আল্লাহ নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও বিশ্বজগতের দৃশ্য-অদৃশ্য সবকিছুর স্রষ্টা, পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা ও একমাত্র উপাস্য। সকল সৃষ্ট বস্ত্তর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হ’ল এক আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য স্বীকার করে স্ব স্ব অবস্থানে বিচরণ করা। সৃষ্টির সেরা মানব জাতিকে আল্লাহর অনুগত থেকে ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْن-
‘আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি’(যারিয়াত ৫১/৫৬)।
এই অমূল্য বাণীর মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে ইবাদতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য। আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে শুধু সৃষ্টির শ্রেষ্ঠই নয় বরং তাঁর প্রতিনিধি হিসাবেও সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। অতঃপর এই প্রতিনিধিত্বকে ঐতিহাসিক সম্মানে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্যে সৃষ্টির প্রথম মানব আদম (আঃ)-কে ফেরেশতাকূল কর্তৃক সিজদা করান। এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত ফেরেশতা মন্ডলীকে আদম (আঃ)-এর প্রতি সিজদা করার আদেশ করেন। একমাত্র ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদায় অংশগ্রহণ করে। ইবলীস আদেশ অমান্য করে শয়তানে পরিণত হয়। অতঃপর স্বেচ্ছায় মানব জাতির ক্ষতি সাধনের জন্য ব্রতী হয়।
শয়তানের প্রার্থনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তাকে কিছু ক্ষমতা প্রদান করেছেন। এই ক্ষমতা প্রদানের বিষয় মানব জাতিকে পুরোপুরিভাবে অবহিত করা হয়েছে এবং তার শত্রুতা হ’তে সাবধান থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু এই শয়তানের কারণেই ইবাদতের ব্যাপারে মানবজাতির মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়। আর এই ভাঙ্গন প্রতিরোধ কল্পে আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে মানব সম্প্রদায়ের হেদায়াতের জন্য নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। সর্বশেষে প্রেরিত হয়েছেন আমাদের মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। যিনি বিশ্বনবী, শ্রেষ্ঠ নবী ও নবীকূলের সর্দার। তাঁর প্রতি নাযিল হয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে মানব জাতির ইবাদত ছাড়াও নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের মধ্যস্থিত সৃষ্ট বস্ত্তগুলোর ইবাদতের বর্ণনা রয়েছে। মানব জাতি ছাড়া দৃশ্য-অদৃশ্য সকল বস্ত্তই আল্লাহ্কে সিজদা করে। সৌভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীর অলীক মোহে পথভ্রষ্ট ও পথহারা হতভাগ্য মানব গোষ্ঠীকে হেদায়াত ও জ্ঞান প্রদানের প্রয়াসেই পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এদের আনুগত্য প্রকাশের পদ্ধতির বিশদ বিবরণ বিধৃত হয়েছে। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন,
سَبَّحَ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ-
‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করে। তিনি পরাক্রমশালী মহাজ্ঞানী’ (হাশর ৫৯/১; ছফ ৬১/১)।
অন্যত্র তিনি বলেন,
سَبَّحَ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ- لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يُحْيِيْ وَيُمِيْتُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ-
‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে। তিনি শক্তিধর প্রজ্ঞাময়। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব তাঁরই। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। তিনি সবকিছু করতে সক্ষম’ (হাদীদ ৫৭/১, ২)।
আল্লাহ আরো বলেন,
تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالأَرْضُ وَمَنْ فِيْهِنَّ وَإِن مِّنْ شَيْءٍ إِلاَّ يُسَبِّحُ بِحَمْدَهِ وَلَـكِن لاَّ تَفْقَهُوْنَ تَسْبِيْحَهُمْ إِنَّهُ كَانَ حَلِيْماً غَفُوْراً-
‘সপ্ত আকাশ ও পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে সমস্ত কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না। কিন্তু তাদের পবিত্রতা, মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না। নিশ্চয়ই তিনি অতি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৪৪)।
আল্লাহ তা‘আলা শুধু তাঁর ইবাদতের জন্য মানব সৃষ্টি করে যেমন তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তেমনি ইবাদতকে মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক কর্তব্য স্থির করায় তারা সকলেই আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে বা আল্লাহর অনুগত থাকে। উপরের আয়াতগুলোতে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের মধ্যস্থিত সকল সৃষ্ট বস্ত্তর আল্লাহর প্রতি পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণার পুনরুল্লেখ রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য সৃষ্ট বস্ত্তর প্রতি ইবাদত ও আনুগত্যের আদেশ না থাকা সত্ত্বেও তারা স্ব স্ব অবস্থান থেকেই আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, এর কারণ কি? সঠিক উত্তর একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন। তবে পবিত্র কুরআনের বাণী হ’তেই জানা যায় সকল সৃষ্টির আনুগত্য। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অতীব প্রিয় মানব জাতিকে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ সহ বহুমূখী উৎস হ’তে শিক্ষা বা জ্ঞান দান করতে চান। তাই উপরোল্লেখিত আয়াতগুলো উক্ত শিক্ষারই অংশবিশেষ। পবিত্র কুরআনে এরূপ বহু আয়াতের অবতারণা হয়েছে, যা মানুষের জন্য অতীব শিক্ষণীয়।
নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের মধ্যবর্তী সৃষ্টবস্ত্তর আল্লাহর প্রতি আনুগত্যে বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। যার কিছু মানুষের ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এ বিষয়ে মহান আল্লাহর প্রত্যাদেশ বাণী হ’ল,
وَلِلّهِ يَسْجُدُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ مِنْ دَآبَّةٍ وَالْمَلآئِكَةُ وَهُمْ لاَ يَسْتَكْبِرُوْنَ-
‘আল্লাহ্কে সিজদা করে যা কিছু নভোমন্ডলে আছে এবং যা কিছু ভূমন্ডলে আছে এবং ফেরেশতাগণ, তারা অহংকার করে না’ (নাহল ১৬/৪৯)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَلِلّهِ يَسْجُدُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ طَوْعاً وَكَرْهاً وَظِلالُهُم بِالْغُدُوِّ وَالآصَالِ-
‘আল্লাহ্কে সিজদা করে যা কিছু নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে আছে ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় এবং তাদের প্রতিচ্ছায়াও সকাল-সন্ধ্যায়। একই মর্মার্থে আল্লাহ আরো প্রত্যাদেশ করেন,
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يَسْجُدُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ وَالنُّجُوْمُ وَالْجِبَالُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ وَكَثِيْرٌ مِّنَ النَّاسِ وَكَثِيْرٌ حَقَّ عَلَيْهِ الْعَذَابُ وَمَنْ يُهِنِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِن مُّكْرِمٍ إِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يَشَاءُ-
‘আপনি কি দেখেননি যে, আল্লাহ্কে সিজদা করে যা কিছু আছে নভোমন্ডলে, যা কিছু আছে ভূমন্ডলে, সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, পর্বতরাজি, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু এবং অনেক মানুষ। আবার অনেকের উপর অবধারিত হয়েছে শান্তি। আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করেন, তাকে কেউ সম্মান দিতে পারে না। আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন’ (হজ্জ ২২/১৮)।
আলোচ্য সিজদায় ছোট-বড় সকলের অংশগ্রহণ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ يَسْجُدَانِ ‘তৃণলতা ও বৃক্ষাদি সিজদারত আছে’ (আর-রাহমান ৫৫/৬)।
উল্লেখ্য, মানব জাতির ইবাদতের শ্রেষ্ঠাংশ হ’ল ‘সিজদা’। আর সিজদার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। এই সিজদার বিষয়াদি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সৃষ্টির সকল বস্ত্ত আল্লাহ্কে সিজদা করে। অতঃপর পৃথক পৃথকভাবে সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, বৃক্ষ লতাপাতা ইত্যাদিও সিজদা করে। এটা মানব জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উপরোক্ত আয়াতগুলোতে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের মধ্যবর্তী ছোট-বড় সকল বস্ত্ত আল্লাহ্কে সিজদা করে বলে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনের এই সত্য বাণীর প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগী তথা আস্থাশীল হ’তে হবে।
সৃষ্টির সকল বস্ত্ত যদি আল্লাহ্কে সিজদা করে, তবে সকল মানুষের সিজদায় আপত্তি কোথায়? এ আপত্তিতে শয়তানই মূখ্য ভূমিকা পালন করে। এজন্য সর্বজ্ঞানী আল্লাহ তা‘আলা শয়তানকে মানুষের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। শয়তান মানুষকে সর্বদা ভ্রান্ত পথে চলার পরামর্শ দেয় এবং পৃথিবীর জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশের প্রতি আকৃষ্ট করে। এতে অনেকেই পথভ্রষ্ট হয়ে ইবাদতে অংশগ্রহণ করে না। মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৎপথ প্রদর্শনের জন্যই সকল সৃষ্টির সিজদা ও আনুগত্যের বাণী সমূহ পবিত্র কুরআনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা পর্যায়ে প্রত্যাদেশ করেছেন। আলোচ্য বিষয়ে পবিত্র কুরআনের বাণী হ’ল, يُسَبِّحُ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ الْمَلِكِ الْقُدُّوْسِ الْعَزِيْزِ الْحَكِيْمِ- রাজ্যাধিপতি, পরাক্রমশালী আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে, যা কিছু আছে নভোমন্ডলে ও যা কিছু আছে ভূমন্ডলে’ (জুম‘আ ৬২/১)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
يُسَبِّحُ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ- هُوَ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَمِنْكُم مُّؤْمِنٌ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ-
‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে। রাজত্ব তাঁরই এবং প্রশংসা তাঁরই। তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ কাফের এবং কেউ মুমিন। তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখেন’ (তাগাবূন ৬৪/১-২)।
আলোচ্য বিষয়ে অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,
وَلَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَنْ عِنْدَهُ لَا يَسْتَكْبِرُوْنَ عَنْ عِبَادَتِهِ وَلَا يَسْتَحْسِرُوْنَ- يُسَبِّحُوْنَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ لَا يَفْتُرُوْنَ-
‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যারা আছে, তারা তাঁরই। আর যারা তাঁর সান্নিধ্যে আছে তারা তাঁর ইবাদতে অহংকার করে না এবং অলসতাও করে না। তারা রাত্রি দিন তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করে এবং ক্লান্ত হয় না’ (আম্বিয়া ২১/১৯-২০)।
মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব (ছাঃ)-কে প্রত্যাদেশ করেন,
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يُسَبِّحُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالطَّيْرُ صَافَّاتٍ كُلٌّ قَدْ عَلِمَ صَلَاتَهُ وَتَسْبِيْحَهُ وَاللَّهُ عَلِيْمٌ بِمَا يَفْعَلُوْنَ-
‘আপনি কি দেখেন না যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যারা আছে, তারা এবং উড়ন্ত পক্ষীকুল তাদের পাখা বিস্তার করতঃ আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে? প্রত্যেকেই তার যোগ্য ইবাদত এবং পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণার পদ্ধতি জানে। তারা যা করে, আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত’ (নূর ২৪/৪১)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,
أَوَلَمْ يَرَوْاْ إِلَى مَا خَلَقَ اللّهُ مِنْ شَيْءٍ يَتَفَيَّأُ ظِلاَلُهُ عَنِ الْيَمِيْنِ وَالْشَّمَآئِلِ سُجَّداً لِلّهِ وَهُمْ دَاخِرُوْنَ-
‘তারা কি আল্লাহর সৃজিত বস্ত্ত দেখে না, যার ছায়া আল্লাহর প্রতি বিনীতভাবে সেজদাবনত থেকে ডান ও বাম দিকে ঝুঁকে পড়ে?’ (নাহল ১৬/৪৮)।
মনে রাখা দরকার যে, সৃষ্টির সকল বস্ত্তই আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, আবার সিজদা হ’তেও বিরত থাকে না কেউ। এতদ্ব্যতীত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নানা প্রক্রিয়ার অনুসরণ করে যা সর্বজন বিদিত নয়।
মানুষকে তার শ্রেষ্ঠ আসনে অধিষ্টিত রাখতে এবং আল্লাহর ইচ্ছার নিকট পরিপূর্ণভাবে সমর্পিত হ’তেই উপরের আয়াতগুলোর অবতারণা। কৌতুহলী মানুষের আরও জ্ঞান সম্প্রসারণের জন্য আকাশের বায়ুমন্ডলে বিচরণশীল পক্ষীকূলের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। উড়ন্ত পাখীরা তাদের ডানা বিস্তারের বা উড়ার সময় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং সকলেই আল্লাহর প্রশংসার উপযোগী পদ্ধতি জানে। সুতরাং সৃষ্টির সকল প্রাণীই আল্লাহর ইবাদত বা প্রশংসার উপযোগী পদ্ধতি জানে। এমনকি জড় বস্ত্তরাও আল্লাহর প্রশংসা ও মহিমা ঘোষণা করে। এমতাবস্থায় অজুহাত খাড়া করার মত কোন যুক্তিই মানুষের নেই। আর সেজন্যই আল্লাহ তা‘আলা এতদসম্পর্কিত বিভিন্ন আয়াত দ্বারা মানব জাতিকে বুঝাতে চেয়েছেন।
সকল সৃষ্টির জন্য ক্বিয়ামতের উপস্থিতি অপরিহার্য। সেদিন মানুষ অতীত জীবনকে খুব সামান্যই উপলব্ধি করবে। কারণ সামনে মৃত্যুহীন জীবন দেখে, হতাশা ব্যক্ত করে পেছনপানে চাইলে তা সামান্যই মনে হবে। বাস্তব জীবনেও যদি কোন ৮০/৯০ বা ১০০ বৎসর বয়সী জ্ঞানী পুরুষ বা মহিলাকে জিজ্ঞেস করা হয় তবে সেও বলবে, খুব স্বল্প সময়েই তার জীবন অতিবাহিত হয়ে গেল। আর ক্বিয়ামতের ঘটনা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যাপার। ইহজগতে যার কোন তুলনাই নেই এবং মানুষেরও কল্পনাতীত।
ক্বিয়ামতের উপস্থিতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
إِنْ كُلُّ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ إِلَّا آتِي الرَّحْمَنِ عَبْداً- لَقَدْ أَحْصَاهُمْ وَعَدَّهُمْ عَدّاً- وَكُلُّهُمْ آتِيهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَرْداً-
‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে কেউ নেই যে, দয়াময় আল্লাহর কাছে দাস হয়ে উপস্থিত হবে। তাঁর কাছে তাদের পরিসংখ্যান রয়েছে এবং তিনি তাদেরকে গণনা করে রেখেছেন। ক্বিয়ামতের দিন তাদের সবাই তাঁর কাছে একাকী অবস্থায় আসবে’ (মারইয়াম ১৯/৯৩-৯৫)।
সকল সৃষ্ট বস্ত্তর সঙ্গে মানুষকেও একদিন আল্লাহর নিকট ফিরে যেতে হবে। তখন শুধু অনুগত দলই ফিরে যাবে তা নয়, সকলকেই বাধ্যতামূলকভাবে ফিরে যেতে হবে। এমনকি সকলকে দাস দাসী অবস্থায় উপস্থিত হ’তে হবে। অনুগত মানব গোষ্ঠী মহা আনন্দে আল্লাহর দরবারে হাযির হবে। অপরপক্ষে শুধু অবাধ্য ও সীমালংঘণকারী দল লজ্জিত ও অপমানিত অবস্থায় আল্লাহর দরবারে হাযির হবে। অতঃপর প্রত্যেককে একাকী অবস্থায় হাযিরা দিতে হবে। এজন্য মানব জাতিকে তাদের যেকোন দ্বিধা-দ্বন্ধ বা কলা-কৌশল হ’তে বিরত থেকে পবিত্র জ্ঞান অর্জন ও হিদায়াত লাভের উদ্দেশ্যে সৃষ্টির আনুগত্যের আয়াতগুলো অনুসরণ করতে হবে। কারণ আল্লাহর সম্মুখে একাকী হাযিরা দেওয়ার অগ্নিপরীক্ষায় একমাত্র আল্লাহ্কে গ্রহণকারীরাই বিজয়ী হবে। অপরদিকে অবিশ্বাসী ও সীমালংঘণকারীরা লজ্জায় ও অপমানে মাটিতে মিশে যেতে চাইবে এবং আল্লাহর নিকট বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য প্রার্থী হবে। এই মহাসত্য ঘটনার কবল হ’তে নিষ্কৃতি লাভের অন্যতম উপায় হিসাবে পবিত্র কুরআনে বহু আদেশ, নির্দেশ ও পরামর্শ এসেছে। যেমন আল্লাহ বলেন,
فَسُبْحَانَ اللَّهِ حِيْنَ تُمْسُوْنَ وَحِيْنَ تُصْبِحُوْنَ- وَلَهُ الْحَمْدُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَعَشِيّاً وَحِيْنَ تُظْهِرُوْنَ-
‘অতএব তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা স্মরণ কর সন্ধ্যায় ও সকালে এবং অপরাহেণ ও মধ্যাহেণ। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে একমাত্র তাঁরই প্রশংসা’ (রূম ৩০/১৭-১৮)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
ادْعُواْ رَبَّكُمْ تَضَرُّعاً وَخُفْيَةً إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِيْنَ-
‘তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাক, কাকুতি-মিনতি করে এবং সংগোপনে। তিনি সীমা অতিক্রমকারীদেরকে পসন্দ করেন না’ (আ‘রাফ ৭/৫৫)।
উপরের আয়াত তিনটি দ্বারা শ্রেষ্ঠ মানব সম্প্রদায়কে আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা স্মরণ করার উদাত্ত আহবান জানানো হয়েছে। কারণ ইতিপূর্বের আলোচনায় নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের মধ্যবর্তী সকল সৃষ্ট বস্ত্তর আল্লাহর প্রতি নিবিড় আনুগত্য পাওয়া গিয়েছে।
বিশেষত ইহকাল ও পরকাল কোনক্রমেই এড়িয়ে যাওয়ার না। কারণ নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও মানব সৃষ্টির পূর্বে ইহকাল ও পরকাল একত্রেই কেন্দ্রীভূত ছিল। অতঃপর মানব সৃষ্টির পর এক অজ্ঞাত কারণে সাময়িকভাবে ইহকালের সৃষ্টি হয়, যা এক নির্দিষ্ট মেয়াদ পর পুনরায় একত্রীভূত হওয়ার প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ। এই প্রতিশ্রুতি স্বয়ং মহা পরাক্রমশালী মহান আল্লাহ তা‘আলার ঘোষিত বাণী। এই বাণীতে ইহকালের যৎসামান্যই মূল্য দেয়া হয়েছে এবং এর (ইহকালের) সময়কালকেও একটা স্বল্পকালীন সময়, এমনকি পরকালের তুলনায় কিছুক্ষণ বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। অপরদিকে পরকালকে এক স্থায়ী সূদীর্ঘ ও অনন্তকাল বলে অভিহিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহর সত্য বিধান অনুযায়ী ইহজগতে আগত প্রতিটি মানব নর-নারীকে ইহকাল হ’তে পাড়ি জমিয়ে পরকালে পৌঁছতে হবে। এই ইহকাল ও পরকালের মধ্যস্থলে এক নির্ধারিত সময় আছে, যার নাম ক্বিয়ামত। ক্বিয়ামত দিবসের ভয়ঙ্কর দৃশ্য, অকল্পনীয় ধ্বংসলীলা, অবর্ণনীয় হতাশা, চতুর্দিকে মহানিনাদ পাপীদের জন্য হবে এক মহা সংকট আর সীমালংঘণকারী কাফেরদের জন্য ধ্বংস অনিবার্য।
যেহেতু মানুষকে শুধু ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে, অতঃপর ইবাদত পালনকারীদের পুরষ্কার প্রদান এবং (ইবাদত) অমান্যকারীদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থারও ঘোষণা রয়েছে। তাই যথাসময়ে ইহকালের সমাপ্তি ঘটিয়ে ক্বিয়ামতের আগমন, অতঃপর পরকালীন জীবনের পুরষ্কার ও শাস্তির ব্যবস্থার সূত্রপাত হবে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَأَنِ اسْتَغْفِرُواْ رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُواْ إِلَيْهِ يُمَتِّعْكُم مَّتَاعاً حَسَناً إِلَى أَجَلٍ مُّسَمًّى وَيُؤْتِ كُلَّ ذِي فَضْلٍ فَضْلَهُ وَإِن تَوَلَّوْاْ فَإِنِّيَ أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ كَبِيْرٍ-
‘তোমরা নিজেদের পালনকর্তা সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অনন্তর তাঁরই প্রতি মনোনিবেশ কর। তাহ’লে তিনি তোমাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উৎকৃষ্ট জীবনোপকরণ দান করবেন এবং অধিক আমলকারীকে বেশী করে দিবেন। আর যদি তোমরা বিমুখ হ’তে থাক, তবে আমি তোমাদের উপর এক মহা দিবসের আযাবের আশঙ্কা করছি’।
একই বিষয়ে আরও অধিক গুরুত্ব সহকারে অন্তর্যামী আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যাদেশ করেন,
أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاء اللَّيْلِ سَاجِداً وَقَائِماً يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِيْنَ يَعْلَمُوْنَ وَالَّذِيْنَ لَا يَعْلَمُوْنَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُوْلُوا الْأَلْبَابِ-
‘যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সেজদার মাধ্যমে অথবা দাঁড়িয়ে ইবাদত করে, পরকালের আশংকা রাখে এবং তার পালনকর্তার রহমত প্রত্যাশা করে, সেকি তার সমান, যে এরূপ করে না, বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান হ’তে পারে? চিন্তাভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান’ (যুমার ৩৯/৯)।
সকল সৃষ্টির ইবাদত ও আনুগত্যের আলোচনায় মানবের ইবাদত প্রক্রিয়ার কিয়দাংশ উপরের আয়াতগুলিতে দেখানো হয়েছে। মানুষ যেমন সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ, তার ইবাদত পদ্ধতিও শ্রেষ্ঠ। মহা প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় মানব জাতিকে সম্মান ও মর্যাদার শীর্ষে পৌঁছানোর জন্য সকল সৃষ্টির ইবাদত কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। শয়তান তার দূরভিসন্ধির সাফল্য অর্জনে পৃথিবীর আড়ম্বরপূর্ণ ভোগ্যপন্য দ্বারা পরকালের প্রকৃত চিত্রকে আড়াল করে রাখে। ফলে বহু চিন্তাহীন, বিবেকহীন ও অদূরদর্শী ব্যক্তি পরকালের প্রতি উদাসীন হয়ে ইবাদত-বন্দেগীর কথা ভুলে যায়। পক্ষান্তরে বহু চিন্তাশীল, বিবেকবান ও দূরদর্শী ব্যক্তিবর্গের (মতে) জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, ভোগবিলাস শান্তি-শৃংখলা, প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা ইত্যাদি নে‘মতের প্রতি আকর্ষণ বা ভালবাসা পারলৌকিক স্থায়ী জীবনের নে‘মতের প্রতি আকৃষ্ট করে এবং (তারা) উপরোক্ত আয়াতের অনুরূপ ইবাদতে আত্মনিয়োগ করে।
বিশেষ লক্ষ্যণীয় যে, নভোমন্ডল ভূমন্ডল ও এতদুভয়স্থ সকল দৃশ্য ও অদৃশ্য বস্ত্তর ইবাদত, আনুগত্য ও আনুগত্য পদ্ধতির দো‘আ সম্পূর্ণরূপে আমাদের ধারণাতীত। দূরবর্তী মহাকাশ সমূহ, কোটি কোটি নক্ষত্র, গ্রহ, তারকা, সূর্য-চন্দ্র, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর, বৃক্ষলতা, পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদির ইবাদত ও আনুগত্য বার্তা বা মহাসংবাদ ধর্মভীরু, আল্লাহভীরু, ঈমানদার বান্দার ঈমান বৃদ্ধিতে যারপর নাই আস্থা গড়ে তুলে। অপরদিকে সীমালংঘণকারী, অবিশ্বাসী ও কাফের সম্প্রদায়েরও দীর্ঘ জীবদ্দশায় অনেকের বোধোদয় হ’তে পারে। এজন্যে আলোচ্য বিষয়ের উপর আলোচনা ও সমালোচনার উপযোগিতা অনস্বীকার্য। মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে তাঁর মনোনীত, নির্দেশিত ও পসন্দনীয় পথে চলার তওফীক দান করুন। আমীন!
রফীক আহমাদ
শিক্ষক (অবঃ), বিরামপুর, দিনাজপুর।