আপেক্ষিকতা সূত্রের
(Law of Relativity) উদ্গাতা জন আইনস্টাইনের পর অনেকের নিকট বর্তমান
বিশ্বের সেরা পদার্থ বিজ্ঞানী ড. স্টিফেন হকিং (জন্ম : লন্ডন, ১৯৪২), যিনি
মধ্যাকর্ষণ শক্তির উদ্ভাবক স্যার আইজাক নিউটনের ন্যায় কেম্ব্রিজ
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘লুকাসিয়ান অধ্যাপক’-এর বিরল সম্মাননায় ভূষিত, তিনি
স্বীয় গবেষণা বিষয়বস্ত্ত তথা ফিজিক্স-এর বাইরে গিয়ে মেটাফিজিক্স বা থিওলজি
সম্পৃক্ত বিষয় নিয়ে সম্প্রতি এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যা তাঁর সুউচ্চ
সম্মানকে কালিমালিপ্ত করেছে। বৃটেনের প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ানের সাথে এক
সাক্ষাৎকারে ‘পরকাল’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর পরে আর কোন
জীবন নেই। স্বর্গ ও নরক মানুষের অলীক কল্পনা মাত্র’। এর আগেও গত বছর তিনি
‘স্রষ্টার অস্তিত্ব ও মহাবিশ্বের শৃংখলা’ নিয়ে তার বই ‘দি গ্রান্ড ডিজাইনে’
অনেক ঔদ্ধত্যপূর্ণ কটাক্ষ করেন। সেখানে তিনি দাবী করেন যে, মহাবিশ্বের
অস্তিত্ব ব্যাখ্যার জন্য ঈশ্বর ধারণার কোন প্রয়োজন নেই। তিনি সৃষ্টিকর্তাকে
‘মানব কল্পিত রূপক’ হিসাবে বর্ণনা করেন। হকিং-এর এসব মন্তব্য স্রেফ কল্পনা
নির্ভর হ’লেও যেহেতু তারা বিজ্ঞানী, অতএব তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে
থাকেন বহু মানুষ। বিশেষ করে দুর্বল বিশ্বাসী, কপট বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী
ব্যক্তিগণ এইসব মন্তব্যগুলিকে তাদের পক্ষে বড় দলীল হিসাবে সোৎসাহে পেশ করে
থাকেন।
খৃষ্টীয় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে যথাক্রমে শিল্পবিপ্লব ও বিজ্ঞানের নানামুখী আবিষ্কারে হতচকিত হয়ে সাময়িকভাবে অনেক বিজ্ঞানী বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন এবং তারা বিশ্ব চরাচরের সবকিছুকে ‘প্রকৃতির লীলাখেলা’ মনে করতেন। কিন্তু এখন তাদের অধিকাংশের হুঁশ ফিরেছে এবং হোয়াইট হেড, আর্থার এডিংটন, জেম্স জীন্স (১৮৭৭-১৯৪৬) সহ বিরাট সংখ্যক বিজ্ঞানী স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, Nature is alive ‘প্রকৃতি এক জীবন্ত সত্তা’। কেবল জীবন্ত নয়, বরং ডব্লিউ,এন, সুলিভানের ভাষায় বিজ্ঞানীদের বক্তব্যের সার নির্যাস হ’ল, The ultimate nature of the universe is mental. ‘বিশ্বলোকের চূড়ান্ত প্রকৃতি হ’ল মানসিক’। অর্থাৎ সৌরজগত আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়নি বা এটা কোন বিগব্যাং বা মহা বিস্ফোরণের ফসল নয় বা অন্ধ-বোবা-বধির কোন ন্যাচার বা প্রকৃতি নয়, বরং একজন প্রজ্ঞাময় সৃষ্টিকর্তার মহা পরিকল্পনার ফসল। আর তিনিই হচ্ছেন ‘আল্লাহ’। যিনি বিশ্ব প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। যাঁর পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনায় সবকিছু চলছে (ইউনুস ১০/৩১)। হাঁ, বিগব্যাং যদি হয়ে থাকে, তবে সেটা দুনিয়ার মানুষ বিজ্ঞানীদের বহু পূর্বে নিরক্ষর নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মুখ দিয়ে শুনেছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা অবিশ্বাস করে তারা কি দেখে না যে, আকাশ সমূহ ও পৃথিবী পূর্বে মিলিত ছিল। অতঃপর আমরা উভয়কে পৃথক করে দিলাম। অতঃপর প্রাণবান সবকিছুকে আমরা সৃষ্টি করলাম পানি হ’তে। তবুও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না’? (আম্বিয়া ২১/৩০)। অতঃপর পরকাল কেন? কেন মানুষকে পুনরায় সৃষ্টি করা হবে? আল্লাহ বলেন, ...নিশ্চয় তিনিই প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি পুনর্বার সৃষ্টি করবেন। যাতে তিনি বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীলদের যথাযথ পুরস্কার দিতে পারেন। আর যারা অবিশ্বাস করে তারা প্রাপ্ত হবে উত্তপ্ত পানীয় ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদের অবিশ্বাসের প্রতিফল স্বরূপ’ (ইউনুস ১০/৪)। আল্লাহ বলেন, তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অতঃপর পুনরায় সৃষ্টি করবেন। আর এটি তার জন্য অধিকতর সহজ। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে সর্বোচ্চ মর্যাদা তাঁরই এবং তিনিই মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (রূম ৩০/২৭)। অদৃশ্য জগতের জ্ঞান বিজ্ঞানীদের নেই। তাই তাদের জ্ঞান অপূর্ণ। সেকারণেই বিজ্ঞানী আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫) বলেছেন, Religion without science is blind and Science without religion is lame. ‘বিজ্ঞান ব্যতীত ধর্ম অন্ধ এবং ধর্ম ব্যতীত বিজ্ঞান পঙ্গু।’
আজকের হকিংদের ন্যায় সেকালে মক্কার মুশরিক নেতাদের অনেকের ধারণা ছিল যে, মানুষ আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রাকৃতিক নিয়মেই তারা ধ্বংস হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তারা বলে যে, পার্থিব জীবনই আমাদের জীবন। এখানেই আমরা মরি ও বাঁচি। আর আমাদের কেউ ধ্বংস করে না কাল ব্যতীত। বস্ত্ততঃ এব্যাপারে তাদের কোন জ্ঞান নেই। তারা কেবল ধারণা করে মাত্র’ (জাছিয়াহ ৪৫/২৪)। আরব নেতারা বলেছিল, ‘যখন আমরা মরব ও মাটি হয়ে যাব (অতঃপর পুনরুজ্জীবিত হব), সেই প্রত্যাবর্তন তো সুদূর পরাহত’ (ক্বাফ ৫০/৩)। এ নিয়ে তারা ঝগড়ায় লিপ্ত ছিল। আল্লাহ বলেন, ‘ওরা কি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে? মহা সংবাদ নিয়ে? ‘যে বিষয়ে তারা মতভেদে লিপ্ত’। ‘কখনোই না (তাদের ধারণা অবাস্তব)। ‘শীঘ্র তারা জানতে পারবে’। ‘আবার বলছি, শীঘ্রই তারা জানতে পারবে’ (নাবা ৭৮/১-৫)। কি সে মহা সংবাদ? সেটি হ’ল পুনর্জন্মের সংবাদ। কেননা মানবজীবনে সবচেয়ে বড় সুসংবাদ হ’ল জন্মগ্রহণ করা। আর সবচেয়ে দুঃসংবাদ হ’ল মৃত্যুবরণ করা বা বিলীন হয়ে যাওয়া। এ দুনিয়াতে কেউ মরতে চায় না। কিন্তু যে মানুষের জন্য আসমান-যমীন সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে, সেই মানুষ গড়ে একশ’ বছরের মধ্যেই মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ ইহজীবনে তার আশা-আকাংখার অনেক কিছুই পূরণ হচ্ছে না। তাই এই অস্থায়ী ও অসম্পূর্ণ জগত থেকে চিরস্থায়ী ও পরিপূর্ণ আরেকটি জগতে হিজরত করতে হয়। যেখানে যালেম তার সমুচিত শাস্তি পাবে এবং মযলূম তার যথাযথ পুরস্কার পেয়ে তৃপ্ত হবে। আর সে জগতটাই হ’ল পরজগত। মৃত্যুর পরেই হবে যার শুরু এবং ক্বিয়ামতের দিন হবে যার পূর্ণতা। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ভয় কর সেই দিনের, যেদিন তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে আল্লাহর দিকে। অতঃপর প্রত্যেকে প্রতিফল পাবে, যা কিছু সে অর্জন করেছিল (দুনিয়াতে)। আর তারা মোটেই অত্যাচারিত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৮১)। আর এটাই হ’ল জগদ্বাসীর প্রতি আল্লাহর সর্বশেষ নাযিলকৃত আয়াত। অতএব যদি পরকাল বিশ্বাস না থাকত, তাহ’লে সবল ও দুর্বলের হানাহানিতে পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ত। অবিশ্বাসীদের সন্দেহ দূর করার জন্যই আল্লাহ স্বীয় নবীকে মে‘রাজে নিয়ে জান্নাত-জাহান্নাম স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়েছেন। এরপরেও কি হকিংদের চোখ খুলবে না। হে বিজ্ঞানী স্টিফেন! কোন সে শক্তি যিনি আপনাকে ১৯৬৩ সাল থেকে বিগত ৪৮ বছর যাবত মাথা ব্যতীত পুরা দেহ প্যারালাইসিসে পঙ্গু করে রেখেছেন? দুনিয়ার সকল চিকিৎসা সুবিধা নাগালের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও কেন আপনি সুস্থ হ’তে পারছেন না? আপনার বুকের মধ্যের রূহটা কি কখনো দেখতে পেয়েছেন? ওটা কার হুকুমে এসেছে, আর কার হুকুমে চলে যাবে? আপনি কি ১৯৮৬ সালে শিকাগো শহরে আগের বছরের দেয়া তত্ত্বের ভুল স্বীকার করেননি? বিজ্ঞান স্রেফ অনুমিতি নির্ভর বস্ত্ত নয় কি? অথচ ‘আল্লাহর কালাম সত্য ও ন্যায় দ্বারা পরিপূর্ণ..’ (আন‘আম ৬/১১৫)। ঐ শুনুন আপনার সৃষ্টিকর্তার বাণী, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রভু আল্লাহ, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশে সমাসীন হয়েছেন। তিনিই সকল কিছু পরিচালনা করেন... (ইউনুস ১০/৩)। অতএব তওবা করুন! মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরণ করুন!! পরকালে ভাল থাকবেন ইনশাআল্লাহ। (স.স.)।