জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচলিত ধারায় দেশে কি সৎ ও যোগ্য নেতারা নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসতে পারবেন? আর এলেও তিনি কি সৎ ও যোগ্য থাকতে পারবেন? বর্তমান নেতৃত্ব নির্বাচন পদ্ধতিতে সেটা আদৌ সম্ভব কি-না ভেবে দেখার বিষয়। কারণ : (১) এখানে প্রার্থী হওয়ার মাধ্যমে নেতৃত্ব চেয়ে নিতে হয়। সৎ ও যোগ্য লোকেরা কখনোই নেতৃত্ব চেয়ে নেন না (২) এখানে সাধারণতঃ দলভিত্তিক প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয় ও তাকে নির্বাচনের জন্য সত্য-মিথ্যা ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। ফলে অন্য দলের কিংবা নিরপেক্ষ কোন সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি নেতা নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন (৩) প্রচলিত নির্বাচন প্রথায় অর্থ, অস্ত্র ও দলীয় ক্যাডার বা সন্ত্রাসী লালন করা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক প্রকার অপরিহার্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। অথচ সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিগণ কখনো এসবের ধারে-কাছে যান না (৪) প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থায় নির্বাচক ও নির্বাচিতদের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট গুণাবলী ও যোগ্যতা নির্ধারিত নেই। ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে যেকোন নাগরিক নেতা হবার জন্য ভোটে দাঁড়াতে পারেন বা ভোট দিতে পারেন। ফলে সন্ত্রাসের গডফাদার বলে খ্যাত এবং নৈতিকতা বিবর্জিত ব্যক্তিদের জন্য এ সিস্টেমে এম.পি বা মন্ত্রী হওয়াটা খুবই সাধারণ ব্যাপার (৫) বর্তমানকালে জাতীয় সংসদ সদস্যগণ জাতির খাদেম হন না, বরং জাতির শোষক হিসাবে গণ্য হন। ফলে মন্ত্রী-এম.পিগণ বর্তমানে জনগণের কাছ থেকে কোনরূপ সম্মান বা শ্রদ্ধা কুড়াতে সক্ষম হন না। কারণ নির্বাচনের সময় যে অঢেল অর্থের ছড়াছড়ি দেখা যায়। এমনকি মনোনয়ন পাওয়ার জন্য দলীয় ফান্ডে বা দলীয় নেতাদেরকে যে কোটি কোটি টাকার গোপন ও প্রকাশ্য চাঁদা দিয়ে নমিনেশন খরিদ করার প্রতিযোগিতা হয়, তাতে টাকার মালিকেরাই কেবল এম.পি হওয়ার সুযোগ পান। এম.পি হওয়ার পরে তারা তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থের বহু গুণ উসূল করে নেবেন, এটা ধরে নেওয়া যায়। অন্যদিকে মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ নেতৃত্ব প্রয়াসীদেরকে রাষ্ট্রের অন্য কোন পদ বা কন্ট্রাক্টরী বাগিয়ে দেওয়ার ওয়াদা দিয়ে দলীয় হাইকম্যান্ড তাদেরকে আশ্বস্ত করে থাকেন। এমতাবস্থায় সৎ, যোগ্য ও আদর্শ সচেতন লোকেরা কোন হিসাবেই আসেন না (৬) বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় মেধাসম্পন্ন এম.পি-রাও নেতাদের চাটুকারে পরিণত হ’তে বাধ্য হন। দলনেতার বিরোধিতা করলে সংবিধানের ৭০ ধারা অনুযায়ী ফ্লোর ক্রসিংয়ের আইনের বলে তাকে সংসদ সদস্য পদ হারাতে হয়। এই দুনিয়াবী লাভ ও সুযোগ-সুবিধা হারানোর ঝুঁকি কেউ নিতে চান না। ফলে জাতীয় সংসদ মূলতঃ স্ব স্ব দলনেতার প্রশংসা ও অপর দলের কুৎসা রটনার কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৯৯৯ সালে প্রদত্ত জনৈক অর্থনীতিবিদের হিসাব মতে ‘বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে প্রতি মিনিটে খরচ হয় ১৫ হাযার টাকা। এক মিনিটে একজন সদস্য ১৬০টি শব্দ উচ্চারণ করতে পারেন। ফলে তার প্রতি শব্দে ১০০ টাকা করে খরচ হয়’। অতএব এই মূল্যবান সময় ও মুহূর্তগুলি পরচর্চা ও খিস্তি-খেউড়ে শেষ করা ও জাতীয় সম্পদের অপচয় করা দ্বীনদার ও বিবেকবান লোকদের পক্ষে মোটেই সম্ভব নয় (৭) দলের নেতাদের কিংবা দেশের বিভিন্ন এলাকাকে খুশী করার জন্য মন্ত্রী-উপমন্ত্রীর সংখ্যা বাড়ানো হয়। সেই সাথে মন্ত্রীর মর্যাদায় উপদেষ্টাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এই সব পদ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় প্রমাণিত হয়। অথচ ৩৩০ জন এম.পি ও ৭৩ জন মন্ত্রী-উপমন্ত্রীর বদলে মাত্র ১০ জন উপদেষ্টা নিয়ে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিগত যেকোন দলীয় সরকারের চেয়ে অত্যন্ত যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততার সাথে দেশ পরিচালনা করছেন। মাত্র দেড় মাসেই তাঁরা জনগণের প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়েছেন (৮) পাঁচ বছর অন্তর অন্তর নেতা নির্বাচন বা পরিবর্তনের কারণে অভিজ্ঞ ও দক্ষ কোন মন্ত্রী বা শাসক সৃষ্টি হ’তে পারেন না। ফলে জাতীয় সংসদ অদক্ষ, আনাড়ী ও দুষ্টু লোকদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয় (৯) জনমতের কোন স্থিরতা না থাকায় জাতীয় সংসদে ভিন্ন ভিন্ন মতের সমাগম ঘটে। ফলে জনকল্যাণের ও দেশ পরিচালনার স্থায়ী কোন নীতি ও ভিত্তি রচনা করা সম্ভব হয় না (১০) ‘সংবিধান’ নামীয় বস্ত্তটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের সংশোধনীতে ভরপুর একটি অপালনযোগ্য বস্ত্ততে পরিণত হয়। (১১) ‘গণতন্ত্রে মাথা গণনা করা হয় মাত্র। কিন্তু মাথার মধ্যে কি আছে, তা যাচাই করা হয় না’ (ইকবাল)। ফলে এখানে সৎ ও যোগ্য লোকদের মূল্যায়ন ও ক্ষমতায়ন প্রায় অসম্ভব বিষয়। (১২) পাঁচ বছর অন্তর অন্তর এম.পি নির্বাচনের এই মরণ খেলায় হাযার হাযার কোটি টাকার অপচয়ের ফলে দেশে যেমন মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়, তেমনি শত শত লোকের জীবন হানি, গাড়ী-বাড়ী ভাংচুর ও মূল্যবান সম্পদরাজি ধ্বংস হওয়ায় জাতীয় ক্ষতি ও সামাজিক অধঃপতন অবশ্যম্ভাবী হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে নেতৃত্ব নির্বাচন ‘ফরযে কেফায়াহ’, যেমন জানাযার ছালাত। অর্থাৎ উম্মতের দায়িত্বশীল কিছু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি যখন পূর্বতন নেতার পরে সৎ ও যোগ্য কাউকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করেন, তখন সকলের পক্ষ থেকে উক্ত ‘ফরয’ আদায় হয়ে যায় এবং সকলকে তা মেনে নেওয়া বাধ্যতামূলক হয়। এটা ছালাত ও যাকাতের ন্যায় ‘ফরযে আয়েন’ নয় যে, উম্মতের প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেক নারী-পুরুষকে এব্যাপারে মতামত ব্যক্ত করতেই হবে। এই ফরয হক আদায়ের কঠিন যিম্মাদারী ইসলাম গুণী-নির্গুণ, সৎ-অসৎ, যোগ্য-অযোগ্য নির্বিশেষে সকলের উপরে ন্যস্ত করেনি। বরং এ দায়িত্বের প্রধান হকদার হ’লেন পূর্ব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সৎ ও যোগ্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ। দ্বিতীয়তঃ নেতা নির্বাচন বলতে দেশের আমীর বা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বুঝাবে, প্রচলিত এম.পি নির্বাচন নয়। আমীর বা প্রেসিডেন্ট হবেন দেশ পরিচালনার সর্বোচ্চ যিম্মাদার। তিনি সৎ ও যোগ্য লোক বাছাই করে একটি মজলিসে শূরা বা পরামর্শ সভা মনোনয়ন দিবেন এবং তাদের সাথে পরামর্শক্রমে তিনি দেশ পরিচালনা করবেন। অতএব কে পার্লামেন্ট সদস্য হবে, সেটা বাছাই ও মনোনয়নের দায়িত্ব প্রেসিডেন্টের। জনগণ কাউকে এম.পি নির্বাচন করে প্রেসিডেন্টের উপরে চাপিয়ে দিতে পারে না। সেটা করলে প্রেসিডেন্ট ও শূরার মধ্যে সংঘর্ষ লেগেই থাকবে। দেশের উন্নতি ব্যাহত হবে। এমনকি দেশ ধ্বংস হবে।
আমরা মনে করি নির্দিষ্ট মেয়াদ ভিত্তিক এম.পি নির্বাচনের রক্তাক্ত খেলা এবং দেশ সেবার নামে দেশ শোষণের বর্তমান অপরাজনীতি বন্ধ করা উচিত। দল ও প্রার্থীভিত্তিক প্রচলিত নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করে দেশের প্রধান বিচারপতির মাধ্যমে নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে সৎ ও যোগ্য, দক্ষ ও নিরপেক্ষ, ইসলামী জ্ঞান সম্পন্ন একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হউক। যিনি পসন্দমত দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে মজলিসে শূরা বা পার্লামেন্ট গঠন করবেন ও তাঁদের পরামর্শ মোতাবেক দেশ পরিচালনা করবেন।
আমরা মনে করি জাতির মুক্তি এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। আল্লাহ আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি দান করুন- আমীন!