৮.
১৫ই আগস্ট, বুধবার। বেলা ৯-টায় মতীউর রহমান ভাই আমাদেরকে নিয়ে গেলেন হোটেল হিলটন কনভেনশন সেন্টারে। সকাল ৯-টা থেকে সঊদী হজ্জ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘বার্ষিক গ্রান্ড হজ্জ কনফারেন্স ১৪৩৯হিঃ’ শুরু হয়েছে। সঊদী আরব সহ বহির্বিশ্বের অনেক মেহমান উপস্থিত হয়েছেন। পূর্ব নির্ধারিত বিষয়সমূহের উপর আলোচনা চলছে। হজ্জের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর এর প্রভাব সম্পর্কে আলোচকগণ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করলেন। যোহরের ছালাতের বিরতিতে আববা সঊদী আরবের হজ্জ ও ওমরাহ মন্ত্রী ড. মুহাম্মাদ ছালিহ বিন তাহির বিনতান, হাইয়াতু কিবারিল উলামার সদস্য ড. সা‘দ বিন নাছির আশ-শাতরী, বাহরাইনের শারঈ আদালতের প্রধান বিচারপতি ড. আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ আল-হাই, জমঈয়তে আহলেহাদীছ জম্মু-কাশ্মীরের সেক্রেটারী ড. আব্দুল লতীফ আল-কিন্দী প্রমুখের সাথে সাক্ষাৎ, পরিচয়পর্ব এবং কুশল বিনিময় করলেন। অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ এই পর্বটিই সবচেয়ে আনন্দঘন ছিল। যোহরের ছালাতের পর বক্তব্য রাখলেন হারামাইনের প্রেসিডেন্ট এবং কা‘বার সম্মানিত ইমাম শায়খ আব্দুর রহমান আস-সুদাইস। শান্ত ভঙ্গিতে এবং আকর্ষণীয় ভাষায় বক্তব্য রাখলেন আধা ঘন্টা। অতঃপর বিদায়ের সময় পথিমধ্যে তাঁর সাথে আববার সাক্ষাৎ এবং কুশল বিনিময় হ’ল। সুললিত কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত আর আবেগময় দো‘আ কুনুতে বিমোহিত করে তোলা এই মহান ব্যক্তিত্বের এত কাছাকাছি এসে বুকটা তোলপাড় করতে থাকে। ছোটখাট, নাদুস-নুদুস এই মানুষটার কন্ঠে আল্লাহ কি জাদুই না দিয়েছেন। মাসজিদুল হারামের ইমামতিতে তাঁকে পাওয়া মানেই পুরো ছালাত জুড়ে তন্ময়তায় ঘিরে থাকা। প্রতি রাক‘আতে তিনি হজ্জ সংক্রান্ত আয়াতগুলিই বেছে নিতেন। তেলাওয়াত করতে করতে কখনও তাঁর কন্ঠস্বর কান্নায় বুঁজে আসত। আর তা সংক্রমিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ত লাখো মুছল্লীর হৃদয়তন্ত্রীতে। তাবৎ দুনিয়ার আধ্যাত্মিক মুসাফিরদের এই মিলনমেলায় শায়খ সুদাইসের এই মুখলিছানা কণ্ঠস্বর যেন এক বাড়তি সওগাত হয়ে আসে।
অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা হ’লে হোটেল রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে নেই। খাওয়া শেষে আববার পায়ে হঠাৎ ব্যথা শুরু হয়ে এমন অবস্থা হ’ল যে এক পাও চলা সম্ভব হচ্ছিল না। মতি ভাই তার হোটেলরুমে নিয়ে গেলেন এবং আমরা গরম পানি দিয়ে আববার পায়ে সেক দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। মাগরিবের পর নাজীব বাসা থেকে আনা কিছু ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করল। তবুও কোন কিছুতেই ব্যথা কমল না। এশার ছালাত পর্যন্ত সেখানেই বিশ্রাম নিলেন। অবশেষে কিছুটা সুস্থ বোধ করলে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। মতি ভাইয়ের রুমে ছিলেন যাত্রাবাড়ী মাদরাসার শিক্ষক টাঙ্গাইলের ইবরাহীম ভাই। তিনি আববার প্রাক্তন ছাত্র। পরে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফারেগ হয়ে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় শায়খ আকমাল ভাইয়ের সাথে দাঈ হিসাবে কর্মরত ছিলেন। পরে দেশে ফিরে তিনি এখন যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় শিক্ষকতা করছেন। তিনিও এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন।
হিলটন হোটেলে থাকা অবস্থায় মতি ভাইয়ের মোবাইলে আববার সাথে সৌজন্য আলাপ হয় কুয়েতের এহয়াইউত তুরাছের পরিচালক শায়খ তারিক সামী আল-ঈসা এবং কর্মকর্তা আবূ খালেদ আল-মুতাইরীর সাথে। আরও আলাপ হয় ভারতের বিশিষ্ট মুহাক্কিক ও গবেষক শায়খ উযাইর শামস্ এবং দাম্মাম ইসলামিক সেন্টারের খ্যাতনামা বাংলাভাষী দাঈ শায়খ মতীউর রহমান মাদানীর সাথে। শায়খ মতীউর রহমান মাদানী হজ্জের পরে মক্কায় আসবেন এবং সে সময় সাক্ষাৎ করবেন বলে জানালেন। শায়খ উযাইর শাম্স আববার থিসিসের উর্দূ অনুবাদ সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন শুনে আমরা খুশী হ’লাম। সে বিষয়ে কিছু আলাপ হ’ল। তিনি বিশেষ করে প্রাচীন আরবী পান্ডুলিপিসমূহের ওপর দীর্ঘদিন যাবৎ গবেষণা করছেন। এ পর্যন্ত তাঁর তাহকীক ও সম্পাদনায় ত্রিশোর্ধ মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং তাঁর মত অভিজ্ঞ ব্যক্তির এই দায়িত্ব গ্রহণ করাটা সত্যিই আনন্দের বিষয়। আল্লাহ তাঁর মেহনত কবূল করুন- আমীন!
পরদিন ১৬ই আগস্ট মক্কার হাই আন-নাসীমে সাক্ষাৎ হ’ল বাহরাইনের ডেপুটি স্পিকার ও পার্লামেন্ট সদস্য আদেল আল-মুআওয়াদাহর ভ্রাতা ও জমঈয়াতুত তারবিয়াহ আল-ইসলামিয়াহর কর্মকর্তা শায়খ জাসেম আল-মুআওয়াদাহ এবং বাহরাইনের জাস্টিস এ্যান্ড ইসলামিক এ্যাফেয়ার্স মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকতা ড. নাছের মুহাম্মাদ লোরীর সাথে। শায়খ নাছের লোরী অনেক আগে নববইয়ের দশকে বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং আববা ও আব্দুল মতীন সালাফী চাচার সাথে তখন বেশ কিছু জনকল্যাণমূণক প্রকল্পে কাজ করেছিলেন। রাজবাড়ী যেলার রঘুনাথপুর গ্রামের মসজিদটি তাঁর সংস্থারই দেয়া। মসজিদটি পরিদর্শনের জন্য একবার আববার সাথে তিনি ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন। কিন্তু আরিচা ঘাটে এসে গাড়ী নষ্ট হওয়ায় তাঁরা আর যেতে পারেননি বলে জানালেন আববা। এতদিন পর আববার সাথে সাক্ষাৎ হওয়ায় তিনি অত্যন্ত খুশী হ’লেন। হজ্জ উপলক্ষে তাঁর সাথে আগত প্রায় ৩০ জন সহযাত্রীর উদ্দেশ্যে আববা আরবীতে বক্তব্য রাখলেন এবং বাংলাদেশের আহলেহাদীছদের সম্পর্কে অবগত করালেন। তাঁর আমন্ত্রণে আমরা সেখানে একত্রে রাতের খাবার গ্রহণ করলাম। অতঃপর সেখান থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে ফিরলাম।
পরদিন ১৭ই আগস্ট শুক্রবার সকাল ১০-টার দিকে জুম‘আর ছালাত আদায় করার উদ্দেশ্যে বের হ’লাম। মাসজিদুল হারামের অভ্যন্তরভাগ ততক্ষণে পূর্ণ হয়ে গেছে। সাড়ে দশটার মধ্যে হারামের মূল গেটগুলো বন্ধ হয়ে গেল। আমরা চতুর্থ তলার ছাদসংলগ্ন বারান্দায় অবস্থান নিলাম। যথাসময়ে খুৎবা শুরু হ’ল। হজ্জের ফযীলত ও আনুসঙ্গিক বিষয়ে নিয়মমাফিক সংক্ষিপ্ত, পরিমিত অথচ সারগর্ভ বক্তব্য। তবে খত্বীবের নাম জানা গেল না। জুম‘আর ছালাতের পর উন্মুক্ত ছাদ থেকে বায়তুল্লাহ এবং বায়তুল্লাহকে ঘিরে তাওয়াফের সুপরিচিত দৃশ্য দেখলাম। আঠার মত দৃষ্টি আটকে থাকে সেদিকে। সেই কত সহস্র বছরের ইতিহাস আজও চিরসজীব হয়ে আছে এই ঘরকে কেন্দ্র করে। ইবরাহীম (আঃ)-এর দো‘আর বরকতে সেই যে শুরু হ’ল তাওয়াফ, তা আজ অবধি বিরামহীনভাবে চলমান। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্ত থেকে কত শত মানুষ এসে যোগ দিচ্ছে এই বরকতের মহাসাগরে ডুবে ডুবে মণি-মানিক্য আহরণের অন্তহীন প্রতিযোগিতায়-প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। সুবহানাল্লাহ!
এবার হজ্জে বিভিন্ন কাফেলায় আমার ছোট খালা-খালু, দুই চাচাতো ভাইসহ আমাদের বেশ কয়েকজন নিকটাত্মীয় এসেছিলেন। তারা হোটেলে এসে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। এছাড়া সংগঠনের বিভিন্ন যেলার প্রতিনিধিদের অনেকেই এসেছিলেন। যেমন কুমিল্লার মাওলানা শরাফত আলী, মেহেরপুরের মোশারর্ফ হোসেন প্রমুখ। এক রাতে সাতক্ষীরার হাজী আব্দুর রহমান, আব্দুল লতীফ, আব্দুল ওয়াদূদসহ আব্দুল মান্নান চাচার কাফেলার প্রায় ২০ জন এসে সাক্ষাৎ করলেন। এভাবে অনেক পরিচিত মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হ’ল হজ্জে এসে, যাদের অনেকের সাথেই দীর্ঘদিন যোগাযোগ হয়নি। এ ক’দিন আমরা সাধারণত হিলটন হোটেলের ৪র্থ তলায় আবূ বকর মসজিদে বাদ আছর থেকে এশা পর্যন্ত অবস্থান করতাম। সংগঠনের কর্মী এবং শুভাকাঙ্ক্ষীগণ অনেকেই এখানে সাক্ষাৎ করতে আসতেন। নেপালী ৩ জন ভাই ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু ভাই একদিন আসলেন। আববা তাদের উদ্দেশ্যে উর্দূতে বক্তব্য রাখলেন। এরপর একদিন এলেন ঢাকার নর্দা জামে মসজিদের খত্বীব ড. ইমাম হোসেন। সালাফী আক্বীদা ও মানহাজের প্রচার ও প্রসারে তিনি সাম্প্রতিককালে বেশ জোরালো ভূমিকা রাখছেন মাশাআল্লাহ। এ বিষয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা হ’ল তাঁর সাথে। আল্লাহ তাঁকে কবূল করুন- আমীন!
৯.
১৮ই সেপ্টেম্বর। হজ্জের মূল কার্যক্রম তথা মীনায় যাত্রার জন্য প্রস্ত্ততি নিতে সারাদিন অতিক্রান্ত হ’ল। বিশেষ ভিসায় হজ্জে আসায় মু‘আল্লিম পেতেও বিশেষ ব্যবস্থাপনার আশ্রয় নিতে হয়েছে এবং তাতে যথেষ্ট ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। এদিন রাত ৯-টায় আমরা ইহরামের কাপড় পরিধান করে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম। ফুরকান রোডের ইসকানে অবস্থিত মু‘আল্লিমের অফিসে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়। এই মু‘আল্লিমের তত্ত্বাবধানে যারা রয়েছেন তারা সবাই ‘ফুরাদা’ তথা কোন এজেন্সির সাহায্য ছাড়া স্ব স্ব ব্যবস্থাপনায় বিচ্ছিন্নভাবে আগত। ফলে আমাদের এই দলে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ তথা পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, মালদ্বীপ ছাড়াও সিরিয়া ও লেবাননের কিছু আরব হজ্জযাত্রী রয়েছেন। সবমিলিয়ে বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের মিশেলে এক বিচিত্র দল।
শুরুতেই অব্যবস্থাপনা দেখতে পাই। রাত অনেকটা গড়িয়ে যায় কিন্তু বাস আসে না। পাকিস্তানী হাজীদের কয়েকজন তো ক্ষুব্ধ হয়ে রীতিমত সড়ক আটকে বসে পড়ে। তাতে বেশ কাজও হয়। অবশেষ রাত ৩-টায় আমাদের বাস মিনার উদ্দেশ্যে ছাড়ে। মিনায় আমাদের ক্যাম্পের অবস্থান ছিল কুয়েত মসজিদের নিকটস্থ এক পাহাড়ের চুড়ায়। ক্যাম্প নং ২৬০। গাড়ী থেকে নেমে পাহাড়ের উপর বেশ কিছুটা পথ হেঁটে উঠতে হ’ল। আববা এবং ফুফুর তাতে বেশ কষ্ট হয়। কিন্তু পাহাড় থেকে দৃশ্যমান মিনার সুবিস্তৃত ময়দান আর হলুদাভ আলোকজ্জ্বল সারি সারি তাবুর ঠিকরে পড়া সৌন্দর্য আমাদের কষ্ট প্রায় লাঘব করে দিল। ১ লক্ষেরও বেশী তাবু রয়েছে এখানে প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে। যেখানে একত্রে ৩০ লক্ষেরও বেশী হজ্জযাত্রী অবস্থান করতে পারেন।
ক্যাম্পে ঢুকে নিজেদের তাঁবু খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না। হাজীদের সহযোগিতার জন্য সেখানে সঊদী বয় স্কাউটদের দেখা গেল। একেকটি তাঁবুতে ২৮/৩০ জনের থাকার ব্যবস্থা। নারী-পুরুষ ভিন্ন ভিন্ন তাঁবু। শোয়ার জন্য বরাদ্দ জায়গা বেশ সংকীর্ণ হ’লেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। প্রত্যেকের জন্য একটি করে ম্যাট্রেস ও বালিশ। গরমের তীব্রতা কাটাতে রয়েছে তাপানুকুল যন্ত্র। তবে সবচেয়ে প্রসন্ন বোধ করি টয়লেট ও পানির সুব্যবস্থা দেখে। লক্ষ লক্ষ মানুষের এই আয়োজনে টয়লেট ব্যবস্থাপনাতে কিছু ত্রুটি থাকবেই। তা সত্ত্বেও মনে হয়েছে ত্রুটিগুলো দূর করতে কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ আন্তরিকতাই দেখিয়েছেন। আমরা ফজর ছালাত আদায় করে শুয়ে পড়লাম। সকাল ৯-টায় ঘুম থেকে জাগার পর ক্যাম্প থেকে বরাদ্দ নাশতা গ্রহণ করি। আমাদের তাঁবুর প্রায় সকল হাজীই ছিলেন পাকিস্তানী। ফলে তাদের সাথে সহজেই আন্তরিকতা গড়ে উঠল।
পরদিন হজ্জ শুরু হবে বলে সেদিন অনেকটা বিশ্রামেই কাটল। পাকিস্তানীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে ক্যাম্প থেকে বরাদ্দ খাবারের মেন্যু ছিল সব পাকিস্তানী হেঁসেলের। আমার অভ্যাস থাকলেও পরিবারের বাকী সদস্যদের তা খেতে বেশ কষ্ট হ’ল। বিকেলবেলা আসমান হঠাৎ ঢেকে গেল কালো আঁধারে। আষাঢ়ের মত মেঘমেদুর আকাশ। শুরু হ’ল ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিও। সেই সাথে তাপমাত্রা কমে এসে। আবহাওয়া অনেকটা স্বস্তিদায়ক হয়ে ওঠে। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে বইতে শুরু করল তীব্র ঝড়ো হাওয়া। প্রায় ঘন্টাখানিক ধরে ঝড়ের তান্ডব চলল। ধুলোয় ধুসরিত হয়ে গেল মিনার আকাশ-বাতাস। তাঁবুগুলো অত্যন্ত মযবূত বলে শেষ পর্যন্ত বাঁধন আলগা হ’ল না বটে, কিন্তু প্রতিমুহূর্তে আশংকা হচ্ছিল এই বুঝি সব ভেঙ্গে পড়ল। না, তেমন কিছু হয়নি শেষ পর্যন্ত আলহামদুলিল্লাহ। ঝড় শেষে প্রশান্তির ঝিরঝিরে সমীরণ বইতে থাকে। তাতে গা জুড়িয়ে আমরা ক্যাম্পের বাইরে পাহাড়ের চুড়ায় দাঁড়াই আর চায়ের কাপে চুমুক দেই। উপর থেকে মিনার সুবিস্তৃত ময়দানে, পাহাড়ের অাঁকে-বাঁকে লক্ষ মানুষের জমায়েত দেখি আর হজ্জের জন্য মানসিক প্রস্ত্ততি নিতে থাকি।
১০.
২০শে আগস্ট, সোমবার। হজ্জের দিন। সকালে উঠে আরাফা ময়দানের উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য প্রস্ত্ততি শুরু হ’ল। সূর্য ওঠার পর একে একে হাজীরা রওয়ানা হ’তে লাগলেন। ভীড় এড়াতে আমরা একটু দেরীতেই বের হ’লাম। কিন্তু ভুলক্রমে অন্য একটি ক্যাম্পের বাসে উঠে পড়ায় বিপদ ঘটল। পাকিস্তানী ড্রাইভার এই সুযোগে বাড়তি কিছু আয়-উপার্জনের সুযোগ নিল। হজ্জের দিনও এদের এমন আচরণ দেখে ব্যথিত হ’লাম। যাইহোক, বাস চলল মিনা পেরিয়ে আরাফার পথে। সাড়ে ৯-টার দিকে আরাফা ময়দানের পশ্চিম প্রান্তে মসজিদে নামিরার পার্শ্বস্থ মহাসড়কে আমাদের নামিয়ে দেয়া হ’ল। জানি না কোথায় আমাদের ক্যাম্প। প্রচন্ড রোদে হাঁটতে হাটতে হাফিয়ে উঠলাম আমরা। অবশেষে একজন রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে মসজিদে নামিরার শেষভাগে বাদশাহর ক্যাম্প অতিক্রম করে আমাদের ২৬০ নং ক্যাম্পটি খুঁজে পেলাম। ক্যাম্প প্রায় ফাঁকাই পাওয়া গেল। অর্থাৎ একটু ব্যাকওয়ার্ড স্থানে হওয়ার কারণে আমাদের দলের অধিকাংশই ক্যাম্পটি খুঁজে পায়নি। মসজিদে নামিরা ততক্ষণে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। মসজিদের বাইরে রাস্তাগুলোতেও কোন জায়গা নেই। ফলে ক্যাম্পে বসেই আমরা মসজিদের মাইকে হজ্জের খুৎবা শুনলাম। মসজিদে নববীর ইমাম ও খত্বীব ড. হুসাইন বিন আব্দুল আযীয আলে শায়খ খুৎবা দিলেন। প্রায় ৩৫ মিনিটের মত খুৎবা হ’ল। আক্বীদা, আমল, আখলাক সব বিষয়েই কম-বেশী আলোকপাত করলেন। খুৎবার পর ছালাত শুরু হ’ল। জমা ও ক্বছর করে প্রথমে দু’রাক‘আত যোহর, অতঃপর ইক্বামত দিয়ে দু’রাক‘আত আছর। আমরা ক্যাম্প থেকেই মসজিদের মূল জামা‘আতের ইক্বতিদা করলাম। আববা বললেন, ইতিপূর্বে যে দু’বার হজ্জ করেছেন, মসজিদে নামিরার খুৎবা শুনতে পাননি এবং মূল জামা‘আতেও অংশগ্রহণ করতে পারেননি। ফলে সরাসরি খুৎবা শোনা ও জামা‘আতে ছালাত আদায় করা তাঁর জন্যও প্রথম অভিজ্ঞতা। আশ্চর্য হ’লাম যে, আমাদের ক্যাম্পে যে ক’জন উপস্থিত ছিল, তাদের অনেকেই জমা ও ক্বছর না করে পৃথক সময়ে ও পৃথকভাবে যোহর ও আছর পড়ল। দুর্ভাগ্য, একটি মাযহাবী ভুল ফৎওয়া আরাফার ময়দানেও মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করে রাখল।
আরাফা ময়দানে ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা এ বছর যথেষ্ট উন্নত করা হয়েছে। সবার জন্য তাঁবু, টয়লেট ও পানির উন্নত ও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। তাঁবুতে রয়েছে এসিও। ফলে সারাদিন নিরবচ্ছিন্নভাবে ইবাদত-বন্দেগী করার জন্য চমৎকার পরিবেশ পাওয়া গেল আলহামদুলিল্লাহ। এভাবে আল্লাহর অশেষ রহমতে হজ্জের দিনটি আমাদের হজ্জ সফরের সর্বোত্তম দিন হয়ে উঠল। আল্লাহ আমাদের প্রার্থনাগুলো কবুল করুন এবং পরিচিত-অপরিচিত সকলের হজ্জকে হজ্জে মাবরূর হিসাবে গ্রহণ করে নিন- আমীন!
বিকেলে মসজিদে নামিরার অভ্যন্তরভাগ পরিদর্শনে গিয়ে হতবাক হ’লাম। বিশালায়তন দ্বিতল মসজিদে জুতা-স্যান্ডেল নিয়ে নারী-পুরুষ যেভাবে প্রবেশ করছে এবং পানির বোতল, খাবারের প্যাকেট যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছে, তাতে মনে হয়েছে ইবাদতের পরিবেশ এবং মসজিদের পবিত্রতা রক্ষার দিকটি এখানে অনেকটাই অবহেলিত। নাজীব বাইরে সংরক্ষিত জায়গায় স্যান্ডেল রেখে ভেতরে গিয়েছিল। খানিকবাদে ফিরে এসে সেটি আর যথাস্থানে পেল না। স্যান্ডেলটি ভিন্ন ধরনের হওয়ায় ভুলক্রমে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। সুতরাং কে সরাতে পারে, তার কোন ধারণা পেলাম না। এ মসজিদটি সারাবছর বন্ধই থাকে। কেবল আরাফার দিন খোলা হয়। দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদের আয়তন এত বড় যে, কেবল অভ্যন্তরভাগেই ছালাত আদায় করতে পারে প্রায় ৪ লক্ষাধিক মুছল্লী। মুছল্লীদের বড় অংশই ক্যাম্পে না গিয়ে মসজিদেই থেকে যান এবং সেখানেই খাওয়া-দাওয়া সারেন। এজন্যই বোধ হয় এমন অপরিচ্ছন্ন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
মাগরিবের আযানের পর দলে দলে মানুষ চলতে শুরু করল মুযদালিফার উদ্দেশ্যে। পায়ে হেঁটে। একবার তাদের দলে যোগদানের কথা ভাবলেও আববা ও ফুফুর শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করে বাসে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম। গাড়ি এসে পৌঁছতে প্রায় রাত সাড়ে ৯-টা বাজল। আরাফার ময়দান তখন প্রায় শূন্য। আরাফা থেকে মুযদালিফা ময়দানের দূরত্ব ৫/৬ কি.মি.-এর বেশী নয়, তবুও জ্যাম অতিক্রম করতে ঘন্টাখানিকের বেশী সময় লেগে গেল। হাযার হাযার মানুষ তখনও পায়ে হাঁটা পথে এগিয়ে চলেছে মুযদালিফার পানে।
১১.
মুযদালিফা ময়দানে গাড়ি থেকে নামার আগেই দেখলাম মানুষ সারিবদ্ধভাবে রাস্তার পার্শ্বে সড়কদ্বীপেই শোয়ার বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। আমরা মূল সড়ক থেকে বেশ ভেতরে একটি স্থানে আরো অনেক লোকের সাথে বিছানা পেতে রাত্রি যাপনের আয়োজন করলাম। প্রথমেই মাগরিব ও এশার ছালাত জমা ও ক্বছর আদায় করে কিছু শুকনা খাবার খেয়ে নেয়া হ’ল। রাত বারোটার দিকে আববারা ঘুমিয়ে পড়লেন। এদিকে আমি আর নাজীব কিছুতেই ঘুমের কথা ভাবতে পারলাম না। মুযদালিফার এই ময়দান এবং এখানে বালি-পাথরের ওপর শুয়ে রাত্রিবাসের বাস্তবরূপ যে এমন হ’তে পারে তা কল্পনাতেও আসেনি। আসার আগে এর কোন স্থির বা ভিডিওচিত্রও দেখিনি বলে এই দৃশ্য অচিন্তনীয় মনে হ’ল। শেষ পর্যন্ত আমি আর নাজীব বিছানা ছেড়ে অদূরে মাশআ‘রুল হারাম মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সিন্ধান্ত নিলাম।
ময়দানে অল্প কিছু দূর পর পর টয়লেট ও পানির ব্যবস্থা, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্মিত হয়েছে। ফলে হজ্জযাত্রীদের আগের মত আর বাথরুমের জন্য কষ্ট পেতে হয় না। কিন্তু যত্র-তত্র শোয়ার দৃশ্য আর অপরিচ্ছন্নতা দেখে কষ্ট পেলাম। কেবলই মনে হচ্ছিল সরকারীভাবে ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত ও সুশৃংখল হওয়ার প্রয়োজন ছিল। মিনা ও আরাফা ময়দানের মত এটিও সুবিন্যাস্ত করা গেলে মানুষের শোয়ার দৃশ্যটা এতটা বিশৃংখল মনে হ’ত না হয়তবা। তবে জাতি-বর্ণ, ধনী-গরীব, আমীর-ফকীর, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিশ্ব মানবকূল একাকার হয়ে রাত্রিযাপনের এই দৃশ্য পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যাবে না এটা সুনিশ্চিত। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ও আত্মগর্বী মানুষটিরও এখানে এসে সর্বহারা ও মাথা গোঁজার ঠাঁইহীন মানুষের মত খোলা আকাশের নিচে শোয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। একটি রাতের জন্য হ’লেও তাকে আশ্রয়হীন ভাসমান মানুষের দলে অংশগ্রহণ এবং উদ্বাস্ত্ত জীবনের স্বাদ নিতেই হবে। এভাবে জাত্যাভিমান ও অহম হরণের দ্বিতীয় কোন উপলক্ষ আর হ’তে পারে বলে জানা নেই।
মাশ‘আরুল হারাম মসজিদে এসে দেখলাম অসংখ্য মানুষ মসজিদের ভেতরে ঘুমিয়ে রয়েছে। মসজিদের চতুর্দিকের চতবরও গাদাগাদি করে বিশ্রামরত মানুষে ভরপুর। তবে এখানকার পরিবেশ অনেকটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মসজিদের দ্বাররক্ষীদের কয়েকজন বাঙালী ছিল। চোখে চোখ পড়তেই তারা এগিয়ে এসে খুব আন্তরিকভাবে ভাববিনিময় করল, যেটা সঊদীতে সচরাচর দেখিনি। এমনকি মসজিদে শোয়ার জন্য জায়গাও করে দিতে চাইল। আমরা তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে আসলাম। ক্বাযী হারূণ চাচা তাঁর দল নিয়ে কাছেই কোথাও ছিলেন। ফোন পেয়ে এলেন। তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে আমরা আবার আমাদের অবস্থানস্থলে ফিরে এলাম। রাত তখন ৩-টা বাজে। এবার অবশ্য শুয়ে পড়তেই ঘুমিয়ে গেলাম। এক ঘন্টা বাদেই আবার ফজর ছালাতের জন্য উঠে পড়লাম। প্রক্ষালনের উত্তম ব্যবস্থা থাকায় তেমন কোন ঝক্কি পোহাতে হ’ল না। এভাবেই পরিসমাপ্ত হ’ল মুযদালিফা ময়দানে অবস্থান পর্বটি। সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আযীম।
১২.
২১শে আগস্ট মঙ্গলবার। ফজরের ছালাত আদায়ের পর দো‘আ-দরূদ পাঠ শেষে আকাশ ফর্সা হ’লে আমরা জামরাতুল আক্বাবায় কংকর নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। লক্ষ লক্ষ মানুষের পায়দল মিছিল অবশ্য ফজরের পর পরই শুরু হয়েছে। সেই মিছিলে যোগ দিয়ে আমরা এগুতে থাকলাম। আজ ঈদের দিন। সুতরাং তালবিয়া ধ্বনি নয়, বরং তাকবীর ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। প্রচন্ড ভীড়। শৃংখলা রক্ষার জন্য পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত তৎপর। অন্ততঃ তিনটি রাস্তা দিয়ে মানুষ জামরার পথে ঢুকছে। ৫/৬ কি. মি. দীর্ঘ পথ। তবে ভীড়ের কারণে গতি শ্লথ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সূর্য তেতে ওঠে আর গরমে অস্থিরতা বাড়ে। ভীড়ের মধ্যে সতর্ক থাকতে হয় পেছন থেকে যেন হঠাৎ হুইলচেয়ার এসে পা মাড়িয়ে না দেয়। পথে পর্যাপ্ত টয়লেট ও পানির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বিশ্রামের তেমন সুযোগ নেই। প্রায় ৩ ঘন্টা পর আমরা জামরার নিকট পৌঁছলাম। জামরাতে পাথর মারার এই পর্বটিই হজ্জের সবচেয়ে কঠিন অংশ। পূর্বে প্রায় বছরই ভিড়ের কারণে এখানে অনেক হাজী মারা যেত। তখন উন্মুক্ত স্থানে একটি উঁচু পিলারে পাথর মারা হ’ত এবং চতুর্দিক থেকে হাজীরা পাথর মারত। ফলে এক জায়গায় তীব্র ভিড়ের সৃষ্টি হয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরী হ’ত এবং প্রাণহানির সমূহ আশংকা থাকত। তবে ২০০৪ সালে এখানে ভীড়ের চাপে একসঙ্গে ২৫১ জন হাজী নিহত হ’লে সঊদী সরকার বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং পাথর মারার স্থানটি আরও প্রশস্ত করে। এতদসত্ত্বেও ২০০৬ সালে আবার অনুরূপ এক ঘটনায় এক সঙ্গে ৩৪৬ জন হাজী নিহত হ’লে জামরাকে ঘিরে চারতলা ব্রীজ নির্মাণ করা হয় এবং কঠোর ও সুশৃংখল ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হয়। ফলে পাথর মারার পর্বটি এখন অনেক সহজতর হয়েছে এবং দুর্ঘটনার আশংকা প্রায় দূরীভূত হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। বর্তমানে সেখানে প্রতি ঘন্টায় ৫/৬ লক্ষ মানুষ নিরাপদে পাথর মেরে অতিক্রম করতে পারে।
জামরাতুল আক্বাবায় পাথর মারার স্থান রয়েছে মোট ৩টি, যে সকল স্থানে ইবরাহীম (আঃ)-কে কুমন্ত্রণা দিয়েছিল ইবলীস। এগুলি ছুগরা (ছোট), উসত্বা (মধ্যম) এবং কুবরা (বড়) বলে পরিচিত। ইবরাহীম (আঃ) ৭ বার করে পাথর মেরে প্রতিবার শয়তানকে বিতাড়িত করেছিলেন। সেই ঘটনার স্মরণে এই স্থানগুলোতে পাথর নিক্ষেপ করতে হয়। তবে প্রথমদিন তথা ঈদের দিন কেবল বড় জামরায় ৭টি পাথর মারতে হয়। আমরা পাথর নিক্ষেপের পর একটু দূরে গিয়ে পরিবারের জন্য এবং যারা খাছ দো‘আ চেয়েছেন, সকলের নেক মকছূদ পূরণের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করলাম। এছাড়া অব্যক্ত বহু কথা ইবরাহীম (আঃ)-এর একটি বাক্য দিয়েই শেষ করলাম- হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি জান যা আমরা লুকিয়ে রাখি ও যা আমরা প্রকাশ করি। আর তোমার নিকট যমীন ও আসমানের কোন কিছুই লুকানো থাকে না (ইব্রাহীম ১৪/৩৮)। অতঃপর নিজেদের ও সকলের জন্য সোলায়মানের দো‘আ (নমল ১৯), আবুবকরের দো‘আ (আহক্বাফ ১৫), সর্বোপরি রাসূল (ছাঃ)-এর পঠিত সারগর্ভ দো‘আ রববানা আ-তিনা ফিদ্দুনিয়া... (বাক্বারাহ ২০১) পড়ি।
জামরা থেকে বের হওয়ার পর সেলুনে মাথা মুন্ডনের জন্য যাই। কিন্তু সেখানে বিশাল লাইন দেখে আমরা মাথা মুন্ডন না করেই মক্কায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। অধিকাংশই পায়ে হেঁটে মক্কায় যাচ্ছে। আমরা গাড়ি পাওয়া যাবে জানতে পেরে আযীযিয়াহর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। কিন্তু আযীযিয়াহ পর্যন্ত পৌঁছতে তীব্র গরমে আমাদের অবস্থা কাহিল হয়ে যায়। হজ্জ সফরের সবচেয়ে কষ্টকর সময় ছিল এটি। অবশেষে প্রায় ঘন্টাখানিক হাঁটার পর আযীযিয়াহ থেকে হারামগামী একটি বাস পেয়ে চড়ে বসি। রাস্তায় জ্যামের কারণে হারামে পৌঁছতে আরও এক ঘন্টা লাগে। অবশেষে হারামে এসে যোহরের ছালাত আদায়ের পর আমরা এক বাঙালী সেলুনে জনপ্রতি ৩০ রিয়ালে মাথা মুন্ডন করি। হোটেলে এসে ইহরাম খুলে গোসল করার পর প্রচন্ড ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া শরীর কিছুটা শক্তি ফিরে পায়। ওদিকে আমাদের নিজ হাতে দুম্বা কুরবানী করার কথা ছিল। কাযী হারূণ চাচা সব ব্যবস্থা করেও রেখেছিলেন। কিন্তু ক্লান্ত শরীরে আমরা আর বের হ’তে পারলাম না। মাগরিব পর্যন্ত টানা কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম নেয়ার পর বেশ চাঙ্গা বোধ করলাম। তবে সে রাতে তাওয়াফে ইফাযাহ করার সাহস পেলাম না। একেবারে মিনা থেকে মক্কা ফেরার পরই তাওয়াফ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। মাগরিবের পর আব্দুল আহাদ ভাই কুরবানীর গোশত রান্না করে পাঠিয়ে দিলেন। সুস্বাদু বাঙালী রান্না খেয়ে আমরা খুবই তৃপ্তি পেলাম। হারূণ চাচা আমাদের কুরবানীর গোশতের কোন গতি না করতে পারলেও আব্দুল আহাদ ভাইয়ের এই খেদমতে ঈদের দিন গোশত খাওয়ার সুযোগ মিলল। আল্লাহ তার মঙ্গল করুন।
এশার ছালাতের পর মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে ২৫০ রিয়ালে একটি ‘উজরা’ গাড়ী নিলাম। পাকিস্তানী ড্রাইভার জামরার নিকটে কিং খালিদ ব্রীজের সম্মুখে নামিয়ে দিল। এই ব্রীজ থেকে আমাদের ক্যাম্পের দূরত্ব ছিল অনেকটা। মিনার অভ্যন্তরে যাত্রী পরিবহণের জন্য বিশেষ গাড়ীর ব্যবস্থা থাকলেও ভিড়ের কারণে সার্ভিসটি বন্ধ পাওয়া গেল। অতএব পায়ে হেঁটেই যেতে হবে। উপায়ন্তর না দেখে আমরা গুগল ম্যাপ ধরে হাঁটা শুরু করলাম। এছাড়া মূল ম্যাপাটিও হাতে ছিল। ফলে আত্মবিশ্বাস ছিল যে সহজেই খুঁজে পাব। কিন্তু বিপদে পড়লাম যখন দেখলাম যে, ম্যাপে সব ক্যাম্পের নম্বর দেয়া থাকলেও আমাদের ক্যাম্পের অবস্থান নির্দেশ করা নেই। কুয়েত মসজিদের কাছাকাছি এসে পথ না পেয়ে অনেক পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে জানতে চাইলাম ২৬০ নং ক্যাম্পের কথা। কিন্তু কেউ বলতে পারল না।
ওদিকে মু‘আল্লিম অফিসের নম্বরও নেয়া হয়নি। ফলে সেখানেও যোগাযোগ করতে পারলাম না। অবাক হ’লাম যে সুবিস্তৃত মিনার ময়দানে আমাদের মত আরও অসংখ্য মানুষ নিজ নিজ ক্যাম্পের খোঁজে বিশৃংখলভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের দিক-নির্দেশনা দেওয়ার জন্য কোথাও কোন দায়িত্বশীল নেই। নেই কোন তথ্য কেন্দ্র। কিছু পাকিস্তানী স্বেচ্ছাসেবক চেষ্টা করছে মানুষকে সহযোগিতা করার জন্য। কিন্তু তারাও ম্যাপ সম্পর্কে বিশেষ অবগত নয়। একজন পুলিশকেও পাওয়া গেল না যারা এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারে। মনে হ’ল ‘হার্রিক ইয়া হাজ্জ..রুহ..গিদ্দাম’ (হে হাজী! দ্রুত চল, এগিয়ে যাও, সামনে যাও) বুলি ছুড়ে দেওয়া ব্যতিরেকে তাদের আর কোন দায়িত্ব নেই। একজন পুলিশকে দেখা গেল আপনমনে সুরে সুরে ‘হার্রিক ইয়া হাজ্জ..’ যপ করতে। পুলিশের এমন দায়িত্বহীন ও বালসুলভ আচরণে অনেককেই বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখলাম। বহু মানুষ রাস্তার ধারে বিছানা পেতে শুয়ে পড়েছে, হয়তবা ক্যাম্প খুঁজে না পেয়ে। আমাদের যদি ভাষা জানা সত্ত্বেও গন্তব্য খুঁজে পেতে এত ধকল পোহাতে হয়, তবে সাধারণ মানুষের কি দশা হ’তে পারে তা বলাই বাহুল্য।
আববাদের কিং আব্দুল্লাহ ব্রীজের নীচে একটি স্থানে বসিয়ে রেখে আমি আর নাজীব ক্যাম্প খুঁজতে বের হ’লাম। অবশেষে অনেক খোঁজার পর পাহাড়ের ওপর ক্যাম্পটির অবস্থান জানা গেল। রাত তখন ২-টা বেজে গেছে। একবার তো ভেবেছিলাম মক্কায় আবার ফিরেই যাব। অতঃপর আববাদের নিয়ে এসে পাহাড়ের উপর ক্যাম্পে পৌঁছতে রাত ৩-টা বেজে গেল। এসে দেখি বহু লোক ক্যাম্পে তখনও ফেরেনি। পরে আমাদের মতই ঘুরাঘুরি করতে করতে ফজরের আগে-পরে তারা পৌঁছেছেন। যাইহোক, সারারাত ধরে প্রায় পাঁচ ঘন্টা অনুসন্ধানের পর অবশেষে ক্যাম্পে পৌঁছতে পেরে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আলহামদুলিল্লাহ।
(ক্রমশঃ)