এই
ধরাধামে পা রাখার আগেই মানব শিশুর জন্য তার মায়ের স্তনে না চাইতেই দুধের
ব্যবস্থা করেছেন যেই মহান প্রভু ও সকল সৃষ্টির স্রষ্টা, সেই আল্লাহ তা‘আলা
আসমান-যমীনের সকল সৃষ্টিকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করে তাকে আশরাফুল
মাখলূক্বাতের আসনে বসিয়ে দিয়েছেন। যেন সকল সৃষ্টি বরযাত্রী এবং মানুষ হচ্ছে
বরপুত্র। তাইতো আল্লাহ বলেছেন,وَسَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَاوَاتِ
وَمَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا مِنْهُ، ‘আর তিনি তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন
নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে সবকিছুকে তাঁর পক্ষ হ’তে’ (জাছিয়া ৪৫/১৩)।
যমীনের এই বরপুত্র, যার জন্য পুরো স্টেজ সাজানো হয়েছে, তাঁর মেযাজ ও স্বভাব কেমন এবং তার প্রয়োজন কতটুকু, তা তাঁর স্রষ্টা থেকে আর অধিক কে জানেন? যেমন তিনি বলেন, أَلَا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ، ‘তিনি কি জানবেন না, যিনি সৃষ্টি করেছেন? বস্ত্ততঃ তিনি অতীব সূক্ষ্মদর্শী ও সবকিছু সম্যক অবহিত’ (মুলক ৬৭/১৪)।
মানুষের স্রষ্টা ও রব মানুষের স্বভাবই এমন করে গড়েছেন যে, তার জন্য তিনি যে যে নে‘মত তৈরি করেছেন তার ব্যবহার না জানা পর্যন্ত তা থেকে ফায়েদা লাভ সম্ভব নয়। কোন দামী থেকে দামী নে‘মতেরও সঠিক ব্যবহার বিধি জানা না থাকলে তা থেকে উপকৃত হওয়া তো দূরের কথা, অনেক সময় তার ব্যবহার মরণও ডেকে আনতে পারে। মহান স্রষ্টা মানুষকে সামাজিক জীব করে সৃষ্টি করেছেন এবং লম্বা সুতো, আড় সুতোর বুনুনির মাধ্যমে কাপড় তৈরির মতো করে মানব সমাজকে এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছেন। এজন্য প্রত্যেক মানুষ আল্লাহর দেওয়া নানা নে‘মত কাজে লাগিয়ে বেশির থেকে বেশি ফায়েদা অর্জন করে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে কিভাবে জৌলুসপূর্ণ করে গড়ে তুলবে? এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়া, যেখানে তাকে আখিরাতের অনন্তকালীন জীবনের প্রস্ত্ততির জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। সেখানে আরাম-আয়েশ ও সম্মানের জীবন-যাপন শেষে মৃত্যুর পর চিরস্থায়ী জীবনে জাহান্নামের শাস্তি থেকে কিভাবে পরিত্রাণ লাভ করবে, কিভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে জান্নাত ও তার আরাম-আয়েশের উপকরণ জোগাড় করবে সেজন্য সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা প্রথম দিনেই সর্বপ্রথম মানুষ হযরত আদম (আঃ)-কে ছহীফা জাতীয় আসমানী কিতাব প্রদান করেছিলেন। তারপর একের পর এক আগত নবী-রাসূলগণকে তিনি ছহীফা ও বড় বড় আসমানী কিতাব দিয়েছেন। সর্বশেষে কুরআন মাজীদকে আসমানী কিতাবের হালনাগাদ পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ হিসাবে হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর নাযিল করেছেন। মানুষের স্বভাবে এটাও রয়েছে যে, পসন্দনীয় কোন কাজ যথাযথভাবে শিখতে চাইলে তার জন্য শুধু বই হ’লে চলে না, বরং একজন হাতে-কলমে শিক্ষাদাতা শিক্ষকেরও প্রয়োজন পড়ে। কোন ব্যক্তি ড্রাইভিং এর উপর পিএইচ.ডি করলেও যদি ড্রাইভিংয়ের প্রশিক্ষক তাকে স্টিয়ারিং-এর পাশে বসে কার্যকরভাবে ড্রাইভিং না শেখায় তাহ’লে সে কখনও ড্রাইভার হ’তে পারে না। আল্লাহ পাক কত মেহেরবান! মানুষের এই সহজাত প্রয়োজন লক্ষ্য করে তিনি শুধু কিতাবই পাঠাননি বরং প্রথম দিনে প্রথম মানুষ হযরত আদম (আঃ)-কে নবী করে পাঠিয়েছেন। পরবর্তীতে একের পর এক এবং প্রত্যেক এলাকার জন্য কম-বেশী সোয়া লাখ নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। যাঁরা মানব জাতিকে এই জীবনরূপী গাড়ির ড্রাইভিং এবং আল্লাহর নে‘মত ব্যবহারের কৌশল এবং তা থেকে উপকৃত হওয়ার পদ্ধতি শিখিয়ে গেছেন। মানুষের স্বভাবের এটিও একটি দিক যে, তার বয়স যতই বাড়তে থাকে এবং তার বুদ্ধির বিকাশ যতই পরিপক্ক হ’তে থাকে ততই তার জীবনের নিয়ম-নীতি ও দাবী-দাওয়া বদলাতে থাকে। দুধের শিশুর দিন কাটানো এবং তার পানাহারের রীতি-নীতি আলাদা কিসিমের হয়ে থাকে। কিন্তু যতই সে বড় হ’তে থাকে ততই তার জীবন-যাত্রার নিয়ম-পদ্ধতি পাল্টাতে থাকে। যখন সে বালেগ বা প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়ে যায় তখন তার উপর পুরো বিধি-বিধান মেনে চলার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়।
একইভাবে মানব সভ্যতার বোধশক্তি যতই প্রসার লাভ করতে থাকে এবং তার মধ্যে আল্লাহর সৃষ্ট নে‘মত সমূহ থেকে উপকৃত হওয়ার যোগ্যতা বাড়তে থাকে, ততই দ্বীনের মৌলিক নীতিমালা এক রেখে শরী‘আতের নিয়ম-কানূনে পরিবর্তন হ’তে থাকে। এমনি করে সবার শেষ নবী রহমাতুল্লিল আলামীন (ছাঃ) আবির্ভূত হয়ে দ্বীন ও শরী‘আতের পূর্ণতা সাধন করেছেন। তাঁর আমলেই দ্বীন পরিপূর্ণ হওয়ার এবং নে‘মত পূর্ণ করার ঘোষণা জারী করা হয়েছে,الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا، ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদা ৫/৩)।
আগেকার নবীদের আনীত সংবিধান ও শারঈ আইন-কানূন ছিল অঞ্চল ভিত্তিক ও সাময়িক। একজন এক অঞ্চলের তো অন্যজন অন্য অঞ্চলের; একজন এক সময়ের তো অন্যজন অন্য সময়ের। কোন কোন নবী তো বিশেষ কোন খানদান বা বংশের এবং গোত্রের জন্য এসেছিলেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে খতমে নবুঅতের সীলমোহর লাগিয়ে ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত মানবকুলের নবী করে পাঠানো হয়েছে। এজন্য তাঁর পরে এখন শুধুই তাঁর প্রচারিত দ্বীনকে সমগ্র মানব জাতির দ্বীন এবং তাঁর চরিতাদর্শ ও জীবনীকে সকল মানুষের অনুসরণীয় আদর্শ নির্ধারণ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلَامُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট মনোনীত একমাত্র দ্বীন হ’ল ইসলাম’ (আলে ইমরান ৩/১৯)। অন্য আয়াতে এসেছে,وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ، ‘আর যে ব্যক্তি ‘ইসলাম’ ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে, তার নিকট থেকে তা কখনোই কবুল করা হবে না’ (আলে ইমরান ৩/৮৫)।
রাসূলের চরিতাদর্শ অনুসরণ সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে,لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে’ (আহযাব ৩৩/২১)।
মহান আল্লাহ মানব সৃষ্টির আগে সকল রূহের নিকট থেকে তাঁকে রব হিসাবে মেনে চলার অঙ্গীকার নিয়েছিলেন। যুগে যুগে আগমনকারী প্রত্যেক রাসূল নিজেদের উম্মাত ও অনুসারীদেরকে সেই অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে গেছেন এবং তাদের থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, ভবিষ্যতে দ্বীন ইসলামের চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা এবং শরী‘আতের পূর্ণাঙ্গ বিধি-বিধান নিয়ে শেষ যে রাসূল আসবেন তোমরা তাঁর অনুসরণ করবে। তোমাদের মধ্যে যে বা যারাই তাঁকে পাবে তার বা তাদের মুক্তি কেবল তাঁরই অনুসরণে মিলবে, অন্য কোন মত কিংবা ধর্ম অনুসরণে নয়। একইভাবে ছোট বড় সকল আসমানী গ্রন্থে তাঁর আগমনের কথা এবং শেষ রাসূল হওয়ার খবর প্রদান করা হয়েছে। এই সৃষ্টি জগতের সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক, আসমান-যমীনের প্রভু আল্লাহ যেহেতু কুরআন মাজীদকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সকল মানুষের জীবনব্যবস্থা বানিয়েছেন, সেহেতু কুরআন মাজীদ হেফাযতের দায়িত্বও তিনি স্বয়ং গ্রহণ করে বলেছেন, إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ، ‘আমরাই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমরাই এর হেফাযতকারী’ (হিজর ১৫/৯)।
একই সাথে তিনি মূর্ত কুরআন মাজীদ অর্থাৎ আখেরী নবী (ছাঃ)-এর চরিতাদর্শ ও জীবনীও সংরক্ষণের বিস্ময়কর ও বিরল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। এজন্য তিনি আখেরী নবী (ছাঃ)-এর সাহচর্য ও বন্ধুত্বের জন্য ছাহাবীদের এমন এক হুঁশিয়ার, গুণগ্রাহী ও মূল্য অনুধাবনকারী জামা‘আত পয়দা করেন যাঁরা আজ থেকে চৌদ্দশত বছর পূর্বে আখেরী নবী (ছাঃ)-এর পবিত্র জীবনী এবং তাঁর সুন্নাহ বা আদর্শ এমন সূক্ষ্মভাবে যাচাই করেছেন, বুঝেছেন এবং মযবূত সনদ সূত্রে খুঁটিনাটি বিষয় পর্যন্ত সংরক্ষণ করে মানবজাতির কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন যে, আজকের ভিডিওগ্রাফির যুগেও তার থেকে বেশী সতর্কতার সাথে কারও জীবনের খুঁটিনাটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় সংরক্ষণ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মিডিয়া, ভিডিওগ্রাফি ও স্যাটেলাইটের এ যুগে দুনিয়ার বড় থেকে বড় কোন শাসনকর্তা, অভিনেতা, ক্রিকেটার, খেলোয়াড় ও নেতার জীবনী প্রযুক্তির এত উন্নতির পরেও আমাদের সামনে সেভাবে সংরক্ষিত নেই, যেভাবে চৌদ্দশত বছর পূর্বে ছাহাবীগণ তাঁদের নবী (ছাঃ)-এর আদর্শ ও জীবনী সংরক্ষণ করে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছিয়েছেন। আখেরী নবী (ছাঃ)-এর জীবনের এক একটি অংশ, এক একটি খন্ড আমাদের সামনে সীরাত ও হাদীছের গ্রন্থগুলোতে সুরক্ষিত অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে। তা পড়লে তাঁকে আমাদের সম্মুখে একজন চলাফেরাকারী জীবন্ত মানুষ বলে খুব পরিষ্কারভাবে অনুভূত হবে। কিভাবে তিনি নখ কাটতেন, খাবার শেষে কোন নিয়মে আঙ্গুল চাটতেন, শোয়ার নিয়ম কেমন ছিল, হাঁটার পদ্ধতি কেমন ছিল মোটকথা তাঁর খানাপিনা, চলাফেরা, ওঠা-বসা ইত্যাদি জীবনের সবকিছুই এক এক অংশ হিসাবে আমাদের সামনে উন্মুক্ত বই আকারে ধরা রয়েছে।
ব্রিটিশ নাগরিক আইজ্যাক মোজেয (ইসহাক মূসা) নামক খৃষ্টীয় ইতিহাসের এক গবেষক ওরিয়েন্টালিস্টদের গবেষণাকেন্দ্র জার্মানীর ‘ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার অব মিউনিখ’-এ ১৯৯৮ খৃষ্টাব্দে ইসলাম ও ইসলামের নবীর বিরোধিতা ও সমালোচনার উপর ভিত্তি করে ‘Hypocrisy of Muhammad’s Followers’ শিরোনামে তার পিএইচ.ডি অভিসন্দর্ভ লেখা শুরু করেন। রিসার্চের মাঝে ব্যাপক অধ্যয়ন তাঁর মস্তিষ্কের জড়তা খুলে দেয়। তিনি তাঁর অভিসন্দর্ভের শিরোনাম পাল্টিয়ে ‘Historical miracle in life biografy of Muhammad and his Followers’ (হিস্টোরিক্যাল মিরাকেল ইন লাইফ বায়োগ্রাফি অব মুহাম্মাদ এন্ড হিজ ফলোয়ার্স) রাখেন। ব্রিটেনের নির্ভরযোগ্য ও বিখ্যাত অনেক পত্রিকায় এই রিসার্চের উপর সম্পাদকীয় লেখা হয়। বিজ্ঞান ও ইতিহাসের জগতে এই লেখা এক ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। কয়েক বছর পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এই গবেষণা প্রবন্ধের সূচনায় ডক্টর ইসহাক মূসা ১৯৬২ সালের এক গবেষণার কথা উল্লেখ করেছেন, যা ডক্টর বেঞ্জামিন জেকব আখেরী রাসূলের সীরাতের উপর করেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে ডক্টর বেঞ্জামিন জেকবও তাঁর রিসার্চ চলাকালে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
ডক্টর ইসহাক মূসা লিখেছেন যে, ডক্টর বেঞ্জামিন জেকবের ১৯৬২ সালের গবেষণা সারা দুনিয়ার বিদ্বানদের মাঝে এ মর্মে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল যে, চৌদ্দশত বছর পূর্বে উট-বকরি চরানো বেদুঈনরা তাদের যাযাবর যুগে ইসলামের নবীর অনুসারী (ছাহাবী) হয়ে কেমন করে নিজেদের নবীর যিন্দেগীকে এত সূক্ষ্মভাবে দেখেছেন, বুঝেছেন ও যাচাই করেছেন! আর চূড়ান্ত সাবধানতার সাথে প্রামাণ্য উৎসসহ সংরক্ষণ করে তা পরবর্তীকালের লোকদের কাছে এমনভাবে পৌঁছিয়ে গেছেন যে, আজও সেসব উৎসমূলে প্রাপ্ত জ্ঞান দ্বারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নবুঅতী জীবনের দিনগুলোর এমন চার্ট তৈরী করা সম্ভব যে, তাঁর প্রথম দিন কি কি কাজে কেটেছে এবং দ্বিতীয় দিন কি কি কাজে অতিবাহিত হয়েছে। ডক্টর ইসহাক মূসা লিখেছেন, ‘কিন্তু আমি আমার রিসার্চকালে জীবনীগ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করে এবং হাদীছ গ্রন্থসমূহ তন্ন তন্ন করে খুঁজে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, ডক্টর বেঞ্জামিনের গবেষণা ছিল অপূর্ণ। আল্লাহর নবীর ছাহাবীগণ নিজেদের নবীর যিন্দেগীকে এত সূক্ষ্মভাবে দেখেছেন, বুঝেছেন ও যাচাই করেছেন এবং চূড়ান্ত সতর্কতার সাথে প্রামাণ্য উৎসসহ আমাদের কাছে এমনভাবে পৌঁছিয়েছেন যে, তা দিয়ে আমরা আল্লাহর রাসূলের দৈনন্দিন জীবনের প্রতি ঘণ্টার চার্ট পর্যন্ত করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ হেরা গুহায় জিবরীল (আঃ)-এর সাথে তাঁর কতক্ষণ ধরে কি কি কথা হয়েছিল? জিবরীলের প্রস্থানের পর হেরা গুহায় তিনি কতক্ষণ দেরী করেছিলেন? হেরা গুহায় কোথায় পা দিয়ে নিচে নেমেছিলেন? কোন রাস্তা ধরে মক্কা মুকাররমায় গিয়েছিলেন? ঘরে হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর সঙ্গে কি কি কথা হয়েছিল? কতক্ষণ চাদর মুড়ি দিয়ে আরাম করেছিলেন? ওয়ারাকা বিন নওফেলের নিকট কোন রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলেন? সেখানে কতক্ষণ ধরে কি কি কথা হয়েছিল? এমনকি মৃত্যুর মুহূর্তের চার্ট পর্যন্তও করা সম্ভব।
যেহেতু অনাদি-অনন্তকালের সর্বময় জ্ঞান যাঁর নিকটে রয়েছে আসমান-যমীনের সেই স্রষ্টা শুধুই এবং শুধুই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মহান সত্তাকে পুরো দুনিয়ার মানুষের জন্য উত্তম আদর্শ (একক ও পূর্ণাঙ্গ রোল মডেল) বানিয়েছেন। তাই তাঁর বাণী ও কর্মকে সর্বপ্রকার কলুষতা এবং শয়তান ও বাতিলের দূষণ থেকে রক্ষার নিমিত্ত মুসলিম উম্মাহর মধ্যে মুহাদ্দিছ, জীবনীকার ও ইতিহাস লেখকদের মত জ্ঞানী-গুণীদের একটি দল সৃষ্টি করেন। যাঁরা এই ব্যবহারিক কুরআন তথা রাসূলের পবিত্র জীবনীকে সকল উল্টো-সিধে, ভালো-মন্দ এবং শয়তানী দাগাবাজি থেকে বাঁচাতে শাস্ত্রের পর শাস্ত্র রচনা করেছেন। যেমন করে বাঙ্ময় কুরআনের বিস্ময় কখনো শেষ হবার নয়, বিলকুল তেমনি করে এই ব্যবহারিক কুরআন রাসূলের পবিত্র জীবনীর বিস্ময়ও কখনো শেষ হবে না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের যতই উৎকর্ষ ও উন্নতি সাধিত হ’তে থাকবে ততই তার বিস্ময় ও আজব দিক বেশী বেশী উন্মোচিত হ’তে থাকবে। কতই না বিস্ময়কর যে, জীবনী লেখকগণ তাঁর ছাগল, উট, ঘোড়া, অস্ত্র-শস্ত্রের বর্ণনার উপর পৃথক পৃথক বই লিখেছেন। এমনকি তাঁর জুতা-স্যান্ডেলের বর্ণনা দিয়েও অনেক বই রচিত হয়েছে।
মাওলানা কালীম ছিদ্দীকী একবার মদীনা মুনাওয়ারায় এক সীরাত লাইব্রেরী পরিদর্শন করেছিলেন। সেখানে তিনি এক আলমারিতে ডক্টর আবদুল জাববার রিফাঈ রচিত একটি গ্রন্থ দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। গ্রন্থটির নাম ‘মু‘জামু মা কুতিবা আনির রাসূলি ওয়া আহলিল বায়ত’ (রাসূল ও তাঁর পরিবারের উপর লিখিত বইসমূহের তালিকা)। এটি ছিল আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত তার পিএইচ.ডি গবেষণার অভিসন্দর্ভ। সম্ভবত গ্রন্থটি ১৮ খন্ডে রচিত। তাতে তিনি কেবল পবিত্র জীবনীর উপর রচিত গ্রন্থসমূহের ফিরিস্তি ও সূচী তৈরি করেছেন। বইয়ের নাম, ভাষা, লেখকের নাম, ঠিকানা, পৃষ্ঠা সংখ্যা, প্রেসে ছাপা না হাতে লেখা, কোথা থেকে বইটি সংগৃহীত তা লেখার পর লেখক দু’চার লাইনে বইয়ের পরিচিতি তুলে ধরেছেন। তালিকায় (রেজিস্টারে) কত বই আছে তার সংখ্যা জানার জন্য মাওলানা কালীম ছিদ্দীকী শেষ খন্ডটি হাতে নেন এবং দেখতে পান যে, সর্বশেষ গ্রন্থের নম্বর ২৯৭৭৪ (ঊনত্রিশ হাযার সাত শত চুহাত্তর)। এ গ্রন্থে ডক্টর আবদুল জাববার পবিত্র সীরাতের সেসব গ্রন্থের পরিচিতি তুলে ধরেছেন যা তিনি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। তন্মধ্যে একটি গ্রন্থ ৮৫ খন্ডে লিপিবদ্ধ ছিল, যাকে ডক্টর ছাহেব একটি গ্রন্থ ধরে হিসাব করেছেন। আরবীতে লেখা সিরিয়ার এক আলেমের একটি বই ছিল, যা শুধু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ‘না‘লাইন’ বা জুতার উপর লেখা হয়েছিল।
এটা ঘটনাচক্রে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা নয়। বরং জগতের স্রষ্টা ও পরিচালক পরওয়ারদিগার স্বীয় নিয়ম-নীতি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বলে সমগ্র মানব জাতির মধ্যে শুধুই এবং শুধুই আখেরী নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মহান সত্তা ও তাঁর চরিতাদর্শকে সর্বকালের সকল দেশের মানবকুলের জন্য একমাত্র রোলমডেল, বরকতময় ও সুন্দর আদর্শ বানানোর সিদ্ধান্ত স্থির করেছিলেন। এজন্যই তাঁর পবিত্র জীবনীকে এমন প্রামাণ্য ও গ্রহণযোগ্য পন্থায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। আখেরী নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর তুলনায় দুনিয়ার বড় বড় নেতৃবৃন্দ, ধর্মপ্রবক্তা, এমনকি নবীদের জীবনীরও হাযার ভাগের একভাগ পর্যন্ত সুরক্ষিত নেই। হযরত ঈসা (আঃ) যিনি নবী করীম (ছাঃ)-এর সবচেয়ে নিকটকালের পয়গম্বর ছিলেন এবং বিজ্ঞান ও গবেষণার দুনিয়ায় সবচেয়ে সভ্য জাতির কাছে প্রেরিত হয়েছিলেন। খোদ সেই খৃষ্টানরাও স্বীকার করেন যে, ঈসা (আঃ)-এর জীবনের খুব সামান্যই জানা যায়।
কিছু ধর্মভীরু খৃষ্টান মনে করেন যে, ঈসা (আঃ)-এর জীবনের শুধুমাত্র আড়াই দিনের বৃত্তান্ত পাওয়া যায় এবং তার শিক্ষারও ৩০%-এর বেশী সুরক্ষিত নেই। জানার এহেন স্বল্পতা হেতু কিছু খৃষ্টানের মনে এই প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে যে, ঈসা ইবনু মারিয়াম নামের কোন লোক আদৌ ছিলেন কি-না? বার্টান্ড রাসেল ও অন্য কয়েকজন পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী এমন প্রশ্নই তুলেছেন। এমনিভাবে হযরত মূসা (আঃ) সম্পর্কে খোদ তাঁর অনুসারী পন্ডিতগণ বলেছেন, তিনি একজন কাল্পনিক ব্যক্তি (নাউযুবিল্লাহ)। এছাড়াও মহাভারত, রামায়ণ ও ভারতীয় অন্যান্য ধর্মের প্রবক্তাদের সম্পর্কে সাধারণত এমন ধারণাই পোষণ করা হয় যে, ওগুলো নাটকের কাল্পনিক চরিত্রবিশেষ। অথচ আল্লাহর আখেরী রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনের নানা দিকই কেবল চূড়ান্ত ঐতিহাসিক প্রমাণ সহকারে বিদ্যমান নেই; বরং তাঁর সাথে সম্পর্কিত সকল কিছুই মহান আল্লাহর ইচ্ছায় সুরক্ষিত আছে। মদীনা মুনাওয়ারায় বসবাসকারী একজন ধর্মীয় চিন্তাবিদ আলেম সকল নবীপত্নীর গৃহের বর্ণনা দিয়ে পুরো একটা বই লিখেছেন। তাতে তিনি ইতিহাসের নিরীখে গৃহগুলোর সাইজ, অবস্থানক্ষেত্র এবং তাদের বিস্তারিত বিবরণ সন্নিবেশিত করেছেন। হযরত আদম (আঃ) থেকে নিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের মধ্যে শুধুই কেবল এক মহান সত্তা রহমাতুল্লিল আলামীন নবীর জীবনী এবং তাঁর জীবনপদ্ধতিকে এভাবে প্রামাণ্য বরাত সহকারে সংরক্ষণ এ কথারই প্রমাণ বহন করে যে, জগৎসমূহের স্রষ্টা ও মালিক শুধুই এবং শুধুই তাঁর মহান সত্তাকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী মানবকুলের জন্য বিশ্বব্যাপী একক রোলমডেল ও সুন্দরতম আদর্শ করে সৃষ্টি করেছেন। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুসারে শুধুই তাঁর মহান সত্তাকে একক রোল মডেল ও সুন্দরতম আদর্শ করেছেন, সেহেতু পুরো মানবজাতির মধ্যে তাঁর মহান সত্তার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য তাঁকে ‘বিশ্ববাসীর প্রতি রহমত’ করে পয়দা করেছেন। তিনি বলেছেন,وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِيْنَ، ‘আমরা তো তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য কেবল রহমত হিসাবেই প্রেরণ করেছি’ (আম্বিয়া ২১/১০৭)।
ভারতের বিখ্যাত ইসলাম প্রচারক মাওলানা কালিম ছিদ্দীকী বলেন যে, তাঁর মুরশিদ সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) বলতেন, মহান আল্লাহর সৃষ্টির মাহাত্ম্য দেখুন, আল্লাহ তা‘আলা কোটি কোটি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, যাদের আকৃতি, মেযাজ, রুচি পৃথক পৃথক, তাদের দৃষ্টি, বাচনভঙ্গি এমনকি শোনাশুনির রুচি পর্যন্ত পৃথক। আমাদের এলাকায় ফর্সা রং পসন্দনীয়, আবার আফ্রিকার দেশগুলোতে চটকদার কালো রংকে কমনীয় ও আকর্ষণীয় ভাবা হয়। কেউ মিষ্টি পসন্দ করে তো অন্য কেউ তিতা পসন্দ করে, কারো একজনের চেহারা ভালো লাগলেও অন্যজন আবার আরেকজনকে পসন্দ করে। একইভাবে মানুষে মানুষে মানসিক রুচিবোধেও তারতম্য ঘটে। বিদ্যা মানুষের দামী অলঙ্কার। তারপরও দুনিয়াতে এমন মানুষও পাওয়া যাবে যাদের লেখাপড়া জানা মানুষের প্রতি বিদ্বেষ আছে। দানশীলতা মানুষের একটি মর্যাদাপূর্ণ গুণ, কিন্তু এই দুনিয়াতে এমন কৃপণও আছে যারা অন্যের দান-দক্ষিণাতেও এলার্জি বোধ করে। কিন্তু সারা দুনিয়া খুঁজে এমন একটা লোকও মিলবে না যার দয়া-অনুকম্পা পসন্দ নয়, দয়া-অনুকম্পা লাভ থেকে তার মন দূরে থাকতে চায় কিংবা দয়া-অনুকম্পা দেখে এলার্জি বোধ হয়। তাই আল্লাহ তাঁর রাসূল (ছাঃ)-কে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত বানিয়ে পাঠিয়েছেন। যাতে সারা দুনিয়ার প্রত্যেকটি মানুষ তাঁর সত্তা, তাঁর চরিত্র এবং তাঁর পবিত্র জীবনীর প্রতি মোহমুগ্ধ হয় এবং আকর্ষণ বোধ করে।
সেই ব্যক্তি বড়ই ভাগ্যবান, আল্লাহর রহমতে যিনি রাসূল (ছাঃ)-এর বিশ্বব্যাপী দয়ালু সত্তার পরিচয় পেয়েছেন, তাঁর প্রতি ঈমান এনেছেন এবং তাঁর নবুঅতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রেখেছেন। এই জাতি ও উম্মাহকে ‘শ্রেষ্ঠ উম্মাত’-এর পদমর্যাদা দিয়ে তাদের উপর এই পদকেন্দ্রিক দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পণ করা হয়েছে। যাতে তারা পুরো মানববিশ্ব জুড়ে বিশ্ববাসীর জন্য করুণাময় রাসূল (ছাঃ), তাঁর শিক্ষা ও তাঁর দ্বীনের পরিচিতি তুলে ধরার কাজ চালিয়ে যায়। তাঁর মাধ্যমে অবতীর্ণ রহমত ও করুণাকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়। আফসোস! এই উম্মত বর্তমানে শ্রেষ্ঠ উম্মত পদের প্রতি এমন অপরাধযোগ্য উদাসীনতা দেখিয়ে চলছে যে রহমতপূর্ণ রাসূল, তাঁর শিক্ষা এবং তাঁর আনীত দ্বীনকে অন্যদের কাছে পৌঁছানো তো দূরে থাক নিজেরাই তাঁর রহমতপূর্ণ জীবন ও চরিত্র থেকে উদাসীন থাকার দরুন বিশ্ব মানবতা ও রহমতপূর্ণ রাসূলের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা সমগ্র মানব জাতির জন্য প্রেরিত হেদায়াতনামা বা পথনির্দেশ বাঙময় কুরআন যাকে খোদ কুরআন সমগ্র মানবজাতির পথনির্দেশ বলেছেন, তার উপর এতটাই যুলুম-অবিচার করেছি যে, তাকে শুধু মুসলিম জাতির ধর্মীয় গ্রন্থ বলে পরিচিত করিয়েছি। একইভাবে ব্যবহারিক কুরআন রাসূলে রহমত (ছাঃ)-কে স্রেফ মুসলমানদের রাসূল আখ্যা দিয়েছি। অথচ না কুরআন মাজীদের কোথাও আছে, না রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কোন বাণীতে এ কথা বলা হয়েছে যে, কুরআন শুধুই মুসলিমদের জন্য এসেছে এবং তা কেবল তাদের ধর্মগ্রন্থ। কুরআন তো বরং পুরো বিশ্বের মানুষের জন্য পথনির্দেশ। মুহাম্মাদ (ছাঃ)ও শুধু মুসলমানদের রাসূল নন। খোদ কুরআন যেখানে তাঁর পরিচয় তুলে ধরেছে সেখানে তাঁকে সমগ্র মানব জাতির রাসূল বলে আখ্যায়িত করেছে। এরশাদ হয়েছে, قُلْ يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا ‘তুমি বল, হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল’ (আ‘রাফ ৭/১৫৮) অন্যত্র এসেছে,وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا، ‘আর আমরা তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য (জান্নাতের) সুসংবাদদাতা ও (জাহান্নামের) ভয় প্রদর্শনকারী হিসাবে প্রেরণ করেছি’ (সাবা ৩৪/২৮)।
সমগ্র মানবজাতির অধিকার ক্ষুণন করে এবং কুরআন ও সীরাতের সাথে এরূপ অপরাধপূর্ণ আচরণ করে আমরা শুধুই নিজেদের শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার সম্মান খোয়াইনি, বরং সমগ্র মানবজাতিকে কুরআন ও সীরাতের খায়ের-বরকত থেকেও বঞ্চিত করেছি। যে কারণে মানবজাতি কুরআন মাজীদকে মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ এবং নবীয়ে রহমত (ছাঃ)-কে মুসলিম জাতির পথপ্রদর্শক, মহাপুরুষ ও নেতা মনে করে। আজ তাঁর রেখে যাওয়া দাওয়াতের প্রতি আমাদের অপরাধভরা উদাসীনতা, আমাদের আমল-আখলাক এবং বাতিল, শয়তানী ও ত্বাগূতী প্রচার মাধ্যমের অহর্নিশ বিরূপ প্রোপাগান্ডার ফলে তাঁকে এমন এক জাতির রাসূল মনে করা হয় যারা তাদের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসী, জঙ্গি, যালেম ও মূর্খ জাতি বলে বিবেচিত। অতএব কেন তারা এক কুখ্যাত জাতির বীরপুরুষ, নেতা ও রাসূলকে এবং তাদের ধর্মীয় গ্রন্থকে বুঝা, পড়া ও মানার জন্য চেষ্টা করবে?
বিভিন্ন ভাষায় কুরআন মাজীদের যেভাবে অনুবাদ ও তাফসীর হয়েছে, তাকে সত্যই বিস্ময় মানতে হয়। কিন্তু তা সত্তেবও দুর্ভাগ্যবশত এমন অনুবাদ ও তাফসীর ইসলামী পাঠাগারগুলোতে খুব কমই মিলবে যা দাওয়াত ও প্রচারের ময়দানে সক্রিয় আলেমদের হাতে লেখা হয়েছে এবং যা কোন দাওয়াতদানের জন্য উদ্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে তুলে দিয়ে একজন দাওয়াতদাতা এই মর্মে তৃপ্ত হবেন যে, আমি তার মান-মর্যাদা, বোধ-বুদ্ধি, আক্বীদা-বিশ্বাস, সমাজ-জামা‘আতের প্রতি লক্ষ্য রেখে তার মাতৃভাষায় তার কাছে কুরআন মাজীদ পৌঁছাতে পেরেছি। একইভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবনী বিষয়ক এমন বইও খুব দুষ্প্রাপ্য যা দাওয়াতদানের জন্য উদ্দিষ্ট অমুসলিম ভাইকে দিয়ে দিল আশ্বস্ত হ’তে পারে যে, আমি একজন তার মেযাজ ও বোধ অনুযায়ী নবীজীবনী তার কাছে পৌঁছিয়েছি।
এটা কাকতালীয়ই বলি, আর শ্রেষ্ঠ উম্মত বা দাওয়াতদাতা উম্মতের উদাসীনতাই বলি, রাসূলের পবিত্র জীবনীর উপর এত বিস্ময়কর কাজ হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ বই পড়ে পাঠক বেশীর থেকে বেশী এটাই অনুভব করতে পারে যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছিলেন একজন সফল যোদ্ধা, সেনাপতি ও শাসক- যিনি বিস্ময়করভাবে বিশ্ব-ভূমন্ডল জয় করে ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেছিলেন এবং তৎকালীন বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ অবধি তাঁর রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল। অথচ শ্রেষ্ঠ উম্মতের, বিশেষত ওলামায়ে উম্মতের দায়িত্ব ছিল আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসাবে সারা দুনিয়ার মানুষের নিকট তাঁর পরিচয় তুলে ধরা এবং তাঁর শিক্ষা ও সত্য দ্বীন তাদের নিকট পৌঁছানো।
এটা খুবই প্রয়োজন ছিল যে, কুরআন ও সীরাত সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় এমনভাবে সাধারণ দৃশ্যপটে নিয়ে আসতে হবে, যাতে কুরআন শুধু মুসলমানদের দ্বীনী গ্রন্থ এবং আল্লাহর আখেরী রাসূল (ছাঃ) শুধুই মুসলমানদের রাসূল মনে করার মতো ভ্রান্ত ধারণা শুধু মুসলমানদের থেকেই দূরীভূত হবে না বরং অমুসলিমরাও তাতে কুরআন ও নবী করীম (ছাঃ)-এর আসল পরিচয়, প্রকৃত শিক্ষা এবং রহমত ভরা জীবনের সন্ধান পাবে। তার থেকেও বড় কথা অমুসলিম ভাইদের নিকট কুরআন ও সীরাত পাকের আসল পরিচয় পৌঁছে যাবে। আল্লাহর রাসূলের হেদায়াতমূলক কর্মকান্ড জানা ও মানার জন্যই এমন গ্রন্থ রচনা করা এবং পাঠ করা একান্ত দরকার। তাতে আল্লাহ চাহেন তো তারা কুরআন ও সুন্নাহর ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করবে। আললাহ আমাদের এ লক্ষ্যে কাজ করার তাওফীক দিন-আমীন!
[মাওলানা কালীম ছিদ্দীকী রচিত ‘গায়ের মুসলিমূঁ মেঁ সীরাত পাক কা তা‘আরুফ করানা ভি দাওয়াতী যিম্মাদারী হায়’ (অমুসলিমদের মাঝেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সীরাত তুলে ধরা দাওয়াতী দায়িত্ব) প্রবন্ধ অবলম্বনে রচিত। সূত্র: মাসিক আরমুগান (উর্দূ), জানুয়ারী, ২০২১ সংখ্যা। ফুলাত, মুযাফ্ফরনগর, ইউপি, ইন্ডিয়া। www.armughan.net]
মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ঝিনাইদহ।