ভূমিকা :
পৃথিবীর মানুষের হেদায়াতের জন্য আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। তাঁরা এসে মানুষকে হেদায়াতের পথে পরিচালনার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সবাই হেদায়াত লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেনি। নানা কারণে হেদায়াতের আলোকিত রাজপথে চলা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন বাধা-প্রতিবন্ধকতা তাদেরকে হেদায়াত থেকে দূরে রেখেছে। নিম্নে হেদায়াতের পথে প্রতিবন্ধকতা সমূহ উল্লেখ করা হ’ল।-
১. জ্ঞানের স্বল্পতা :
হক-বাতিল তথা সঠিক-বেঠিক অবগত হওয়া এবং বাতিলের উপরে হকের প্রভাব জানলে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া যায়। কেননা জ্ঞান না থাকলে সঠিক পথে চলা বা হক লাভ করা সম্ভব হয় না। অজ্ঞতার কারণেই অনেকে হক থেকে ছিটকে পড়ে, অনেকে হকের নিকটবর্তী হয়েও হক গ্রহণ করতে পারে না। ইবাদতও সঠিকভাবে আদায় করতে পারে না। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَعْبُدُ اللهَ عَلَى حَرْفٍ فَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ اطْمَأَنَّ بِهِ وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ انْقَلَبَ عَلَى وَجْهِهِ خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةَ ذَلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ، ‘লোকদের মধ্যে কেউ কেউ (অর্থাৎ কপট বিশ্বাসী ও সুবিধাবাদীরা) আল্লাহর ইবাদত করে দ্বিধার সাথে। তাকে কল্যাণ স্পর্শ করলে শান্ত হয় এবং বিপর্যয় স্পর্শ করলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর সেটাই হ’ল তার সুস্পষ্ট ক্ষতি’ (হজ্জ ২২/১১)। তাই জ্ঞানার্জন করা যরূরী। আর অজ্ঞতার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। অজ্ঞতার পরিণতি সম্পর্কে হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا، يَنْتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ، وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ، حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا، اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالاً فَسُئِلُوا، فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ ، فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا-
‘আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অন্তর থেকে ইলম ছিনিয়ে নেয়ার মত তুলে নিবেন না, বরং আলেমদের উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইলমকে উঠিয়ে নিবেন। এমনকি যখন কোন আলেম অবশিষ্ট থাকবে না তখন লোকেরা মূর্খদেরকেই নেতা বানিয়ে নিবে। তারা তাদেরকে (দ্বীনের বিষয়ে) জিজ্ঞেস করবে। অতঃপর তারা অজ্ঞতা সত্ত্বেও ফৎওয়া প্রদান করবে। ফলে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যকেও পথভ্রষ্ট করবে’।[1]
২. হেদায়াতের যোগ্য না হওয়া :
হেদায়াত মানব জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান বিষয়। হেদায়াতের যথাযথ হকদার না হ’লে কেউ তা লাভ করতে পারে না। যেমন কাফের, মুশরিক, যালেম ও মুনাফিকদেরকে আল্লাহ হেদায়াত দান করেন না। আল্লাহ বলেন, وَاللهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ، ‘বস্ত্ততঃ আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৬৪)। তিনি আরো বলেন, وَاللهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ ‘বস্ত্ততঃ আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৬৪; আলে ইমরান ৩/৮৬)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَاللهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ، ‘আর আল্লাহ পাপিষ্ঠদের সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (মায়েদাহ ৫/১০৮)। অর্থাৎ যারা শিরক, কুফরী, যুলম ও পাপাচারের মধ্যে অব্যাহত থাকে, আল্লাহ তাদের হেদায়াত করেন না।[2] অনুরূপভাবে যার মৃত্যু কাফের-মুশরিক অবস্থায় হবে বলে আল্লাহর ইলমে আছে, তাদেরকে আল্লাহ হেদায়াত দান করেন না।[3] আল্লাহ বলেন,وَلَوْ عَلِمَ اللهُ فِيهِمْ خَيْرًا لَأَسْمَعَهُمْ وَلَوْ أَسْمَعَهُمْ لَتَوَلَّوْا وَهُمْ مُعْرِضُونَ، ‘যদি আল্লাহ তাদের মধ্যে কিছু কল্যাণ আছে বলে জানতেন, তাহ’লে অবশ্যই তিনি তাদের শুনাতেন। আর যদি তিনি তাদের শুনাতেন, তবুও তারা মুখ ফিরিয়ে নিত ও এড়িয়ে যেত’ (আনফাল ৭/২৩)। তাদের অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ আরো বলেন,وَإِذَا ذُكِرَ اللهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِنْ دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ، ‘যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না, তাদের সামনে যখন কেবল আল্লাহর কথা বলা হয়, তখন তাদের অন্তরগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। আর যখন তাকে বাদ দিয়ে অন্যদের কথা বলা হয়, তখন তারা উল্লসিত হয়’ (যুমার ৩৯/৪৫)। অতএব হেদায়াতের যোগ্য না হ’লে সে হেদায়াতের উপরে টিকে থাকতে পারে না। এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ رضى الله عنهما أَنَّ أَعْرَابِيًّا بَايَعَ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى الإِسْلاَمِ، فَأَصَابَهُ وَعْكٌ فَقَالَ أَقِلْنِى بَيْعَتِى. فَأَبَى، ثُمَّ جَاءَهُ فَقَالَ أَقِلْنِى بَيْعَتِى. فَأَبَى، فَخَرَجَ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الْمَدِينَةُ كَالْكِيرِ، تَنْفِى خَبَثَهَا، وَيَنْصَعُ طِيبُهَا.
‘জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, এক বেদুঈন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট ইসলামের বায়‘আত করল। তারপর সে জ্বরে আক্রান্ত হ’ল। তখন সে বলল, আমার বায়‘আত ফিরিয়ে দিন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা অস্বীকৃতি জানালেন। সে আবার তাঁর কাছে আসল। তিনি আবার অস্বীকৃতি জানালেন। সে আবার তাঁর কাছে এসে বলল, আমার বায়‘আত ফিরিয়ে দিন। তিনি আবারও অস্বীকার করলেন। তখন সে বেরিয়ে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, মদীনা হাপরের মত, সে তার আবর্জনাকে দূর করে দেয় এবং ভালোটাকে ধরে রাখে’।[4] অতএব প্রতীয়মান হয় যে, হেদায়াতের হকদার না হ’লে যেমন তা লাভ করা যায় না, তেমনি হেদায়াতের উপরে টিকেও থাকা যায় না।
৩. হিংসা ও অহংকার :
হিংসা-অহংকার হেদায়াত লাভের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কারণ আল্লাহ অহংকারীদের হেদায়াত দান করেন না। তিনি বলেন, سَأَصْرِفُ عَنْ آيَاتِيَ الَّذِينَ يَتَكَبَّرُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَإِنْ يَرَوْا كُلَّ آيَةٍ لَا يُؤْمِنُوا بِهَا وَإِنْ يَرَوْا سَبِيلَ الرُّشْدِ لَا يَتَّخِذُوهُ سَبِيلًا وَإِنْ يَرَوْا سَبِيلَ الْغَيِّ يَتَّخِذُوهُ سَبِيلًا ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَكَانُوا عَنْهَا غَافِلِينَ، ‘এ পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে দম্ভ করে আমি তাদেরকে আমার আয়াতসমূহ থেকে ফিরিয়ে রাখব। তারা আমার সমস্ত নিদর্শন দেখলেও তাতে বিশ্বাস স্থাপন করবে না। তারা হেদায়াতের পথ দেখলেও সে পথে যাবে না। কিন্তু যদি ভ্রষ্টতার পথ দেখে তাহ’লে তারা সেটাই গ্রহণ করবে। এটা এ কারণে যে, তারা আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করে এবং তারা এ থেকে উদাসীন’ (আ‘রাফ ৭/১৪৬)।
কুরাইশ নেতাদের মন্দ প্রতিক্রিয়ার অন্যতম কারণ ছিল গোত্রীয় হিংসা এবং ভালোর প্রতি বিদ্বেষ। যেমন কুরাইশের অন্যতম নেতা আখনাস বিন শারীক্ব-এর প্রশ্নের উত্তরে আবু জাহ্ল বলেছিল,تَنَازَعْنَا نَحْنُ وَبَنُو عَبْدِ مَنَافٍ الشَّرَفَ... قَالُوا: مِنَّا نَبِيٌّ يَأْتِيهِ الْوَحْيُ مِنَ السَّمَاءِ، فَمَتَى نُدْرِكُ مِثْلَ هَذِهِ؟ وَاللهِ لاَ نُؤْمِنُ بِهِ أَبَدًا وَلاَ نُصَدِّقُهُ، ‘বনু ‘আব্দে মানাফের সাথে আমাদের বংশমর্যাদাগত ঝগড়া আছে’।... তারা বলবে, আমাদের বংশে একজন নবী আছেন, যার নিকটে আসমান থেকে ‘অহি’ আসে। আমরা কিভাবে ঐ মর্যাদায় পৌঁছব? অতএব আল্লাহর কসম! আমরা কখনোই তার উপর ঈমান আনব না বা তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করব না’।[5] কুরাইশরা নবী করীম (ছাঃ)-কে নবী হিসাবে চেনা-জানার পরও কেবল হিংসা-অহংকার বশত মানতে অস্বীকৃতি জানায়। যেমন আল্লাহ বলেন,الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ وَإِنَّ فَرِيقًا مِنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ ‘আমরা যাদেরকে কিতাব দিয়েছি, তারা তাকে (মুহাম্মাদকে) ভালভাবে চেনে, যেমন তারা তাদের সন্তানদের চেনে। নিশ্চয়ই তাদের একটি দল জেনে-শুনে সত্যকে গোপন করে’ (বাক্বারাহ ২/১৪৬)।
রাসূল (ছাঃ) হিংসা-বিদ্বেষকে দ্বীনের মুন্ডনকারী হিসাবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন,دَبَّ إِلَيْكُمْ دَاءُ الأُمَمِ قَبْلَكُمْ: الحَسَدُ وَالبَغْضَاءُ، هِيَ الحَالِقَةُ، لَا أَقُولُ تَحْلِقُ الشَّعَرَ وَلَكِنْ تَحْلِقُ الدِّينَ، وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَا تَدْخُلُوا الجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا، وَلَا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا، أَفَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِمَا يُثَبِّتُ ذَلِكَ لَكُمْ؟ أَفْشُوا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ، ‘তোমাদের আগেকার উম্মাতদের রোগ তোমাদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে। তা হ’ল পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণা। আর এটা মুন্ডনকারী। আমি বলছি না যে, চুল মুন্ডন করে দেয়, বরং এটা দ্বীনকে মুন্ডন করে দেয়। সেই মহান সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার জীবন! তোমরা ঈমানদার না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আর তোমরা পরস্পরকে ভাল না বাসলে ঈমানদার হ’তে পারবে না। আমি কি তোমাদেরকে বলবো না যে, পারস্পরিক ভালবাসা কোন্ কাজের মাধ্যমে মযবূত হয়? তোমরা পরস্পর সালামের বিস্তার ঘটাও’।[6] এ হাদীছের ব্যাখ্যায় আল্লামা ত্বীবী বলেন,الْبَغْضَاءُ تَذْهَبُ بِالدِّينِ كَالْمُوسى تَذْهَبُ بِالشَّعْرِ ‘বিদ্বেষ দ্বীনকে বিদূরিত করে যেমন খুর চুলকে দূর করে দেয়’।[7]
হিংসা-অহংকারই উবাই ইবনে সালূলকে ঈমান আনতে বাধা দিয়েছিল। অনুরূপভাবে আবু জাহল ও অন্যান্য কুরাইশ নেতাকে ঈমান আনা থেকে বিরত রেখেছিল তাদের অহংকার, আভিজাত্য ও হিংসা। বর্তমানেও বহু মানুষ হক জেনেও তা গ্রহণ করতে পারে না তাদের মিথ্যা অহংকার ও হিংসা বশত।
৪. নেতৃত্ব বা পদমর্যাদা লাভ :
নেতৃত্ব বা পদ মর্যাদার লোভ হেদায়াত লাভের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে হিরাকলের অবস্থা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাসূল (ছাঃ)-এর দূত দাহিয়া বিন খলীফা আল-কালবী (রাঃ) হিরাকলের নিকটে গেলে তিনি পত্র পাঠ ও আবু সুফিয়ান (রাঃ)-এর কাছে রাসূলের অবস্থা জানার পর বলেন,
فَإِنْ كَانَ مَا تَقُولُ حَقًّا فَسَيَمْلِكُ مَوْضِعَ قَدَمَىَّ هَاتَيْنِ، وَقَدْ كُنْتُ أَعْلَمُ أَنَّهُ خَارِجٌ، لَمْ أَكُنْ أَظُنُّ أَنَّهُ مِنْكُمْ، فَلَوْ أَنِّى أَعْلَمُ أَنِّى أَخْلُصُ إِلَيْهِ لَتَجَشَّمْتُ لِقَاءَهُ، وَلَوْ كُنْتُ عِنْدَهُ لَغَسَلْتُ عَنْ قَدَمِهِ... ثُمَّ اطَّلَعَ فَقَالَ يَا مَعْشَرَ الرُّومِ، هَلْ لَكُمْ فِى الْفَلاَحِ وَالرُّشْدِ وَأَنْ يَثْبُتَ مُلْكُكُمْ فَتُبَايِعُوا هَذَا النَّبِىَّ، فَحَاصُوا حَيْصَةَ حُمُرِ الْوَحْشِ إِلَى الأَبْوَابِ، فَوَجَدُوهَا قَدْ غُلِّقَتْ، فَلَمَّا رَأَى هِرَقْلُ نَفْرَتَهُمْ، وَأَيِسَ مِنَ الإِيمَانِ قَالَ رُدُّوهُمْ عَلَىَّ. وَقَالَ إِنِّى قُلْتُ مَقَالَتِى آنِفًا أَخْتَبِرُ بِهَا شِدَّتَكُمْ عَلَى دِينِكُمْ، فَقَدْ رَأَيْتُ. فَسَجَدُوا لَهُ وَرَضُوا عَنْهُ، فَكَانَ ذَلِكَ آخِرَ شَأْنِ هِرَقْلَ-
‘তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়, তবে শীঘ্রই তিনি আমার এ দু’পায়ের নীচের জায়গার অধিকারী হবেন। আমি নিশ্চিত জানতাম, তাঁর আবির্ভাব হবে; কিন্তু তিনি যে তোমাদের মধ্য হ’তে হবেন, এ কথা ভাবতে পারিনি। যদি জানতাম, আমি তাঁর নিকট পৌঁছতে পারব, তাহ’লে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আমি যে কোন কষ্ট সহ্য করতাম। আর আমি যদি তাঁর নিকট থাকতাম তবে অবশ্যই তাঁর পা দু’খানা ধৌত করে দিতাম। ...অতঃপর তিনি সম্মুখে এসে বললেন, হে রোমের অধিবাসী! তোমরা কি মঙ্গল, হেদায়াত এবং তোমাদের রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব চাও? তাহ’লে এই নবীর নিকটে বায়‘আত গ্রহণ কর। এ কথা শুনে তারা বন্য গাধার ন্যায় দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে দরজার দিকে ছুটল, কিন্তু তারা তা বন্ধ দেখতে পেল। হিরাক্লিয়াস যখন তাদের অনীহা লক্ষ্য করলেন এবং তাদের ঈমান থেকে নিরাশ হয়ে গেলেন, তখন বললেন, ওদের আমার নিকট ফিরিয়ে আন। তিনি বললেন, আমি অব্যবহিত পূর্বে যে কথা বলেছি, তা দ্বারা তোমাদের দ্বীনের উপরে তোমাদের দৃঢ়তার পরীক্ষা করছিলাম। এখন তা দেখে নিলাম। একথা শুনে তারা তাঁকে সিজদা করল এবং তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হ’ল। এটাই ছিল হিরাক্লিয়াসের সর্বশেষ অবস্থা’।[8]
এই ব্যাধিই ফেরাঊন ও তার সম্প্রদায়ের ঈমানের পথে বাধা হয়েছিল। যেমন আল্লাহ বলেন,فَقَالُوا أَنُؤْمِنُ لِبَشَرَيْنِ مِثْلِنَا وَقَوْمُهُمَا لَنَا عَابِدُونَ، ‘তারা বলল, আমরা কি আমাদের মত দু’ব্যক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করব? অথচ তাদের সম্প্রদায় (বনু ইস্রাঈল) আমাদের দাসত্ব করে’ (মুমিনূন ২৩/৪৭)। বর্তমানেও বহু মানুষ হক জেনেও তা গ্রহণ করতে পারছে না পদমর্যাদা বা নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে।
৫. প্রবৃত্তির অনুসরণ ও সম্পদের লোভ :
প্রবৃত্তির পুজা ও সম্পদের লোভ বহু আহলে কিতাবকে ঈমান থেকে দূরে রেখেছিল। তাদের আশংকা ছিল যে, তারা ঈমান আনলে তাদের সম্প্রদায় তাদের পানাহার ও সম্পদ থেকে বঞ্চিত করবে। কারণ কুরাইশরা কোন লোককে ঈমান থেকে ফিরিয়ে রাখতো এভাবে যে, তার প্রিয় বস্ত্ত বা প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে বাধা দিত। যেমন মদ পানকারীকে তা থেকে নিষেধ করা এবং নারী আসক্তকে প্রতিহত করার ভয় দেখিয়ে তারা মানুষকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করত। তৎকালীন বিখ্যাত কবি আ‘শা বিন ক্বায়েস ইবনে ছা‘লাবার ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছিল।
সে ইসলাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য ইয়ামন থেকে রওয়ানা হয়। সে মক্কা অথবা মক্কার নিকটবর্তী পৌঁছার পর আবু জাহল এসে বলল, হে আবূ বাছীর! ঐ মুহাম্মাদ তো ব্যভিচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আ‘শা বললেন, আল্লাহর কসম! আমার তো ব্যভিচারের আদৌ কোন প্রয়োজন নেই। সে বলল, হে আবূ বাছীর! তিনি তো মদ্যপান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আ‘শা বললেন, আল্লাহর কসম! মদের প্রতি তো আমার চরম দুর্বলতা রয়েছে। ঠিক আছে আমি তাহ’লে এবারকার মত ফিরে যাব এবং এই এক বছর তৃপ্তি সহকারে মদ পান করে নেব। তারপর মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নিকট ফিরে এসে ইসলাম গ্রহণ করব। এ যাত্রা তিনি ফিরে যান। ঐ বছরেই তাঁর মৃত্যু হয়। পুনরায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট ফিরে আসার সুযোগ তাঁর হয়ে উঠেনি।[9] এভাবে প্রবৃত্তি পুজা মানুষকে হেদায়াত থেকে ফিরিয়ে রাখে। আর এরূপ মানুষের পরিণতি হবে ভয়াবহ। আল্লাহ বলেন,أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَى بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَنْ يَهْدِيهِ مِنْ بَعْدِ اللهِ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ، ‘তুমি কি দেখেছ তাকে, যে তার খেয়াল-খুশীকে তার উপাস্য বানিয়েছে? আর আল্লাহ তাকে জেনে-শুনেই পথভ্রষ্ট করেছেন। তার কানে ও অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তার চোখের উপর আবরণ টেনে দিয়েছেন। অতএব আল্লাহর পরে কে তাকে সুপথ প্রদর্শন করবে? এরপরেও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না’? (জাছিয়া ৪৫/২৩)। অন্যত্র আল্লাহ আরো বলেন,وَمَنْ لَا يُجِبْ دَاعِيَ اللهِ فَلَيْسَ بِمُعْجِزٍ فِي الْأَرْضِ وَلَيْسَ لَهُ مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءُ أُولَئِكَ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ، ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে আহবানকারীর ডাকে সাড়া দিবে না, সে পৃথিবীতে আল্লাহকে (প্রতিশোধ গ্রহণে) অক্ষম করতে পারবে না এবং আল্লাহ ছাড়া তাদের কোন সাহায্যকারীও থাকবে না। ওরা স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে’ (আহকাফ ৪৬/৩২)।
প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষকে হক থেকে বিচ্যুত করে দেয়। আল্লাহ বলেন, وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ ‘আর তুমি প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তাহ’লে তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৬)। অন্যত্র রাসূলকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন,وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا ‘আর তুমি ঐ ব্যক্তির আনুগত্য করোনা যার অন্তরকে আমরা আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং সে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে ও তার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে গেছে’ (কাহফ ১৮/২৮)।
প্রবৃত্তির অনুসারী হ’লে যে সে হক গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে না এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
تُعْرَضُ الْفِتَنُ عَلَى الْقُلُوبِ كَالْحَصِيرِ عُودًا عُودًا، فَأَيُّ قَلْبٍ أُشْرِبَهَا، نُكِتَ فِيهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ، وَأَيُّ قَلْبٍ أَنْكَرَهَا، نُكِتَ فِيهِ نُكْتَةٌ بَيْضَاءُ، حَتَّى تَصِيرَ عَلَى قَلْبَيْنِ، عَلَى أَبْيَضَ مِثْلِ الصَّفَا فَلَا تَضُرُّهُ فِتْنَةٌ مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ، وَالْآخَرُ أَسْوَدُ مُرْبَادًّا كَالْكُوزِ، مُجَخِّيًا لَا يَعْرِفُ مَعْرُوفًا، وَلَا يُنْكِرُ مُنْكَرًا، إِلَّا مَا أُشْرِبَ مِنْ هَوَاهُ،
‘মানুষের হৃদয়ে ফিৎনাসমূহ এমনভাবে প্রবেশ করে, যেমন আঁশ একটির পর আরেকটি বিছানো হয়ে থাকে এবং যেই হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা প্রবেশ করে তাতে একটি কালো দাগ পড়ে। আর যে অন্তর তাকে জায়গা দেয় না, তাতে একটি সাদা দাগ পড়ে। ফলে মানুষের অন্তরসমূহ পৃথক পৃথক দু’ভাগে আলাদা হয়ে যায়। একপ্রকার অন্তর হয় মর্মর পাথরের ন্যায় শ্রভ্র-সাদা। যাকে আসমান ও যমীন বহাল থাকা পর্যন্ত (ক্বিয়ামত পর্যন্ত) কোন ফিৎনাই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না। অপরদিকে দ্বিতীয় প্রকার অন্তর হয় কয়লার মতো কালো। যেমন উপুড় হওয়া পাত্রের মতো, যাতে কিছুই ধারণ করার ক্ষমতা থাকে না। তা ভালোকে ভালো জানার এবং মন্দকে মন্দ জানার ক্ষমতা রাখে না, ফলে শুধুমাত্র তাই গ্রহণ করে যা তার প্রবৃত্তির চাহিদা হয়’।[10]
আলী (রাঃ) বলেন, إنَّمَا أَخَافُ عَلَيْكُمَ اثْنَتَيْنِ: طُولَ الأَمَلِ، وَاتِّبَاعَ الْهَوَى؛ فَإِنَّ طُولَ الأَمَلِ يُنْسِي الآخِرَةَ، وَإِنَّ اتِّبَاعَ الْهَوَى يَصُدُّ عَنِ الْحَقِّ، ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্য দু’টি বস্ত্তর ভয় করছি- দীর্ঘ আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রবৃত্তির পূজা। কেননা দীর্ঘ আশা আখিরাত ভুলিয়ে দেয় এবং প্রবৃত্তির পূজা মানুষকে হক থেকে বাধা দেয়’।[11]
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেন,وصاحِبُ الهوى يُعمِيه الهوى ويُصِمُّه، فلا يستحضر ما لله ورسوله صلى الله عليه وسلم في ذلك، ولا يطلبه، ولا يرضى لرضا الله ورسوله، ولا يغضب لغضب الله ورسوله؛ بل يرضى إذا حصل ما يرضاه بهواه، ويغضب إذا حصل ما يغضب له بهواه، ‘প্রবৃত্তিপূজারীকে তার খেয়াল-খুশি অন্ধ ও বধির করে দেয়। ফলে সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য তার করণীয় বিস্মৃত হয় ও তা সে অনুসন্ধান করে না। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের রাযী-খুশির প্রতি সে সন্তুষ্ট হয় না এবং তাঁদের অসন্তোষের জন্য সে ক্ষুব্ধ হয় না। বরং তার প্রবৃত্তির চাহিদায় সে খুশি হয় এবং নিজের খেয়াল-খুশির বিরোধিতায় সে ক্রোধোন্মত্ত হয়’।[12]
অতএব প্রবৃত্তির অনুসারী কখনও হেদায়াত লাভ করতে পারে না। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنَ اللهِ إِنَّ اللهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হেদায়াতকে অগ্রাহ্য করে নিজের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে, তার চাইতে বড় পথভ্রষ্ট আর কে আছে? নিশ্চয়ই আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (ক্বাছাছ ২৮/৫০)।
৬. আত্মীয়-স্বজন, ঘর-বাড়ি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মহববত :
কোন ব্যক্তি যখন হকের অনুসারী হয় কিন্তু তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন তার বিরোধিতা করে, তখন সে হক থেকে দূরে সরে যায়। তাদের আশংকা ছিল ঘর-বাড়ী, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার। বহু ইহুদী-নাছারা ও অবিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে এরূপ ঘটনা ঘটেছে। দ্বীনে হক অপেক্ষা আপনজনের ভালবাসাই তাদের কাছে অগ্রগণ্য হয়েছে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللهُ بِأَمْرِهِ وَاللهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ، ‘তুমি বল, যদি তোমাদের নিকট তোমাদের পিতা, পুত্র, ভাই, স্ত্রী, স্বগোত্র ও ধন-সম্পদ যা তোমরা উপার্জন কর, ব্যবসা-বাণিজ্য যা তোমরা বন্ধ হবার আশংকা কর এবং বাড়ী-ঘর যা তোমরা পসন্দ কর- আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাস্তায় জিহাদ করার চাইতে অধিক প্রিয় হয়; তাহ’লে তোমরা অপেক্ষা কর আল্লাহর নির্দেশ (আযাব) আসা পর্যন্ত। বস্ত্ততঃ আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (তওবা ৯/২৪)।
আর যখন তারা দেখল যে, রাসূল (ছাঃ) বা যারা হকের অনুসরণ করে তাদেরকে ঘর-বাড়ী ও দেশ ছেড়ে ভিন দেশে হিজরত করতে হয় তখন অনেকেই ইসলাম গ্রহণ কিংবা হক গ্রহণ থেকে দূরে সরে যায়। অথচ ছাহাবায়ে কেরাম তাদের ঘর-বাড়ী, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে মদীনায় হিজরত করেছেন, কেবল দ্বীনের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায়। ফলে আল্লাহ তাদের সাহায্য করেছেন এবং তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন।
৮. পূর্বপুরুষের অনুসরণ :
কেউ কেউ ধারণা করে যে, ইসলাম গ্রহণ ও রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ করলে বাপ-দাদা ও পূর্বপুরুষের অবমাননা ও তাদের অবজ্ঞা করা হয়। এ কারণেই আবু তালেব সহ বহু কুরাইশ নেতা ইসলাম থেকে দূরে থেকেছে। আবু তালেব সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে,
عَنِ الزُّهْرِىِّ قَالَ أَخْبَرَنِى سَعِيدُ بْنُ الْمُسَيَّبِ عَنْ أَبِيهِ قَالَ لَمَّا حَضَرَتْ أَبَا طَالِبٍ الْوَفَاةُ جَاءَهُ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَوَجَدَ عِنْدَهِ أَبَا جَهْلٍ وَعَبْدَ اللهِ بْنَ أَبِى أُمَيَّةَ بْنِ الْمُغِيرَةِ، فَقَالَ أَىْ عَمِّ قُلْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، كَلِمَةً أُحَاجُّ لَكَ بِهَا عِنْدَ اللهِ. فَقَالَ أَبُو جَهْلٍ وَعَبْدُ اللهِ بْنُ أَبِى أُمَيَّةَ أَتَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَلَمْ يَزَلْ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَعْرِضُهَا عَلَيْهِ، وَيُعِيدَانِهِ بِتِلْكَ الْمَقَالَةِ حَتَّى قَالَ أَبُو طَالِبٍ آخِرَ مَا كَلَّمَهُمْ عَلَى مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ، وَأَبَى أَنْ يَقُولُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ. قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَاللهِ لأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ مَا لَمْ أُنْهَ عَنْكَ. فَأَنْزَلَ اللهُ (مَا كَانَ لِلنَّبِىِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ) وَأَنْزَلَ اللهُ فِى أَبِى طَالِبٍ، فَقَالَ لِرَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم (إِنَّكَ لاَ تَهْدِى مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللهَ يَهْدِى مَنْ يَشَاءُ).
‘ইমাম যুহরী (রহঃ) কর্তৃক সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি স্বীয় পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যখন আবূ তালিবের মৃত্যু নিকটবর্তী হ’ল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর কাছে আসলেন। তিনি সেখানে আবূ জাহল ও আব্দুল্লাহ ইবনু আবূ উমাইয়াহ ইবনে মুগীরাকে পেলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে চাচা! আপনি বলুন ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ। এ কালেমা দ্বারা আমি আপনার জন্য ক্বিয়ামতে আল্লাহর কাছে প্রমাণ পেশ করতে পারব। আবূ জাহল ও আব্দুল্লাহ ইবনু আবূ উমাইয়াহ বলল, তুমি কি আব্দুল মুত্তালিবের ধর্ম ত্যাগ করবে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বারবার তার কাছে এ কালিমা পেশ করতেই থাকলেন। আর তারা তাদের কথা পুনরাবৃত্তি করেই চলল। অবশেষে আবূ তালিব তাঁদের সঙ্গে সর্বশেষ এ কথা বললেন, আমি আব্দুল মুত্তালিবের মিল্লাতের উপর আছি, এবং তিনি কালিমা ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ পাঠ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! আমাকে নিষেধ না করা অবধি আপনার জন্য ক্ষমা চাইতেই থাকব। তারপর আল্লাহ অবতীর্ণ করলেন, ‘নবী ও মুমিনদের জন্য এটা শোভনীয় নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে’ (তওবা ৯/১১৩)। আর আল্লাহ আবূ তালিব সম্পর্কে আয়াত অবতীর্ণ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সম্বোধন করে তিনি বলেন, ‘তুমি যাকে ভালবাস তাকেই সৎপথে আনতে পারবে না। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে হেদায়াত দান করেন’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৬)।[13]
বর্তমানেও বহু মানুষ বাপ-দাদা ও পূর্বপুরুষের দোহাই দিয়ে হক গ্রহণ থেকে বিরত থাকছে। বাতিল যেনেও তা পরিত্যাগে আগ্রহী হচ্ছে না। বাপ-দাদার ভুল রসম-রেওয়াজকেই আঁকড়ে ধরে থাকছে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللهُ وَإِلَى الرَّسُولِ قَالُوا حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ، ‘আর যখন তাদের বলা হয়, তোমরা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সেদিকে এবং রাসূলের দিকে আস, তখন তারা বলে আমাদের জন্য তাই-ই যথেষ্ট, যার উপরে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছু জানত না এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত ছিল না’ (মায়েদাহ ৫/১০৪)।
৯. ইসলাম বিরোধীদের অনুসরণ করা :
যারা ইসলামের বিরোধিতা করে তাদের অনুসরণ মানুষকে ইসলাম ও হক থেকে ফিরিয়ে রাখে এবং হেদায়াতের আলোকিত রাজপথ থেকে বিচ্যুত করে দেয়। এমনকি কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে তারা তার সাথে শত্রুতা শুরু করে এবং তার বিরোধিতায় লিপ্ত হয়, যদিও ইতিপূর্বে তাদের মাঝে সুসম্পর্ক ছিল। যেমন ইহূদী ও আনছারদের মধ্যে ঘটেছিল। আনছাররা ইসলাম গ্রহণ ও রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ করলে তাদের সাথে ইহুদীরা শত্রুতা শুরু করে।
১০. কওমের অনুসৃত রীতি-নীতির প্রতি আসক্তি :
সমাজ ও কওমের অনুসৃত রীতি-নীতির প্রতি আসক্তি মানুষকে হেদায়াত গ্রহণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বস্ত্ততঃ অধিকাংশ মানুষ প্রচলিত রীতি-পদ্ধতির অনুসারী হয়। ফলে তাদের অনুসৃত রীতির বিপরীত কিছু দেখলে তারা তাকে নতুন বিষয় হিসাবে গ্রহণ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অনুরূপভাবে রাসূল (ছাঃ) যখন দ্বীনে হক নিয়ে আসলেন এবং তার প্রতি মানুষকে দাওয়াত দিলেন, তখন তারা একে নতুন দ্বীন হিসাবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং পূর্বপুরুষের আচরিত দ্বীনের অনুসরণের কথা বলে। যেমন আল্লাহ কাফেরদের কথা উল্লেখ করে বলেন,إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِمْ مُقْتَدُونَ، ‘আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি এক রীতির উপর এবং আমরা তাদের রীতির অনুসরণ করি’ (যুখরুফ ৪৩/২৩)।
১১. শয়তানের অনুসরণ :
শয়তান মানুষকে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করার জন্য আল্লাহর সাথে চ্যালেঞ্জ করেছে। সে মানুষকে হক থেকে বিচ্যুত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে (আ‘রাফ ৭/১৬-১৮)। সুতরাং সে মানুষের শত্রু। তাই তার অনুসরণ করলে মানুষ পথভ্রষ্ট হবে। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوهُ عَدُوًّا إِنَّمَا يَدْعُو حِزْبَهُ لِيَكُونُوا مِنْ أَصْحَابِ السَّعِيرِ، ‘নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের শত্রু। অতএব তাকে শত্রু হিসাবেই গ্রহণ কর। সে তার দলবলকে আহবান করে যেন তারা জাহান্নামী হয়’ (ফাতির ৩৫/৬)। তিনি আরো বলেন,وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ، ‘আর তুমি তাদেরকে সেই ব্যক্তির কথা শুনিয়ে দাও, যাকে আমরা আমাদের অনেক নিদর্শন (নে‘মত) প্রদান করেছিলাম। কিন্তু সে তা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ফলে শয়তান তার পিছু নেয় এবং সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়’ (আ‘রাফ ৭/১৭৫)। তিনি আরো বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ وَمَنْ يَتَّبِعْ خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ فَإِنَّهُ يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ، ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। যে ব্যক্তি শয়তানের পদাংক অনুসরণ করে, সে তো তাকে নির্লজ্জতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়’ (নূর ২৪/২১)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ، ‘শয়তান তো কেবল চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও ছালাত হ’তে তোমাদের বিরত রাখতে’ (মায়েদাহ ৫/৯১)।
মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য শয়তান মন্দ আমলকে তার সামনে সুশোভিত করে দেখায়। আল্লাহ বলেন,أَفَمَنْ زُيِّنَ لَهُ سُوءُ عَمَلِهِ فَرَآهُ حَسَنًا، ‘যাকে তার মন্দকর্মগুলি শোভনীয় করে দেখানো হয় এবং সে তাকে উত্তম মনে করে (সে কি তার সমান হবে যে সৎকর্ম করে?)’ (ফাতির ৩৫/৮)। তাই শয়তান থেকে সতর্ক-সাবধান না হয়ে তার অনুসরণ করলে সে মানুষকে হেদায়াতবিমুখ করে দেয় এবং হক থেকে বিচ্যুত করে দেয়। তাই সবাইকে সাবধান থাকতে হবে।
পরিশেষে বলব, আল্লাহ মানুষকে হেদায়াতের জন্য আসমানী কিতাব সমূহ নাযিল করেছেন এবং যুগে যুগে নবী-রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। মানুষ সেই ইলাহী গ্রন্থ সমূহের দিক-নির্দেশনা এবং নবী-রাসূলগণের পদাংক অনুসরণ করলেই হেদায়াত লাভে ধন্য হবে। পক্ষান্তরে কুরআন-হাদীছের নির্দেশনা ত্যাগ করে নিজস্ব মতানুসারে চললে হোদায়াত থেকে বঞ্চিত হবে এবং পরকালে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। অতএব পার্থিব জীবনে হেদায়াত ও পরকালে জান্নাত লাভের জন্য আমরা আল্লাহ ও তদীয় রাসূলে দিক-নির্দেশনা মেনে চলি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন-আমীন!
[1]. বুখারী হা/১০০; মুসলিম হা/২৬৭৩; মিশকাত হা/২০৬।
[2]. ইসলাম ওয়েব. নেট, ফৎওয়া নং ১১৯০২।
[3]. ইসলাম ওয়েব. নেট, ফৎওয়া নং ৩৬৯৬৩।
[4]. বুখারী হা/৭২০৯, ১৮৮৩; মুসলিম হা/১৩৮৩; মিশকাত হা/২৭৩৯।
[5]. ইবনু হিশাম ১/৩১৫-১৬; সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩০৪); বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/২০৬; আল-বিদায়াহ ৩/৬৪।
[6]. তিরমিযী হা/২৫১০; ইরওয়া হা/২৩৮; মিশকাত হা/৫০৩৯; গাইয়াতুল মারাম হা/৪১৪।
[7]. মোল্লা আলী ক্বারী, মিরক্বাতুল মাফাতীহ, ৮/৩১৫৪।
[8]. বুখারী হা/৭, ২৯৪১; ছহীহাহ হা৩৬০৭।
[9]. আবুল ফিদা ইবনু কাছীর, আল-বিাদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১৪০৭ হিঃ/১৯৮৬ খ্রিঃ), ৩/১০২।
[10]. মুসলিম হা/১৪৪; ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২৩১৯; ছহীহুল জামে‘ হা/২৯৬০।
[11]. আল-বিাদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৭/৩৪২।
[12]. ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ), মিনহাজুস সুন্নাহ, (সঈদী আরব : মুহাম্মাদ ইবনে সঊদ বিশ্ববিদ্যালয়, ১ম প্রকাশ, ১৪০৬ হিঃ/১৯৮৬ খ্রিঃ), ৫/২৬৫ পৃঃ।
[13]. বুখারী হা/৪৭৭২, ৩৮৮৪; মুসলিম হা/২৪; নাসাঈ হা/২০৩৫।