দ্বীন সম্পর্কে বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ হ’লেন আলেম। যারা দ্বীনের সংরক্ষণ, দ্বীনী ইলম বিতরণ ও প্রচার-প্রসারের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে থাকেন। ফলে ইহকালে যেমন তারা নন্দিত ও বরিত হন, তেমনি পরকালে জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যমে সম্মানিত ও সফলতা লাভে ধন্য হবেন। কুরআন-হাদীছে তাদের গুরুত্ব ও মর্যাদা সবিস্তার আলোচিত হয়েছে। আলোচ্য নিবন্ধে তা উপস্থাপন করা হ’ল।-
(১) প্রত্যেক মানুষ আলেমের মুখাপেক্ষী : পৃথিবীর সকল মানুষকে কখনও না কখনও আলেমের মুখাপেক্ষী হ’তে হয়। আমল বাস্তবায়নের জন্য আলেমদের থেকে জ্ঞান লাভ করা যরূরী। তাইতো মহান আল্লাহ বলেন, فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ، ‘যদি তোমরা না জানো, তাহ’লে জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস কর’ (নাহল ১৬/৪৩; আম্বিয়া ২১/৭)।
উপরোক্ত আয়াতে আলেমদেরকে জিজ্ঞেস করার নির্দেশ এসেছে। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ‘আহলুয যিকর’ হ’ল ‘আহলুল কুরআন’। কেউ কেউ বলেন, আহলুু যিকর হ’ল জ্ঞানীগণ।[1] আব্দুর রহমান আস-সা‘দী (রহঃ) বলেন, ‘এই আয়াতে জ্ঞানীদের প্রশংসা করা হয়েছে। কেননা তাদের কাছে জিজ্ঞেস করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।[2] আলেমদেরকে জিজ্ঞেস না করে অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করলে দুনিয়া ও আখেরাতে বিপদ হ’তে পারে। যেমন পূর্বযুগে ৯৯ জনকে হত্যাকারী ব্যক্তির ঘটনা। এজন্য আবুদ্দারদা (রাঃ) বলেন,مثل العلماء فى الناس كمثل النجوم فى السماء يهدى بها، ‘মানুষের মধ্যে আলেমদের উদাহরণ আকাশের নক্ষত্রের মত। যার দ্বারা পথের দিশা লাভ করা যায়’।[3]
(২) আল্লাহ আলেমের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিয়েছেন : আল্লাহ দ্বীনী ইলমের অধিকারীকে দুনিয়া ও আখেরাতে মর্যাদাবান করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,يَرْفَعِ اللهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا العِلْمَ دَرَجَاتٍ، ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করবেন’ (মুজাদালা ৫৮/১১)। প্রকৃত আলেম তারা যারা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের জ্ঞানে বিজ্ঞ। আর এই জ্ঞান তাদেরকে সম্মানিত করে। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِن الله يَرْفَعُ بِهَذَا الْكِتَابِ أَقْوَامًا وَيَضَعُ بِهِ آخَرِينَ ‘আল্লাহ তা‘আলা এ কিতাব কুরআনের মাধ্যমে কোন কোন জাতিকে উন্নতি দান করেন। আবার অন্যদেরকে করেন অবনত’।[4] আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন,مَدَحَ اللهُ الْعُلَمَاءَ فِي هَذِهِ الْآيَةِ، ‘আল্লাহ এই আয়াতে আলেমদের প্রশংসা করেছেন’।[5] ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,إن العلم يرفع صاحبه في الدنيا والآخرة ما لا يرفعه الملك ولا المال ولا غيرهما، فالعلم يزيد الشريف شرفاً ويرفع العبد المملوك حتى يجلسه مجالس الملوك، ‘নিশ্চয়ই ইলম তার অধিকারীকে দুনিয়া ও আখেরাতে মর্যাদাবান করে, যা রাজত্ব, সম্পদ বা অন্য কিছু করতে পারে না। আর ইলম মর্যাদাবানের মর্যাদা বাড়িয়ে দেয় এবং মালিকানাধীন দাসকে উঁচু করে তোলে যতক্ষণ না সে রাজাদের পরিষদে বসে’।[6]
দুনিয়া ও আখেরাতে দ্বীনী জ্ঞানে পারদর্শিরাই সম্মানিত হবেন। আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! মানুষের মাঝে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, তাদের মধ্যে যে সর্বাধিক মুত্ত্বাকী। তখন তারা বলল, আমরা তো আপনাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করিনি। তিনি বললেন, তাহ’লে আল্লাহর নবী ইউসুফ, যিনি আল্লাহর নবীর পুত্র, আল্লাহর নবীর পৌত্র এবং আল্লাহর খলীল-এর প্রপৌত্র। তারা বলল, আমরা আপনাকে এ ব্যাপারেও জিজ্ঞেস করিনি। তিনি বললেন, তাহ’লে কি তোমরা আরবের মূল্যবান গোত্রসমূহ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছ? خِيَارُهُمْ فِي الْجَاهِلِيَّةِ خِيَارُهُمْ فِي الْإِسْلَامِ إِذَا فَقُهُوْا، ‘জাহেলী যুগে তাদের মধ্যে যারা সর্বোত্তম ব্যক্তি ছিলেন, ইসলামেও তাঁরা সর্বোত্তম ব্যক্তি যদি তাঁরা ইসলাম সম্পর্কিত জ্ঞানার্জন করেন’।[7]
ইসলামে আবেদ অপেক্ষা আলেমের মর্যাদা অধিক। আবূ উমামাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,فَضْلُ العَالِمِ عَلَى العَابِدِ كَفَضْلِي عَلَى أَدْنَاكُمْ ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللهِ إِنَّ اللهَ وَمَلاَئِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّماوَاتِ وَالأَرْضِ حَتَّى النَّمْلَةَ فِي جُحْرِهَا وَحَتَّى الحُوْتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِي النَّاسِ الخَيْرَ، ‘আলেমের মর্যাদা আবেদের উপর ঠিক তদ্রূপ, যেরূপ আমার ফযীলত তোমাদের উপর। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন, তাঁর ফেরেশতাকুল, আসমান-যমীনের সকল বাসিন্দা এমনকি গর্তের পিপড়া এবং (পানির মধ্যে) মাছ পর্যন্ত মানবমন্ডলীর শিক্ষাগুরুদের জন্য কল্যাণ কামনা ও নেক দো‘আ করে থাকে’।[8] আবুদ্দারদা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, আবেদ বা ইবাদতকারী ব্যক্তির উপর আলেমের মর্যাদা হ’ল যেমন সমস্ত তারকার উপর পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদা’।[9]
হাসান বছরী (রহঃ) হ’তে মুরসালরূপে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে বনী ইসরাঈলের দু’জন লোক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’ল। তাদের একজন ছিলেন আলেম, যিনি ওয়াক্তিয়া ফরয ছালাত আদায় করার পর বসে বসে মানুষকে তা‘লীম দিতেন। আর দ্বিতীয়জন দিনে ছিয়াম পালন করতেন এবং রাত জেগে ইবাদত করতেন। রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, এ দু’ব্যক্তির মধ্যে মর্যাদার দিক দিয়ে উত্তম কে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ফরয ছালাত আদায় করার পর যে ব্যক্তি মানুষকে তা‘লীম দেয়, সে দিনে ছিয়াম পালনকারী ও রাতে ইবাদাতকারী অপেক্ষা অধিক মর্যাদাবান। যেমন তোমাদের একজন সাধারণ মানুষের উপরে আমার মর্যাদা।[10] আলী (রাঃ) বলেন, العالم أفضل من الصائم القائم المجاهد، ‘একজন আলেম ছিয়াম পালনকারী, তাহাজ্জুদ আদায়কারী ও মুজাহিদের চেয়েও উত্তম’।[11]
(৩) আলেমের জন্য সবার দো‘আ রয়েছে : আলেমদের জন্য আসমান ও যমীনের সবাই আল্লাহর কাছে দো‘আ করেন। আবূদ্দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,وَإِنَّ العَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الأَرْضِ حَتَّى الحِيتَانُ فِي المَاءِ، ‘নিশ্চয়ই আলেম ব্যক্তির জন্য আকাশ-পৃথিবীর সকল বাসিন্দা এমনকি পানির মাছ পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে’।[12] আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,الخَلْقُ كلُّهُمْ يُصَلُّونَ على مُعَلِّمِ الخيرِ حتى نِينانِ البَحْرِ، ‘সৃষ্টির সবকিছুই দ্বীন শিক্ষা দানকারীর জন্য দো‘আ করে থাকে, এমনকি সমুদ্রের মাছও তাদের জন্য দো‘আ করে’।[13]
(৪) আলেমের সাথে ঈর্ষা করা যায় : হিংসা করা মহাপাপ (বনু ইস্রা্ঈল ১৭/৩৭)[14] হ’লেও দু’টি ক্ষেত্রে ঈর্ষা করা জায়েয। ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ حَسَدَ إِلاَّ فِي اثْنَتَيْنِ : رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالاً، فَسَلَّطَهُ عَلَى هَلَكَتِهِ فِي الحَقِّ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ الحِكْمَةَ فَهُوَ يَقْضِي بِهَا وَيُعَلِّمُهَا، ‘কেবল দু’জন ব্যক্তি ঈর্ষার পাত্র। ১. সেই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছেন এবং তাকে তা সৎপথে ব্যয় করার সামর্থ্যও দিয়েছেন। ২. সেই লোক, যাকে আল্লাহ জ্ঞান-বুদ্ধি দান করেছেন, যার দ্বারা সে বিচার-ফায়ছালা করে থাকে ও তা অপরকে শিক্ষা দেয়’।[15]
(৫) জ্ঞানীরাই আল্লাহর একতেবর সাক্ষ্য দান করেন : আল্লাহ সম্পর্কে সাক্ষ্য দেওয়ার পূর্বে যরূরী বিষয় হ’ল তাঁর সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা (মুহাম্মাদ ৪৭/১৯)। যারা আল্লাহ সম্পর্কে যতবেশী জ্ঞানী তারা ততবেশী আল্লাহকে ভয় করে।[16] আর যারা জ্ঞানী তারাই মহান আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দিয়ে থাকেন। মহান আল্লাহ বলেন,شَهِدَ اللهُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيْمُ، ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আর ফেরেশতামন্ডলী ও ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (আলে ইমরান ৩/১৮)। ইমাম কুরতবী (রহঃ) বলেন,هَذِهِ الْآيَةِ دَلِيلٌ عَلَى فَضْلِ الْعِلْمِ وَشَرَفِ الْعُلَمَاءِ وَفَضْلِهِمْ، ‘এই আয়াত ইলম ও আলেমদের সম্মান-মর্যাদার প্রমাণ বহন করে।[17] হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) বলেন, এ আয়াত দ্বারা আলেমদের মর্যাদা সাব্যস্ত হয়েছে’।[18] ইবনুল কাইয়িম (রহঃ) বলেন, এই আয়াত দ্বারা ইলম ও আলেমের ফযীলত বিভিন্নভাবে ফুটে উঠে- ১. মানুষের মধ্যে কেবলমাত্র আলেমের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। ২. আল্লাহর সাক্ষ্যের সাথে আলেমের সাক্ষ্যকে যুক্ত করেছেন। ৩. ফেরেশতাদের সাক্ষ্যের সাথে আলেমদের সাক্ষ্যকে যুক্ত করেছেন। ৪. পরস্পর সাক্ষ্য সংযুক্তিই আলেমদের প্রশংসা ও ন্যায়পরায়ণতার প্রমাণ। কেননা আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি ছাড়া কারো সাক্ষ্য গ্রহণ করেন না।[19]
(৬) আলেমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী : আবূদ্দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,فَضْلُ العَالِمِ عَلَى العَابِدِ كَفَضْلِ القَمَرِ عَلَى سَائِرِ الكَوَاكِبِ وَإِنَّ العُلَمَاءَ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ وَإِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَاراً وَلاَ دِرْهَماً وَإِنَّمَا وَرَّثُوا العِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بحَظٍّ وَافِرٍ ‘আবেদের উপর আলেমের ফযীলত ঠিক তেমন, যেমন সমস্ত নক্ষত্রপুঞ্জের উপর পূর্ণিমার চাঁদের ফযীলত। আলেমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী। আর এ কথা সুনিশ্চিত যে, নবীগণ কোন স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্রার কাউকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে যাননি; বরং তাঁরা ইলমের (দ্বীনী জ্ঞানের) উত্তরাধিকারী বানিয়ে গেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা অর্জন করল, সে পূর্ণাংশই লাভ করল’।[20] অন্যত্র এসেছে যে, দ্বীনী ইলম হচ্ছে রাসূল (ছাঃ)-এর মীরাছ বা উত্তরাধিকারী সম্পদ।[21]
(৭) আলেমরাই আল্লাহকে সর্বাধিক ভয় করে : আলেমগণ যেহেতু আল্লাহর কর্তৃত্ব, বড়ত্ব ও মহত্ত সম্পর্কে অন্যদের তুলনায় অধিক অবগত সেহেতু আলেমরাই আল্লাহকে অধিক ভয় করে। মহান আল্লাহ বলেন, إنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ العُلَمَاءُ ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল আলেমরাই আল্লাহকে ভয় করে’ (ফাতির ৩৫/২৮)। আল্লাহর ক্ষমতা, আল্লাহর কর্তৃত্ব সম্পর্কে জানা থাকলে আল্লাহকে ভয় করা যায়। আল্লাহ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বেশী জ্ঞাত ছিলেন, সেজন্য তিনি আল্লাহকে বেশী ভয় করতেন। তিনি ছিলেন সর্বাধিক মুক্তাকী।[22] আর উম্মাত সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে তবে তোমরা খুব কম হাসতে এবং বেশী কাঁদতে’।[23]
হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) বলেন, প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি যত বেশী আল্লাহ সম্বন্ধে জানবে সে তত বেশী আল্লাহর প্রভাবে প্রভাবিত হবে এবং তার অন্তরে তাঁর ভয় তত বেশী জাগ্রত হবে। যে জানবে যে, আল্লাহ সর্বশক্তিমান সে পদে পদে তাঁকে ভয় করতে থাকবে। আল্লাহ সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞান তার অন্তরে স্থান পাবে। সে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। তাঁর কৃত হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম জানবে। তাঁর বাণীর প্রতি বিশ্বাস রাখবে এবং তাঁর বাণী রক্ষা করতে চেষ্টা করবে। তাঁর সাথে সাক্ষাৎকে সে সত্য বলে মেনে নিবে। আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে ভীতি পর্দা স্বরূপ দাঁড়িয়ে থাকে। আল্লাহর নাফরমানীর মাখঝানে এটা বাধা হয়ে যায়।[24]
(৮) আলেম ব্যক্তিই ছালাতের ইমাম হবে : ছালাতে ইমাম হওয়া একটি সম্মানের বিষয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সহ ছাহাবীগণের যোগ্য ব্যক্তিবর্গ ইমামতি করেছেন। আর ইমাম হওয়ার জন্য দ্বীনী জ্ঞানে পারদর্শিরাই বেশী হকবদার। আবু মাসঊদ আনছারী (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,يَؤُمُّ الْقَوْمَ أَقْرَؤُهُمْ لِكِتَابِ اللهِ فَإِنْ كَانُوا فِي الْقِرَاءَةِ سَوَاءً فَأَعْلَمُهُمْ بِالسُّنَّةِ، ‘যে ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াতে বেশী পারদর্শী সে লোকদের ইমামতি করবে। যদি কুরআন পাঠে সবাই সমান হয়, তাহ’লে যে ব্যক্তি বেশী হাদীছ জানে’।[25]
(৯) প্রকৃত আলেমরাই কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা বুঝতে সক্ষম : মহান আল্লাহ মানবতার হেদায়াতের জন্য কুরআন নাযিল করেছেন। কিন্তু এ কুরআন সবাই অনুধাবন করতে পারে না। কেবল আলেমগণই সঠিকভাবে কুরআন অনুধাবন করতে সক্ষম। মহান আল্লাহ বলেন,
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللهُ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ،
‘তিনিই তোমার প্রতি এই কিতাব নাযিল করেছেন। যার মধ্যে কিছু আয়াত রয়েছে ‘মুহকাম’ বা সুস্পষ্ট অর্থবোধক। আর এগুলিই হ’ল কিতাবের মূল। আর কিছু আয়াত রয়েছে ‘মুতাশাবিহ’ বা অস্পষ্ট অর্থবোধক। অতঃপর যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে, তারা অস্পষ্ট আয়াতগুলির পিছে পড়ে ফিৎনা সৃষ্টির জন্য এবং তাদের মনমত ব্যাখ্যা দেবার জন্য। অথচ এগুলির সঠিক ব্যাখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। আর গভীর জ্ঞানীরা বলে, আমরা এগুলিতে বিশ্বাস স্থাপন করলাম। সবকিছুই আমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে এসেছে। বস্ত্তত জ্ঞানীরা ব্যতীত কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না’ (আলে ইমরান ৩/৭)।
(১০) জ্ঞানীদের জন্য কুরআন নিদর্শন : মহান আল্লাহ বলেন,
بَلْ هُوَ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ فِي صُدُورِ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَمَا يَجْحَدُ بِآيَاتِنَا إِلَّا الظَّالِمُونَ، ‘বরং যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, তাদের অন্তরে এটি (কুরআন) স্পষ্ট নিদর্শন। বস্ত্তত যালেমরা ব্যতীত কেউ আমাদের আয়াত সমূহকে অস্বীকার করে না’ (আনকাবূত ২৯/৪৯)। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,مدح سبحانه أهل العلم، وأثنى عليهم، وشرّفهم بأن جعل كتابه آيات بينات في صدورهم، وهذه خاصية ومنقبه لهم دون غيرهم، ‘আল্লাহ তা‘আলা জ্ঞানীদের প্রশংসা করেছেন, তাদের প্রশংসা করেছেন এবং তাঁর কিতাবকে তাদের বুকের মধ্যে স্পষ্ট আয়াত হিসাবে স্থাপন করে তাদের সম্মান করেছেন। এটি তাদের জন্য একটি বৈশিষ্ট্য এবং একটি গুণ, অন্যদের নয়’।[26]
(১১) আলেম ও জাহেল সমান নয় : আলেম ও জাহেলের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ هَلْ يَسْتَوي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لاَ يَعْلَمُونَ، ‘তুমি বল, যারা বিজ্ঞ এবং যারা অজ্ঞ, তারা কি সমান? বস্ত্তত জ্ঞানীরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে থাকে’ (যুমার ৩৯/৯)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,وَمَا يَسْتَوِي الْأَعْمَى وَالْبَصِيرُ، وَلَا الظُّلُمَاتُ وَلَا النُّورُ، وَلَا الظِّلُّ وَلَا الْحَرُورُ، وَمَا يَسْتَوِي الْأَحْيَاءُ وَلَا الْأَمْوَاتُ ‘বস্ত্তত অন্ধ ও চক্ষুস্মান কখনো সমান নয়। আর সমান নয় অন্ধকার ও আলো। আর সমান নয় ছায়া ও রৌদ্র। আর সমান নয় জীবিত ও মৃতগণ’ (ফাতির ৩৫/১৯-২২)। ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন, অন্ধ ও দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি বলতে আলেম
এবং জাহেলকে বুঝানো হয়েছে।[27]
(১২) আলেমদের অধিকার রক্ষা করার নির্দেশ : উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,لَيْسَ مِنْ أُمَّتِي مَنْ لَمْ يُجِلَّ كَبِيرَنَا وَيَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيَعْرِفْ لِعَالِمِنَا حَقَّهُ، ‘সে ব্যক্তি আমার উম্মতের দলভুক্ত নয়, যে ব্যক্তি আমাদের বড়দেরকে সম্মান করে না, ছোটদেরকে স্নেহ করে না এবং আলেমের অধিকার সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না’।[28]
(১৩) আলেমরাই বিবেকসম্পন্ন হয়ে থাকেন : আল্লাহ বলেন, وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ وَمَا يَعْقِلُهَا إِلَّا الْعَالِمُونَ، ‘এসব দৃষ্টান্ত আমরা বর্ণনা করি মানুষের জন্য। অথচ তা কেউ অনুধাবন করে না, জ্ঞানীরা ব্যতীত’ (আনকাবূত ২৯/৪৩)। আল্লাহ তা‘আলা এই আয়াতে তাদেরকেই আলেম বলেছেন, যারা আল্লাহ ও রাসূল বর্ণিত দৃষ্টান্তসমূহ বুঝে। আমর ইবনে মুররা বলেন, আমি যখন এমন কোন আয়াতে পৌঁছি, যা আমার বোধগম্য নয়, তখন মনে খুব দুঃখ পাই। কেননা আল্লাহ বলেন, ‘এ সকল উদাহরণ আমি মানুষের জন্য দেই, কেবলমাত্র জ্ঞানীরাই তা বুঝে’।[29]
(১৪) আলেম না থাকা ফিৎনার কারণ : আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘তোমাদের তখন কি অবস্থা হবে, যখন তোমাদেরকে ফিৎনা-ফাসাদ গ্রাস করে ফেলবে? প্রশ্ন করা হ’ল, এমনটি কখন ঘটবে? তিনি বললেন,إِذَا قَلَّتْ أُمَنَاؤُكُمْ وَكَثُرَتْ أُمَرَاؤُكُمْ وَقَلَّتْ فُقَهَاؤُكُمْ وَكَثُرَتْ قُرَّاؤُكُمْ وَتُفِقِّهَ لِغَيْرِ الدِّينِ وَالْتُمِسَتِ الدُّنْيَا بِعَمَلِ الْآخِرَةِ، ‘যখন তোমাদের মধ্যে আমানতদার কমে যাবে ও নেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। বিজ্ঞ আলেমের সংখ্যা কম হবে ও ক্বারী (কুরআন পাঠকারীর) সংখ্যা বেশী হবে। দ্বীন ছাড়া ভিন্ন উদ্দেশ্যে জ্ঞান
অন্বেষণ করা হবে এবং আখেরাতের আমল দ্বারা পার্থিব
কল্যাণ অনুসন্ধান করা হবে’।[30]
(১৫) আলেম চলে যাওয়ার মাধ্যমে ইলম চলে যাবে : আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনিল আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبِضُ العِلْمَ انْتِزَاعاً يَنْتَزعهُ مِنَ النَّاسِ، وَلكِنْ يَقْبِضُ العِلْمَ بِقَبْضِ العُلَمَاءِ حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِماً اتَّخَذَ النَّاسُ رُؤُوساً جُهَّالاً فَسُئِلُوا فَأَفْتوا بِغَيْرِ عِلْمٍ فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا، ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ মানুষের নিকট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ইলম তুলে নিবেন না; বরং আলেমগণকে উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ইলম তুলে নিবেন (অর্থাৎ আলেম দুনিয়া থেকে শেষ হয়ে যাবে)। অবশেষে যখন কোন আলেম অবশিষ্ট থাকবে না, তখন জনগণ মূর্খ ব্যক্তিদেরকে নেতা বানিয়ে নিবে এবং তাদেরকে ফৎওয়া জিজ্ঞেস করা হবে। আর তারা না জেনে ফৎওয়া দিবে। ফলে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে এবং অপরকেও পথভ্রষ্ট করবে’।[31]
উমাইয়া খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (মৃত ১০১ হিঃ) শাসকদেরকে লক্ষ্য করে চিঠি লিখলেন,انظر ما كان من حديث رسول الله صلى الله عليه وسلم فاكتبه فإني خفت دروس العلم وذهاب العلماء. ‘রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ যেখানে যা পাওয়া যায় তা লিখে ফেল। কেননা আমি ইলমের বিলুপ্তি ও আলেমের গত হয়ে যাওয়ার আশংকা করছি’।[32]
অতএব আসুন! আমরা দ্বীনী ইলম শিক্ষা লাভ করি। সে অনুযায়ী আমল করি। নিজেদের সার্বিক জীবনকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী ঢেলে সাজাই। আল্লাহকৃত হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম জেনে সে অনুযায়ী জীবন যাপন করে আখেরাতে সম্মানিত হওয়ার কোশেশ করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন-আমীন!
মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
তুলাগাঁও, দেবিদ্বার, কুমিল্লা।
[1]. কুরতুবী, আল-জামে‘ লি আহকামিল কুরআন ১০/১১৪, সূরা নাহল ৪৩নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[2]. তাফসীরে সা‘দী, সূরা নাহল ৪৩নং আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
[3]. আখলাকুল ওলামা, পৃ. ৪২; নাযরাতুন নাঈম ৭/২৯৭৮।
[4]. মুসলিম হা/৮১৭; ইবনু মাজাহ হা/২১৮; ছহীহাহ হা/২২৩৯।
[5]. আল-জামে‘ লিল আহকামিল কুরআন ১৭/২৮৫, সূরা মুজাদালা ১১নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[6]. ফাযলুল ইলম ওয়াল ওলামা, পৃ: ৮৬।
[7]. বুখারী হা/৩৩৫৩; মুসলিম হা/২৩৭৮।
[8]. তিরমিযী হা/২৬৮৫; ছহীহুত তারগীব হা/৭৭।
[9]. আবূদাউদ হা/৩৬৪১; ছহীহুল জামে‘ হা/৪২১২।
[10]. দারেমী হা/৩৪০, মিশকাত হা/২৫০। আলবানী, সনদ হাসান।
[11]. ফাহারিস লিসানুল আরব ১/৩২০; নাজরাতুন নাঈম ৭/২৯৭৬।
[12]. আবূদাঊদ হা/৩৬৪৩, তিরমিযী ২৬৮২, ছহীহুত তারগীব হা/৬৭।
[13]. ছহীহুল জামে‘ হা/৩৩৪৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৮৫২।
[14]. বুখারী হা/৪৯১৮।
[15]. বুখারী হা/৭৩, ১৪০৯; মুসলিম হা/১৯৩৩।
[16]. বুখারী হা/৪৬২১।
[17]. কুরতুবী ৪/৪৪; আলে ইমরান ১৮নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[18]. ইবনে কাছীর ১/৪৬২।
[19]. ইবনুল ক্বাইয়িম (৬৯১-৭৫১), ফাযলুল ইলম ওয়াল ওলামা (বৈরূত: আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১ম প্রকাশ ১৪২২/২০০১ খ্রি:), পৃ: ২৩।
[20]. আবু দাঊদ হা/৩৬৪৩; তিরমিযী হা/২৬৮২; ছহীহুত তারগীব ৬৭।
[21]. ছহীহুত তারগীব হা/৮২; তাবারানী, মু‘জামুল আওসাত ২/১১৪।
[22]. বুখারী হা/৫০৬৩।
[23]. বুখারী হা/৪৬২১।
[24]. তাফসীর ইবনু কাছীর, সূরা ফাতির ২৮নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র:।
[25]. মুসলিম হা/৬৭৩; আবু দাউদ হা/৫৮২; তিরমিযী হা/২৩৫।
[26]. মিফতাহু দারিস সা‘আদাহ ১/২২৩।
[27]. তাফসীরে কুরতুবী ফাতির ১৯নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র.।
[28]. আহমাদ হা/২২৭৫৫; ছহীহুত তারগীব হা/৯৫।
[29]. ইবনে কাছীর, কুরআনুল কারীম (বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর) (মদীনা: বাদশাহ্ ফাহাদ কুরআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স), ২/২০৬৮।
[30]. ইবনে আবী শায়বাহ হা/৩৭১৫৬; ছহীহুত তারগীব হা/১১১।
[31]. বুখারী হা/৭৩০৭; মুসলিম হা/৬৯৭১।
[32]. ফাতহুল বারী ১/১৪০; আহলেহাদীছ আন্দোলন উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ পৃ: ৪৯।