হিংসা ও অহংকার সকল পতনের মূল

মানবদেহে ষড়রিপু হ’ল কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। এর মধ্যে ‘মদ’ হ’ল হিংসা, গর্ব ও অহংকার। জীবনে চলার পথে ষড়রিপু আমাদের সার্বক্ষণিক সাথী। এগুলি ডাক্তারের আলমারিতে রক্ষিত ‘পয়জন’ (Poison)-এর বোতলের মত। দেহের মধ্যে লুক্কায়িত উপরোক্ত ৬টি আগুনের মধ্যে ‘মদ’ বা হিংসা ও অহংকারের স্ফুলিঙ্গ একবার জ্বলে উঠলে ও তা নিয়ন্ত্রণ হারালে পুরা মানব গাড়ীটাকে পুড়িয়ে ছারখার করে। এমনকি সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেয়। আধুনিক বিশ্বে ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধ এবং জাপানের ‘হিরোশিমা’ ও ‘নাগাসাকি’-র ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়াও সর্বসাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ যার বাস্তব প্রমাণ। হিংসুকের বৈশিষ্ট্য হ’ল সর্বদা ‘হিংসাকৃত ব্যক্তির নে‘মতের ধ্বংস কামনা করা’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘দু’টি বস্ত্ত ভিন্ন অন্য কিছুতে হিংসা নেই। ১. আল্লাহ যাকে মাল দিয়েছেন। অতঃপর সে তা হক-এর পথে ব্যয় করে। ২. আল্লাহ যাকে প্রজ্ঞা দিয়েছেন, সে তা দ্বারা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং শিক্ষা দেয়’ (বুখারী হা/৭৩; মিশকাত হা/২০২)। এটিকে মূলত ‘হিংসা’ বলা হয় না, বরং ‘ঈর্ষা’ বলা হয়। হিংসা নিষিদ্ধ এবং ঈর্ষা সিদ্ধ, বরং আকাংখিত। আসমানে প্রথম হিংসা করেছিল ইবলীস আদিপিতা আদম ও মা হাওয়ার সাথে। যমীনে প্রথম হিংসা করেছিল আদম পুত্র ক্বাবীল তার উত্তম ছোট ভাই হাবীলের সাথে। তাই ভাল-র প্রতি হিংসা চিরন্তন।

রহমাতুললিল আলামীন বা ‘জগদ্বাবাসীর জন্য শান্তি’ বলে খ্যাত শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে হিংসা করেছিল মদীনার মুনাফিক লাবীদ বিন আ‘ছাম। সে তার মেয়েকে দিয়ে গোপনে রাসূল (ছাঃ)-এর মাথার একটি চুল ও চিরুনীর একটি ভাঙ্গা দাঁত সংগ্রহ করে। অতঃপর চুলটিতে জাদুমন্ত্র পাঠ করে উক্ত দাঁতে জড়িয়ে ১১টি গিরা দেয়। অতঃপর খেজুরের শুকনা মোচার মধ্যে বেঁধে বনু যুরায়েক্ব গোত্রের খেজুর বাগানে ‘যারওয়ান’ কূয়ার নীচে পাথর চাপা দিয়ে রেখে আসে। এর ফলে রাসূল (ছাঃ) মাঝে-মধ্যে কিছু ভুলে যেতে থাকেন। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সূরা ফালাক্ব ও নাস নাযিল হয়। তখন তিনি আলী (রাঃ)-কে পাঠিয়ে উক্ত কূয়ার নীচ থেকে সেটি উঠিয়ে আনেন। অতঃপর তিনি একেকটি আয়াত পাঠ করেন ও একেকটি গিরা খুলে যেতে থাকে। অবশেষে ১১টি গিরা সব খুলে যায় এবং তিনি হালকা বোধ করেন। প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলা হলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। আমি চাই না যে, লোকদের মধ্যে মন্দ ছড়িয়ে পড়ুক’ (বুখারী হা/৬৩৯১)। তবে তিনি মৃত্যু অবধি ঐ মুনাফিকের চেহারা দেখেননি (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)

ইমাম রাযী বলেন, আল্লাহ মানুষের সকল নষ্টের মূল হিসাবে ‘হিংসা’ দিয়ে সূরা ফালাক্ব শেষ করেছেন। অতঃপর সকল অনিষ্টের মূল হিসাবে মানুষের মনে শয়তানের ‘খটকা’ সৃষ্টি বা ওয়াসওয়াসা দিয়ে সূরা নাস শেষ করেছেন’। যা তারতীবের দিক দিয়ে কুরআনের সর্বশেষ সূরা। এর মাধ্যমে মানুষকে মানুষের হিংসা থেকে ও শয়তানের খটকা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে। কেননা আল্লাহর রহমত ব্যতীত হিংসা ও শয়তানের খটকা থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। হুসাইন বিন ফযল বলেন, আল্লাহ এই সূরায় সকল মন্দকে একত্রিত করেছেন এবং ‘হিংসা’ দিয়ে সূরা শেষ করেছেন এটা বুঝানোর জন্য যে এটাই হ’ল সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বভাব’।

আনাস (রাঃ) বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে বসেছিলাম। এমন সময় তিনি বললেন, ‘এখন তোমাদের নিকট একজন জান্নাতী মানুষের আগমন ঘটবে’। অতঃপর আনছারদের একজন ব্যক্তি আগমন করল। যার দাড়ি দিয়ে ওযূর পানি টপকাচ্ছিল ও তার বাম হাতে জুতা জোড়া ছিল। দ্বিতীয় দিন ও তৃতীয় দিন রাসূল (ছাঃ) একই রূপ বললেন এবং পরক্ষণে একই ব্যক্তির আগমন ঘটলো। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মজলিস থেকে উঠলেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল ‘আছ তাঁর পিছু নিলেন।...আনাস (রাঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ বিন আমর বলেন, আমি তার বাসায় একরাত বা তিন রাত কাটাই। কিন্তু তাকে রাতে ছালাতের জন্য উঠতে দেখিনি। কেবল ফজরের জন্য ওযূ করা ব্যতীত। তাছাড়া আমি তাকে সর্বদা ভাল কথা বলতে শুনেছি। এভাবে তিনদিন তিনরাত চলে গেলে আমি তার আমলকে হীন মনে করতে লাগলাম। তখন আমি ঐ ব্যক্তিকে বললাম, আপনার সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) এই এই কথা বলেছিলেন এবং আমিও আপনাকে গত তিনদিন যাবৎ লক্ষ্য করছি। কিন্তু আপনাকে বড় কোন আমল করতে দেখলাম না। তা’হলে কোন বস্ত্ত আপনাকে ঐ স্থানে পৌঁছিয়েছে, যার সুসংবাদ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে শুনিয়েছেন? তিনি বললেন, আমি যা করি তাতো আপনি দেখেছেন। অতঃপর যখন আমি চলে আসার জন্য পিঠ ফিরাই, তখন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘আপনি যা দেখেছেন, তাতো দেখেছেন। তবে আমি আমার অন্তরে কোন মুসলিমের প্রতি বিদ্বেষ রাখি না এবং আমি কারু প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত কোন কল্যাণের জন্য হিংসা পোষণ করি না’। একথা শুনে আব্দুল্লাহ বিন আমর বললেন, ‘এটিই আপনাকে উক্ত স্তরে পৌঁছিয়েছে। এটি এমন এক বস্ত্ত যা আমরা করতে সক্ষম নই’ (হাকেম হা/৪৩৮০, আহমাদ হা/১২৭২০)

বস্ত্তত হিংসুকের সবচেয়ে বড় শাস্তি হ’ল সে হিংসার আগুনে নিজেই জ্বলে-পুড়ে মরে। হিংসা তার সকল নেকী খেয়ে ফেলে যেমন আগুন কাঠকে খেয়ে ফেলে’ (কুরতুবী)। আর অন্যায় দম্ভ ও অহংকার মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যায় (যুমার ৩৯/৭২)। ...আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করে এবং তা থেকে অহংকারবশে মুখ ফিরিয়ে থাকে, তাদের জন্য আকাশের দুয়ার সমূহ উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না ছুঁচের ছিদ্রপথে উষ্ট্র প্রবেশ করে। এভাবেই আমরা পাপীদের বদলা দিয়ে থাকি’ (আ‘রাফ ৭/৪০)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে।...তিনি বলেন, ‘অহংকার’ হ’ল ‘সত্যকে দম্ভের সাথে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা’ (মুসলিম হা/৯১; মিশকাত হা/৫১০৮)। দুনিয়াতে অহংকারের পরিণতি হ’ল লাঞ্ছনা। আর আখেরাতে এর পরিণতি হ’ল ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ অর্থাৎ জাহান্নামীদের উত্তপ্ত পুঁজ-রক্ত পান করা (তিরমিযী হা/২৪৯২)

আল্লাহ মানুষকে মেধায়, শক্তিতে, সম্পদে ও মর্যাদায় পরস্পরে উঁচু-নীচু করেছেন কেবল তাদের পরীক্ষা করার জন্য এবং এগুলির মাধ্যমে পরকালীন পাথেয় সঞ্চয়ের জন্য। যারা এটা করেন, তারাই প্রকৃত অর্থে বিচক্ষণ ব্যক্তি (ইবনু মাজাহ হা/২৪৫৯)। বর্তমান যুগে দেশে দেশে বর্ণবিদ্বেষ, অঞ্চল বিদ্বেষ, দলীয় বিদ্বেষ, ব্যক্তিবিদ্বেষ মানুষকে অন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি পসন্দনীয় ব্যক্তি বা দলের বিপরীত কোন মুসলমানের মৃত্যুতে ইন্নালিল্লাহ...বলার স্বাধীনতাটুকুও হরণ করা হচ্ছে। অথচ মুখে সর্বদা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ফেনা উঠছে। এদেশে বহু সার্চ কমিশন, ট্রুথ কমিশন হয়েছে। তবে এটাই বাস্তব যে, সত্যকে সবাই ভালবাসলেও সত্যকে কেউ গ্রহণ করেনা। যার মৌলিক কারণ হ’ল হিংসা ও অহংকার। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কোন অঙ্গনই এ থেকে মুক্ত নয়। অথচ অহংকারের পতন যে অবশ্যম্ভাবী, তার বাস্তব প্রমাণ এদেশেই রয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে হিংসা ও অহংকারের অনিষ্টকারিতা হ’তে রক্ষা করুন।-আমীন! (স.স.)






দল ও প্রার্থী বিহীন নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শিক্ষার মান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সত্যদর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সীমান্তে পুশইন : মানবতা তুমি কোথায়? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিরোধী নেত্রীর জনসভায় গ্রেনেড হামলা : দেশপ্রেমিকগণ সাবধান! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
Urge to sort out the world governance system - Prof. Dr. Muhammad Asadullah Al-ghalib
ভাষার স্বকীয়তা অক্ষুণ্ণ রাখুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
গণজোয়ার ও গণঅভ্যুত্থান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
উৎসের সন্ধানে - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হাদীছ অস্বীকারের ফিৎনা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
৩য় বর্ষে পদার্পণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.