ভূমিকা : শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে যেসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য মানব সমাজে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে, তন্মধ্যে ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা অন্যতম। কেননা ভুল-ত্রুটি ও ভালো-মন্দের মিশ্রণেই মানুষের জীবন। সামান্য ভুলের জন্য কারো প্রতি ভীষণ রাগ ও ক্রোধ দেখানো এবং উত্তেজিত হওয়া উচিত নয়। এসব সাধারণ কারণে পরিবার ও সমাজে বড় ধরনের অঘটন ঘটে যায়। ভাই-ভাই, পিতা-পুত্রে, স্বামী-স্ত্রীতে, প্রতিবেশীর সাথে একটু ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার অভাবে বিবাদ-বিসম্বাদ ও হানাহানি যেন বর্তমান সভ্য সমাজে নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ মানুষ জানে যে, এগুলো নিন্দনীয় অপরাধ। এগুলো মানুষকে অন্যের কাছে ছোট করে ও তার ছওয়াব কমিয়ে দেয়। পক্ষান্তরে একটু ক্ষমাশীল হ’লেই সমাজের বহু সমস্যা অল্পতেই মিটে যেত। কেননা ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা মানুষের মান-মর্যাদা বাড়ায়। এতে রয়েছে মানসিক শান্তি ও তৃপ্তি। আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়াস পাবো ইনশাআল্লাহ।
ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার পরিচয় : ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা পরস্পর সমার্থক শব্দ। ক্ষমা শব্দের অর্থ অপরাধ মার্জনা, সহিষ্ণুতা, সহনক্ষমতা, অপকার সহন, অন্যের অপরাধ সহনরূপ সদবৃত্তি। সেখান থেকে ক্ষমাশীল অর্থ যিনি সহজেই অন্যের অপরাধ ক্ষমা করেন।[1] আর সহিষ্ণুতা শব্দের অর্থ শক্তি-সামর্থ্য থাকার পরও প্রতিশোধ গ্রহণ না করা। সেখান থেকে সহিষ্ণু অর্থ বরদাস্তকারী, সহনশীল, ধৈর্যশীল, ক্ষমাশীল।[2]
ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার আরবী প্রতিশব্দ العفو والصفح ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শায়খ উছায়মীন (রহঃ) বলেন,العفو ترك المؤاخذة على الذنب؛ والصفح الإعراض عنه، ‘অপরাধের প্রতিশোধ গ্রহণ না করাকে ক্ষমা ও তা এড়িয়ে চলাকে সহিষ্ণুতা বলা হয়’।[3]
ইমাম বায়যাবী (রহঃ) বলেন,العفو ترك عقوبة المذنب، والصفح ترك لومه، ‘অপরাধীকে শাস্তি না দেওয়াকে ক্ষমা ও তাকে তিরস্কার না করাকে সহিষ্ণুতা বলা হয়’।[4]
অর্থাৎ অন্যের অপরাধ মাফ করে দেওয়া এবং তার প্রতিশোধ গ্রহণ না করাই ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা। ব্যক্তিগত ও সামাজিক অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার পথ অবলম্বন করলে পরিবার ও সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় থাকে। তবে বিভিন্ন অপরাধের ক্ষেত্রে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি বাস্তবায়নে ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার পথ অবশ্যই পরিহার করতে হবে। অন্যথায় সমাজে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেতেই থাকবে এবং সমাজের শান্তি দূরীভূত হবে। যা মূলতঃ প্রশাসন ও দেশের সরকারের দায়িত্ব। যেমন আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,مَا ضَرَبَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لنَفسِهِ شَيْئًا قَطُّ بِيَدِهِ وَلَا امْرَأَةً وَلَا خَادِمًا إِلَّا أَنْ يُجَاهِدَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَمَا نِيلَ مِنْهُ شَيْءٌ قَطُّ فَيَنْتَقِمُ مِنْ صَاحِبِهِ إِلَّا أَنْ يُنْتَهَكَ شَيْءٌ مِنْ مَحَارِمِ اللهِ فَيَنْتَقِمُ لِلَّهِ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছা.) কখনো কাউকে নিজের স্বার্থে নিজ হাতে মারেননি। কোন মহিলা বা খাদেমকে কখনো প্রহার করেননি। যদি তাঁর দেহে বা অন্তরে কারো পক্ষ থেকে কোন প্রকারের ব্যথা লাগত, তখন তিনি নিজের ব্যাপারে সেই লোক হ’তে কোন প্রতিশোধ নিতেন না। কিন্তু কেউ যদি আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ করে বসত, তখন তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে প্রতিশোধ নিতেন’।[5]
ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার গুরুত্ব ও মর্যাদা
ইসলামে ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম। এ মর্যাদা কেবল তিনিই লাভ করতে পারেন, যিনি নিজের ক্রোধকে দমন করেন এবং মানুষের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে তাদের সাথে উত্তম আচরণ করেন। মন্দকে প্রতিহত করেন ভালো দ্বারা। নিম্নে ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক তুলে ধরা হ’ল।-
১. আল্লাহর নির্দেশ পালন : আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা পসন্দ করেন। তাই পরসম্পরের মধ্যে ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার পথ অবলম্বনের নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, فَاعْفُوا وَاصْفَحُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللهُ بِأَمْرِهِ إِنَّ اللهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘অতএব তোমরা ক্ষমা কর এবং এড়িয়ে চলো যতক্ষণ না আল্লাহর নির্দেশ এসে পড়ে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল কিছুর উপরে সর্বশক্তিমান (বাক্বারাহ ২/১০৯)। তিনি আরো বলেন, خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ، ‘তুমি ক্ষমার নীতি গ্রহণ কর। লোকদের সৎকাজের আদেশ দাও এবং মূর্খদের এড়িয়ে চল’ (আ‘রাফ ৭/১৯৯)।
ক্ষমার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর ভালোবাসা লাভ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاصْفَحْ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ، ‘অতএব তুমি তাদের মার্জনা কর ও ক্ষমা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন’ (মায়েদাহ ৫/১৩)। তিনি আরো বলেন, فَاصْفَحِ الصَّفْحَ الْجَمِيلَ ‘অতএব তুমি ওদের সুন্দরভাবে মার্জনা কর’ (মায়েদাহ ১৫/৮৫)। যারা ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার পথ অবলম্বন করেন, তারা মূলতঃ আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ পালন করেন। যারা এ পথ থেকে দূরে থাকে তারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে। ফলে তারা আল্লাহর ক্রোধে পতিত হয়।
২. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশের অনুসরণ : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জীবনে বহু অবাঞ্ছিত ও অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্তু তিনি এসব বিষয় ক্ষমা, সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে মোকাবেলা করেছেন। আর তিনি উম্মতকে ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার পথ অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,تَعَافَوُا الْحُدُودَ فِيمَا بَيْنَكُمْ فَمَا بَلَغَنِى مِنْ حَدٍّ فَقَدْ وَجَب، ‘তোমরা তোমাদের মধ্যে সংঘটিত দন্ডযোগ্য বিষয়সমূহ পরস্পরে ক্ষমা করে দাও। কেননা আমার নিকট যখন দন্ডের বিষয়টি পৌঁছবে তখন তা বাস্তবায়ন করা ওয়াজিব হয়ে যাবে’।[6]
কেউ সম্পর্ক ছিন্ন করলেও তার সাথে সদ্ব্যবহার করা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশ। ওক্ববা বিন আমের (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলে তিনি আমাকে বলেন,يَا عُقْبَةُ صِلْ مَنْ قَطَعَكَ وَأَعْطِ مَنْ حَرَمَكَ وَأَعْرِضْ عَمَّنْ ظَلَمَكَ، ‘হে ওক্ববা! তোমার সাথে যে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তুমি তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখো। তোমাকে যে বঞ্চিত করে তুমি তাকে দান করো। আর যে তোমার প্রতি যুলুম করে তুমি তাকে এড়িয়ে চলো’।[7]
আবুল আহওয়াছ (রাঃ) তাঁর পিতা হ’তে বর্ণনা করেন তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)!الرَّجُلُ أَمُرُّ بِهِ فَلاَ يَقْرِينِى وَلاَ يُضَيِّفُنِى فَيَمُرُّ بِى أَفَأَجْزِيهِ قَالَ لاَ، أَقْرِهِ ‘আমি এক লোকের নিকট দিয়ে অতিক্রম করেছি। কিন্তু সে আমাকে সম্মান করেনি এবং আতিথেয়তা করেনি। সে আমার নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় আমি কি তার সাথে অনুরূপ আচরণ করব। রাসূল (ছাঃ) বললেন, না। তুমি তাকে অতিথি হিসাবে আপ্যায়ন করো’।[8]
৩. ক্ষমা আল্লাহর অন্যতম গুণ : পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে আল্লাহ তা‘আলার শতাধিক গুণবাচক নাম রয়েছে। এগুলোকে আসমাউল হুসনা বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ لِلَّهِ تَعَالَى تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا مِائَةً إِلَّا وَاحِدًا مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘আল্লাহ তা‘আলার নিরানববইটি-এক কম একশ’টি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি (সঠিক উপলব্ধির সাথে) এগুলো গণনা (মুখস্থ) করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[9] আল্লাহর গুণবাচক নামগুলির একটি হচ্ছে- গফূর বা ক্ষমাশীল। তিনি বান্দার অপরাধের বিচার সঙ্গে সঙ্গে করতে সক্ষম। কিন্তু তিনি বান্দার অপরাধ ক্ষমা করেন, পাপীকে অবকাশ দেন এবং তওবাকারীর তওবা কবুল করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّ اللهَ كَانَ عَفُوًّا غَفُورًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মার্জনাকারী ও ক্ষমাশীল’ (নিসা ৪/৪৩)। তিনি আরো বলেন,وَهُوَ الَّذِي يَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِهِ وَيَعْفُو عَنِ السَّيِّئَاتِ وَيَعْلَمُ مَا تَفْعَلُونَ ‘তিনিই তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন ও পাপ সমূহ মার্জনা করেন। আর তিনি জানেন তোমরা যা করে থাক’ (শূরা ৪২/২৫)।
আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন, আবার যাকে ইচ্ছা শাস্তি প্রদান করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَغْفِرُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَشَاءُ وَكَانَ اللهُ غَفُورًا رَحِيمًا، ‘আর আল্লাহরই জন্য নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব। তিনি যাকে চান ক্ষমা করেন ও যাকে চান শাস্তি দেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আহযাব ৪৮/১৩-১৪)। তিনি আরো বলেন, وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ يَغْفِرُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَشَاءُ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ، ‘আর আল্লাহর জন্যই সবকিছু, যা আছে আসমানে ও যমীনে। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন ও যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়’ (আলে ইমরান ৩/১২৯)।
আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,قَالَ اللهُ تَعَالَى: يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ مَا دَعَوْتَنِي وَرَجَوْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ عَلَى مَا كَانَ فِيكَ وَلَا أُبَالِي يَا ابنَ آدمَ إِنَّك لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوبُكَ عَنَانَ السَّمَاءِ ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ وَلَا أُبَالِي يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ لَقِيتَنِي بِقُرَابِ الْأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيتَنِي لَا تُشْرِكُ بِي شَيْئًا لَأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مغْفرَة، ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে ডাকবে ও আমার নিকট ক্ষমার আশা রাখবে, তোমার অবস্থা যাই হোক না কেন, আমি কারো পরোয়া করি না, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব। হে আদম সন্তান! তোমার গুনাহ যদি আকাশ পর্যন্তও পৌঁছে, আর তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব, আমি কারো পরোয়া করি না। হে আদম সন্তান! তুমি যদি পৃথিবী ভর্তি গুনাহ নিয়ে আমার কাছে হাযির হও এবং আমার সাথে কাউকে শরীক না করা অবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ কর, আমি পৃথিবীব্যাপী ক্ষমা নিয়ে তোমার কাছে হাযির হব’।[10]
আল্লাহ তা‘আলা অসীম ধৈর্যশীল ও ক্ষমাশীল। যুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ ও শাস্তিদানের পূর্ণ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কাউকে সহজে শাস্তি দেন না। তিনি যদি অসীম ক্ষমার মালিক না হ’তেন, তাহ’লে পৃথিবীতে কোন জীবের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللهُ النَّاسَ بِظُلْمِهِمْ مَا تَرَكَ عَلَيْهَا مِنْ دَابَّةٍ وَلَكِنْ يُؤَخِّرُهُمْ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى ‘আর যদি আল্লাহ মানুষকে তাদের সীমালংঘনের জন্য পাকড়াও করতেন, তাহ’লে পৃথিবীতে কোন প্রাণীকেই তিনি ছাড়তেন না। কিন্তু একটি নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত তিনি তাদের অবকাশ দেন’ (নাহল ১৬/৬১)।
৪. নবী-রাসূল ও পূর্ববর্তীদের বৈশিষ্ট্য : নবী-রাসূলগণ এবং তাঁদের ছাহাবীরা ক্ষমা, সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতার প্রতীক ছিলেন। তাদের কাহিনী মানবতার জন্য অনুপম দৃষ্টান্ত। এসব কাহিনী এক একটি অবিরাম বিচ্ছুরিত আলোকধারা, যার প্রতিটি কণায় বিকশিত হয় মানবতার সর্বোচ্চ নমুনা। এ বিষয়ে কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিম্নরূপ-
ক. আদম (আঃ)-এর দুই পুত্র ক্বাবীল ও হাবীলের জীবনীতে রয়েছে ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দু’ভাই আল্লাহর নামে কুরবানী করেছিল। কিন্তু আল্লাহ হাবীলের কুরবানী কবুল করেন। কিন্তু ক্বাবীলের কুরবানী কবুল করেননি। এতে ক্বাবীল ক্ষুব্ধ হয়ে হাবীলকে বলল, لَأقْتُلَنَّكَ ‘আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব’। হাবীল তখন তাকে উপদেশ দিয়ে মার্জিত ভাষায় বলল,إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ، لَئِن بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لَأَقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাক্বওয়াশীল বান্দাদের থেকে (কুরবানী) কবুল করে থাকেন। এক্ষণে যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হও, তবে আমি তোমাকে পাল্টা হত্যা করতে উদ্যত হব না। কেননা আমি বিশ্বচরাচরের পালনকর্তা আল্লাহ্কে ভয় করি’ (মায়েদাহ ৫/২৭-২৮)। বড় ভাই ছোট ভাইকে হত্যা করেছিল। হাবীল অন্যায়ের বদলে অন্যায় করেনি। বরং সে ক্ষমা ও সহনশীলতা অবলম্বন করেছে।
খ. দশজন বিমাতা ভাই মিলে নবী ইউসুফ (আঃ)-কে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তারা বিফল হ’ল। আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফ (আঃ)-কে দুনিয়ায় রাজত্ব দান করলেন। বিমাতা ভাইয়েরা তাঁর নিকট সাহায্য চাইতে আসলে তিনি প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। বরং তাদের ক্ষমা করে দিয়ে বিশ্ব ইতিহাসে নযীরবিহীন ক্ষমার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ইউসুফ (আঃ)-এর বিমাতা ভাইয়েরা বলল, تَاللهِ لَقَدْ آثَرَكَ اللهُ عَلَيْنَا وَإِنْ كُنَّا لَخَاطِئِيْنَ- ‘আল্লাহর কসম! আমাদের উপরে আল্লাহ তোমাকে পসন্দ করেছেন এবং আমরা অবশ্যই অপরাধী ছিলাম’। ইউসুফ বললেন, لاَ تَثْرَيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ يَغْفِرُ اللهُ لَكُمْ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِيْنَ- ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সকল দয়ালুর চাইতে অধিক দয়ালু’ (ইউসুফ ১২/৯১-৯২)।
গ. শেষনবী মুহা্ম্মাদ (ছাঃ) ছিলেন ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার মূর্ত প্রতীক। তিনি জীবনে অনেক প্রতিকূল পরিবেশের শিকার হয়েছেন। অনেক মিথ্যা অপবাদ ও অশ্লীল গালিগালাজ তাঁকে শুনতে হয়েছে। কিন্তু তিনি ধৈর্যের সাথে তা মোকাবেলা করেছেন। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, لَمْ يَكُنْ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاحِشًا وَلَا مُتَفَحِّشًا وَلَا سَخَّابًا فِي الْأَسْوَاقِ وَلَا يَجْزِي بِالسَّيِّئَةِ السَّيِّئَةَ وَلَكِنْ يَعْفُو وَيَصْفَحُ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অশ্লীলভাষী এবং তিনি অশ্লীল আচরণকারী ছিলেন না। তিনি হাটে-বাজারে শোরগোলকারী ছিলেন না। আর মন্দের প্রতিশোধ তিনি মন্দের দ্বারা নিতেন না। বরং তিনি ক্ষমা করে দিতেন ও উপেক্ষা করে চলতেন’।[11]
আতা ইবনু ইয়াসার (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-কে বললাম, আপনি আমাদের কাছে তাওরাতে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ)-এর গুণাবলী বর্ণনা করুন। তখন তিনি বললেন, আচ্ছা। আল্লাহর কসম! কুরআনে বর্ণিত তাঁর কিছু গুণাবলী তাওরাতে বর্ণিত হয়েছে।...لَيْسَ بِفَظٍّ وَلاَ غَلِيظٍ وَلاَ سَخَّابٍ فِى الأَسْوَاقِ، وَلاَ يَدْفَعُ بِالسَّيِّئَةِ السَّيِّئَةَ وَلَكِنْ يَعْفُو وَيَغْفِرُ ‘তিনি কর্কশ স্বভাবের, কঠোর হৃদয়ের এবং বাজারে শোরগোলকারী ছিলেন না। আর মন্দের প্রতিশোধ তিনি মন্দ দ্বারা নিতেন না। বরং তিনি মাফ করে দিতেন ও ক্ষমা করতেন’।[12]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই মক্কা বিজয়ের সময়। যে মক্কাবাসী তাঁকে একে একে ১৬টি মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই মক্কায় তিনি বিজয়ী বেশে প্রবেশ করে শত্রুদের হাতের মুঠোয় পেয়েও ক্ষমা করে দিলেন। তিনি তাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। বিশ্ব ইতিহাসে রক্তপাতহীন বিজয় হ’ল মক্কা বিজয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কা বিজয়ের দিন বললেন, نَعَم مَنْ دَخَلَ دَارَ أَبِيْ سُفْيَانَ فَهُوَ آمِنٌ وَمَنْ أَغْلَقَ عَلَيْهِ بَابَهُ فَهُوَ آمِنٌ وَمَنْ أَلْقَى السَّلاَحَ فَهُوَ آمِنٌ وَمَنْ دَخَلَ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ فَهُوَ آمِنٌ- ‘বেশ, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে। যে ব্যক্তি তার ঘরের দরজা বন্ধ রাখবে, সে নিরাপদ থাকবে। যে ব্যক্তি অস্ত্র ফেলে দিবে, সে নিরাপদ থাকবে এবং যে ব্যক্তি মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে’।[13]
আলী (রাঃ) আবু সুফিয়ান মুগীরাহ ইবনুল হারেছকে শিখিয়ে দিলেন যে, তুমি রাসূল (ছাঃ)-এর সম্মুখে গিয়ে সেই কথাগুলি বল, যা ইউসুফের ভাইয়েরা তাঁকে বলেছিলেন,تَاللهِ لَقَدْ آثَرَكَ اللهُ عَلَيْنَا وَإِنْ كُنَّا لَخَاطِئِيْنَ، ‘আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনাকে আমাদের উপরে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং আমরা অবশ্যই অপরাধী ছিলাম’ (ইউসুফ ১২/৯১)। আবু সুফিয়ান ইবনুল হারেছ তাই করলেন। আর সাথে সাথে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সেই জবাবই দিলেন, যা ইউসুফ (আঃ) তার ভাইদের দিয়েছিলেন-لاَ تَثْرَيْبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ يَغْفِرُ اللهُ لَكُمْ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِيْنَ، ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি হ’লেন দয়ালুদের সেরা দয়ালু’ (ইউসুফ ১২/৯২)।
আবু সুফিয়ান ইবনুল হারেছ ছিলেন আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি এবং রাসূল (ছাঃ)-এর বড় চাচা হারেছ-এর পুত্র। রাসূল (ছাঃ) তাকে ক্ষমা করে দিলে খুশীতে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে নয় লাইনের একটি কবিতা পাঠ করেন। যার মধ্যে ৩য় লাইনে তিনি বলেন,
هَدَاني هادٍ غيرُ نفسي ودَلَّني * على الله مَنْ طَرَّدتُ كُلَّ مُطَرَّدٍ
‘আমার নফস ব্যতীত অন্য একজন পথপ্রদর্শক আমাকে পথ দেখিয়েছেন এবং আমাকে আল্লাহর পথের সন্ধান দিয়েছেন, যাকে সকল প্রকারের তিরষ্কারের মাধ্যমে আমি তাড়িয়ে দিতাম’। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার বুকে থাবা মেরে বললেন, হ্যাঁ। أَنْتَ طَرَّدْتَنِيْ كُلَّ مُطَرَّدٍ ‘তুমিই তো আমাকে সর্বদা তাড়িয়ে দিতে’।[14]
৫. ছাহাবী, সালাফে ছালেহীন ও মুত্তাক্বীদের বৈশিষ্ট্য : ছাহাবী, সালাফে ছালেহীন, মুত্তাকী ও সৎকর্মশীলদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হ’ল ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা। তাঁরা এই মহৎ গুণ দ্বারা নিজেদের সুশোভিত করেছেন। ফলে তারা আল্লাহর নিকট নিজেদের মান-সম্মান ও মর্যাদাকে উনণত করেছেন এবং মানুষের ভালোবাসা লাভে ধন্য হয়েছেন। আল্লাহ তাদের গুণ বর্ণনায় বলেন, الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ ‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সর্বাবস্থায় (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় করে, যারা ক্রোধ দমন করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৩৩-১৩৪)।
মুত্তাকী তথা আল্লাহভীরু লোকদের বৈশিষ্ট্য হ’ল তারা সহজেই অপরের অপরাধ, দোষ-ত্রুটি ও ভুলগুলি ক্ষমার চোখে দেখেন এবং এড়িয়ে চলেন। আর এটি তাক্বওয়া অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহ বলেন, وَأَنْ تَعْفُوا أَقْرَبُ لِلتَّقْوَ ‘তবে যদি তোমরা মার্জনা কর, তা তাক্বওয়ার অধিক নিকটবর্তী’ (আলে ইমরান ৩/১৩৩-১৩৪)।
ছাহাবীগণ ছিলেন ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীতে সর্বোত্তম মানুষ। ক্ষমা সম্পর্কে কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিম্নরূপ :
ক. একদা এক ব্যক্তি ওমর ফারূক (রাঃ)-এর মুখের উপর তাঁকে কৃপণতা ও যুলুমের মিথ্যা অপবাদ দেয়। এতে তিনি ধৈর্যধারণ করেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন। যেমন ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা ওয়ায়না বিন হিছন বিন হুযায়ফা এসে তার ভাতিজা হুর বিন ক্বায়সের কাছে অবস্থান করল। আর হুর ছিলেন ওমর (রাঃ)-এর নিকটবর্তী লোকদের অন্যতম। অতঃপর তার মাধ্যমে সে খলীফা ওমর (রাঃ)-এর নিকট প্রবেশ করে বলল, يَا ابْنَ الْخَطَّابِ، فَوَاللهِ مَا تُعْطِينَا الْجَزْلَ، وَلاَ تَحْكُمُ بَيْنَنَا بِالْعَدْلِ. فَغَضِبَ عُمَرُ حَتَّى هَمَّ بِهِ، ‘হে ওমর বিন খাত্ত্বাব! আপনিতো আমাদের বেশী বেশী দান করেন না এবং আমাদের মাঝে ন্যায়বিচার করেন না। এতে ওমর (রাঃ) রাগান্বিত হয়ে তাকে একটা কিছু করতে উদ্যত হ’লেন। তখন হুর বিন ক্বায়স বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ তা‘আলা তো তাঁর নবীকে বলেছেন, خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ، ‘তুমি ক্ষমার নীতি গ্রহণ কর। লোকদের সৎকাজের আদেশ দাও এবং মূর্খদের এড়িয়ে চল’ (আ‘রাফ ৭/১৯৯)। আর এই লোক তো অবশ্যই মূর্খদের অন্তর্ভু&ক্ত। আল্লাহর কসম! ওমর (রাঃ) আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেননি। আল্লাহর কিতাবের সামনে তিনি চুপ হয়ে গেলেন।[15]
খ. একদা আবুদ্দারদা (রাঃ) একদল লোকের নিকট দিয়ে পথ চলতে চলতে দেখলেন যে, তারা একজন ব্যক্তিকে প্রহার করছে ও গালি দিচ্ছে। তিনি তাদের বললেন, ঘটনা কি? তারা বলল, সে বড় ধরনের অপরাধ করেছে। তিনি বললেন, যদি সে কোন কূপে পতিত হ’ত, তাহ’লে তোমরা কি তাকে সেখান থেকে তুলতে না? তারা বলল, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, তাহ’লে তোমরা তাকে গালি দিয়ো না ও প্রহার করো না। বরং তাকে উপদেশ দাও ও বুঝাও। আর সেই আল্লাহর প্রশংসা কর, যিনি তোমাদেরকে তার মত অপরাধে পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন। তারা বলল, আপনি কি তাকে ঘৃণা করবেন না? তিনি বললেন, আমি তার কাজকে ঘৃণা করি। সে যখন তা ছেড়ে দিবে, তখন সে আমার ভাই। এতে সেই লোকটি বিলাপ করে কাঁদতে লাগল এবং তওবা করতে লাগল।[16]
গ. একদা আবু যার (রাঃ) তার গোলামকে বললেন, তুমি কেন বকরীটিকে ঘোড়ার খাবারের মধ্যে ছেড়ে দিয়েছ? সে বলল, আমি এ কাজের মাধ্যমে আপনাকে রাগান্বিত করতে চেয়েছিলাম। তখন তিনি বললেন, আমি অবশ্যই রাগের সাথে ছওয়াব চাই। তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আজ থেকে স্বাধীন’।[17]
অনুরূপভাবে সালাফে ছালেহীনদেরকে কেউ গালি দিলে, নিন্দা করলে বা গীবত করলেও তাঁরা পাল্টা আক্রমণ করতেন না। বরং তা এড়িয়ে চলতেন। যেমন-
ঘ. একদা ইমাম বুখারী (রহঃ)-কে তাঁর কতিপয় সাথী বললেন,إن بعض الناس يقع فيك، ‘কিছু মানুষ আপনার নিন্দা করছে। তখন তিনি বললেন, إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا، ‘নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল অতীব দুর্বল’ (নিসা ৪/৭৬)। অতঃপর তিনি আল্লাহ তা‘আলার বাণী তেলাওয়াত করলেন, وَلا يَحِيقُ الْمَكْرُ السَّيِّئُ إِلا بِأهْلِهِ ‘কূট চক্রান্ত কেবল চক্রান্তকারীকেই বেষ্টন করে’ (ফাত্বির ৪/৪৩)।[18]
ঙ. জনৈক ব্যক্তিকে বলা হ’ল, তোমার সম্পর্কে অমুকে নিন্দা করছে। তোমার সম্পর্কে অমুকে এরূপ এরূপ বলছে এবং মানুষের নিকট তোমাকে খারাপভাবে উপস্থাপন করছে। তখন তিনি বললেন, আমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি নির্যাতিত হ’লে আমরা কি করব? যে ব্যক্তি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহর সীমালংঘন করে, আমরা তার ব্যাপারে আল্লাহর সীমালংঘন করব না। ক্ষমা করাই উত্তম। তোমার কারণে তোমার কোন মুসলিম ভাইকে শাস্তি দেওয়া হ’লে, তা তোমার কোন উপকার করবে না। সুতরাং তোমরা ক্ষমা কর ও এড়িয়ে চল। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবেন।[19]
তাই ক্ষমা, সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতার পথ অবলম্বনই শ্রেয়। কেননা ক্ষমার মাধ্যমে অন্তর প্রশান্তিতে থাকে, সৌভাগ্য অর্জিত হয়। আর যে ব্যক্তি ক্ষমার পরিবর্তে অন্তরে ক্রোধ, হিংসা ও প্রতিশোধ প্রবণতা লুকিয়ে রাখে তার জীবন সংকুচিত হয়, অন্তর অস্থির থাকে ও সম্মান ধুলায় ধুসরিত হয়। পক্ষান্তরে ক্ষমাকারী ব্যক্তি প্রশান্ত চিত্তে রাত যাপন করে। কেননা সে আল্লাহর নিকট প্রতিদানের উদ্দেশ্যে প্রতিশোধ গ্রহণ না করে ক্ষমা করেছে। আর ব্যক্তিগত কারণে প্রতিশোধ গ্রহণকারী প্রতিশোধ গ্রহণের পর বলে হায়! আমি যদি ক্ষমা করতাম ও প্রতিশোধ গ্রহণ না করতাম তাহ’লে কতইনা ভালো হ’ত! ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন,
ما عفوت ولم أحقد على أحد* أرحت نفسي من هم العداوات
‘যখন আমি ক্ষমা করি এবং কারো প্রতি হিংসা না করি, তখন আমি আমার হৃদয়কে শত্রুতার চিন্তা হ’তে প্রশান্তি দান করি’।
ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার উপকারিতা
ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার উপকারিতা অত্যধিক। ক্ষমার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। পরিবার ও সমাজে শান্তি ফিরে আসে। ক্ষমাকারীর অন্তরে প্রশান্তি থাকে। নিম্নে ক্ষমার কিছু উপকারিতা তুলে ধরা হ’ল-
১. সম্মান ও মর্যাদা লাভ : ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে মানুষ সম্মান ও মর্যাদা লাভ করে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ وَمَا زَادَ اللهُ عَبْدًا بِعَفْوٍ إِلاَّ عِزًّا وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ، ‘দান সম্পদ কমায় না। ক্ষমা দ্বারা আল্লাহ কোন বান্দার সম্মান বৃদ্ধি ছাড়া হ্রাস করেন না এবং যে কেউ আল্লাহর ওয়াস্তে বিনয় প্রকাশ করে, আল্লাহ তার মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে দেন’।[20]
আবুদ্দারদা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল যে,قيل لأبي الدرداء: من أعز الناس؟ فقال: (الذين يعفون إذا قدروا؛ فاعفوا يعزكم الله تعالى، ‘সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তি কারা? উত্তরে তিনি বললেন, যারা প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা করে। সুতরাং তোমরা ক্ষমা করো, তাহ’লে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন।[21]
২. শুভ পরিণাম লাভ : ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার পরিণাম শুভ ও সুন্দর হয়। ক্ষমাই উত্তম প্রতিশোধ। পারস্পরিক ভুল বুঝাবুঝিতে অনেক সময় বড় ধরনের সংঘাত সংঘটিত হয়। এমতাবস্থায় যে ব্যক্তি ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার পথ অবলম্বন করে পরিণামে সে উত্তম প্রতিদান লাভ করে। মুমিন ও মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য হ’ল তারা কারো উপর কোন কারণে রাগান্বিত হ’লে সহজেই ক্ষমা করে দেয়। তাদের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন,وَمَا عِنْدَ اللهِ خَيْرٌ وَأَبْقَى لِلَّذِينَ آمَنُوا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ، وَالَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ وَإِذَا مَا غَضِبُوا هُمْ يَغْفِرُونَ ‘আর আল্লাহর নিকটে যা আছে তা উত্তম ও স্থায়ী, তাদের জন্য যারা ঈমান আনে ও তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে। আর (তাদের জন্য) যারা কবীরা গোনাহ ও অশ্লীল কর্মসমূহ হ’তে বিরত থাকে এবং যখন তারা ক্রুদ্ধ হয় তখন ক্ষমা করে’ (শূরা ৪২/৩৬-৩৭)।
মানুষ দুনিয়াবী তুচ্ছ স্বার্থে ভাইয়ে ভাইয়ে, পিতা-পুত্রে, স্বামী-স্ত্রীতে হানাহানিতে লিপ্ত হয়। ফলে পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয়। অথচ একটু ধৈর্যধারণ করলে এবং একে অপরকে ক্ষমা করলে বড় কোন অঘটন থেকে মানুষ বেঁচে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে সংসার ভাঙ্গা থেকে স্বামী-স্ত্রী রক্ষা পায়। সুতরাং বলা যায় যে, ক্ষমা ও সহনশীলতার মাধ্যমে সকলে শান্তি পায়।
৩. শত্রু বন্ধুত্বে পরিণত : সমাজ জীবনে মানুষের সাথে চলতে গিয়ে বিভিন্ন সময় ভুল-ত্রুটি হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন করলে অনেক সমস্যা সমাধান হয়। এছাড়া ক্ষমা, সহনশীলতার মাধ্যমে শত্রুও বন্ধুতে পরিণত হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ - وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ ‘ভাল ও মন্দ কখনো সমান নয়। তুমি উত্তম দ্বারা (অনুত্তমকে) প্রতিহত কর। ফলে তুমি দেখবে যে, তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে যেন (তোমার) অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গেছে। এই গুণের অধিকারী কেবল তারাই হ’তে পারে, যারা ধৈর্যশীল এবং এই গুণের অধিকারী কেবল তারাই হ’তে পারে, যারা মহা ভাগ্যবান’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৪-৩৫)।
হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,إذا أحسنتَ إلى من أساء إليك قادته تلك الحسنة إلى مصافاتك ومحبتك، والحنوّ عليك، حتى يصير كأنه وليّ لك، حميم أي: قريب إليك من الشفقة عليك والإحسان إليك ‘যখন তুমি সদাচরণ করবে ঐ ব্যক্তির সাথে যে তোমার সাথে অসদাচরণ করে, তখন ঐ সদাচরণ তাকে তোমার সাথে থাকার, তোমার প্রতি মনোনিবেশ করার ও তোমার প্রতি ভালোবাসার পথে পরিচালিত করবে। এমনকি সে তোমার ঘনিষ্ট বন্ধুতে পরিণত হয়ে যায় এবং তোমার প্রতি সহানুভূতি ও অনুগ্রহ করার মাধ্যমে সে তোমার নিকটবর্তী হবে’।[22]
সৎকর্ম ও অসৎকর্ম, ভালো ও মন্দ এবং ক্ষমা ও প্রতিশোধের মধ্যে সুদূর ব্যবধান। যখন কোন ব্যক্তির মন্দ কর্ম ও আচরণকে মন্দ দ্বারা প্রতিহত করা হবে, তখন উভয়ের মধ্যে শত্রুতা ও হিংসা সৃষ্টি হবে। আর যখন মন্দকে ভালো দ্বারা প্রতিহত করা হবে, তখন শত্রুতা ও হিংসা দূরীভূত হবে। এভাবে দু’জন শত্রুভাবাপন্ন ব্যক্তির মধ্যে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব তৈরি হবে। এ সম্পর্কে কয়েকটি ঘটনা নিম্নরূপ :
ক. আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার রাসূল (ছাঃ) নাজদের দিকে কিছু অশ্বারোহী (সৈন্য) পাঠালেন। তারা বনী হানীফা গোত্রের জনৈক ব্যক্তিকে ধরে আনল। তার নাম ছুমামাহ বিন উছাল। সে ইয়ামামাবাসীদের সরদার। তারা তাকে মসজিদে নববীর একটি খুঁটির সাথে বেঁধে রাখল। রাসূল (ছাঃ) তার কাছে আসলেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওহে ছুমামাহ! তুমি কি মনে করছ’? সে বলল,عِنْدِى يَا مُحَمَّدُ خَيْرٌ، إِنْ تَقْتُلْ تَقْتُلْ ذَا دَمٍ وَإِنْ تُنْعِمْ تُنْعِمْ عَلَى شَاكِرٍ وَإِنْ كُنْتَ تُرِيدُ الْمَالَ فَسَلْ تُعْطَ مِنْهُ مَا شِئْتَ- ‘হে মুহাম্মাদ! আমার নিকটে উত্তম (দ্বীন) আছে। যদি আপনি আমাকে হত্যা করেন, তাহ’লে অবশ্যই আপনি একজন খুনীকে হত্যা করবেন। আর যদি আপনি অনুগ্রহ করেন, তাহ’লে একজন কৃতজ্ঞ ব্যক্তির উপরই অনুগ্রহ করবেন। আর যদি আপনি মাল চান, তাহ’লে যা ইচ্ছা চাইতে পারেন, তা দেওয়া হবে’। তার কথা শুনে রাসূল (ছাঃ) তাকে (সেদিনের মত তার নিজের অবস্থার উপর) ছেড়ে দিলেন। এভাবে পরপর তিনদিন একই উত্তর পেয়ে রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তোমরা ছুমামাহকে ছেড়ে দাও’! (তাকে ছেড়ে দেওয়া হ’ল)। অতঃপর সে মসজিদে নববীর নিকটবর্তী একটি খেজুর বাগানে গিয়ে গোসল করল। তারপর মসজিদে ফিরে এসে বলে উঠল,أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’। হে মুহাম্মাদ! আল্লাহর কসম! পৃথিবীর বুকে আপনার চেহারা অপেক্ষা আর কারও চেহারা আমার নিকট অধিক ঘৃণ্য ছিল না। কিন্তু এখন আপনার চেহারা আমার কাছে সবচেয়ে বেশী প্রিয় হয়ে গেছে। আল্লাহর কসম! (ইতিপূর্বে) আপনার দ্বীন অপেক্ষা অধিক অপ্রিয় দ্বীন আমার কাছে আর কোনটিই ছিল না। কিন্তু এখন আপনার দ্বীনই আমার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় হয়ে গেছে। আল্লাহর কসম! (এর আগে) আপনার শহরের চেয়ে অধিক ঘৃণ্য শহর আর কোনটিই আমার কাছে ছিল না। কিন্তু এখন আপনার শহরটিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় হয়ে গেছে’।[23]
খ. একদা আলী বিন হাসান (রহঃ)-এর উপর এক ব্যক্তি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করল। তখন তিনি তাকে বললেন, তুমি যে অপবাদ দিয়েছ আমরা যদি অনুরূপ হই তাহ’লে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করব। আর যদি আমরা অনুরূপ না হই, তাহ’লে আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন। এতে লোকটি নিজের ভুল বুঝতে পেরে তাঁর নিকট গিয়ে তাঁর মাথা চুম্বন করে বললেন, আমি আপনার জন্য উৎসর্গিত। আমি যা বলেছি তা ঠিক নয়। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। তখন আলী বিন হাসান (রহঃ) বললেন, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন।[24]
৩. পাপ মোচন : ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে মানুষের পাপ মোচন করা হয়। যে ব্যক্তি অপরকে ক্ষমা করে আল্লাহ তা‘আলা তার অপরাধ ক্ষমা করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَإِنْ تَعْفُوا وَتَصْفَحُوا وَتَغْفِرُوا فَإِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ، ‘আর যদি তোমরা তাদের মার্জনা কর ও দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা কর ও ক্ষমা কর, তাহ’লে নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (তাগাবুন ৬৪/১৪)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,وَلَا يَأْتَلِ أُولُو الْفَضْلِ مِنْكُمْ وَالسَّعَةِ أَنْ يُؤْتُوا أُولِي الْقُرْبَى وَالْمَسَاكِينَ وَالْمُهَاجِرِينَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَلْيَعْفُوا وَلْيَصْفَحُوا أَلَا تُحِبُّونَ أَنْ يَغْفِرَ اللهُ لَكُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন এমন শপথ না করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজনকে, অভাবগ্রস্তদেরকে এবং আল্লাহর পথে যারা গৃহত্যাগ করেছে, তাদেরকে কিছুই দিবে না। তারা যেন তাদের মার্জনা করে ও দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে যায়। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেন? বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াবান’ (নূর ২৪/২২)।
ইসলামে প্রথম খলীফা আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) অত্যন্ত ক্ষমাশীল ছিলেন। যখন তিনি মিসত্বাহ বিন আছাছাহ-এর জন্য কিছুই ব্যয় করবেন না বলে কসম করেন, তখন আলোচ্য আয়াতটি তাঁর সম্পর্কে নাযিল হয়। কারণ মিসত্বাহ আয়েশা (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে অপবাদ রটনাকারীদের সাথে শরীক ছিলেন এবং এজন্য তাকে অপবাদের শাস্তি স্বরূপ আশিটি বেত্রাঘাত করা হয়। তিনি তওবা করেন এবং আবুবকর (রাঃ)-এর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু আবুবকর (রাঃ) তাকে ক্ষমা না করে তাকে কিছুই দিবেন না বলে কসম করে বলেন,وَاللهِ لاَ أُنْفِقُ عَلَى مِسْطَحٍ شَيْئًا أَبَدًا بَعْدَ مَا قَالَ لِعَائِشَةَ ‘আল্লাহর কসম! আয়েশার বিরুদ্ধে মিসত্বাহ যে অপবাদ দিয়েছে তাতে আমি মিসত্বার জন্য কিছুই ব্যয় করব না। তখন আল্লাহ তা‘আলা আবুবকরকে ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার প্রতি উৎসাহিত করে অত্র আয়াত নাযিল করেন। ফলে আবুবকর (রাঃ) বলেন, بَلَى وَاللهِ إِنِّي لأُحِبُّ أَنْ يَغْفِرَ اللهُ لِي ‘হ্যাঁ অবশ্যই আমি চাই যে, আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন। অতঃপর তিনি কসম ভঙ্গ করেন এবং মিসত্বাহর কাছে গিয়ে তাকে পূর্বের ন্যায় খরচ দেওয়া শুরু করেন। উল্লেখ্য যে, মিসত্বাহ ছিলেন মুহাজির ও মিসকীন ছাহাবীদের অন্যতম। অভাবের কারণে আবুবকর (রাঃ) তার সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতেন।[25]
৪. ছওয়াব অর্জন : ক্ষমা, সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে মানুষ নেকী উপার্জন করতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِثْلُهَا فَمَنْ عَفَا وَأَصْلَحَ فَأَجْرُهُ عَلَى اللهِ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ، ‘বস্ত্ততঃ মন্দের প্রতিফল তো অনুরূপ মন্দই হয়ে থাকে। এক্ষণে যে ব্যক্তি ক্ষমা করে ও আপোষ করে তার পুরষ্কার তো আল্লাহর নিকটেই রয়েছে। নিশ্চয়ই তিনি অত্যাচারীদের ভালবাসেন না’ (শূরা ৪২/৪০)।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিশোধ গ্রহণ ত্যাগ করে এবং ক্ষমা করে দিয়ে নিজের এবং যালিমের মধ্যে সংশোধন করে, তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে রয়েছে, অর্থাৎ আল্লাহ তাকে এজন্য পুরস্কৃত করবেন। মুকাতিল বলেন, ক্ষমা করা আমলে ছালেহের অন্তর্ভুক্ত’।
সাহল বিন মু‘আয (রাঃ) তার পিতার মাধ্যমে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ كَظَمَ غَيْظًا، وَهُوَ قَادِرٌ عَلَى أَنْ يُنْفِذهُ، دَعَاهُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَى رُءُوسِ الْخَلاَئِقِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُخَيِّرَهُ مِنْ أيِّ الْحُور شَاءَ ‘যে ব্যক্তি ক্রোধ বাস্তবায়িত করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা সংবরণ করবে, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতে দিন সমস্ত সৃষ্টির সামনে ডেকে এখতিয়ার দিবেন, যেন সে যেকোন হূরকে নিজের জন্য পসন্দ করে নেয়’।[26]
৪. আল্লাহর ক্ষমা লাভ : ক্ষমাকারী ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার অফুরন্ত ক্ষমা লাভে ধন্য হয়। যে অপরকে ক্ষমা করে সে আল্লাহ ও মানুষের ভালোবাসা লাভ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنْ تُبْدُوا خَيْرًا أَوْ تُخْفُوهُ أَوْ تَعْفُوا عَنْ سُوءٍ فَإِنَّ اللهَ كَانَ عَفُوًّا قَدِيرًا، ‘যদি তোমরা কোন সৎকর্ম প্রকাশ কর বা গোপন কর কিংবা কোন অপরাধ মার্জনা কর, তবে আল্লাহ নিশ্চয়ই মার্জনাকারী ও সর্বশক্তিমান’ (নিসা ২৪/১৪৯)।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ أَقَالَ مُسْلِمًا أَقَالَ اللهُ عَثْرَتَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের ভুল ক্ষমা করবে, আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার ভুল ক্ষমা কররেন’।[27]
আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি নবী করীম (ছাঃ)-কে মিম্বরের উপর বলতে শুনেছেন, ارْحَمُوا تُرْحَمُوا، وَاغْفِرُوا يَغْفِرِ اللهُ لَكُمْ، وَيْلٌ لأَقْمَاعِ الْقَوْلِ، وَيْلٌ لِلْمُصِرِّينَ الَّذِينَ يُصِرُّونَ عَلَى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ، ‘তোমরা দয়া কর, তাহ’লে তোমরা করুণা প্রাপ্ত হবে। ক্ষমা কর, তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবেন। ভালো কথাকে দমনকারীদের জন্য ধ্বংস। আর ধ্বংস তাদের জন্য, যারা জেনে-শুনে পাপ করে এবং পাপ কাজে অনড় থাকে’।[28]
অপরের ভুল ও পদস্খলনকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা প্রত্যেক মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। যেকোন মানুষের ভুল হ’তেই পারে। আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, كُلُّ بَنِى آدَمَ خَطَّاءٌ وَخَيْرُ الْخَطَّائِيْنَ التَّوَّابُوْنَ، ‘প্রত্যেক আদম সন্তান ভুলকারী। আর তওবাকারীরাই সর্বোত্তম ভুলকারী’।[29] তাই অপরের ভুলকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার আহবান জানিয়ে জনৈক কবি বলেন,
سامح صديقك إن زلّت به قدمٌ * فليسَ يسلمُ إنسانٌ من الزَّلل
‘তোমার বন্ধুর যদি পা পিছলে যায়, তাকে ক্ষমা কর। কেননা পিছলে যাওয়া থেকে কেউ নিরাপদ নয়’।
উপসংহার : ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমেই সংঘাতপূর্ণ পারিবারিক ও সামাজিক জীবন শান্তি ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ মধুময় সমাজে পরিণত হ’তে পারে। কাউকে ক্ষমা করে মানুষ তার আন্তরিক ভালোবাসা লাভে ধন্য হ’তে পারে। এছাড়া আজীবন অকৃত্রিম বন্ধুতে পরিণত হ’তে পারে ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে। এ মহৎ গুণের মাধ্যমে একজন সাধারণ মানুষও অসাধারণ মানুষে পরিণত হ’তে পারে। ক্ষমাশীল মানুষ ধৈর্যশীল ও সর্বোত্তম আচরণের অধিকারী। তিনি ভদ্র ও উদার প্রকৃতির। যাদের এ ধরনের গুণাগুণ রয়েছে, তারা আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা ও ক্ষমা লাভে ধন্য। দুনিয়ায় তারা চিন্তামুক্ত জীবন যাপন করে এবং আখেরাতে জান্নাত লাভে সৌভাগ্যবান হয়। তাই আসুন! আমরা ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার মত উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সেই তাওফীক দান করুন-আমীন!
ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, সেপ্টেম্বর ২০০৩), পৃ. ৩০১।
[2]. বাংলা অভিধান, ঐ, পৃ. ১১৩৬।
[3]. উছায়মীন, তাফসীরুল কুরআন, সূরা বাক্বারাহ ১০৯ আয়াতের তাফসীর, ৩/২৬৯ পৃ.।
[4]. আনওয়ারুত তানযীল ওয়া আসরারুত তাবীল (তাফসীর বায়যাবী), সূরা বাক্বারাহ ১১১ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র.।
[5]. মুসলিম হা/২৩২৮ (৭৯); মিশকাত হা/৫৮১৮।
[6]. আবুদাঊদ হা/৪৩৭৬; মিশকাত হা/৩৫৬৮।
[7]. আহমাদ হা/১৭৪৮৮।
[8]. তিরিমিযী হা/২০০৬।
[9]. বুখারী হা/২৭৩৬, ৭৩৯২; মিশকাত হা/২২৮৭।
[10]. তিরমিযী হা/৩৫৪০; মিশকাত হা/২৩৩৬।
[11]. তিরমিযী হা/২০১৬; মিশকাত হা/৫৮২০।
[12]. বুখারী হা/২১২৫।
[13]. মুসলিম হা/১৭৮০; আবুদাঊদ হা/৩০২১; মিশকাত হা/৬২১০।
[14]. হাকেম হা/৪৩৫৯; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ৩৭৬ পৃ., সনদ হাসান; সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), ৩য় মুদ্রণ, পৃ. ৫২৮।
[15]. বুখারী হা/৪৬৪২।
[16]. ইয়াসীর আব্দুর রহমান, কিতাবু মাওসূআতিল আখলাক ওয়ায যুহুদ ওয়ার রাক্বায়েক্ব, ১/৩৮৬ পৃ. ।
[17]. যামাখশারী, রবীইল আবরার ওয়া নুছূছিল আখবার, ২/৩৩৭।
[18]. শায়খ ইবরাহীম আদ-দুওয়াইশ, কিতাবু দুরূস, ২০/১৭ পৃ.।
[19]. শায়খ আলী আল-ক্বারানী কিতাবু দুরূস, ২০/২২ পৃ.।
[20]. মুসলিম হা/২৫৮৮; মিশকাত হা/১৮৮৯।
[21]. ইমাম নববী, নিহায়াতুল আরিব ফী ফুনূনিল আদব, ৬/৫৮।
[22]. হাফেয ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম (তাফসীর ইবনে কাছীর), ৭/১৮১।
[23]. বুখারী হা/৪৬২; মুসলিম হা/১৭৬৪; মিশকাত হা/৩৯৬৪।
[24]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়াহ, ১/৩৫৫
[25]. ইবনু কাছীর ৬/৩১; মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তরজমাতুল কুরআন, (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১ম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারী ২০২২ খৃ.), পৃ. ৫৪১।
[26]. আবুদাঊদ হা/৪৭৭৭; মিশকাত হা/৫০৮৮।
[27]. ইবনু মাজাহ হা/২১৯৯; ইরওয়া হা/১৩৩৪, সনদ ছহীহ।
[28]. আহমাদ হা/৬৫৪১; ছহীহাহ হা/৪৮২; ছহীহুল জামে‘ হা/৮৯৭।
[29]. ইবনু মাজাহ হা/৪২৫১; মিশকাত হা/২৩৪১।