পর্ব ১ । পর্ব ২ । শেষ পর্ব 

শয়তানই মানুষকে গুমরাহ বা পথভ্রষ্ট করে

মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য শয়তান আল্লাহর সাথে চ্যালেঞ্জ করেছে। তাই সর্বদা সে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। সে তার প্রচেষ্টা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন পথ-পন্থা ও কৌশল অবলম্বন করে। অন্মধ্যে নিম্নে কতিপয় উল্লেখ করা হ’ল।-

১. মানুষের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করা :

শয়তান ইসলামের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ও আল্লাহ সম্পর্কে মানুষের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

جَاءَ نَاسٌ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَسَأَلُوهُ إِنَّا نَجِدُ فِى أَنْفُسِنَا مَا يَتَعَاظَمُ أَحَدُنَا أَنْ يَتَكَلَّمَ بِهِ. قَالَ وَقَدْ وَجَدْتُمُوْهُ، قَالُوا نَعَمْ. قَالَ ذَاكَ صَرِيحُ الْإِيمَانِ-

‘ছাহাবাদের একদল লোক রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল যে, আমরা আমাদের অন্তরে কখনো এমন বিষয় অনুভব করি, যা মুখে উচ্চারণ করা আমাদের কাছে খুব কঠিন ঠেকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, সত্যিই কি তোমরা এ রকম পেয়ে থাক? তারা বললেন, হ্যাঁ, আমরা এ রকম অনুভব করে থাকি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এটি ঈমানের প্রকাশ্য প্রমাণ’।[1] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন,

يَأْتِي الشَّيْطَانُ أَحَدَكُمْ فَيَقُوْلُ مَنْ خَلَقَ كَذَا مَنْ خَلَقَ كَذَا حَتَّى يَقُولَ مَنْ خَلَقَ رَبَّكَ فَإِذَا بَلَغَهُ فَلْيَسْتَعِذْ بِاللَّهِ وَلْيَنْتَهِ-

‘তোমাদের একজনের কাছে শয়তান এসে বলে, কে এটি সৃষ্টি করেছে? কে ঐটি সৃষ্টি করেছে? এক পর্যায়ে সে বলে, কে তোমার প্রতিপালককে সৃষ্টি করেছে? তোমাদের কারও অবস্থা এ রকম হ’লে সে যেন শয়তানের কুমন্ত্রণা হ’তে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায় এবং এ রকম চিন্তা-ভাবনা করা হ’তে বিরত থাকে’।[2]

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘শয়তান আদম সন্তানের রক্তনালীতেও চলাচল করতে পারে। আমার আশংকা হ’ল, হয়তো শয়তান চলাচল করে তোমাদের মনে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করে দেবে’।[3]

আবার মানুষ যখন ছালাতের জন্য ওযূ করে অথবা ছালাত আদায় করতে আরম্ভ করে তখন শয়তান মানুষের মনে এমন সন্দেহ সৃষ্টি করে যেন তার ওযূ নষ্ট হয়ে গেছে। এ অবস্থায় শব্দ শুনা বা গন্ধ না পাওয়া পর্যন্ত ওযূ করতে হবে না। একদা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হ’ল যে, তার মনে হয়েছিল যেন ছালাতের মধ্যে কিছু বের হয়ে গিয়েছিল। তিনি বললেন, ‘সে যেন ফিরে না যায়, যতক্ষণ না শব্দ শুনে বা দুর্গন্ধ পায়’।[4]

এভাবে শয়তান মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে। মানুষ এভাবে যতই খারাপ চিন্তা করুক না কেন এজন্য তাকে পাকড়াও করা হবে না বা কোন গুনাহ লিখা হবে না যতক্ষণ না সে এগুলি বাস্তবায়ন করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

إِنَّ اللهَ تَجَاوَزَ لِي عَنْ أُمَّتِي مَا وَسْوَسَتْ بِهِ صُدُوْرُهَا مَا لَمْ تَعْمَلْ أَوْ تَكَلَّمْ-

‘আমলে পরিণত করা অথবা এটা মুখে উচ্চারণ না করা পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা আমার উম্মতের মনের ওয়াসওয়াসাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন’।[5]

২. মানুষকে দুনিয়ার চাকচিক্যের দিকে আকৃষ্ট করা :

দুনিয়া মানুষের জন্য ক্ষণস্থায়ী বাসস্থান হ’লেও শয়তান দুনিয়াকে বিভিন্নভাবে সৌন্দর্যমন্ডিত করে দুনিয়ার বিভিন্ন চাকচিক্যের দিকে মানুষদেরকে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে পথভ্রষ্ট করে। আদ ও ছামূদ জাতিকে শয়তান চাকচিক্যের মধ্যে ফেলে ধ্বংস করেছে। আল্লাহ বলেন,

وَعَاداً وَثَمُوْدَ وَقَد تَّبَيَّنَ لَكُمْ مِّنْ مَّسَاكِنِهِمْ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ فَصَدَّهُمْ عَنِ السَّبِيْلِ وَكَانُوْا مُسْتَبْصِرِيْنَ-

‘আমি আদ ও ছামূদকে ধ্বংস করেছি। তাদের বাড়ী-ঘর থেকেই তাদের অবস্থা তোমাদের জানা হয়ে গেছে। শয়তান তাদের কর্মকে তাদের দৃষ্টিতে সুশোভিত করেছিল, অতঃপর তাদেরকে সৎপথ অবলম্বনে বাধা দিয়েছিল এবং তারা ছিল হুঁশিয়ার’ (আনকাবূত ২৯/৩৮)

সাবা জনপদের অধিবাসীদেরকে শয়তান চাকচিক্যে ফেলে শিরক করিয়েছিল। যেমন হুদহুদ পাখি বলেছিল, وَجَدتُّهَا وَقَوْمَهَا يَسْجُدُوْنَ لِلشَّمْسِ مِنْ دُوْنِ اللهِ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ فَصَدَّهُمْ عَنِ السَّبِيْلِ فَهُمْ لاَ يَهْتَدُوْنَ- ‘আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যাবলী সুশোভিত করে দিয়েছে। অতঃপর তাদেরকে সৎপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে। অতএব তারা সৎপথ পায় না’ (নামল ২৭/২৪)

বদর যুদ্ধের দিন ইবলীস মানুষ রূপে কাফেরদের কাছে এসে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আল্লাহ বলেন,

وَإِذْ زَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ وَقَالَ لاَ غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّيْ جَارٌ لَّكُمْ فَلَمَّا تَرَاءَتِ الْفِئَتَانِ نَكَصَ عَلَى عَقِبَيْهِ وَقَالَ إِنِّيْ بَرِيْءٌ مِّنْكُمْ إِنِّيْ أَرَى مَا لاَ تَرَوْنَ إِنِّيْ أَخَافُ اللهَ وَاللهُ شَدِيْدُ الْعِقَابِ-

‘আর যখন সুদৃশ্য করে দিল শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপকে এবং বলল যে, আজকের দিনে কোন মানুষই তোমাদের উপর বিজয়ী হ’তে পারবে না। আর আমি হ’লাম তোমাদের সমর্থক। অতঃপর যখন সামনাসামনি হ’ল উভয় বাহিনী তখন সে অতি দ্রুতপায়ে পেছনে পালিয়ে গেল এবং বলল, আমি তোমাদের সাথে নেই। আমি দেখছি, যা তোমরা দেখছ না; আমি ভয় করি আল্লাহকে। আর আল্লাহর আযাব অত্যন্ত কঠিন’ (আনফাল ৮/৪৮)

সকল যুগে সকল মানুষকে শয়তান দুনিয়ার সেŠন্দর্য ও চাকচিক্যেরের প্রতি আকৃষ্ট করে এবং বিভিন্ন পাপে লিপ্ত করে। আল্লাহ বলেন, تَاللهِ لَقَدْ أَرْسَلْنَا إِلَى أُمَمٍ مِّنْ قَبْلِكَ فَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ فَهُوَ وَلِيُّهُمُ الْيَوْمَ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ- ‘আল্লাহর কসম! আমি আপনার পূর্বে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি, অতঃপর শয়তান তাদের কর্মসমূহ শোভনীয় করে দেখিয়েছে। আজ সে-ই তাদের অভিভাবক এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (নাহল ১৬/৬৩)

আর শয়তান আল্লাহর কাছেই মানুষকে দুনিয়ার চাকচিক্যে ফেলে গোমরাহ করার ওয়াদা করে এসেছিল।

قَالَ رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِيْ لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِيْنَ، إِلاَّ عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِيْنَ-

‘সে বলল, হে আমার পালনকর্তা! আপনি যেমন আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করব এবং তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করব। আপনার একনিষ্ঠ বান্দাদের ব্যতীত’ (হিজর ১৫/৩৯-৪০)

৩. শিরকের প্রচলন করা :

পৃথিবীতে প্রথম শিরকের প্রচলন হয়েছিল নূহ (আঃ)-এর কওমের মধ্যে। এটা হয়েছিল শয়তানের প্ররোচনা ও বুযর্গ লোকদের প্রতি অতি মাত্রায় ভালবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। নূহ (আঃ)-এর কওমের বুযর্গ লোকদের মৃত্যুর পর শয়তান ঐ কওমের লোকদের প্ররোচিত করল তারা যেন ঐ সব বুযর্গগণ যেসব আসরে বসতেন সেখানে তাদের প্রতিমা বানিয়ে রাখে এবং তাদের নামে এগুলোর নামকরণ করে। তারা তাই করল। তবে সে সময় এগুলোর উপাসনা করা হ’ত না। এসব লোক মৃত্যুবরণ করার পর ক্রমান্বয়ে তাওহীদের জ্ঞান বিস্মৃত হ’ল, তখন এগুলোর উপাসনা ও পূজা হ’তে লাগল।[6]

ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, তখনকার যুগে নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের প্রতি শয়তান এ কুমন্ত্রণা দেয় যে, এরা যে স্থানে বসতেন তোমরা সে সব স্থানে কিছু মূর্তি নির্মাণ করে তাদের নামে সে সবের নামকরণ করে দাও। তখন তারা তাই করে। তখনও কিন্তু এগুলির পূজা শুরু হয়নি। তারপর তাদের মৃত্যু হয় এবং ইলম লোপ পায়। অতঃপর সেসবের পূজা শুরু হয়। কোন কোন মুফাসসিরের মতে, আদম ও নূহ (আঃ)-এর মধ্যবর্তী কালে কয়েকজন পুণ্যবান লোক ছিল তাদের বেশ কিছু অনুসারীও ছিল। তারপর যখন তাদের মৃত্যু হয় তখন তাদের অনুসারীরা বলল, আমরা যদি তাদের প্রতিকৃতি তৈরী করে রাখি তাহ’লে তাদের কথা স্মরণ করে ইবাদতে আমাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। যখন তাদের মৃত্যু হয় এবং অন্য প্রজন্ম আসে তখন শয়তান তাদের প্রতি এ বলে প্ররোচনা দেয় যে, তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের উপাসনা করত এবং তাদের অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করত। তখন তারা তাদের পূজা শুরু করে দেয়।[7] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ বলেন,

وَإِنِّى خَلَقْتُ عِبَادِى حُنَفَاءَ كُلَّهُمْ وَإِنَّهُمْ أَتَتْهُمُ الشَّيَاطِيْنُ فَاجْتَالَتْهُمْ عَنْ دِينِهِمْ-

‘আমি আমার বান্দাদেরকে ‘হানীফ’ অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ রূপে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর শয়তান তার পিছে লেগে তাকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে নিয়ে যায়’।[8]

৪. বিদ‘আত চালু করা :

বিদ‘আত সুন্নাতের বিপরীত আমল এবং ইবাদতের নামে ইসলামের মধ্যে নতুন সংযোজন। বিদ‘আতকারীর কোন আমল আল্লাহর নিকট কবুল হবে না[9] এবং আখেরাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শাফা‘আত ও কাওছারের পানি থেকে বঞ্চিত হবে।[10] তাই একজন বিদ‘আতীর জাহান্নামে যাওয়ার সম্ভাবনা সাধারণ গোনাহগারের চেয়ে বেশী। তাই শয়তান সমাজে বিদ‘আত চালু করতে চায়। সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, اَلْبِدْعَةُ أَحَبُّ إِلَى إِبْلِيْسَ مِنَ الْمَعْـصِيَةِ، اَلْمَعْـصِيَةُ يُتَابُ مِنْهَا، وَالْبِدْعَةُ لاَ يُتَابُ مِنْهَا- ‘ইবলীসের কাছে গোনাহ ও পাপাচারের চেয়ে বিদ‘আত বেশী প্রিয়। কারণ গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তির তওবা করার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু বিদ‘আতে লিপ্ত ব্যক্তির তওবা করার সম্ভাবনা থাকে না’।[11]

৫. রাগাম্বিত করা :

রাগ মানুষের একটি খারাপ গুণ। রাগের কারণে মানুষ যে কোন অন্যায় করতে পারে। আর রাগ আসে শয়তানের পক্ষ থেকে। সুলায়মান ইবনু ছুরাদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (ছাঃ)-এর সঙ্গে উপবিষ্ট ছিলাম। তখন দু’জন লোক গালাগালি করছিল। তাদের একজনের চেহারা লাল হয়ে গিয়েছিল এবং তার রগগুলো ফুলে গিয়েছিল। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, আমি এমন একটি দো‘আ জানি, যদি এই লোকটি তা পড়ে তবে তার রাগ দূর হয়ে যাবে। সে যদি পড়ে ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানি’ তবে তার রাগ চলে যাবে। তখন লোকেরা তাকে বলল, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, তুমি আল্লাহর নিকট শয়তান থেকে আশ্রয় চাও। সে বলল, আমি কি পাগল হয়েছি’।[12]

৬. অলসতা :

ইংরেজীতে একটি কথা আছে, An idle brain is the devil’s workshop. ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’। শয়তান মানুষকে গুমরাহ করার জন্য কর্মবিমুখ ও অলস করে তোলে। বিশেষ করে দ্বীনের কাজের ক্ষেত্রে অলস করে তোলে এবং দুনিয়াবী ও খারাপ কাজে উৎসাহিত করে। মানুষ ঘুমালে ফজর ছালাত কাযা করার জন্য চেষ্টা করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ ঘুমায় শয়তান তার মাথার পিছন দিকে তিনটি গিরা দেয় এবং প্রত্যেক গিরার উপর মোহর মেরে বা থাবা মেরে বলে, রাত অনেক আছে তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও। যদি সে জাগে ও দো‘আ পড়ে তাহ’লে একটি গিরা খুলে যায়। তারপর যদি সে ওযূ করে তাহ’লে আরও একটি গিরা খুলে যায়। তারপর যদি সে ছালাত আদায় করে তবে অপর গিরাটিও খুলে যায় এবং সে সকালে প্রফুল্ল­ মন ও পবিত্র অন্তরে সকাল করে। অন্যথা সে সকালে উঠে কলুষিত অন্তর ও অলস মনে’।[13]

৭. পরস্পর তর্কের মাধ্যমে ঝগড়া লাগানো ও আল্লাহ সম্পর্কে এমন কথা বলা যা সে জানে না :

শয়তান মানুষের মাঝে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে এবং আস্তে আস্তে তর্ক ঝগড়ায় রূপ নেয়। আল্লাহ বলেন,

وَإِنَّ الشَّيَاطِيْنَ لَيُوْحُوْنَ إِلَى أَوْلِيَآئِهِمْ لِيُجَادِلُوْكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوْهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُوْنَ-

‘নিশ্চয়ই শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে প্রত্যাদেশ করে, যেন তারা তোমাদের সাথে তর্ক করে। যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তোমরাও মুশরিক হয়ে যাবে’ (আন‘আম ৬/১২১)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُّجَادِلُ فِي اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّبِعُ كُلَّ شَيْطَانٍ مَّرِيْدٍ- ‘কতক মানুষ অজ্ঞতাবশতঃ আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করে এবং প্রত্যেক অবাধ্য শয়তানের অনুসরণ করেন’ (হজ্জ্ব ২২/৩)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يَأْمُرُكُمْ بِالسُّوءِ وَالْفَحْشَاءِ وَأَنْ تَقُوْلُوْا عَلَى اللهِ مَا لاَ تَعْلَمُوْنَ. ‘নিশ্চয়ই সে তোমাদেরকে মন্দ ও অশ্লীল কাজের আদেশ দেয় এবং আল্লাহ সম্পর্কে এমন কথা বলে যা তোমরা জান না’ (বাক্বারাহ ২/১৬৯)

৮. পাপকাজের চাকচিক্য দেখিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান করানো :

বদর যুদ্ধের দিন কাফেরদের সাথে গায়িকা মেয়েরা ছিল এবং তারা গানবাজনাও করছিল। শয়তান তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। সে তাদেরকে মিষ্টি কথা দিয়ে ভুলাচ্ছিল এবং তাদের কার্যাবলী তাদের দৃষ্টিতে খুব চাকচিক্যময় ও শোভনীয় করে দেখাচ্ছিল। তাদের কানে কানে সে বলছিল, ‘তোমাদেরকে কে পরাজিত করতে পারে? আমি তোমাদের সাহায্যকারী হিসাবে রয়েছি’। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

وَإِذْ زَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ وَقَالَ لاَ غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّيْ جَارٌ لَّكُمْ-

‘যখন শয়তান তাদের কার্যাবলীকে তাদের দৃষ্টিতে খুব চাকচিক্যময় ও শোভনীয় করে দেখাচ্ছিল, তখন সে গর্বভরে বলেছিল, কোন মানুষই আজ তোমাদের উপর বিজয় লাভ করতে পারবে না, আমি সাহায্যার্থে তোমাদের নিকটেই থাকব’ (আনফাল ৮/৪৮)

৯. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সম্পর্কে অতিরঞ্জিত কথা চালু করা :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মুহাববত করতে হবে সেভাবে যেভাবে তিনি শিক্ষা দিয়েছেন। শয়তান মাঝে মাঝে এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সম্পর্কে এমন কথা চালু করে, যা তিনি বলতে নিষেধ করেছেন। যেমন কতিপয় লোক রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলল, হে আমাদের রাসূল, হে আমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তি ও সর্বোত্তমের সন্তান, আমাদের প্রভু, আমাদের প্রভু তনয়! তখন তিনি বললেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ عَلَيْكُمْ بِتَقْوَاكُمْ وَلَا يَسْتَهْوِيَنَّكُمْ الشَّيْطَانُ أَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ وَاللَّهِ مَا أُحِبُّ أَنْ تَرْفَعُوْنِي فَوْقَ مَنْزِلَتِي الَّتِي أَنْزَلَنِي اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ-

‘হে লোকসকল! তোমরা তোমাদের কথা বলে যাও। শয়তান যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করতে না পারে। আমি হচ্ছি মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আল্লাহ আমাকে যে মর্যাদার স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন, তোমরা এর ঊর্ধ্বে আমাকে স্থান দাও এটা আমি পসন্দ করি না’।[14]

অন্য হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কতিপয় ছাহাবী তাঁকে বলল, আপনি আমাদের প্রভু। তদুত্তরে তিনি বললেন, ‘বরকতময় মহান আল্লাহই হ’লেন একমাত্র প্রভু’। আর তারা যখন বললেন, আপনি আমাদের মধ্যে মর্যাদার দিক দিয়ে সর্বোত্তম এবং আমাদের মধ্যে সর্বাধিক দানশীল। তখন তিনি বললেন, ‘তোমরা যা বলছিলে বলে যাও। শয়তান যেন তোমাদের উপর সওয়ার না হ’তে পারে’।[15]

১০. গণক বা যাদুর মাধ্যমে বিভ্রান্ত করা :

একদল শয়তান আকাশ থেকে ফেরেশতাদের কথা শুনার জন্য তাঁদের নির্ধারিত স্থানে গমন করে এবং চুরি করে কিছু শুনেও ফেলে। তাদের মধ্যে যারা উপরে থাকে তারা তাদের নীচে অবস্থানকারীদেরকে তা বলে দেয়। এভাবে ঐ কথাগুলো দুনিয়ায় চলে আসে এবং গণক যাদুকরদের কানে পৌঁছে যায়। আর গণক ও যাদুকররা সেই একটি সত্য কথার সাথে আরো দশটি মিথ্যা কথা বলে প্রচার করে। আর যখন একটি কথা সত্যে পরিণত হয় তখন তাদের কদর বেড়ে যায় ও মানুষ সেদিকে আকৃষ্ট হয়। ঐ শয়তান জিনদের জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে। কিন্তু তার পূর্বেই কিছু কিছু খবর তারা দুনিয়ায় পৌঁছে দেয়। কখনো কখনো আবার খবর পৌঁছানোর আগেই তারা জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,

وَلَقَدْ جَعَلْنَا فِي السَّمَاء بُرُوجاً وَّزَيَّنَّاهَا لِلنَّاظِرِيْنَ- وَحَفِظْنَاهَا مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ رَّجِيْمٍ- إِلاَّ مَنِ اسْتَرَقَ السَّمْعَ فَأَتْبَعَهُ شِهَابٌ مُّبِيْنٌ-

‘আমি আকাশে রাশিচক্র বানিয়েছি এবং ওকে দর্শকদের চোখে সৌন্দর্যময় জিনিস করেছি। প্রত্যেক বিতাড়িত শয়তান হ’তে ওকে রক্ষিত রেখেছি। যে কেউ কোন কথা চুরি করে শুনবার চেষ্টা করে তার পশ্চাদ্ধাবন করে এক তীক্ষ্ণ অগ্নিশিখা’ (হিজর ১৫/১৬-১৮)

 [চলবে]

মুহাম্মাদ আবদুল ওয়াদূদ

তুলাগাঁও, সুলতানপুর, দেবিদ্বার, কুমিল্লা।


[1]. মুসলিম, ‘ঈমান‘ অধ্যায়, ‘অন্তরের ওয়াসওয়াসা‘ অনুচ্ছেদ

[2]. বুখারী, ‘সৃষ্টির সূচনা’ অধ্যায়, ‘ইবলীস ও তার সৈন্যদের আলোচনা‘ অনুচ্ছেদ হা/৩২৭৬; মুসলিম হা/১৩৪; মিশকাত হা/৬৫

[3]. বুখারী হা/২০৩৫ ‘ই‘তিক্বাদ’ অধ্যায়; মুসলিম হা/২১৭৫; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/১৮৪৯

[4]. বুখারী হা/১৭৭ ‘ওযূ’ অধ্যায়; মুসলিম হা/৩৬১

[5]. বুখারী হা/২৫২৮ ‘ইতক‘ অধ্যায়, ‘তালাক ও আযাদ করার ক্ষেত্রে ভুল-ত্রুটি’ অনুচ্ছেদ; মুসলিম ‘ঈমান‘ অধ্যায়; মিশকাত হা/৬৩

[6]. বুখারী হা/৪৯২০

[7]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৪৬-১৪৭

[8]. মুসলিম হা/২৮৬৫ ‘জান্নাতের বিবরণ’ অধ্যায়; আহমাদ হা/১৬৮৩৭

[9]. মুসলিম হা/১৭১৮; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/১৬৪৬, ১৬৯।

[10]. মুসলিম হা/৪২৪৩

[11]. শাত্বেবী, আল-ই‘তিছাম ১/১১৯; সুয়ূতী, আল-আমরু বিল ইত্তিবা, পৃঃ ১৯

[12]. বুখারী হা/৩২৮২ ‘সৃষ্টি সূচনা’ অধ্যায়; মুসলিম হা/২৬১০

[13]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১২১৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১১৫১

[14]. আহমাদ হা/১২৫৭৪; সিলসিলাহ ছহীহাহ হা১৫৭২

[15]. আবূদাঊদ হা/৪৮০৬ ‘আদব’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৪৯০১, হাদীছ ছহীহ






বিষয়সমূহ: সৃষ্টিজগৎ
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা - মীযানুর রহমান মাদানী
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম (২য় কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
এক নযরে হজ্জ - আত-তাহরীক ডেস্ক
নিয়মের রাজত্ব (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (৪র্থ কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
মুনাফিকী (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
গীবত : পরিণাম ও প্রতিকার (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
দাওয়াতের ক্ষেত্র ও আধুনিক মাধ্যম সমূহ (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
হজ্জকে কবুলযোগ্য করার উপায় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আহলেহাদীছদের রাজনীতি : ইমারত ও খেলাফত - ড. নূরুল ইসলাম
হারাম দৃষ্টিপাতের ভয়াবহতা - সুরাইয়া বিনতে মামূনুর রশীদ
আরও
আরও
.