ভূমিকা : ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানব বংশের ধারাবাহিক সংরক্ষণ, মানববংশ বৃদ্ধি, ইসলামের পরিপূর্ণ অনুশীলন ও বৈধভাবে জৈবিক চাহিদা পূরণ ও লজ্জাস্থান হেফাযতের জন্য মহান আল্লাহ পরিবার প্রথা প্রচলন করেছেন। আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ)-এর মাধ্যমে আল্লাহ নিজেই মানব জাতির প্রথম পরিবার গঠন করেন (বাক্বারাহ ২/৩৫)। পরিবার মানব সমাজের মূল ভিত্তি। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের অধিকার আদায় ও বিশ্বাসের মাধ্যমেই পরিবার টিকে থাকে। অপরদিকে অধিকার খর্ব হ’লে এবং বিশ্বাসে ঘাটতি হ’লে পরিবার ধ্বংস হয়। জন্ম নেয় পরিবার বিরোধী চিন্তা-চেতনা। অধিকার লাভে পা বাড়ায় ভুল পথে। জড়িয়ে পড়ে অনৈতিক সম্পর্কে, জড়িত হয় পরকীয়ায়।

সাম্প্রতিককালে যেসব সামাজিক ব্যাধি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তন্মধ্যে শীর্ষে রয়েছে পরকীয়া। যৌতুক, বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং-এর মত এটি ব্যক্তিচরিত্র ও নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম রূপ। প্রতিদিনের খবরের কাগজের একটি অংশে থাকে পরকীয়ার খবর। আর এই পরকীয়ার নিষ্ঠুর বলি হচ্ছে স্বামী বা স্ত্রী, পিতা-মাতা ও সন্তানসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। আলোচ্য প্রবন্ধে পরকীয়ার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।-

পরকীয়ার পরিচয় : ‘পরকীয়া’ বাংলা স্ত্রীবাচক শব্দ। পরকীয়া হ’ল বিবাহিত কোন নারী বা পুরুষ নিজ স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কারো সাথে বিবাহোত্তর বা বিবাহবহির্ভূত প্রেম, যৌন সম্পর্ক ও যৌন কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়া। সমাজে এটি নেতিবাচক হিসাবে গণ্য।[1]

মূলতঃ পরকীয়া হ’ল- বৈধ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর নিজ স্বামী বা স্ত্রীকে ফাঁকি দিয়ে পর পুরুষ বা পর নারীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া।

পরকীয়ায় জড়িত হওয়ার কারণ :

বর্তমানে সমাজে পরকীয়ার হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেলজিয়ামের মনস্তাত্ত্বিক এস্থার পেরেল তাঁর ‘দ্য স্টেট অব অ্যাফেয়ার’ গ্রন্থে পরকীয়াকে ক্যান্সারের সঙ্গে তুলনা করেছেন।[2] বিবাহিত নারী-পুরুষের পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার অনেক কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে কিছু নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-

১. ইসলামী শিক্ষার অভাব: ইসলাম মানব জাতির চরিত্রের হিফাযতের জন্য নারী-পুরুষকে বিবাহের নির্দেশ দিয়েছে[3] এবং বিবাহ বহির্ভূত যাবতীয় সম্পর্ককে হারাম ঘোষণা করেছে (আন‘আম ৬/১৫১)। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক হারাম ও এর ভয়াবহ শাস্তি না জানার কারণে মানুষ পরকীয়ার মত নিকৃষ্ট কাজে জড়িয়ে পড়ে।

২. সামাজিক কারণ : ইসলাম সামর্থ্যবান পুরুষকে একাধিক বিবাহের অনুমতি দিলেও (নিসা ৪/৩) অনেক পুরুষ সামাজিক কারণে একাধিক বিয়ে করতে পারেন না। কারণ সমাজ বহু বিবাহকে ভাল চোখে দেখে না। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌন চাহিদার অতৃপ্তি থেকে অনেকে এ সম্পর্কে জড়ায়। অপরদিকে দুর্বল ও অসুস্থ পুরুষের ক্ষেত্রেও নারী সামাজিক ভয়ে তালাক না নিয়ে পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে।

৩. নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা : পুরুষ-নারীর অবাধ মেলামেশার সুযোগে একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এরপর আলাপচারিতা ও পরবর্তীতে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। মহিলারা আজকাল চাকুরী, ব্যবসা, লেখাপড়া, চিকিৎসা ও অন্যান্য কারণে ইসলামী বিধান উপেক্ষা করে বাড়ির বাইরে যাচ্ছে। আর পর পুরুষের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ, কথা-বার্তা ও ঠাট্টা-মশকরার মধ্য দিয়ে একে অপরের প্রতি ঝুকে পড়ছে। অথচ নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِيَّاكُمْ وَالدُّخُولَ عَلٰى النِّسَاءِ فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الأَنْصَارِ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَفَرَأَيْتَ الْحَمْوَ قَالَ الْحَمْوُ الْمَوْتُ، ‘মহিলাদের নিকট একাকী যাওয়া থেকে বিরত থাক। এক আনছার ছাহাবী জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! স্বামীর ভাইয়ের (দেবর-ভাসুর) ব্যাপারে কি হুকুম? তিনি উত্তর দিলেন, স্বামীর ভাই হচ্ছে মরণের ন্যায়’।[4] স্বামীর ভাইয়ের ব্যাপারে যদি ইসলাম এত কঠোরতা আরোপ করে তাহ’লে অপরিচিত বা সাময়িক পরিচিতদের ব্যাপারে ইসলামের বিধান কি হ’তে পারে? নিঃসন্দেহে তা আরো কঠোর হবে।

৪. পর্দাহীনতা : পরকীয়ার অন্যতম কারণ হ’ল পর্দাহীনতা। এর ফলে নারী-পুরুষ একে অপরের দেখা-সাক্ষাৎ করার ও কথা বলার সুযোগ পায়। এতে তারা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। আর শয়তান এটাকে আরো সুশোভিত করে উপস্থান করে এবং পরকীয়ার দিকে নিয়ে যায়। এজন্য ইসলাম পর্দাহীনতাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,الْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ فَإِذَا خَرَجَتِ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ، ‘মহিলারা হচ্ছে আবৃত বস্ত্ত। সে বাইরে বের হ’লে শয়তান তাকে পুরুষের দৃষ্টিতে সুশোভিত করে তোলে’।[5] সুতরাং যে পোষাকে নারীর চুল, গ্রীবা, বক্ষ, পেট, পিঠ ও আবৃত অঙ্গ প্রকাশিত থাকে তা পরিধান করা হারাম।

পর্দাহীনতা বিভিন্নভাবে হ’তে পারে। আর এসবের কারণে নারী-পুরুষ পরকীয়ার দিকে ধাবিত হয়। নিম্নে পর্দাহীনতার কয়েকটি পর্যায় উল্লেখ করা হ’ল।-

ক. দৃষ্টিপাত : পরকীয়া শুরু হয় নারী-পুরুষের একে অপরের প্রতি দৃষ্টিপাতের মাধ্যমে। গায়র মাহরাম (যাদের সাথে বিবাহ জায়েয) নারীর প্রতি তাকানো ইসলাম হারাম করেছে। মহিলাদের মধ্যে যাদের প্রতি সাধারণভাবে তাকানো হারাম তাদের ছবি দেখাও হারাম; এমনকি মৃত হ’লেও। আবূ মূসা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,كُلُّ عَيْنٍ زَانِيَةٌ وَالْمَرْأَةُ إِذَا اسْتَعْطَرَتْ فَمَرَّتْ بِالْمَجْلِسِ فَهِيَ كَذَا وَكَذَا يَعْنِي زَانِيَةً، ‘প্রতিটি চোখই যিনাকারী। কোন নারী সুগন্ধি মেখে কোন মজলিসের পাশ দিয়ে গেলে সে এমন এমন’। অর্থাৎ যিনাকারিণী।[6] তিনি আরো বলেন,اَلعَيْنَانِ تَزْنِيَان وَزِنَاهُمَا اَلنَّظْرُ، ‘(মানুষের) চক্ষু দু’টিও যেনা করে, আর চক্ষুদ্বয়ের যেনা হ’ল দৃষ্টিপাত করা’।[7] এই পাপের মাধ্যমেই পরকীয়ার সূচনা হয়।

খ. কথা বলা : গায়র মাহরাম নারী-পুরুষ পরস্পরের সাথে সরাসরি বা টেলিফোনে কথা বলার মাধ্যমে একে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এক পর্যায়ে তারা পরকীয়ার দিকে ধাবিত হয়, জড়িয়ে পড়ে ব্যভিচারে। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

كُتِبَ عَلَى ابْنِ آدَمَ نَصِيبُهُ مِنَ الزِّنا، مُدْرِكٌ ذلكَ لا مَحالَةَ، فالْعَيْنانِ زِناهُما النَّظَرُ، والأُذُنانِ زِناهُما الاسْتِماعُ، واللِّسانُ زِناهُ الكَلامُ، والْيَدُ زِناها البَطْشُ، والرِّجْلُ زِناها الخُطا، والْقَلْبُ يَهْوى وَيَتَمَنّى، وَيُصَدِّقُ ذَلِكَ الفَرْجُ وَيُكَذِّبُهُ،

‘আদম সন্তানের উপর যেনার কিছু অংশ লিপিবদ্ধ হয়েছে সে অবশ্যই তাতে লিপ্ত হবে। দুই চোখের যেনা হ’ল, দৃষ্টিপাত করা, দুই কানের যেনা হ’ল শ্রবণ করা, মুখের যেনা হ’ল, (গায়র মাহরাম মহিলার সাথে) কথা বলা, হাতের যেনা হ’ল, স্পর্শ করা এবং পায়ের যেনা হ’ল, অগ্রসর হওয়া। আর অন্তর আশা ও আকাঙ্ক্ষা করতে থাকে। লজ্জাস্থান তাকে বাস্তবায়ন করে অথবা মিথ্যায় পরিণত করে’।[8] সুতরাং গায়র মাহরাম পুরুষের সাথে অপ্রয়োজনীয় ও অনর্থক কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে।

গ. স্পর্শ করা : গায়র মাহরাম নারীর প্রতি তাকানো যেমন যেমন জায়েয নয়, তেমনি তার গায়ে হাত লাগানোও জায়েয নয়। নবী করীম (ছাঃ) পুরুষদের হাতে হাত রেখে বায়‘আত করতেন। কিন্তু মেয়েদের বায়‘আত নেবার সময় কখনো তাদের স্পর্শ করতেন না। আয়েশা (রাঃ) বলেন,

وَاللهِ مَا مَسَّتْ يَدُ رَسولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدَ امْرَأَةٍ قَطُّ، غيرَ أنَّه بايَعَهُنَّ بالكَلامِ، واللهِ ما أخَذَ رَسولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ على النِّساءِ إلّا بما أمَرَهُ اللهِ، يقولُ لهنَّ إذا أخَذَ عليهنَّ: قدْ بايَعْتُكُنَّ كَلامًا-

‘আল্লাহর কসম! কথার দ্বারা বায়‘আত গ্রহণ ব্যতীত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাত কখনো কোন নারীর হাত স্পর্শ করেনি। আল্লাহর কসম! তিনি কেবল সেসব বিষয়েই বায়‘আত গ্রহণ করতেন, যেসব বিষয়ে বায়‘আত গ্রহণ করার জন্য আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন। বায়‘আত গ্রহণ শেষে তিনি বলতেন, আমি কথা দ্বারা তোমাদের বায়‘আত গ্রহণ করলাম’।[9] অন্য বর্ণনায় এসেছে, উমায়মা বিনতে রুকায়া (রাঃ) বলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আসুন, আমরা আপনার হাতে বায়‘আত করব। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমি স্ত্রীলোকের হাতে হাত মিলাই না’।[10] সুতরাং গায়র মাহরাম মহিলাকে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

অনুরূপভাবে যেসব পুরুষের সাথে বিবাহ বৈধ, তাদের সাথে মুছাফাহা করা বৈধ নয়। মহিলা বৃদ্ধা অথবা পুরুষ বৃদ্ধ হ’লেও আপোষে মুছাফাহা জায়েয নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে মহিলা (স্পর্শ করা) হালাল নয়, তাকে স্পর্শ করার চেয়ে তোমাদের কারো মাথায় লোহার সুচ গেঁথে যাওয়া অনেক ভাল’।[11]

মুছাফাহার ব্যাপারে যদি ইসলাম এত কঠোরতা অবলম্বন করে, তাহ’লে কিভাবে একজন বেগানা পুরুষ-নারী একে অপরকে স্পর্শ করতে পারে?

ঘ. গায়র মাহরামের সাথে সফর করা : মেয়েদের মাহরাম ছাড়া একাকী অথবা গায়র মাহরামের সাথে সফর করতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিষেধ করেছেন। কেননা এতে পরকীয়া ও অবৈধ সম্পর্ক সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়। অপরদিকে পরকীয়ার কারণেও নারী-পুরুষ নিজেদের কামনা-বাসনা পূরণের জন্য অনেক স্থানে সফর করে থাকে। সেকারণ ইসলাম মাহরাম ব্যতীত মহিলাদের সফর কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। এমনকি হজ্জের মত ফযীলতপূর্ণ সফরও মাহরাম ব্যতীত জায়েয নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لاَ تُسَافِرِ الْمَرْأَةُ إِلاَّ مَعَ ذِي مَحْرَمٍ، وَلاَ يَدْخُلُ عَلَيْهَا رَجُلٌ إِلاَّ وَمَعَهَا مَحْرَمٌ، ‘মেয়েরা মাহরাম (যার সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ) ব্যতীত অন্য কারো সাথে সফর করবে না। মাহরাম কাছে নেই এমতাবস্থায় কোন পুরুষ কোন মহিলার নিকট গমন করতে পারবে না’।[12] তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ ও পরকালে বিশ^াস রাখে এমন কোন মহিলার জন্য বৈধ নয় যে, সে তার পিতা, পুত্র, স্বামী, ভাই অথবা কোন মাহরাম পুরুষ ছাড়া তিন দিন বা তার বেশী পথ সফর করে’।[13]

স্মর্তব্য যে, মহিলাদের একাকী সফরের কারণে অনেক সময় তারা ধর্ষণের শিকার হন। এমনকি চলন্ত বাসে বা গাড়ীতেও ইদানিং এই বর্বরোচিত ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। বখাটের ইভটিজিং-এর শিকার, শারীরিক ও মানসিক যৌনতার শিকার ইত্যাদি কারণে অনেক মেয়ে অত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

ঙ. মাহরাম ব্যতীত নারী-পুরুষের নির্জনবাস করা : পর্দাহীনতার আরেকটি স্তর হ’ল গায়র মাহরাম নারী-পুরুষ নির্জনে একত্রিত হওয়া। ইসলাম একে হারাম ঘোষণা করেছে। জাবির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ تَلِجُوْا عَلَى الْمُغِيبَاتِ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ يَجْرِيْ مِنْ أَحَدِكُمْ مَجْرَى الدَّمِ‏.‏ قُلْنَا وَمِنْكَ قَالَ وَمِنِّيْ وَلَكِنَّ اللهَ أَعَانَنِيْ عَلَيْهِ فَأَسْلَمُ، ‘যাদের স্বামী উপস্থিত নেই, সে সকল মহিলাদের নিকট তোমরা যেও না। কেননা তোমাদের সকলের মাঝেই শয়তান (প্রবাহিত) রক্তের শিরায় বিচরণ করে। আমরা বললাম, আপনার মধ্যেও কি? তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমার মধ্যেও। কিন্তু আমাকে আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য করেছেন, তাই আমি নিরাপদ’।[14]

তিনি আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন কখনো কোন মেয়ের সাথে নির্জনে সাক্ষাৎ না করে যতক্ষণ না ঐ মেয়ের কোন মাহরাম তার সাথে থাকে। কারণ সে সময় তৃতীয় জন থাকে শয়তান’।[15] তিনি আরো বলেন, ‘কোন পুরুষ যেন মহিলার সাথে একান্তে সাক্ষাৎ না করে যতক্ষণ তার সাথে তার মাহরাম না থাকে এবং কোন মহিলা যেন সফর না করে যতক্ষণ না কোন মাহরাম তার সাথে থাকে’।[16]

বিবাহ বৈধ সকল নারী-পুরুষ নির্জন স্থানে, গাড়ীতে, লিফটে, বাড়ীতে বা পর্দার অন্তরালে একাকী কিছু সময়ের জন্যও অবস্থান করা জায়েয নয়। ইসলাম একে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا كَانَ ثَالِثُهُمَا الشَّيْطَانُ، ‘কোন পুরুষ কোন (গায়র মাহরাম) নারীর সাথে নির্জনে একত্রিত হ’লে শয়তান হয় তাদের তৃতীয় জন’।[17] বর্তমানে এটাকে অনেকে পাপই মনে করে না। দেবর-ভাবী, শালী-দুলাভাই, ড্রাইভার-মহিলা গৃহকর্তা, ডাক্তার-নার্স, অফিসের বস-মহিলা পিএ, শিক্ষক-ছাত্রী, পীর-মহিলা মুরীদ ইত্যাদি বেগানা নারী-পুরুষ প্রতিনিয়ত নির্জনে একত্রিত হয়ে কাজ করছে। ফলে সমাজে পরকীয়ার ঘটনা তীব্রতর হচ্ছে।

৬. ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া : পরকীয়ার আকেরটি কারণ হ’ল, ছেলে-মেয়ের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের অমতে বিয়ে দেওয়া। অভিভাবকরা নিজেদের কথা ভাবেন এবং অনেক তাড়াহুড়া করে তাদের সন্তানদের বিয়ে দেন। কিন্তু ছেলে-মেয়ের পসন্দ বা মতামতকে অনেক ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেন না। ফলে এসব ছেলে-মেয়েদের বিবাহিত জীবন সুখের হয় না। ছেলে-মেয়ে প্রথমে মেনে নিলেও পরে তাদের মধ্যে পারিবারিক অশান্তির সৃষ্টি হয়। পরিবারের ভয়ে কিছু না বললেও এক সময়য়ে তারা উভয়ে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে পড়ে।

৭. দৈহিক অক্ষমতা : নারী-পুরুষ জৈবিক চাহিদা পূরণ করার জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু এই চাহিদা পূরণ না হ’লে নারী-পুরুষ পরকীয়ায় লিপ্ত হয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড অ্যাডোলসেন্ট ও ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলালুদ্দীন আহমাদ বলেন, মনোদৈহিক ও সামাজিক কারণে মানুষ পরকীয়ায় জড়ায়। প্রথমে আসে দৈহিক বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌন সম্পর্কে অতৃপ্তি থেকে অনেকে এ সম্পর্কে জড়ায়।[18]

৮. নারীর পোষাক : পোষাক মানুষকে যেমন সম্মানিত করে তেমনি পোষাকের কারণে অনেক অঘটনও ঘটে থাকে। নারীদের টাইটফিট, আঁট-সাট, পাতলা ও জাঁকজমকপূর্ণ পোষাকের কারণে পর পুরুষ তার দিকে আকৃষ্ট হয়। ইসলাম এমন পোষাককে হারাম করেছে, যা পাতলা হওয়ার কারণে ভিতরের চামড়ার রঙ নযরে আসে। এজন্য মুসলিম মহিলাদের পাতলা শাড়ি, ওড়না প্রভৃতি পোষাক পরিধান করে বাইরে যাওয়া জায়েয নয়।[19] আলকামাহ ইবনু আবু আলকামাহ (রাঃ) তাঁর মাতা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,دَخَلَتْ حَفْصَةُ بِنْتُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ عَلَى عَائِشَةَ وَعَلَيْهَا خِمَارٌ رَقِيقٌ فَشَقَّتْهُ عَائِشَةُ وَكَسَتْهَا خِمَارّا كَثَيفا، ‘একদিন হাফছাহ্ বিনতু আব্দুর রহমান (রাঃ) একটি খুব পাতলা ওড়না পরিহিত অবস্থায় আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট গেলেন। তখন আয়েশা (রাঃ) উক্ত পাতলা ওড়নাখানা ছিঁড়ে ফেললেন এবং তাকে একটি মোটা ওড়না পরিয়ে দিলেন’।[20] আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,

صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلاَتٌ مَائِلاَتٌ رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ لاَيَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلاَيَجِدْنَ رِيحَهَاوَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا.

‘দুই শ্রেণীর মানুষ জাহান্নামের অধিবাসী, যাদেরকে আমি দেখিনি (তারা ভবিষ্যতে আসবে।) প্রথম শ্রেণী (অত্যাচারীর দল) যাদের সঙ্গে থাকবে গরুর লেজের মত চাবুক, যা দ্বারা তারা লোককে প্রহার করবে। আর দ্বিতীয় শ্রেণী হ’ল সেই নারী যারা কাপড় পরিধান করেও উলঙ্গ থাকবে, যারা পুরুষদের আকৃষ্ট করবে এবং নিজেরাও তাদের প্রতি আকৃষ্ট হবে, যাদের মাথা (খোপা বাঁধার কারণে) উটের হেলে যাওয়া কুঁজের মত হবে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, তার গন্ধও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধি এত এত দূর থেকে পাওয়া যাবে’।[21]

আয়েশা (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, একদা আসমা বিনতু আবুবকর (রাঃ) পাতলা কাপড় পরিহিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট আসলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘হে আসমা! মেয়েরা যখন সাবালিকা হয় তখন এই দু’টি অঙ্গ ছাড়া অন্য কোন অঙ্গ প্রকাশ করা তার জন্য সংগত নয়। এ বলে তিনি তাঁর চেহারা ও দু’হাতের কব্জির দিকে ইশারা করেন’।[22]

৯. পশ্চিমা সংস্কৃতি : পশ্চিমাদের নিকট খোলামেলা পোষাকে চলা, বেপর্দায় নিজেকে প্রদর্শন করা অন্যায় নয়। অনেক মুসলিম ছেলে-মেয়ে পশ্চিমাদের অনুকরণে পোষাক পরিধান, তাদের স্টাইলে চলা এবং তাদের মত বেশ ধারণ করে আধুনিক হওয়ার চেষ্টা করে। এভাবে পাশ্চাত্যের অনুকরণে ছেলে-মেয়েরা খোলামেলা পোষাক পরা এবং নারী-পুরুষ অবাধে মেলা-মেশা করার কারণে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে।

১০. অসমতা : বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ের বয়স, আর্থিক সচ্ছলতা, পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বয়সের অধিক ব্যবধানের ফলে অনেক সময় স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মানসিক অশান্তি সৃষ্টি হয়। যা এক সময় স্থায়ী বিচ্ছেদের রূপ পরিগ্রহ করে কিংবা তারা পরকীয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এজন্য ইসলাম বয়স, সম্পদ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সমতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,تَخَيَّرُوْا لِنُطَفِكُمْ وَانْكِحُوا الْأَكْفَاءَ وَأَنْكِحُوا إِلَيْهِمْ، ‘তোমরা ভবিষ্যত বংশধরদের স্বার্থে উত্তম মহিলা গ্রহণ কর এবং সমতা বিবচেনায় বিবাহ কর, আর বিবাহ দিতেও সমতার প্রতি লক্ষ্য রাখ’।[23]

১১. প্রযুক্তির সহজলভ্যতা : প্রযুক্তি যেমন মানুষের জীবনকে সহজ ও গতিময় করেছে তেমনি অনেক ক্ষেত্রে এর অপকারিতা জীবনকে নষ্ট করে দিচ্ছে। হাতের নাগালে মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেইসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক বিভিন্ন মাধ্যমে থাকার কারণে প্রতিনিয়ত অনেকের সাথে পরিচয় হচ্ছে এ পরিচয় থেকে অনেকে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ছে।

১২. কর্মসংস্থান : কর্মসংস্থান পৃথক হওয়ার কারণে অনেক স্বামী-স্ত্রী একসাথে অবস্থান করতে পারে না। ফলে পুরুষ তার অফিসের মহিলা সহকর্মীর সাথে এবং নারী তার অফিসের পুরুষ সহকর্মীর সাথে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ‘ক্রিয়ার মেন্টাল হেলথ ইউনিট’-এর সাইকোলজিস্ট ইশরাত জাহান বীথি বলেন, পরকীয়ায় জড়ানোর একটি বড় কারণ হ’ল শূন্যতা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যখন শূন্যতা তৈরী হয়, তখন আরেকজন সেখানে প্রবেশ করে। হয়তো স্বামী বা স্ত্রী আর আগের মতো করে কথা বলে না বা আদর করে না। যত্ন কম নেয়। এসব কারণে অন্যের প্রতি আসক্তি তৈরি হয়।[24]

১৩. বিদেশী টিভি চ্যানেলের প্রভাব : বিদেশী টিভি চ্যালেনগুলো পরকীয়ার জন্য বিশেষভাবে দায়ী। এসব চ্যানেলগুলো বিভিন্ন সিরিয়ালের আড়ালে মানুষদেরকে পারিবারিক কলহ, স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব বিশেষ করে পরকীয়ার শিক্ষা দিয়ে থাকে।

১৪. আইনের দুর্বলতা: আধুনিক সমাজে পরকীয়ার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব বজায় থাকলেও এটি আইনত অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না, তবে অভিযোগ প্রমাণিত হ’লে পরকীয়াকারী ব্যক্তির বিবাহিত সঙ্গী তার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য কোর্টে আবেদন করতে পারেন।[25] বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে কারো স্ত্রী যদি পরকীয়ায় লিপ্ত হয় তাহ’লে স্বামীর কোন আইনগত প্রতিকার নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক প্রদান করতে পারে। পরকীয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে স্ত্রীর কোন শাস্তির বিধান নেই। কিন্তু দন্ডবিধির ৪৯৭ ধারা অনুসারে স্ত্রীর প্রেমিকের শাস্তির বিধান করা হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করেছে তাকে আইনের মুখোমুখি করানো যাবে। কিন্তু স্ত্রীকে আইনে সোপর্দ করা যাবে না। এমনকি স্ত্রীকে অপরাধের সাহায্যকারী হিসাবেও গণ্য করা যাবে না।

ইসলামে পরকীয়ার শাস্তি : ইসলামে যেসব অপরাধের দন্ড উল্লেখিত হয়েছে, তন্মধ্যে পরকীয়ার মাধ্যমে সংঘটিত যেনা-ব্যভিচারের শাস্তিই সবচেয়ে কঠিন। নিম্নে এ বিষয়ে উল্লেখ করা হ’ল।-

যেনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া : ইসলামে ব্যভিচারের সকল উপায়-উপকরণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও কেউ ব্যভিচার করলে তাকে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হ’তে হয়। সাক্ষ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে যেনা-ব্যভিচার প্রমাণিত হলে এর দু’ধরণের শাস্তি রয়েছে।-

এক. অবিবাহিত নারী-পুরুষের শাস্তি : পরকীয়ার দুই জনের একজন যদি অবিবাহিত হয় তাহ’লে তার শাস্তি হ’ল- ১০০ বেত্রাঘাত ও এক বছরের জন্য নির্বাসন দেওয়া। মহান আল্লাহ বলেন,الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللهِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ، ‘ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী- তাদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত করবে। আল্লাহর বিধান কার্যকরীকরণে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে প্রভাবিত না করে। যদি তোমরা আল্লাহ এবং আখেরাতের উপর ঈমানদার হও; আর মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে’ (নূর ২৪/২)

দুই. বিবাহিত নারী-পুরুষের শাস্তি : বিবাহিত ব্যভিচারীর জন্য পাথর নিক্ষেপে মৃত্যু নিশ্চিত করা। আবূ হুরায়রাহ ও যায়দ ইবনু খালিদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তাঁরা বলেছেন, একবার দু’লোক ঝগড়া করতে করতে নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে এলো। তাদের একজন বলল, আল্লাহর কিতাব মুতাবিক আমাদের মাঝে ফায়ছালা করে দিন। দু’জনের মধ্যে বুদ্ধিমান লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে আল্লাহর কিতাব মুতাবিক ফায়ছালা করে দিন। আর আমাকে কিছু বলার অনুমতি দিন। তিনি বললেন, বল। লোকটি বলল, আমার পুত্র এ লোকটির কাছে চাকর হিসাবে ছিল। আমার পুত্র তার স্ত্রীর সঙ্গে যেনা করেছে। লোকেরা বলেছে, আমার পুত্রের (শাস্তি) রজম হবে। তাই আমি একশ’ বকরি ও একটি বাঁদী নিয়ে তার ফিদইয়া দিয়েছি।

এরপর আমি আলেমদের নিকট এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছি। তারা আমাকে জানালেন যে, আমার পুত্রের একশ’ বেত্রাঘাত ও এক বছরের নির্বাসন হবে। আর রজম হবে ঐ ব্যক্তির স্ত্রীর। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, কসম ঐ সত্তার, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! আমি তোমাদের উভয়ের মধ্যে অবশ্যই আল্লাহর কিতাব মুতাবিক ফায়ছালা করে দেব। তোমার বকরী ও বাঁদী তোমাকেই ফিরিয়ে দেয়া হবে। তিনি তাঁর পুত্রকে একশ’ বেত্রাঘাত ও এক বছরের জন্য নির্বাসিত করলেন। আর উনায়ক আসলামীকে আদেশ দেয়া হ’ল অন্য লোকটির স্ত্রীর কাছে যাওয়ার জন্য। সে যদি (ব্যভিচার) স্বীকার করে তবে তাকে রজম করতে। সে তা স্বীকার করল। সুতরাং তাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা হ’ল।[26]

বুরায়দাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন মায়েয ইবনু মালিক নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ‘আমাকে পবিত্র করুন’। তিনি বললেন, তোমার ওপর আক্ষেপ হয়, ফিরে যাও এবং আল্লাহর নিকটে ক্ষমা চাও ও তওবা কর। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি চলে গেলেন কিন্তু কিছু দূরে গিয়ে পুনরায় ফিরে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে পবিত্র করুন। নবী করীম (ছাঃ)

এবারও তাকে পূর্বের ন্যায় বললেন। এভাবে যখন তিনি চতুর্থবার এসে বললেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, আচ্ছা! তোমাকে আমি কিসের থেকে পবিত্র করব? তিনি বললেন, যিনা থেকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, সে কি পাগল? জানানো হ’ল, না সে পাগল নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তবে কি সে মদ্যপায়ী? তখন জনৈক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে তার মুখ শুঁকলেন, কিন্তু মদের গন্ধ পাওয়া গেল না। তখন তিনি বললেন, أَزَنَيْتَ؟ قَالَ: نَعَمْ فَأَمَرَ بِهِ فَرُجِمَ ‘তুমি কি যিনা করেছ? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর তিনি তাকে রজম করার নির্দেশ দিলেন। তখন তাকে রজম করা হ’ল।

এ ঘটনার পর আয্দ বংশের গামিদী গোত্রের জনৈক নারী এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাকে পবিত্র করুন। তিনি বললেন, তোমার ওপর আক্ষেপ হয়, ফিরে যাও! আল্লাহ তা‘আলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তওবা কর। তখন সে বলল, আপনি মায়েয ইবনু মালিককে যেভাবে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আমাকেও কি অনুরূপ ফিরিয়ে দিতে চান? অথচ আমি তো সেই নারী যে যিনার দ্বারা অন্তঃসত্তা। তখন তিনি বললেন, সত্যি কি তুমি যিনার দ্বারা গর্ভবতী? মহিলা বলল, জি, হ্যাঁ! নবী করীম (ছাঃ) বললেন, যাও! তোমার পেটের বাচ্চা প্রসব হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর। তখন এক আনছারী মহিলাটির বাচ্চা প্রসব হওয়া পর্যন্ত তাকে নিজ তত্ত্বাবধানে নিয়ে গেলেন। অতঃপর সন্তান হওয়ার পর ঐ লোকটি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, গামিদী গোত্রীয় মহিলা বাচ্চা প্রসব করেছে। তখন তিনি বললেন, তার শিশু বাচ্চাটি রেখে এখন তাকে রজম করা যাবে না। কেননা বাচ্চাটির দুধ পান করানোর মতো কেউ থাকবে না। তখন আনছারদের থেকে জনৈক লোক দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর নবী! তাকে দুধপান করানোর দায়িত্ব আমার ওপর। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর তিনি তাকে রজম করলেন’।[27]

উল্লেখ্য যে, যেনা-ব্যভিচারের এই শাস্তি বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব কেবলমাত্র দেশের সরকারের। কোন ব্যক্তি বা সামাজিক দায়িত্বশীল তা বাস্তবায়ন করবে না। [ক্রমশঃ]

-মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ

তুলাগাঁও (নোয়াপাড়া), দেবিদ্বার, কুমিল্লা।

[1]. www.bn.wikipedia.org/wiki/পরকীয়া।

[2]. https://www.kalerkantho.com/online/Islamic-lifestylie/ 2019 /12/12/850097

[3]. বুখারী হা/৫০৬৬; মুসলিম হা/১৪০০।

[4]. বুখারী হা/৫২৩২; মুসলিম হা/২১৭২; তিরমিযী হা/১১৭১।

[5]. তিরমিযী হা/১১৭৩; ছহীহাহ হা/২৬৮৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৬৯০।

[6]. আবু দাউদ হা/৪১৭৩; নাসাঈ হা/৫১২৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৫৪০।

[7]. বুখারী হা/৬২৪৩; মুসলিম হা/২৬৫৭।

[8]. বুখারী হা/৬২৪৩; মুসলিম হা/২৬৫৭।

[9]. বুখারী হা/৫২৮৮; মুসলিম হা/১৮৬৬।

[10]. নাসাঈ হা/৪১৮১; ইবনু মাজাহ হা/২৮৭৪; ছহীহুল জামে‘ হা/২৫১৩।

[11]. ত্বাবারানী হা/৪৮৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২২৬।

[12]. বুখারী হা/১৮৬২; মুসলিম হা/১৩৪১ ‘হজ্জ অধ্যায়’।

[13]. মুসলিম, আবূদাউদ হা/১৭২৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৬৫০।

[14]. তিরমিযী হা/১১৭২; মুসনাদ আহমাদ হা/১৪৩২৪।

[15]. তিরমিযী হা/২১৬৫; ছহীহুল জামে‘ হা/২৫৬৪।

[16]. বুখারী হা/১৮৬২, ৩০০৬, ৩০৬১, ৫২৩৩; মুসলিম হা/৩৪১।

[17]. তিরমিযী হা/১১৭১; মিশকাত, হা/৩১১৮।

[18]. https://www.ntvbd.com/health/101693/পরকীয়ায়-মানুষ কেন -জড়ায়।

[19]. আলবানী, হিজাবুল মার‘আতিল মুসলিমা, পৃ: ৫৯।

[20]. মুওয়াত্ত্বা মালিক হা/৩৩৮৩; আস্-সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী হা/৩৩৯১; মিশকাত হা/৪৩৭৫।

[21]. মুসলিম হা/২১২৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৩২৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৭৯৯।

[22]. বায়হাকী; আবুদাউদ হা/৪১০৪।

[23]. ইবনু মাজাহ হা/১৯৬৮; ছহীহাহ হা/১০৬৭।

[24]. www.ntvbd.com/health/101693/

[25]. www.bn.wikipedia.org/wiki/পরকীয়া।

[26]. বুখারী হা/৬৬৩৩, ৬৬৩৪; মুসলিম হা/১৬৯৭, ১৬৯৮।

[27]. মুসলিম হা/১৬৯৫; মিশকাত হা/৩৫৬২।






বিষয়সমূহ: পাপ
মুসলমানদের রোম ও কন্সটান্টিনোপল বিজয় (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
এক নযরে হজ্জ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইসলামে পোশাক-পরিচ্ছদ : গুরুত্ব ও তাৎপর্য - মুহাম্মাদ আবু তাহের, পরিচালক, কিউসেট ইনস্টিটিউট, সিলেট।
বিতর্কের ক্ষেত্রে করণীয়-বর্জনীয় (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণ সমূহ (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
কবিগুরুর অর্থকষ্টে জর্জরিত দিনগুলো - ড. গুলশান আরা
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের আবশ্যকতা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
দান-ছাদাক্বা : পরকালীন পাথেয় সঞ্চয়ের অনন্য মাধ্যম - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইসলামে পোশাক-পরিচ্ছদ : গুরুত্ব ও তাৎপর্য (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আবু তাহের, পরিচালক, কিউসেট ইনস্টিটিউট, সিলেট।
আরও
আরও
.