আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করে জান্নাতে স্থান দিয়েছিলেন। কিন্তু
শয়তানের প্ররোচনায় আল্লাহর আদেশ অমান্য করার কারণে দুনিয়াতে নামিয়ে দিলেন।
আর শয়তানকে মানুষের শত্রু হিসাবে পাঠিয়ে দিলেন। শয়তান আল্লাহর সাথে
চ্যালেঞ্জ করেছিল যে, সে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে তাদের অধিকাংশকে জাহান্নামে
নিয়ে যাবে। শয়তানকে মানুষের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই
পরীক্ষাতে যারা পাশ করবে তাদের জন্য পরকালে রয়েছে জান্নাত। আর ফেল করলে
পরিণাম হবে জাহান্নাম।
শয়তান দুনিয়ার মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে নানাভাবে। খারাপকে ভাল বানিয়ে তার অনুসরণ করাচ্ছে এবং আল্লাহর বিধান থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তি জীবন থেকে আরম্ভ করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল জীবনে আমরা আল্লাহর বিধান থেকে অনেক দূরে ও শয়তানের বিধানের খুব কাছে অবস্থান করছি। অধিকাংশ মানুষ জানেই না যে কোন্টি ভাল কাজ আর কোন্টি শয়তানের কাজ। এই অজানাকে পুঁজি করে শয়তান মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টায় আল্লাহর ইবাদত থেকে দূরে রাখার কাজে ব্যস্ত। তাই আমাদেরকে শত্রু সম্পর্কে জানতে হবে, তার কাজ সম্পর্কে অবহিত হ’তে হবে ও শয়তানের চক্রান্ত থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে।
শয়তানের পরিচয় :
আদম (আঃ)-কে সৃষ্টির আগে পৃথিবীতে যে জিন জাতি বাস করত ‘ইবলীস’ ছিল তাদের অন্যতম (ক্বাহাফ-৫০)। শাহর ইবনু হাওশাব (রহঃ) বলেন, ‘ইবলীস জিন দলভুক্ত ছিল। যখন তারা পৃথিবীতে হাঙ্গামা সৃষ্টি করে, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের নিকট ফেরেশতাদের প্রেরণ করেন। ফেরেশতাগণ তাদের কতককে হত্যা করেন, কতককে বিভিন্ন দ্বীপে নির্বাসন দেন এবং কতককে বন্দী করেন। ইবলীস ছিল বন্দীদের একজন। ফেরেশতাগণ তাকে ধরে সঙ্গে করে আকাশে নিয়ে যান এবং সে সেখানেই রয়ে যায়’।[1] সে ছিল আগুনের সৃষ্টি (আর-রহমান ১৫; হিজর ২৭)। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, خُلِقَتِ الْمَلَائِكَةُ مِنْ نُوْرٍ وَخُلِقَ الْجَانُّ مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ ‘ফেরেশতাদেরকে নূর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর জিনদেরকে আগুনের শিখা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে’।[2] মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক (রহঃ) ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, ‘পাপে লিপ্ত হওয়ার পূর্বে ইবলীসের নাম ছিল ‘আযাযীল’। সে ছিল পৃথিবীর বাসিন্দা। অধ্যবসায় ও জ্ঞানের দিক থেকে ফেরেশতাদের মধ্যে সেই ছিল সকলের সেরা’।[3]
অতঃপর যখন আল্লাহ আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করে ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দিলেন তাকে সিজদা করার জন্য তখন সকল ফেরেশতা সিজদা করল কিন্তু ইবলীস সিজদা করল না। আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বলেছিলেন, আমি মানুষ সৃষ্টি করছি কাদা মাটি থেকে। যখন আমি তাকে সুষম করব এবং তাতে আমার রূহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হবে। তখন ফেরেশতারা সকলেই সিজদাবনত হ’ল কেবল ইবলীস ব্যতীত। সে অহংকার করল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হ’ল। তিনি বললেন, হে ইবলীস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করলাম, তার প্রতি সিজদাবনত হ’তে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি কি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে? না তুমি উচ্চ মর্যদাসম্পন্ন? সে বলল, আমি তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদা মাটি থেকে। তিনি (আল্লাহ) বললেন, তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও। নিশ্চয়ই তুমি বিতাড়িত এবং তোমার উপর আমার লা‘নত স্থায়ী হবে কর্মফল দিবস পর্যন্ত। সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে অবকাশ দিন পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত। তিনি বললেন, তুমি অবকাশ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হ’লে অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত। সে বলল, আপনার সম্মানের শপথ! আমি তাদের সকলকেই পথভ্রষ্ট করব। তবে তাদের মধ্যে একনিষ্ঠ বান্দাদের নয়। তিনি বললেন, তবে এটাই সত্য আর আমি সত্যই বলি। তোমার দ্বারা ও তোমার অনুসারীদের দ্বারা আমি জাহান্নাম পূর্ণ করবই’ (ছোয়াদ-৩৮/৭১-৮৫)। উক্ত ঘটনাটি বিভিন্ন ভাবে কুরআনের সূরা বাক্বারাহ, আ‘রাফ, হিজর, বনী ইসরাঈল, ত্বা-হা ও ছোয়াদে বর্ণিত হয়েছে।
আদমকে সিজদা না করার কারণে আল্লাহ ইবলীসকে জান্নাত থেকে বের করে দেন। আদম ও হাওয়াকে জান্নাতে থাকার আদেশ দেন এবং তাদেরকে জান্নাতের সকল নে‘মত ভোগ করার অনুমতি দেন কেবল একটি বৃক্ষ ছাড়া। শয়তান আদম ও হাওয়াকে বিভিন্নভাবে আল্লাহর আদেশ অমান্য করার জন্য কুমন্ত্রণা দিতে থাকে। সে আদম (আঃ)-কে এই বলে কুমন্ত্রণা দিল যে, ‘হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দেব অনন্ত জীবনপ্রদ বৃক্ষের কথা এবং অক্ষয় রাজ্যের কথা?’ (ত্বা-হা ১২০)। সে আরো বলল, আল্লাহ তোমাদেরকে এই গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছেন, কারণ যদি তোমরা ফল খাও তাহ’লে তোমার ফেরেশতা হয়ে যাবে, না হয় চিরস্থায়ী হয়ে যাবে। সুতরাং জান্নাতে চিরস্থায়ী হ’তে হ’লে এ বৃক্ষের ফল খাও’ (আ‘রাফ ২০-২২)। শয়তানের চক্রান্তে পড়ে আদম ও হাওয়া (আঃ) এক সময় নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেয়ে ফেলেন। তখন আল্লাহ ডেকে বলেন,
وَنَادَاهُمَا رَبُّهُمَا أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُل لَّكُمَا إِنَّ الشَّيْطَآنَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ، قَالاَ رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُوْنَنَّ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ-
‘তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে ডেকে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হ’তে বারণ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছি, যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং দয়া না করেন তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (আ‘রাফ ৭/২২-২৩)।
আল্লাহ পাক আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর অপরাধ ক্ষমা করে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় নামিয়ে দিলেন এবং শয়তানকে মানুষের জন্য শত্রু করে দিলেন। আর মানব জাতির জন্য নির্দেশ দিয়ে দিলেন,
قُلْنَا اهْبِطُواْ مِنْهَا جَمِيْعاً فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُم مِّنِّيْ هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُوْنَ، وَالَّذِيْنَ كَفَرُواْ وَكَذَّبُواْ بِآيَاتِنَا أُوْلَـئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ-
‘আমি বললাম, তোমরা সকলেই এ স্থান থেকে নেমে যাও। পরে যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট সৎপথের কোন নির্দেশ আসবে, তখন যারা আমার সৎপথের অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। যারা কুফরী করে ও আমার নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করে তারাই জাহান্নামী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/৩৮-৩৯)।
এই হ’ল শয়তান যাকে আমাদের আদি পিতা আদম (আঃ)-এর পূর্বে সৃষ্টি করা হয়েছিল। শয়তান জিন জাতির অন্তর্গত, যাদেরকে আল্লাহ আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তারা আদম সন্তানের মত পানাহার ও বংশ বিস্তার করে। তাদের কতক ঈমানদার ও কতক কাফের।[4] শয়তানের বংশধর সম্পর্কে আললাহ বলেন, أَفَتَتَّخِذُوْنَهُ وَذُرِّيَّتَهُ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُوْنِيْ وَهُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ بِئْسَ لِلظَّالِمِيْنَ بَدَلاً- ‘তোমরা কি আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করছ? অথচ তারা তোমাদের শত্রু। এটা যালিমদের জন্য খুবই নিকৃষ্ট বদল’ (কাহফ ১৮/৫০)। জিনদের মধ্যে যারা কাফির, শয়তান তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আর তাদের প্রধান নেতা হ’ল মানব জাতির শত্রু ইবলীস।[5]
শয়তান মানুষ, পশু-পাখি, এমনকি বন্য প্রাণীর আকৃতি ধারণ করতে পারে। যেমন কুরাইশদের নিকট বদর যুদ্ধের দিন সুরাকা বিন মালিকের আকৃতিতে এবং দারুন নদওয়ার বৈঠকে নাজদী শায়খের রূপ ধরে এসেছিল। শয়তান বাস্তবের ন্যায় স্বপ্নেও আসতে পারে এবং যে কোন রূপ ধারণ করতে পারে। তবে রাসূল (ছাঃ)-এর রূপ ধারণ করতে পারে না।[6]
‘শয়তান’ শব্দের অর্থ- দুরাচারী, পাপাচারী ইত্যাদি। অধিকাংশ শয়তান পাপের স্থান, ময়লা-আবর্জনার জায়গা যেমন পায়খানা, গোসলখানায় অবস্থান করে। এ কারণে রাসূল (ছাঃ) এসব স্থানে ছালাত পড়তে নিষেধ করেছেন ও পায়খানায় প্রবেশ করতে নির্দিষ্ট দো‘আ শিক্ষা দিয়েছেন।[7] আর শয়তান শুধু জিনদের মধ্যে থেকে নয় বরং মানুষের মধ্যেও হয়ে থাকে। মানুষদের মধ্যে যারা অন্যায় কাজ করে, অন্যকে অন্যায়ের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজে উৎসাহিত করে তারাই মানব শয়তান। এজন্যই কুরআনের সূরা নাসে জিন শয়তানের কাছ থেকে আশ্রয় গ্রহণের সাথে সাথে মানব শয়তান থেকেও আশ্রয়ের নির্দেশ এসেছে। হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, ‘শয়তান দু’প্রকার; জিন শয়তান সর্বদা মানুষের মনে ধোঁকা দেয়। আর মানুষ শয়তান প্রকাশ্যে ধোঁকা দেয়’।[8] ক্বাতাদাহ বলেন, ‘জিনের মধ্যেও শয়তান আছে, মানুষের মধ্যেও শয়তান আছে। তারা নিজ নিজ দলভুক্তদেরকে পাপকার্য শিক্ষা দেয়। তোমরা উভয় শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও’। ইকরিমা (রহঃ) বলেন, ‘মানবদের শয়তান হচ্ছে তারাই যারা মানুষকে পাপকার্যের পরামর্শ দেয়’।[9] একদা আবু যার গিফারী (রাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে বলেন, তুমি কি মানুষ শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চেয়েছ? লোকটি বলল, মানুষের শয়তান আছে কি? তিনি বললেন, হ্যঁা আছে। অতঃপর তিনি নিচের আয়াতটি পাঠ করলেন, وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نِبِيٍّ عَدُوّاً شَيَاطِيْنَ الإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوْحِيْ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُوْراً- ‘এমনিভাবে আমি প্রত্যেক নবীর জন্য শত্রু সৃষ্টি করেছি মানুষ শয়তান ও জিন শয়তানদের মধ্য থেকে। তারা ধোঁকা দেওয়ার জন্য একে অপরকে কারুকার্য খচিত কথাবার্তা শিক্ষা দেয়’ (আন‘আম ৬/১১২)।
মানুষের ন্যায় জিন জাতির উপরও আল্লাহর ইবাদত করা ফরয (যারিয়াত ৫৬)। তারাও ক্বিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে (আন‘আন ৬/১৩০)। মুহাম্মাদ (ছাঃ) মানুষের ন্যায় জিনদের জন্যও রাসূল রূপে প্রেরিত হয়েছিলেন। সূরা জিনের শুরুতে ও সূরা আর-রহমানে জিনদেরকে আল্লাহর রাসূলের দাওয়াতের কথা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি জীবকে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছেন। তাই শয়তান তথা জিনদেরও বিবাহ-শাদী হয়, ঘর-সংসার আছে এবং তাদেরও বংশ বৃদ্ধি হয় (কাহফ ১৮/৫০)। তাদের খাদ্য হচ্ছে হাড়। তা খাওয়ার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বললেই তা পূর্ণাঙ্গ গোশতে পরিণত হয়। আর গোবর হচ্ছে তাদের পশুর খাদ্য।[10] শয়তান মানুষের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে, যেভাবে রক্তনালী প্রবাহিত হয়।[11]
মানুষকে পাপের পথে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন শয়তান সব সময় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মানব শিশু জন্মের সাথে সাথেই শয়তান তাকে আঘাত করে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَا مِنْ مَوْلُوْدٍ يُوْلَدُ إِلاَّ وَالشَّيْطَانُ يَمَسُّهُ حِيْنَ يُوْلَدُ فَيَسْتَهِلُّ صَارِخًا مِنْ مَسِّ الشَّيْطَانِ إِيَّاهُ إِلاَّ مَرْيَمَ وَابْنَهَا- ‘প্রত্যেক শিশু সন্তান জন্মগ্রহণ করার সময় শয়তান তাকে স্পর্শ করে। শয়তানের স্পর্শমাত্রই সে চিৎকার করে উঠে। কিন্তু মারিয়াম (আঃ) ও তাঁর পুত্র ঈসা (আঃ)-কে পারেনি’।[12]
আর জন্মের সময়ে প্রত্যেকেই সত্য দ্বীনের উপর থাকে কিন্তু শয়তান তাকে সত্য দ্বীন থেকে বিচ্যুত করে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ বলেন, وَإِنِّيْ خَلَقْتُ عِبَادِيْ حُنَفَاءَ كُلَّهُمْ وَإِنَّهُمْ أَتَتْهُمْ الشَّيَاطِيْنُ فَاجْتَالَتْهُمْ عَنْ دِيْنِهِمْ- ‘আমি আমার বান্দাদের ‘হানীফ’ (অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ) রূপে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর শয়তান তার পিছে লেগে তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে দূরে নিয়ে যায়’।[13]
এমনিভাবে শয়তান প্রত্যেক মানুষকে জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এমনকি মৃত্যুর সময়ও ধোঁকা দিয়ে থাকে। তাই আল্লাহ দুনিয়াতে মানুষকে প্রেরণ করে আল্লাহর অনুসরণের নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাথে শয়তানের পদাংক অনুসরণ থেকে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, وَلاَ تَتَّبِعُواْ خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ- ‘তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না, নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (বাক্বারাহ ২/১৬৮, ২০৮; আন‘আম ৬/১৪২)। দুনিয়ার জীবন শেষে পরকালেও আল্লাহ শয়তানের অনুসরণ না করার প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। তাই মানুষকে লক্ষ্য করে আল্লাহর ওয়াদা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁর ইবাদত করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন,
أَلَمْ أَعْهَدْ إِلَيْكُمْ يَا بَنِيْ آدَمَ أَن لاَّ تَعْبُدُوْا الشَّيْطَانَ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ، وَأَنِ اعْبُدُوْنِيْ هَذَا صِرَاطٌ مُّسْتَقِيْمٌ، وَلَقَدْ أَضَلَّ مِنْكُمْ جِبِلاًّ كَثِيْراً أَفَلَمْ تَكُوْنُوْا تَعْقِلُوْنَ-
‘হে বনী আদম! আমি কি তোমাদেরকে বলে রাখিনি যে, শয়তানের ইবাদত করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু এবং আমার ইবাদত কর। এটাই সরল পথ। শয়তান তোমাদের অনেক দলকে পথভ্রষ্ট করেছে। তবুও কি তোমরা বুঝ না?’ (ইয়াসীন ৩৬/৬০-৬২)। শয়তান মানুষকে সব সময় জাহান্নামে নিতে চায়। তাই আমাদের উচিৎ শয়তান সম্পর্কে সচেতন থাকা ও একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর অনুসরণ করা।
শয়তানের কাজসমূহ :
শয়তানের কাজ হ’ল মানুষকে খারাপ ও মন্দ কাজের প্রতি আহবান করা। পৃথিবীতে যত মন্দকাজ আছে সবগুলিই শয়তানের কাজ। নিম্নে কুরআন ও হাদীছের আলোকে শয়তানের কতিপয় কাজ উল্লেখ করা হ’ল।-
১. মানুষকে বিপথগামী করা : আদম (আঃ)-কে সিজদা না করার কারণে যখন শয়তানকে দুনিয়াতে নামিয়ে দেয়া হ’ল তখন সে মানুষকে বিপথগামী করার দৃপ্ত শপথ করে। কুরআনের ভাষায়, قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِيْنَ- ‘সে (শয়তান) বলল, আপনার ইয্যতের কসম! আমি অবশ্যই তাদের সবাইকে বিপথগামী করে দেব’ (ছোয়াদ ৩৮/৮২)। বিপথগামী করার মাধ্যমে শয়তান মানুষদেরকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوْهُ عَدُوّاً إِنَّمَا يَدْعُو حِزْبَهُ لِيَكُوْنُوْا مِنْ أَصْحَابِ السَّعِيْرِ- ‘শয়তান তোমাদের শত্রু। সুতরাং তাকে শত্রু হিসাবে গ্রহণ কর। সে তো তার দলবলকে আহবান করে শুধু এজন্য যে, তারা যেন জাহান্নামী হয়’ (ফাতির ৩৫/৬)। ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমাদের জন্য রাসূল (ছাঃ) একটা দাগ টানলেন, অতঃপর বললেন, ‘এটা আল্লাহ তা‘আলার সোজা ও সঠিক রাস্তা। অতঃপর তার ডানে ও বামে আরো কিছু দাগ টানলেন। তারপর বললেন, এগুলি অন্য রাস্তা, যাদের প্রত্যেকটার শুরুতে শয়তান বসে মানুষদেরকে তার দিকে ডাকছে। তারপর কুরআন থেকে পড়লেন ‘অবশ্যই এর অনুসরণ করবে এবং অন্যান্য রাস্তাসমূহকে অনুসরণ কর না, তাহ’লে এ রাস্তাসমূহ তোমাদেরকে তাঁর রাস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। আল্লাহ তা‘আলা এভাবেই তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, যাতে তোমরা মুত্তাক্বী হ’তে পার’।[14]
২. চক্রান্ত করা: শয়তান সব সময় মানুষের বিরুদ্ধে চক্রান্তকরে থাকে। তার চক্রান্ত দুর্বল উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন,فَقَاتِلُوْا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيْفًا- ‘সুতরাং তোমরা জিহাদ করতে থাক শয়তানের পক্ষাবলম্বনকারীদের বিরুদ্ধে। নিশ্চয়ই শয়তানের চক্রান্ত একান্তই দুর্বল’ (নিসা ৪/৭৬)।
৩. মানুষের মাঝে শত্রুতা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করা ও ইবাদত থেকে বিরত রাখা: আল্লাহ বলেন,
إِنَّمَا يُرِيْدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوْقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَعَنِ الصَّلاَةِ فَهَلْ أَنْتُم مُّنْتَهُوْنَ-
‘শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও ছালাত থেকে তোমাদের বিরত রাখতে। অতএব তোমরা নিবৃত্ত হবে কি?’ (মায়েদা ৫/৯১)। জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি ‘আরব উপদ্বীপের মুসলমানদের কাছ থেকে শয়তান আনুগত্য পাওয়ার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, মনোমালিন্য ও পারস্পরিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যাপারে সে নিরাশ হয়নি’।[15]
৪. আল্লাহর বান্দাদের মাঝে ঝগড়া সৃষ্টি করা: আল্লাহ বলেন, وَقُل لِّعِبَادِيْ يَقُوْلُواْ الَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْزَغُ بَيْنَهُمْ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلإِنْسَانِ عَدُوّاً مُّبِيْناً- ‘আমার বান্দাদেরকে বলে দিন, তারা যেন যা উত্তম এমন কথাই বলে। শয়তান তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধায়। নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৫৩)।
জাবির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘শয়তান তার সিংহাসনকে পানির উপর স্থাপন করে। তারপর মানব সমাজে তার বাহিনীসমূহ প্রেরণ করে। তার দৃষ্টিতে ফেৎনা সৃষ্টি করায় যে যত বড়, মর্যাদায় সে তত বেশী নৈকট্যের অধিকারী। তাদের কেউ একজন আসে আর বলে যে, আমি অমুকের পেছনে লেগেই থাকি। অবশেষে তাকে এমন অবস্থায় রেখে এসেছি যে, সে এমন এমন জঘন্য কথা বলে বেড়াচ্ছে। একথা শুনে ইবলীস বলে, না, আল্লাহর শপথ! তুমি কিছুই করনি। আবার আরেকজন এসে বলে, আমি অমুক ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়েই তবে ছেড়েছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, একথা শুনে শয়তান তাকে কাছে টেনে নেয় এবং বলে, কত উত্তম কাজই না তুমি করেছো!’[16]
৫. প্ররোচিত করা: শয়তান মানুষকে খারাপ কাজের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে প্ররোচনা দিয়ে থাকে। সে সর্বপ্রথম প্ররোচনা দিয়েছিল আদম (আঃ) ও তাঁর স্ত্রী হাওয়া (আঃ)-কে। আল্লাহ বলেন,
فَوَسْوَسَ لَهُمَا الشَّيْطَانُ لِيُبْدِيَ لَهُمَا مَا وُورِيَ عَنْهُمَا مِن سَوْءَاتِهِمَا وَقَالَ مَا نَهَاكُمَا رَبُّكُمَا عَنْ هَـذِهِ الشَّجَرَةِ إِلاَّ أَنْ تَكُوْنَا مَلَكَيْنِ أَوْ تَكُوْنَا مِنَ الْخَالِدِيْنَ-
‘অতঃপর শয়তান উভয়কে প্ররোচিত করল, যাতে তাদের অঙ্গ, যা তাদের কাছে গোপন ছিল, তাদের সামনে প্রকাশ করে দেয়। সে বলল, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করেননি; তবে তা এ কারণে যে, তোমরা না আবার ফেরেশতা হয়ে যাও কিংবা হয়ে যাও চিরকাল বসবাসকারী’ (আ‘রাফ ৭/২০)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, فَوَسْوَسَ إِلَيْهِ الشَّيْطَانُ قَالَ يَا آدَمُ هَلْ أَدُلُّكَ عَلَى شَجَرَةِ الْخُلْدِ وَمُلْكٍ لَّا يَبْلَى- ‘অতঃপর শয়তান তাকে প্ররোচনা দিল, বলল, হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দেব অনন্তকাল জীবিত থাকার বৃক্ষের কথা এবং অবিনশ্বর রাজত্বের কথা’ (ত্বোয়া-হা ২০/১২০)।
৬. পাপ কাজকে সুশোভিত করা: শয়তান পাপ কাজকে সুশোভিত করে যাতে মানুষ সে দিকে আকৃষ্ট হয়। আল্লাহ বলেন, وَلَـكِنْ قَسَتْ قُلُوْبُهُمْ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ مَا كَانُواْ يَعْمَلُوْنَ- ‘বস্ত্ততঃ তাদের অন্তর কঠোর হয়ে গেল এবং শয়তান তাদের কাছে সুশোভিত করে দেখাল, যে কাজ তারা করছিল’ (আন‘আম ৬/৪৩)। হুদহুদ পাখি সুলায়মান (আঃ)-কে রাণী বিলকীসের জাতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিল,
وَجَدتُّهَا وَقَوْمَهَا يَسْجُدُوْنَ لِلشَّمْسِ مِنْ دُوْنِ اللهِ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ فَصَدَّهُمْ عَنِ السَّبِيْلِ فَهُمْ لاَ يَهْتَدُوْنَ-
‘আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যাবলী সুশোভিত করে দিয়েছে। অতঃপর তাদেরকে সৎপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে। অতঃপর তারা সৎ পথ পায় না’ (নামল ২৭/২৪)। সূরা আনকাবূতের ৩৮ নং আয়াতেও এ বিষয়ে আলোচনা এসেছে।
৭. কৃত ওয়াদা বা অঙ্গীকার ভঙ্গ করা: শয়তান মানুষের সাথে ওয়াদা করে যে, সে খারাপ কাজ করলে মানুষদেরকে সাহায্য করবে; পরে সে ওয়াদা ভঙ্গ করে। আল্লাহ বলেন, يَعِدُهُمْ وَيُمَنِّيْهِمْ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلاَّ غُرُوْراً- ‘সে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তাদেরকে আশ্বাস দেয়। শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা সব প্রতারণা বৈ কিছু নয়’ (নিসা ৪/১২০)। এছাড়া যাকাত দিলে ফকীর হয়ে যাবে এ ধরনের ধোঁকা শয়তান মানুষকে দিয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন,الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُم بِالْفَحْشَاء وَاللهُ يَعِدُكُم مَّغْفِرَةً مِّنْهُ وَفَضْلاً وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيْمٌ- ‘শয়তান তোমাদেরকে অভাব-অনটনের ওয়াদা (ভীতি প্রদর্শন) করে এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তা‘আলা নিজের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও বেশী অনুগ্রহের ওয়াদা করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সুবিজ্ঞ’ (বাক্বারাহ ২/২৬৮)। ক্বিয়ামতের দিন যারা শয়তানের ওয়াদা অনুযায়ী চলেছে তারা যখন দেখবে যে তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে না তখন তারা শয়তানকে দোষারোপ করবে। এর জবাবে শয়তান বলবে, وَقَالَ الشَّيْطَانُ لَمَّا قُضِيَ الأَمْرُ إِنَّ اللهَ وَعَدَكُمْ وَعْدَ الْحَقِّ وَوَعَدتُّكُمْ فَأَخْلَفْتُكُمْ- ‘যখন সব কিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে তখন শয়তান বলবে, আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্য প্রতিশ্রুতি, আমিও তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিনি’ (ইবরাহীম ১৪/২২)।
৮. প্রতারণা করা: শয়তান মানুষকে যে ওয়াদা দেয় সে ওয়াদা আসলে ওয়াদা নয় বরং প্রতারণা মাত্র। আদমকে সিজদা না করার ঘটনায় আল্লাহ শয়তানের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلاَّ غُرُوْرًا- ‘প্রতারণা ছাড়া শয়তান কোন ওয়াদা দেয় না’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৬৪)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘এমনিভাবে আমি প্রত্যেক নবীর জন্য শত্রু করেছি শয়তান, মানব ও জিনকে। তারা প্রতারণা করার জন্য একে অপরকে কারূকার্যখচিত কথাবার্তা শিক্ষা দেয়। যদি আপনার পালনকর্তা চাইতেন, তবে তারা এ কাজ করত না’ (আন‘আম ৬/১১২)।
৯. খারাপ ও অশ্লীল কাজের আদেশ দেয়া : আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لاَ تَتَّبِعُوْا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ وَمَنْ يَتَّبِعْ خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ فَإِنَّهُ يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। যে কেউ শয়তানের পদাংক অনুসরণ করবে, তখন তো শয়তান নির্লজ্জতা ও মন্দ কাজেরই আদেশ করবে’ (নূর ২৪/২১)।
১০. মুসলমানদেরকে বিভক্ত করা: হাদীছে কুদসীতে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ বলেন, وَإِنِّيْ خَلَقْتُ عِبَادِيْ حُنَفَاءَ كُلَّهُمْ وَإِنَّهُمْ أَتَتْهُمْ الشَّيَاطِيْنُ فَاجْتَالَتْهُمْ عَنْ دِينِهِمْ وَحَرَّمَتْ عَلَيْهِمْ مَا أَحْلَلْتُ لَهُمْ- ‘বান্দাদেরকে আমি আমার প্রতি একাগ্রচিত্ত (তাওহীদমুখী) করে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর শয়তান তাদেরকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছে। ফলে আমি তাদের জন্য যা হালাল করেছিলাম তা হারাম করে দিয়েছে’।[17]
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, শয়তানের চক্রান্তের মধ্যে অন্যতম চক্রান্ত হচ্ছে, সাধারণ মানুষকে একই ঢং-এর একই পোষাক পরিধান, নির্দিষ্ট চাল-চলন অবলম্বন, নির্দিষ্ট পীর-মুরশিদ গ্রহণ, নবাবিষ্কৃত তরীকা ও নির্দিষ্ট একটি মাযহাব গ্রহণের আদেশ দেয়া এবং ঐ গুলিকে আঁকড়ে ধরা এমনভাবে তাদের উপর আবশ্যিক করে দেয়, যেমন তারা ফরয কার্যাবলী আকঁড়ে ধরে থাকে। যে ব্যক্তি তাদের ঐ সব কাজ করে না তাকে তারা দোষারোপ করে এবং নিন্দা করে। নির্দিষ্ট মাযহাব সমূহের অধিকাংশ মুক্বাল্লিদ ও ভ্রান্ত আক্বীদাবলম্বী ছূফীদের বিভিন্ন তরীকার মুরীদরা এ ধরনের আচরণ করে থাকে। যেমন- নকশাবন্দিয়াহ, ক্বাদরিয়াহ, সহরওয়ারদিয়াহ, শাযলিয়াহ তাজানিয়াহ প্রভৃতি দলের অনুসারীরা। তারা শরী‘আত ও হাকীকত নামের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে তারা যাবতীয় বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজে নিমজ্জিত হয়েছে। রাসূল (ছাঃ)-এর তরীকা ও এদের তরীকার মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান রয়েছে।[18]
১১. মুমিনদের সাথে তর্কের জন্য শয়তান তার অনুসারীদের পরামর্শ দেয় : আল্লাহ বলেন, إِنَّ الشَّيَاطِيْنَ لَيُوْحُوْنَ إِلَى أَوْلِيَآئِهِمْ لِيُجَادِلُوْكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوْهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُوْنَ- ‘নিশ্চয়ই শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে প্রত্যাদেশ করে যেন তারা তোমাদের সাথে তর্ক করে। যদি তোমরা তাদের অনুগত্য কর, তোমরাও মুশরিক হয়ে যাবে’ (আন‘আম ৬/১২১)।
১২. অপচয় ও অপব্যয় করা: অপচয় ও অপব্যয় শয়তানের কাজ। আল্লাহ বলেন, إِنَّ الْمُبَذِّرِيْنَ كَانُواْ إِخْوَانَ الشَّيَاطِيْنِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُوْراً- ‘নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ’ (বনী ইসরাঈল ১৭/২৭)।
১৩. ধোঁকা দেওয়া: আল্লাহ শয়তানের কাজ সম্পর্কে বলেন, وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُوْلاً- ‘শয়তান মানুষকে বিপদকালে ধোঁকা দেয়’ (ফুরক্বান ২৫/২৯)।
১৪. ভাল কাজে বাধা ও মন্দ কাজে উৎসাহ দান: আল্লাহ মুমিনদেরকে সতর্ক করে বলেন, وَلاَ يَصُدَّنَّكُمُ الشَّيْطَانُ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ- ‘শয়তান যেন তোমাদেরকে (ভাল কাজ করা থেকে) বাধা না দেয়। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (যুখরুফ ৪৩/৬২)। শয়তান ভাল কাজে বাধা দেওয়ার সাথে সাথে মন্দ কাজে উৎসাহিত করে। আল্লাহ বলেন, أَلَمْ تَرَ أَنَّا أَرْسَلْنَا الشَّيَاطِيْنَ عَلَى الْكَافِرِيْنَ تَؤُزُّهُمْ أَزّاً- ‘আপনি কি লক্ষ্য করেননি যে, আমি কাফেরদের উপর শয়তানকে ছেড়ে দিয়েছি। তারা তাদেরকে বিশেষভাবে (মন্দকার্যে) উৎসাহিত করে’ (মারিয়াম ১৯/৮৩)।
১৫. প্রভুত্ব বিস্তার করা ও আল্লাহর স্মরণ থেকে ভুলিয়ে দেওয়া: আল্লাহ বলেন, اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَأَنْسَاهُمْ ذِكْرَ اللهِ أُوْلَئِكَ حِزْبُ الشَّيْطَانِ أَلاَ إِنَّ حِزْبَ الشَّيْطَانِ هُمُ الْخَاسِرُوْنَ- ‘শয়তান তাদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করেছে, ফলে তাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর স্মরণ। তারা শয়তানেরই দল। সাবধান! শয়তানের দল অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত’ (মুজাদালা ৫৮/১৯)।
১৬. যাদু করা: আল্লাহ সুলায়মান (আঃ)-এর সময়ের অবস্থা বর্ণনা করে বলেন, وَاتَّبَعُواْ مَا تَتْلُواْ الشَّيَاطِيْنُ عَلَى مُلْكِ سُلَيْمَانَ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَـكِنَّ الشَّيْاطِيْنَ كَفَرُواْ يُعَلِّمُوْنَ النَّاسَ السِّحْرَ- ‘তারা ঐ শাস্ত্রের অনুসরণ করল, যা মুসলমানদের রাজত্বকালে শয়তানেরা আবৃত্তি করত। সুলায়মান কুফরী করেনি; শয়তানরাই কুফরী করেছিল। তারা মানুষকে যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিত’ (বাক্বারাহ ২/১০২)। জাবের বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-কে যাদু দ্বারা যাদু ছুটানো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, ‘এটি শয়তানের কাজ’।[19]
১৭. বিভ্রান্ত করা: ওহোদ যুদ্ধে মুসলমানদের অবস্থা বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ تَوَلَّوْا مِنْكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ إِنَّمَا اسْتَزَلَّهُمُ الشَّيْطَانُ بِبَعْضِ مَا كَسَبُوْا- ‘তোমাদের যে দু’টি দল লড়াইয়ের দিনে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল শয়তান তাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল, তাদেরই পাপের দরুন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৫)।
১৮. নিজের ইবাদত করানো: হাশরের দিনে জাহান্নামীদের বলবেন, أَلَمْ أَعْهَدْ إِلَيْكُمْ يَا بَنِي آدَمَ أَن لاَّ تَعْبُدُوْا الشَّيْطَانَ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ- ‘হে বনী আদম! আমি কি তোমাদেরকে বলে রাখিনি যে, শয়তানের ইবাদত করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (ইয়াসীন ৩৬/৬০)।
১৯. মদ, জুয়া ও শিরকের প্রচলন করা: আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُواْ إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالأَنْصَابُ وَالأَزْلاَمُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوْهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ-
‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কাজ বৈ তো নয়। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও’ (মায়েদা ৫/৯০)।
২০. কুফরীতে নিমজ্জিত করা: আল্লাহ বলেন,
كَمَثَلِ الشَّيْطَانِ إِذْ قَالَ لِلْإِنْسَانِ اكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّيْ بَرِيْءٌ مِّنْكَ إِنِّيْ أَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعَالَمِيْنَ-
‘তাদের দৃষ্টান্ত শয়তানের মত, যে মানুষকে বলে, কুফরী কর। অতঃপর যখন সে কুফরী করে তখন শয়তান বলে, তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, আমি জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি’ (হাশর ৫৯/১৬)।
[চলবে]
তুলাগাঁও, সুলতানপুর, দেবিদ্বার, কুমিল্লা।
[1]. হাফিয ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ১ম খন্ড (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১ম প্রকাশ, জুন ২০০০), পৃঃ ১৮৩।
[2]. মুসলিম হা/২৯৯৬; মুসনাদে আহমাদ হা/২৪৮২৬; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/১৮৪৬; মিশকাত হা/৫৭০১ ‘সৃষ্টির সূচনা ও নবীদের আলোচনা’ অনুচ্ছেদ।
[3]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৪২।
[4]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১ম খন্ড, ১৪৪ পৃঃ।
[5]. ঐ, পৃঃ ১৪৭।
[6]. বুখারী ‘ইলম’ অধ্যায় হা/১১০; মুসলিম, মিশকাত হা/৪৬০৯।
[7]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৩৭; ইবনু মাজাহ হা/২৯৭।
[8]. তাফসীরে কুরতুবী, সূরা নাস দ্রঃ।
[9]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, সূরা আন’আমের ১১২ নং আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
[10]. মুসলিম হা/৪৫০ ‘ছালাত’ অধ্যায়; তিরমিযী হা/৩২৫৮।
[11]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৬৮; তিরমিযী হা/১১৭২।
[12]. বুখারী, ‘তাফসীর’ অধ্যায় হা/ ৪১৮৯; মুসলিম, মিশকাত হা/৬৯।
[13]. মুসলিম হা/২৮৬৫ ‘জান্নাতের বিবরণ’ অধ্যায়; আহমাদ হা/১৬৮৩৭।
[14]. আহমাদ, নাসাঈ, হাকেম, তাফসীরে ইবনে কাছীর, সূরা আন‘আমের ১৫৩ নং আয়াতের তাফসীর দ্রঃ। পৃঃ ৩/৩৬৬, মিশকাত হা/১৬৬, সনদ হাসান।
[15]. মুসলিম হা/২৮১২; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/১৫৯৪।
[16]. মুসলিম হা/২৮১৩; মিশকাত ‘ঈমান’ অধ্যায়, হা/৭১।
[17]. মুসলিম ‘জান্নাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ হা/২৮৬৫; মিরকাত, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৭৫, টীকা নং ৯০; তাফসীর ইবনে কাছীর, ১১তম খন্ড, পৃঃ ২৬।
[18]. মুহাম্মদ সুলতান আল-মা‘ছুমী আল-খাজান্দী আল-মাক্কী, মুসলিম কি চার মাযহাবের নির্দিষ্ট এক মাযহাব অনুসরণ করতে বাধ্য, অনুবাদ: আবু তাহের (সিরাজগঞ্জ: রুকাইয়া প্রকাশনী, ১ম প্রকাশ, ২০০০), পৃঃ ৬৩।
[19]. আহমাদ হা/১৪১৬৭, ৩/২৯৪; আবু দাউদ হা/৩৮৬৮; মিশকাত হা/৪৫৫৩, সনদ ছহীহ।