পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এখন চলে যাবে ১২ কি.মি. দক্ষিণে কেরানীগঞ্জের খোলামেলা পরিবেশে। বলা হচ্ছে এটি এখন এশিয়ার সর্বাধুনিক ও বৃহত্তম কারাগার। খবরটি বন্দীদের জন্য কিছুটা স্বস্তিদায়ক হ’লেও আসলে এতে বরং আমাদের সমাজের ক্রমবর্ধমান অপরাধী চরিত্রকেই বিশ্বের সামনে তুলে ধরা হ’ল। দেশের ৬৮টি কারাগারে বন্দী ধারণ ক্ষমতা ৩৪,৪৬০ জনের স্থলে বর্তমানে তা দ্বিগুণেরও অধিক হয়ে কারাগার উপচে পড়ার উপক্রম হয়েছে। হিংসা ও প্রতিহিংসার রাজনীতির ফলে কারাগারগুলি এখন সরকারী দমনাগারে পরিণত হয়েছে। গরুর খোয়াড়ের চাইতেও সেখানে অমানবিক পরিবেশ বিরাজ করছে। অথচ পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বিপরীত চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। ইউরোপীয় দেশ নেদারল্যান্ডে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে কয়েদীর অভাবে এ যাবৎ ২৪টি জেলখানা বন্ধ হয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে সেখানে অপরাধীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। নেদারল্যান্ড যেটা পারল, ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমরা কেন সেটা পারি না?

এ বিষয়ে রাজশাহী ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, গোপালগঞ্জ ও বগুড়া সহ মোট ৭টি কারাগারে সরকারের চাপানো মিথ্যা মামলায় ৩ বছর ৬ মাস ৬ দিন হাজতের নামে কারাভোগের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে কারা সংস্কারে আমাদের কিছু প্রস্তাব সরকার ও বিদগ্ধ সমাজের নিকট পেশ করছি।-

(১) শুধুমাত্র সন্দেহ বশে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। সরকারকে জনবান্ধব হ’তে হবে এবং মিথ্যা মামলায় নাগরিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। (২) নিম্ন আদালতগুলিকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। যেন পুলিশের ধরে আনা ব্যক্তিকে আদালত হয়ে কারাগারে পাঠানোই তাদের একমাত্র কাজ না হয়। (৩) সম্মানী-অসম্মানী সকল বন্দীকে সমান গণ্য করে হাতকড়া পরানো ও বেড়ী পরানোর বিধান পরিবর্তন করতে হবে। (৪) সর্বোচ্চ ৬ মাসের বেশী কাউকে হাজতে আটকে রাখা যাবে না। (৫) কারাগারের মধ্যে সার্বক্ষণিকভাবে হাতে-পায়ে বেড়ী পরিয়ে রাখার অমানবিক পদ্ধতি অবশ্যই বাতিল করতে হবে। (৬) বন্দীদেরকে স্ব স্ব ধর্মীয় মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। কারাগারে জুম‘আ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অথবা প্রতি ওয়ার্ডে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ও জুম‘আর ছালাতের ব্যবস্থা করতে হবে। দুই ঈদে সকল বন্দীকে অন্ততঃ তিন ঘণ্টার জন্য খোলামেলাভাবে একত্রিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। জুম‘আ ও ঈদে বাহির থেকে ভাল আলেম এনে বন্দীদের সামনে কুরআন ও হাদীছ থেকে আখেরাত ভিত্তিক উপদেশ দিতে হবে। (৭) নিরক্ষর বন্দীদের দ্রুত অক্ষর জ্ঞান, প্রাথমিক ধর্মীয় জ্ঞান ও অংক জ্ঞান সম্পন্ন করে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে। (৮) প্রতিদিন বাদ ফজর ও বাদ এশা প্রতি কক্ষে দরসে কুরআন ও দরসে হাদীছের ব্যবস্থা রাখা আবশ্যক। বন্দীদের মধ্য থেকেও যোগ্য ব্যক্তিদের একাজে লাগানো যেতে পারে। এর ফলে সংশোধিত বন্দীদের বন্দীত্বের মেয়াদ ক্রমান্বয়ে হ্রাস করার বিধান রাখতে হবে। (৯) কারাগারে ম্যাটদের অত্যাচার ও তাদের মাধ্যমে অর্থ বাণিজ্য এবং কারা ঠিকাদারদের খাদ্য লুট কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সুস্থ মানুষকে অর্থের বিনিময়ে অসুস্থ দেখিয়ে হাসপাতালে দিনের পর দিন ভর্তি রাখা এবং উঁচু-নীচু ভেদাভেদ ছাড়াই সকল বন্দীকে এক সাথে আমদানী ওয়ার্ডে জমা করার রেওয়াজ বাতিল করতে হবে। সেই সাথে বর্তমানের ফাইলিং প্রথা বন্ধ করে তার বদলে কারা কক্ষে গিয়ে বন্দীদের রেজিস্ট্রেশন ও তাদের ছবি ধারণ করা উত্তম হবে। (১০) প্রতি ১৫ দিন অন্তর জেল পরিদর্শনের জন্য দায়িত্বরত অথবা অবসরপ্রাপ্ত সুনামখ্যাত একাধিক যেলা জজকে নিযুক্ত করা আবশ্যক। যারা বন্দীদের কাছে গিয়ে তাদের খোলামেলা কথাগুলি শুনবেন। প্রয়োজনে অডিও বা ভিডিও করে নিবেন। এটি বিচার কাজেও সহযোগিতা হবে। এ সময় কারারক্ষী ব্যতীত অন্যকোন কারা কর্মকর্তা তাদের সঙ্গে থাকবেন না। (১১) সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য কারাগারের মধ্যেই আদালত বসিয়ে প্রাথমিক বিচার সম্পন্ন করা আবশ্যক। তাতে অনেক নিরপরাধ বন্দী দ্রুত মুক্তি পাবে এবং সত্যিকারের অপরাধী দ্রুত চিহ্নিত হবে। বন্দীদের সাথে সরাসরি কথা বললে বিচারক সহজেই তাকে যাচাই করতে পারবেন। বর্তমানের দীর্ঘসূত্রী আদালতে যা আদৌ সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে কারা কর্মকর্তা ও কারারক্ষীগণ এমনকি কারাসাথীগণও সহযোগিতা করতে পারেন। কারণ বন্দীদের সম্পর্কে তারা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশী জানার সুযোগ পান। (১২) কারাগারে বন্দীদের জন্য খোলা আকাশের নীচে হাঁটা-চলা, ব্যায়াম ও সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্তদেরকেও তাদের সেলের বাইরে সকালে-বিকালে চলাফেরার সুযোগ দিতে হবে। মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য সব রকম ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং প্রতিটি সেলে ও কক্ষে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বৈদ্যুতিক ফ্যান ও মানসম্মত বিছানা থাকতে হবে। বন্দীদের খাদ্যমান অবশ্যই রুচিসম্পন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত হ’তে হবে। বন্দীকে নিজের টাকায় ইচ্ছামত খাদ্য কিনে খাবার এবং বাড়ী থেকে খাদ্য পরিবেশনের সুযোগ রাখতে হবে। (১৩) মিথ্যা মামলার বাদী ও সাক্ষীদের জন্য দ্বিগুণ শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ব্যাপারে পুলিশ ও সরকারকে দায়মুক্তি দেওয়া চলবে না। (১৪) সর্বোচ্চ ৫ বছরের বেশী কাউকে কারাদন্ড দেওয়া যাবে না এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান অবশ্যই বাতিল করতে হবে। বন্দী সংশোধিত হ’লে তাকে যেকোন সময় মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। পুনরায় একই অপরাধ করলে পূর্বের চাইতে অধিক শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে। (১৫) ‘আসামী’ পরিভাষা বাতিল করে হাজতীদের জন্য ‘বন্দী’ ও দন্ডপ্রাপ্তদের জন্য ‘কয়েদী’ পরিভাষা চালু করা হৌক। সেই সাথে মুসলমানকে হেয় করার জন্য সাদা টুপি ও জামা পরার প্রচলিত কয়েদী পোষাক এখুনি বাতিল করা হৌক। (১৬) কেবল প্রথম শ্রেণী প্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা বা মন্ত্রী-এমপি নয়, বরং সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন আলেম-ওলামা ও অন্যান্যদেরকে কারাগারে শুরুতেই ডিভিশন প্রাপ্ত হিসাবে মর্যাদা দিতে হবে। (১৭) প্রতি ১৫ দিন অন্তর বন্দীদেরকে তাদের স্ত্রী ও পরিবারের সঙ্গে কারাগারের মধ্যে কমপক্ষে ৫ ঘণ্টা নিরিবিলি থাকার সুযোগ দিতে হবে। তাতে বন্দীদের জৈবিক ও মানবিক চাহিদা পূরণ হবে। তাতে সংসারে শান্তি বজায় থাকবে। (১৮) মাদকসেবী সহ সকল বন্দীর জন্য শাস্তির চাইতে উপদেশ এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। (১৯) হাজতী ও কয়েদী সকল বন্দীর সম্মানজনক উপার্জনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। যার বিনিময় মূল্যের ৯০ শতাংশ বন্দী নিজে বা তার পরিবার নিয়মিতভাবে পাবেন। অথবা দন্ডপ্রাপ্তদের দু’পায়ে ট্রাকার লাগিয়ে কারাগারের বাইরে তাদের কর্মস্থলে বা অন্যত্র ইতিবাচক কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে। তাতে ঐ ব্যক্তি দ্রুত সংশোধিত হ’তে পারেন। এমতাবস্থায় আদালতের সামনে দু’জন আলেমের নিকট আল্লাহর নামে তওবা করলে ঐ বন্দীকে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং তাকে সামাজিকভাবে যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। এতে কারাগার ক্রমেই খালি হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। (২০) অসহায় কারাবন্দীদের খাদ্য দানের নেকী ও তাদের মামলা পরিচালনার জন্য দানশীল মুমিনদের উদ্বুদ্ধ করা আবশ্যক। তাতে সরকারী ব্যয় অনেক কমে যাবে।

পরিশেষে বলব, আদালতে ইসলামী বিধান ও দন্ডবিধি সমূহ কার্যকর করা এবং কারাগারে মানবিক আচরণ নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন -আমীন! (স.স.)






ওয়াহহাবী সংস্কার আন্দোলন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আহলেহাদীছ কখনো জঙ্গী নয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে কটূক্তি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হানাহানি কাম্য নয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সত্য-মিথ্যার মানদন্ড - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ভেসে গেল স্বপ্নসাধ! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নারী শিক্ষা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইরান-আফগান সংকট - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মিসকীন ওবামা, ভিকটিম ওসামা, সাবধান বাংলাদেশ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
তবে কি বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.