গত ১৫ই মার্চ’১৯ শুক্রবার নিউজিল্যান্ডে ক্রাইস্টচার্চের ডিন্স এভিনিউ-এর হ্যাগলি পার্কের নিকট ‘আল-নূর’ মসজিদে ৪২ জন মুছল্লীকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করার পর গাড়ী চালিয়ে ৩ মাইল দূরে ‘লিনউড’ মসজিদে গুলি চালিয়ে আরও ৮ জনকে হত্যা করে ২৮ বছর বয়স্ক ব্রেন্টন ট্যারান্ট নামক অষ্ট্রেলিয় নাগরিক এক শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী চরমপন্থী খ্রিষ্টান। মাত্র ৫ মিনিটের জন্য সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান সফররত বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সদস্যবৃন্দ। উক্ত সন্ত্রাসী নিজে থেকে হেলমেটে ক্যামেরা লাগিয়ে পুরো হামলার দৃশ্য লাইভে সম্প্র্রচার করে। ১৭ মিনিট ধরে চলা এই হামলাকে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা ‘ঠান্ডা মাথায় খুন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ঘটনার পরপরই তাদের পূর্বনির্ধারিত শনিবার থেকে শুরু হ’তে যাওয়া ৩য় টেস্ট বাতিল করে দেশে ফিরে এসেছেন। নাঈম রশীদ নামের একজন পাকিস্তানী যুবক হামলাকারীর উপর ঝাঁপিয়ে না পড়লে হামলা হয়তো দীর্ঘায়িত হ’তে পারত। নাঈম রশীদ নিহত হয়েছেন, কিন্তু তার দেশ পাকিস্তান আজ তাকে নিয়ে গর্বিত। তাকে সর্বোচ্চ সম্মানিত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। অতঃপর হামলাকারী পরবর্তী টার্গেট হিসাবে ‘লিনউড’ মসজিদে গিয়ে প্রবেশরত মুছল্লীদের উপর গুলি চালনা শুরু করলে আব্দুল আযীয (৪৮) নামক জনৈক আফগান মুহাজির তাকে ধাওয়া করেন। তাতে সে ভয়ে গাড়ীতে উঠে পালিয়ে যায়। এরি মধ্যে সে ৮জন মুছল্লীকে হত্যা করে। ৩৬ মিনিটের মাথায় সে প্রশিক্ষণার্থী দু’জন পুলিশের হাতে গাড়ীসহ গ্রেফতার হয়। পরদিন হাতকড়া লাগিয়ে তাকে আদালতে নিয়ে গেলে সে আঙ্গুল দিয়ে ‘ওকে’ চিহ্ন দেখিয়ে বলতে চায় যে, ‘বিশ্বজুড়ে শ্বেতাঙ্গরাই সেরা’। তার চেহারায় আদৌ কোন অনুতাপের চিহ্ন দেখা যায়নি। সে ছিল প্রচন্ড অভিবাসী বিদ্বেষী এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভক্ত। হামলার ১০ মিনিট পূর্বে সে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী বরাবর তার ৭০ পৃষ্ঠার ই-মেইল বার্তা পাঠায়। একইসাথে আরও ৩০টি স্থানে বার্তা পাঠায়। তার ১৬ হাযার শব্দের ইশতেহার চরম বর্ণবাদ, যৌনতা ও সহিংস মন্তব্যের জন্য কুখ্যাত ৮‌টি চ্যানেল ম্যাসেজ বোর্ডে পোস্ট করে। যদিও সেগুলি দ্রুত ডিলিট করার জন্য কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়েছে বলে প্রকাশ। নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ওমর ফারূক মসজিদের চেয়ারম্যান আহমাদ ভামজী দাবী করেন যে, এই হামলার নেপথ্যে ছিল ইস্রাঈলী গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’। তিনি বলেন, হামলাকারী ব্রেন্টন ট্যারান্ট ‘জায়নবাদী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান’ থেকে অর্থের যোগান পেয়েছিল। যদিও সেদেশের ইস্রাঈলী দূতাবাস সেটি অস্বীকার করেছে। নিউজিল্যান্ডের আইন অনুযায়ী হত্যাকান্ডের আসামী ১০ বছর কারাদন্ড ভোগের পর ক্ষমা পেয়ে মুক্ত হ’তে পারে। তবে আমরা এই হত্যাকারীর দ্রুত মৃত্যুদন্ড দাবী করছি।

শুক্রবারের হামলার একদিন পর রবিবার সেদেশের ডানেডিন বিমান বন্দরে একটি সন্দেহজনক ব্যাগ পাওয়া যায়। তাতে বিমানবন্দরের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। একইদিন সেদেশের ‘অকল্যান্ড’ শহরের একটি রেল স্টেশনে হিজাব পরিহিতা মুসলিম দুই তরুণী বোনকে জনৈক দুর্বৃত্ত অপদস্থ করে। তাদের উদ্দেশ্যে তিক্ত ভাষায় সে গালি দিয়ে বলে, ‘তোরা তোদের দেশে ফিরে যা’। পক্ষান্তরে সেদেশের সাধারণ মানুষ আল-নূর মসজিদে হামলায় শহীদদের প্রতি সমবেদনা জানাতে হ্যাগলি পার্কে প্রতিদিন সমবেত হচ্ছেন। যাদের একজন বলেন, ‘যেকোন বিবেচনাতেই ঐ ঘটনা ছিল ভুল। হতাহত ব্যক্তিরা নিউজিল্যান্ডে এসে আমাদের অংশে পরিণত হয়েছেন। তারা আমাদেরই লোক’। নিহত মুছল্লীরা সবাই বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সঊদী আরব, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান, তুরস্ক ও ইরানের নাগরিক। বাংলাদেশের ৫জন নিহত ও ৫জন আহত হয়েছেন।

উল্লেখ্য যে, নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসী হামলার পরদিন শনিবার অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের ‘বায়তুল মাসরূর’ জামে মসজিদে ২৩ বছর বয়সী এক যুবক গাড়ী নিয়ে প্রবেশ করে। যাতে মসজিদের গেটের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। অতঃপর ড্রাইভিং সিটে বসেই সে ভিতরের মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে আক্রমণাত্মক ভাষায় চিৎকার দিয়ে গালি দিতে থাকে। সাথে সাথে পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে। একইদিন শুক্রবার জুম‘আর ছালাত চলাকালীন সময়ে পূর্ব লন্ডনের একটি মসজিদের পাশে নীল গাড়ীতে করে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী তিনজন শ্বেতাঙ্গ যুবক এসে মুছল্লীদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যায়িত করে চিৎকার দিতে থাকে। কয়েকজন মুছল্লী তাদের ধাওয়া করলে একজন গাড়ী থেকে কেরিয়ে এসে মুছল্লীদের উপর হাতুড়ী দিয়ে হামলা চালায়। পরের সপ্তাহে ২১শে মার্চ বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বার্মিংহামে পাঁচটি মসজিদে শ্বেতাঙ্গ হাতুড়ী বাহিনী হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে।

উপরের ৬টি রিপোর্ট পড়লে ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে, পাশ্চাত্য বিশ্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের পরিকল্পিত জঙ্গী হামলা শুরু হয়েছে। এযাবৎ তারা যে মুসলমানদের উপর জঙ্গী তকমা লাগিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছিল, তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলি বিশ্বের দেশে দেশে অধিকাংশ জঙ্গী হামলার সঙ্গে মুসলমানরা জড়িত বলে অভিযোগ করে থাকে। সিএনএন, বিবিসি, স্কাই নিউজ সহ বিশ্বের ইহূদী মালিকানাধীন প্রভাবশালী মিডিয়াগুলি মুসলমানদের ওপর জঙ্গী তকমা দিয়ে প্রচারণা চালায়। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যান্টি-ডিফেম্যাশন লীগ নামক নিউইয়র্ক ভিত্তিক গবেষণা সংস্থার জরিপে দেখা যায় যে, ২০০৮ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত গত ১০ বছরে আমেরিকা সহ কথিত উন্নত বিশ্বের দেশগুলিতে যেসব হামলা হয়েছে, তার শতকরা ৭১ ভাগ হামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীরা। এরা খ্রিষ্টান, ইহূদী এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। আর ২৬ শতাংশের সঙ্গে মুসলমানরা জড়িত বলে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে, ২০১৭ সালের তুলনায় গতবছর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা বেড়েছে ৩৫ শতাংশ।

এদিকে দ্য ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস অব অস্ট্রেলিয়া নামের স্বনামধন্য গবেষণা সংস্থাটি জানিয়েছে যে, এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলছে। সিডনি ভিত্তিক সংস্থাটির বৈশ্বিক সন্ত্রাস সূচক ২০১৮ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে (সারা বিশ্বে) উগ্র ডানপন্থী দল ও ব্যক্তিরা ১১৩টি সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। এতে মৃত্যু হয়েছে ৬৬ জনের। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, শুধুমাত্র ২০১৭ সালেই হামলা হয়েছে ৫৯টি। আর সে বছর মারা গিয়েছে ১৭ জন। ২০১৭ সালে ১২টি হামলা হয়েছে যুক্তরাজ্যে, ৬টি সুইডেনে এবং গ্রীসে ও ফ্রান্সে দু’টি করে হামলা চালানো হয়েছে। একই বছর যুক্তরাষ্ট্রে হামলা হয়েছে ৩০টি। তাতে নিহত হয়েছে ১৬ জন। সংস্থাটির হিসাব মতে নারকীয় এই সব হামলার অধিকাংশই পরিচালিত হয়েছে মুসলিম বিরোধী ভাবাবেগে আক্রান্ত উগ্র ডানপন্থী শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা। গ্লোবাল টেরোরিজম ডাটাবেজ-এর দেয়া তথ্যে জানা যায়, ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যেসব সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, সেগুলির তিনভাগের দুইভাগ চালিয়েছে বর্ণবাদী, মুসলিম বিরোধী, ইহূদী বিরোধী, ফ্যাসিস্ট, সরকার বিরোধী এবং জাতিবিরোধী ভাবাবেগে তাড়িত চরমপন্থী ব্যক্তিরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সহ বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমালোচনা করে বক্তব্য দেন বলেই উগ্র ডানপন্থীরা হামলা করতে উৎসাহ পায়। ধর্মীয় সন্ত্রাসের ঘটনাগুলি যেভাবে প্রচারিত হয়, উগ্র ডানপন্থীদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সেভাবে প্রচারিত হয় না। এখন সেদিকটিতে নযর দেওয়ার সময় এসেছে। কেননা সব জায়গাতেই উগ্র ডানপন্থীদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে।

প্রতিক্রিয়া : সর্বাধিক নিরাপদ ও শান্তিপ্রিয় দেশ হিসাবে খ্যাত নিউজিল্যান্ডে হঠাৎ এই মুসলিম হত্যাযজ্ঞে শোকে স্তব্ধ মুসলিম বিশ্বের সাথে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সহ সাধারণ নাগরিকগণ দুঃখে ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছেন। সেদেশের মাত্র ৩৮ বছর বয়সী মহিলা প্রধানমন্ত্রী ‘জেসিন্ডা আর্ডার্ন’ উপরোক্ত অমানবিক হামলায় যে মানবিক ও সাহসী ভূমিকা রেখেছেন, তা সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। সেই সাথে পুরা নিউজিল্যান্ডবাসী মুসলমানদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এ যুগে এরূপ উদারতার ঘটনা বিরল। আমরা সেদেশের প্রধানমন্ত্রী ও জনগণকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাই। এই সন্ত্রাসী হামলায় চরমপন্থা পরাজিত হয়েছে এবং ইসলাম বিজয়ী হয়েছে। ইতিমধ্যে সেদেশের সাধারণ মানুষ ইসলামের প্রতি যেভাবে ঝুঁকে পড়েছেন, তা সত্যিই ঈর্ষণীয়। খবরে প্রকাশ, হামলার দু’দিনের মধ্যেই সেদেশের ৩৫০ জন অমুসলিম ইসলাম কবুল করেছেন। আলহামদুল্লিাহ! এই ধারা অব্যাহত থাকলে ইনশাআল্লাহ দেশটিতে ইসলাম দ্রুত প্রসার লাভ করবে এবং সারা বিশ্বে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। এ মুহূর্তে কেবলই প্রয়োজন ধৈর্য্যের, তাক্বওয়ার ও উদারতার। ইসলামের বিজয় নির্ভর করে উক্ত তিনটি বিষয়ের উপর। অতএব সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আমাদের আহবান, আসুন! ইসলামের বিজয়ের স্বার্থে ও পরকালীন মুক্তির জন্য আমরা সকল প্রকার চরমপন্থী উস্কানী হ’তে বিরত থাকি এবং নিজেদের সদাচরণের মাধ্যমে সর্বত্র ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরি। 

পরিশেষে নিহত মুছল্লীগণ সবাই পরকালে শহীদের মর্যাদায় অভিষিক্ত হউন এবং আহতদেরকে আল্লাহ দ্রুত সুস্থতা দান করুন, আমরা আল্লাহর দরবারে কায়মনে সেই প্রার্থনা করি- আমীন! (স.স.)






স্বভাবধর্মের বিকাশ চাই! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
উত্তরাঞ্চলকে বাঁচান! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আত-তাহরীক : যাত্রা হ’ল শুরু (২য় সংখ্যা) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মানবাধিকার ও ইসলাম
হিংসা ও প্রতিহিংসা বন্ধ হৌক! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল-কুরআনের আলোকে ক্বিয়ামত
শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার উপায় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নেতৃবৃন্দের সমীপে - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নববর্ষের সংস্কৃতি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পুঁজিবাদের চূড়ায় ধ্বস - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সংস্কারের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সুখী দেশ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.