মানুষের পাপ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই নতুন নতুন গযব নাযিল হবে। পাপের প্রকৃতির যেমন পরিবর্তন হচ্ছে, গযবের প্রকৃতিও তেমনি পরিবর্তিত হচ্ছে। এক সময় ম্যালেরিয়া জ্বর, কালাজ্বর এদেশের আতংক ছিল। ওলাউঠা, গুটি বসন্ত, টিবি ইত্যাদির পরে আসলো ‘ক্যান্সার’। তারপর বর্তমান শতাব্দীর বিশ্বকাঁপানো মরণব্যাধি এইডস-এর আক্রমণ শুরু হ’ল। এখন আবার আসলো ডেঙ্গু জ্বর। গযবের পর গযব। এসবই আসে পরিকল্পিতভাবে বিশ্বপালক আল্লাহর নির্দেশে (হাদীদ ৫৭/২২-২৩) তাঁর অবাধ্য বান্দাদেরকে বাধ্য করার জন্য ও তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের কথা, মৃত্যুর কথা ও জাহান্নামের চিরস্থায়ী আযাবের কথা স্মরণ করিয়ে সাবধান করার জন্য (তওবা ৯/৭৪)। সমাজের বিশেষ করে উঁচু স্তরের নেতৃবৃন্দ যখন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং যখন তাদের ফিসক্ব ও ফুজূরী তথা পাপাচার সীমা ছাড়িয়ে যাবার উপক্রম হয়, তখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ধরনের গযব চলে আসে (ইসরা ১৭/১৬) বিশ্ব পরিচালনায় স্থিতি আনার জন্য (রূম ৩০/৪১)। এটাই আল্লাহর চিরস্থায়ী রীতি যার কোন পরিবর্তন নেই (ফাত্বির ৩৫/৪২-৪৫)। এই রীতির আলোকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের গযব আসে। কখনও আসে সামাজিক ফিৎনা ও অশান্তির আকারে, কখনো আসে প্রাকৃতিক গযব আকারে (নূর ২৪/৬৩)। বিগত উম্মতগুলির মিথ্যাবাদিতা ও অবাধ্যতার কারণে তাদের উপর একই নিয়মে গযব এসেছে ও তারা ধ্বংস হয়েছে (মুমিন ৪০/৮৫)। নূহ (আঃ)-এর কওমের উপরে মহাপ্লাবণের শাস্তি, হূদ (আঃ)-এর কওমের উপরে ৮ দিনের প্রবল ঝড়ে নিশ্চিহ্ন করার শাস্তি, লূত্ব (আঃ)-এর কওমের উপরে জনপদ উল্টে দিয়ে ধ্বংস করার শাস্তি, অহংকারী নমরূদকে মশার আক্রমণে ধ্বংস করার শাস্তি, ক্ষমতাগর্বী ফেরাঊনকে সদলবলে নদীতে ডুবিয়ে মারার শাস্তি, উচ্চাভিলাষী আবরাহা বাহিনীকে পাখির ঠোঁট দিয়ে নিক্ষিপ্ত কংকর দ্বারা নিশ্চিহ্ন করার শাস্তি প্রভৃতি আমাদের উপদেশ হাছিলের জন্য এখন ইতিহাসের অমর সাক্ষ্য হিসাবে মওজূদ আছে (আন‘আম ৬/৪২, নাহল ১৬/৩৬, যুখরুফ ৪৩/২৫)

১৭৭৯ সালে মিসর ও জাভা (ইন্দোনেশিয়া)-তে প্রথম ডেঙ্গুজ্বরের মহামারী ঘটে। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ডেঙ্গু মহামারী আকারে প্রথম দেখা দেয় ১৭৮০ সালে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়াতে। অতঃপর ঊনিশ শতকে ও বিশ শতকের প্রথম দিকে ডেঙ্গুজ্বরের মহামারী ঘটে আমেরিকা, দক্ষিণ ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়াতে। ভারত মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর ও ক্যারিবিয়ান সাগরের কিছু কিছু দ্বীপেও ডেঙ্গুর সন্ধান মেলে। তবে এইসব ডেঙ্গু প্রাণঘাতী ছিল না। পরবর্তীতে হেমোরেজিক বা রক্তক্ষরণজনিত প্রাণঘাতী ডেঙ্গুজ্বর (DHF) মহামারী আকারে প্রথম ঘটে ১৯২২ সালে আমেরিকার টেক্সাস ও লুসিয়ানা নগরীতে। ১৯৫৬ সালে ফিলিপাইনের শিশুদের মারাত্মক আকারে হেমোরেজিক ডেঙ্গু দেখা দেয়। ১৯৮১ সালে কিউবাতে এবং ১৯৮৯ সালে ভেনেজুয়েলাতে এই জ্বর মহামারী আকারে দেখা দেয়। তবে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফেভার সবচেয়ে বেশী হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ (WHO)-এর হিসাব মতে ১৯৮১ থেকে ’৮৬ পর্যন্ত এই রোগে এই অঞ্চলে আক্রান্ত হয়েছে ৭ লাখ ৯৬ হাযার ৩৮৬ জন এবং মারা গেছে ৯ হাযার ৭৭৪ জন। ১৯৯৭ সালে নয়াদিল্লীতে ডেঙ্গুজ্বর ভয়াবহরূপে দেখা দেয়। যাতে ৩০ হাযার লোক আক্রান্ত হয় এবং সহস্রাধিক লোক মারা যায়।

১৯৬৪ সালে ঢাকায় প্রথম ডেঙ্গুজ্বর দেখা দেয়। অতঃপর ১৯৭৭-৭৮ সালে পুনরায় দেখা দেয়। তবে এগুলি ছিল সামান্য আকারে। তখন একে ‘ঢাকা ফেভার’ বলা হ’ত। অতঃপর ১৯৯৭ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে যখন ঢাকায় হঠাৎ করে ডেঙ্গুজ্বরে দুই তরুণ মারা গেল, তখন সরকারের টনক নড়ল। ঢাকা মহানগরীকে ২৩টি জোনে ভাগ করে ২১টিতেই ডেঙ্গু স্ত্রী জাতীয় এডিস মশার উপস্থিতি পাওয়া গেল। এরপরে ১৯৯৮ সালের জুলাই-আগস্টে ভয়াবহ বন্যার পরপরই ‘বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা’র পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে ডেঙ্গুজ্বর সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হ’ল। অতঃপর ২০০০ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু এখন মহামারী আকারে ঢাকা মহানগরীকে গ্রাস করেছে। সেই সাথে সারা দেশে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে। ২রা আগস্ট পর্যন্ত ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আক্রান্ত হয়েছে পাঁচ শতাধিক। দৈনিক এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

এ গযব আল্লাহর হুকুমে এসেছে আমাদের হুঁশিয়ার করার জন্য। এক্ষণে যদি আমরা হুঁশিয়ার হই ও অবিরত ধারায় কৃত পাপসমূহ থেকে তওবা করি, অনুতপ্ত হই ও আমাদের কর্ম সংশোধন করি, তাহ’লে ইনশাআল্লাহ তিনি এ গযব সত্বর উঠিয়ে নেবেন (আন‘আম ৬/৫৪)। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া ঠিক নয় (যুমার ৩৯/৫৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন যে, আল্লাহ এমন কোন রোগ নাযিল করেন না, যার ঔষধ নাযিল করেন না’।[1] অতএব এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, ডেঙ্গুজ্বরের ঔষধ আল্লাহ অবশ্যই নাযিল করেছেন। আমাদের তা খুঁজে বের করতে হবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের একাজে গভীর গবেষণায় লিপ্ত হ’তে হবে। ইতিমধ্যে থাইল্যান্ডে ডেঙ্গু ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়েছে। যা দু’বছরের মধ্যে বাজারজাত হবে বলে শোনা যাচ্ছে। হোমিওপ্যাথিতে এর অব্যর্থ মহৌষধ আছে বলে দাবী করা হচ্ছে। অতএব এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চালানোর সাথে সাথে মশক নিধন ও মশকের বংশ বিস্তার রোধের ব্যবস্থা নিতে হবে।

পরিশেষে আসুন! আত্মসমালোচনা করি। আত্মসংশোধনের সাথে সাথে সমাজ সংশোধনে ব্রতী হই। আল্লাহর দেওয়া প্রশাসনিক ক্ষমতাকে আল্লাহর পথে ব্যয় করি। প্রাণঘাতী ডেঙ্গুজ্বরের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সরকারী-বেসরকারী সকল প্রকারের চেষ্টা সমন্বিত করি এবং এই গযব উঠিয়ে নেওয়ার জন্য আল্লাহর নিকটে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি। আল্লাহ তুমি তোমার অসহায় বান্দাদের গুনাহ-খাতা মাফ কর এবং আমাদের তওবা কবুল কর। হে আল্লাহ তোমার দুর্বল বান্দাদের উপর থেকে এই কঠিন গযব উঠিয়ে নাও-আমীন! ইয়া রববাল ‘আ-লামীন!


[1]. বুখারী হা/৫৬৭৮; মিশকাত হা/৪৫১৪।







বিষয়সমূহ: পাপ দো‘আ
ভাষার স্বকীয়তা অক্ষুণ্ণ রাখুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আমরাও আল্লাহকে বলে দেব - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
চেতনার সংঘাত - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শাসন ব্যবস্থায় আল্লাহর ওয়াদা স্মরণ রাখুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সালাফীবাদ নয় সালাফী পথ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি ব্যঙ্গোক্তি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শেয়ার বাজার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সুখী দেশ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিপন্ন স্বাধীনতা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কুরবানীর মাসায়েল - .
নারী শিক্ষা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
স্বাধীনতার মাসে অধীনতার কসরৎ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.