ফারাক্কা বাঁধ থেকে ছাড়া পানি হু হু করে ধেয়ে আসছে রাজশাহীর দিকে। সে চায় শিক্ষানগরী রাজশাহীকে গ্রাস করতে। শহর রক্ষা বাঁধ তার প্রধান শত্রু। একে সে খাবেই। এবার যেন সে মরিয়া হয়ে উঠেছে। উত্তরাঞ্চলের এই বিভাগীয় শহরকে তলিয়ে দিতে পারলে পুরা উত্তরাঞ্চলকে সে ডুবিয়ে দিতে পারবে নিমেষে। সাড়ে ৪ কোটি মানুষ আজ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে নিজেদের এই ধ্বংস দৃশ্য।

কই আগে তো কখনো এরূপ ছিল না। প্রমত্তা পদ্মা যার নাম। তার বুকে আজ গভীরতা নেই কেন? কেন সে আজ পানি বিহনে কাতরাচ্ছে। ব্লাড প্রেসারের রোগীর মত অল্পতেই সে ফুঁসে উঠছে কেন? কে তার স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ও গতিপ্রবাহ বিনষ্ট করল? আসুন একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি পার্শ্ববর্তী বন্ধু দেশটির দিকে। কেননা তাদেরই সৃষ্ট এই মরণ বাঁধ ফারাক্কা। এই ফারাক্কাই আজ আমাদের ও আমাদের প্রাণপ্রিয় পদ্মার মধ্যে ফারাক সৃষ্টি করেছে। পদ্মাকে আমাদের শত্রু বানিয়েছে।

ফারাক্কা বাংলাদেশের রাজশাহী-চাঁপাই নবাবগঞ্জ সীমান্ত থেকে মাত্র ১১ মাইল ভিতরে গঙ্গা নদীর উপরে ভারতের দেওয়া বাঁধের নাম। যা কেবল বাংলাদেশের জনগণের জন্য নয়, খোদ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জন্যেও গলার ফাঁসে পরিণত হয়েছে। কারণ গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দেওয়ার ফলে তার বুকে পলি জমে জমে ক্রমশঃ নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তার পানি ধারণ ক্ষমতা প্রতি বছর কমে যাচ্ছে। ফলে উজানের ধেয়ে আসা প্রবল পানিস্রোত আর স্বাভাবিক বর্ষার পানি একত্রিত হয়ে তার বুক ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর সেই সাথে ভেসে যাচ্ছে তার তীরবর্তী মুর্শিদাবাদ, নদীয়া প্রভৃতি যেলার লাখ লাখ বনু আদমের স্বপ্নসাধ। ধ্বংস হচ্ছে তাদের ফসল ও বাড়ী-ঘর। বাপ-দাদার ভিটে-মাটি ছাড়া হয়ে তারা এখন উদ্বাস্ত্ত হিসাবে আশ্রয় নিচ্ছে পার্শ্ববর্তী যেলাগুলিতে। ফলে তাদের মন রক্ষার জন্য সাময়িক ব্যবস্থা হিসাবে ফারাক্কার বাঁধ খুলে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। আর কোটি কোটি গ্যালন পানি ভীষণ ক্রোধে ঝাঁপিয়ে এসে আছড়ে পড়ছে রাজশাহীর মরা পদ্মার বুকে। এভাবে বর্ষাকালে পানি ছেড়ে ও শুকনা মওসুমে পানি আটকিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে ও শুকিয়ে মারার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ এই দেশটি।

কলিকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার অজুহাতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের প্রবল বাধা উপেক্ষা করে ১৯৭০ সালে ভারত এই বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করে। কিন্তু তা চালু করতে সাহস করেনি। ইতিমধ্যে এসে যায় ’৭১-এর যুদ্ধ। ভারত সুকৌশলে যুদ্ধের জয়মাল্য নিজের ঘরে তুলে নেয়। পাকিস্তান আর্মীর রেখে যাওয়া বিপুল অস্ত্রশস্ত্র এবং এদেশের মিল-কলকারখানা সমূহের মেশিন-পত্র ও যন্ত্রপাতি সব সে নিজ দেশে লুটে নিয়ে যায়। বাধা দিতে গিয়ে ৯ম সেক্টর কমান্ডার মেজর আব্দুল জলীলকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ফলে তিনিই হন স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম রাজবন্দী। অতঃপর বাংলাদেশ নামক একটি ফোকলা ও খুঁড়িয়ে চলা সদ্য স্বাধীন দেশের দুর্বলতাকে ভারত পুরোপুরি নিজ স্বার্থে কাজে লাগায়। ফলে তৎকালীন সরকারের কৃতজ্ঞতাসুলভ আচরণের সুযোগে সে অতি সহজেই ১৯৭৫ সালের ২১শে এপ্রিল থেকে চালু করে এই মরণ বাঁধ ফারাক্কা। এর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে উত্তরাঞ্চলের মানুষ। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ‘ফারাক্কা মিছিল’ হয় রাজশাহী থেকে চাঁপাই নবাবগঞ্জের কানসাট পর্যন্ত। কিন্তু কে শুনবে দুর্বলের এ আর্ত চীৎকার? মানুষের চোখ-কান-বিবেক যখন অন্ধ হয়ে যায়, তখন সে হয় পশুর চেয়েও অধম। তাই যাদের জন্য এই মিছিল, এই চীৎকার ধ্বনি, এই বক্তব্য, এই লেখনী, তারা তো স্বার্থ উদ্ধার করে নীরবে হাসছে ক্রূর হাসি। আর এদিকে আমাদের চুক্তিবাদী নেতা-নেত্রীরা খুশীমনে গলাবাজি করছেন। আর জনগণকে নিজেদের সাফল্যের ফিরিস্তি শুনাচ্ছেন দিনরাত।

বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের সাথে যে চুক্তি করে, তাতে বলা ছিল যে, (১) ফারাক্কা পয়েন্টে শুকনা মওসুমে বাংলাদেশ শতকরা ৬০ ভাগ পানি পাবে। বলা ছিল (২) ২১শে এপ্রিল থেকে শুকনা মওসুমে প্রতি দশ দিনের সার্কেলে বাংলাদেশ পাবে ৩৪ হাযার ৫শ’ কিউসেক পানি এবং ভারত পাবে ২০ হাযার ৫শ’ কিউসেক পানি। আরও বলা ছিল যে, (৩) বাংলাদেশ তার নির্ধারিত হিস্যার শতকরা ৮০ ভাগের নীচে কখনোই পাবে না। এটাকেই বলা হয় ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ বা পানির নিশ্চয়তা বোধক ধারা। এটা ছিল ভারতের সঙ্গে পানি কূটনীতিতে বাংলাদেশের একটি বিরাট সাফল্য। কিন্তু ১৯৮৬ সালের পর থেকে দু’দেশের মধ্যে আর কোন পানি চুক্তি নেই। এখন চলছে ভারতের একচেটিয়া পানি সন্ত্রাস। সে ইচ্ছামত পানি ছাড়ছে আর বন্ধ করছে। শুধু গঙ্গা নয়, তিস্তা, সুরমা, বরাক সহ ৫৪টি নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে সে আমাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে।

ভূগর্ভে পানির স্বাভাবিক স্তর নেমে গিয়েছে। সেখানে আর্সেনিক দূষণ শুরু হয়েছে। ফলে পানযোগ্য সুপেয় পানি থেকেও আমরা বঞ্চিত হ’তে চলেছি। ফোরাতের তীরে তৃষ্ণার্ত হুসায়েন পরিবারের ন্যায় পানি বিহনে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আজ হাহাকার উঠছে। এটাই হ’ল আজ বাংলাদেশের নিষ্ঠুর বাস্তবতা। ইতিমধ্যে ভারত পেয়ে গেল তার পসন্দমত আরেকটি সরকার। ফলে পুনরায় সুযোগ নিল সে। ৩০ বছরের ‘পানি গোলামী’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করিয়ে নিল সে অতি সহজে ১৯৯৬ সালের ১২ই ডিসেম্বরে। ফল্লো হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নীচে পানিহীন শুকনা পিলারে তাই লেখা দেখি ‘... অবদান, পানি সমস্যার সমাধান’। রোগীকে মেরে ফেলাই যদি রোগের সমাধান হয়, তবে পদ্মাকে মেরে ফেলে আমাদের নেতা-নেত্রীরা নিঃসন্দেহে সেই সমাধান করেছেন বলা চলে।

বর্তমান চুক্তিতে আর আগের সেই গ্যারান্টি ক্লজ নেই, নেই আন্তর্জাতিক ফোরামে বা আদালতে বাংলাদেশের অভিযোগ পেশ করার ক্ষমতা। কেননা সেখানে রয়েছে দ্বিপাক্ষিকভাবেই সবকিছু মিটানোর কথা। যা দুর্বল ও সবলের মধ্যে কোনকালেই সম্ভব নয়। কিন্তু না। পদ্মা মরবে না। তাকে মরতে দেওয়া যাবে না। কেননা তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে উত্তরাঞ্চলের সাড়ে চার কোটি মানুষের জীবন ও স্বপ্ন। তাই পদ্মাকে যারা মেরেছে, সেই হত্যাকারী আসামীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরাম ও আদালতে ঐসব পানি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হবে। ওদেরকে বিশ্ব সমাজে চিহ্নিত করতে হবে। সেই সাথে ব্যাপক সামাজিক চেতনা সৃষ্টি করতে হবে এবং আল্লাহর নিকটে গায়েবী মদদ চাইতে হবে। তিনি যেন কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষাকারী পানি সমস্যার সমাধানের পথ সুগম করে দেন- আমীন!






চলে গেলেন আফ্রিকার সিংহ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জাতীয় সংসদ নির্বাচন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ছিয়াম দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
থার্টি-ফার্স্ট নাইট - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শিশু আয়লানের আহবান : বিশ্বনেতারা সাবধান! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
২০২৩ সালের সিলেবাস - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিপন্ন স্বাধীনতা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কাশ্মীর ট্রাজেডী - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নেপালের ভূমিকম্প ও আমাদের শিক্ষণীয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইনোসেন্স অফ মুসলিম্স - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বন্দী ফিলিস্তীন : জবাব সশস্ত্র জিহাদ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সার্বভৌমত্ব দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.