড প্রকাশিত হয়েছে। এতে ভারত ভাগের পূর্বের অর্থাৎ ১৮৩৫-১৯৪৬ পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের আহলেহাদীছ আলেমদের সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং তাদের মুবাহালা ও বাহাছ-মুনাযারার বিবরণী পেশ করা হয়েছে। ২য় খন্ডে ভারত ভাগের পরের অর্থাৎ ১৯৪৭-২০০১ পর্যন্ত আহলেহাদীছ আলেমদের সংক্ষিপ্ত জীবনী সহ তাদের মুনাযারাগুলোর ইতিবৃত্ত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ১৪২৪ হিজরীর যিলহজ্জ (জানুয়ারী ২০০৪) মাসে এই খন্ডটি প্রকাশিত হয়েছে। এটিও মাওলানা মুহাম্মাদ মুকতাদী আছারী উমরীর অগ্রগণ্য কৃতিত্ব।

আমাদের বন্ধু ড. বাহাউদ্দীন ‘তাহরীকে খতমে নবুঅত’-এর বিভিন্ন খন্ডে কাদিয়ানীদের সাথে বাহাছ-মুনাযারা সম্পর্কিত অনেক ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন।


মূল (উর্দূ) : মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক ভাট্টি

অনুবাদ : নূরুল ইসলাম

পিএইচ.ডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


[1]. মাওলানা মুহাম্মাদ মুকতাদা আছারী উমরী, তাযকিরাতুল মুনাযিরীন ১/১১৮-১২০

[2]. ঐ ১/১২১-১২৫

[3]. ঐতিহ্যবাহী রোপড়ী আহলেহাদীছ পরিবারের আলেমদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন : মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক ভাট্রি, রোপড়ী ওলামায়ে হাদীছ (লাহোর : মুহাদ্দিছ রোপড়ী একাডেমী, ৩য় সংস্করণ, ২০১১)। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৫৩।-অনুবাদক






ইয়াতীম প্রতিপালন (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর পাঁচ দফা মূলনীতি : একটি বিশ্লেষণ (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আমাদের পরিচয় কি শুধুই মুসলিম? - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
মরণ বাঁধ ফারাক্কা
চিন্তার ইবাদত (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠের গুরুত্ব ও ফযীলত (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত পরিচিতি (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
অনুভূতির ছাদাক্বাহ - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকার (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
জান্নাত লাভের কতিপয় উপায় (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
বাংলা বানান রীতি ও আমাদের প্রস্তাবনা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
১৬ মাসের মর্মান্তিক কারা স্মৃতি (৩য় কিস্তি) - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
আরও
আরও
.