২২ সেপ্টেম্বর ’১১ বৃহস্পতিবার বিরোধী দলের ডাকা নিরুত্তাপ হরতালের দিন ঢাকায় নিরীহ দরিদ্র পথচারী হাসপাতাল কর্মী ইউসুফকে লাঠিপেটা করে মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে বুকের উপর দাঁড়িয়ে পুলিশের পেট্রোল ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ হোসেনের বুট জুতায় দাবানো এবং নির্যাতিত যুবকটির পা ধরে আর্তনাদ ও কাতরানোর মর্মান্তিক দৃশ্য প্রায় সকল ইলেকট্রনিক মিডিয়া ছাড়াও বিশ্বের ৮২টি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। একই দৃশ্য দেখা গেল এ ঘটনার মাত্র তিন দিনের মাথায় ২৫ সেপ্টেম্বর রবিবার ঢাকার রাজপথে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল দমনকারী পুলিশের সহযোগী হিসাবে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের ক্যাডারদের দ্বারা সহপাঠি আরেক ছাত্রকে একইভাবে মাটিতে চিৎ করে ফেলে গলায় ও মুখে জুতা দিয়ে মাড়িয়ে নির্যাতনে মৃতপ্রায় করে ফেলার মর্মন্তুদ দৃশ্য। হাঁ, ঐ পুলিশ ইন্সপেক্টরটির কোন শাস্তি হয়নি। বরং ভ্রাম্যমান আদালত নামক নতুন সৃষ্ট এক আজব ক্যাঙ্গারু কোর্ট ‘পুলিশের কাজে বাধা দানের অপরাধে’(?) ঐ পথচারীকে এক বছরের দন্ড দিয়ে তখনই কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেখানে গিয়ে চিকিৎসায় ছেলেটি হয়তবা সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু তার উপরে নির্ভরশীল সংসারের অসহায় মানুষগুলির অবস্থা কেমন হবে বিজ্ঞ বিচারক তা কি একবার ভেবে দেখেছিলেন? ম্যাজিষ্ট্রেট নামধারী ঐ ব্যক্তিটি, যিনি বিচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত, তিনি বিচার করলেন, না অবিচার করলেন? তিনি ঐ অত্যাচারী পুলিশটাকে তো কোন দন্ড দিলেন না। তাহ’লে কি তিনি বলতে চাচ্ছেন পুলিশকে সমানে নির্যাতন করার সুযোগ দেওয়াটাই হ’ল বিচার? আর তার নির্যাতনে আর্তনাদ করাটাই কি পুলিশের কাজে বাধা দান হিসাবে গণ্য? ধিক ঐ বিচারকের। তোমার বিচার যিনি করবেন, তিনি সবই দেখেছেন আরশ থেকে। তোমার ধ্বংস অনিবার্য। আল্লাহ কখনোই যালেমকে বরদাশত করেন না। তবে তিনি বান্দাকে তওবা করার জন্য কিছুটা সুযোগ দেন মাত্র।

হে পুলিশ! তোমার দেহে যে পোশাক, তোমার হাতে যে অস্ত্র, তোমার পায়ে যে বুট জুতা, ওটার মালিক কে? হে উচ্চশিক্ষিত ছাত্র নামধারী ক্যাডার! যাকে তুমি পায়ের তলায় মাড়িয়ে উল্লাস করছ, ওটা কে? সে কি জনগণের অংশ নয়? যে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এবং যাদের ‘ভোট ও ভাতের অধিকার’ কায়েমের জন্য তোমরা রাতদিন মিছিল-মিটিং-হরতাল করে দেশ অচল করে থাক, সেই জনগণের সার্বভৌমত্ব আজ জনগণের বেতনভুক পুলিশের বুটের তলায় ও সরকারি ছত্রছায়ায় লালিত সন্ত্রাসীদের জুতার তলায় পিষ্ট হচ্ছে। দলীয় ক্যাডার ও পুলিশী নির্যাতন থেকে কেবল নিরীহ পথচারী নয়, সমাজের সর্বস্তরের নারী-পুরুষ, সংসদ সদস্য, সংবাদকর্মী, জ্ঞানী-গুণী, আলেম-ওলামা ও প্রবীণ ব্যক্তিগণ কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। পুলিশ ও র‌্যাবের নির্যাতনে পঙ্গু ও মৃত্যু, ক্রসফায়ারে হত্যা, ঘুষ-দুর্নীতি, মিথ্যা মামলা, দোষ প্রমাণিত হওয়ার আগেই হাজতের নামে মেয়াদবিহীনভাবে কারা নির্যাতন, রিম্যান্ড, ডান্ডাবেড়ী এগুলিই এখন গণতন্ত্রের নমুনা হয়ে গেছে। এই দৃশ্য ইতিপূর্বের কথিত গণতান্ত্রিক সরকারও দেখিয়েছে। পার্থক্য কেবল ঊনিশ ও বিশের। দলীয় শাসনের যুপকাষ্ঠে সমাজের সর্বত্র এভাবেই আজ মানবতা পিষ্ট হচ্ছে। কেবল দেশেই নয়, বিশ্বের প্রায় সকল গণতান্ত্রিক দেশে কমবেশী একই অবস্থা বিরাজ করছে।

দেশের ও বিশ্বের সামগ্রিক চিত্র সামনে রাখলে ফলাফল একটাতেই এসে দাঁড়ায় যে, পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র এখন মানবতা পিষ্ট হচ্ছে মানুষ নামক কিছু অমানুষের হাতে। এরা সেযুগের ফেরাঊন-নমরূদকেও হার মানিয়েছে। প্রশ্ন হ’ল : এই পতিত দশা থেকে মানবতাকে বাঁচানোর উপায় কি?

প্রথমে পতনের কারণ সন্ধান করতে হবে। অতঃপর উত্তরণের পথ বের করা সহজ হবে। আমাদের মতে মানবতার এই পতনদশার মূল কারণ হ’ল ‘বস্ত্তবাদ’। যা দুনিয়াকেই মানুষের সর্বশেষ ঠিকানা মনে করে। এই মতবাদীরা যেকোন মূল্যে দুনিয়াকে ভোগ করার জন্য তাদের সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে। আর তারা এখন তাই-ই করছে। দ্বিতীয় কারণ হ’ল এরা মানুষের সৃষ্টি ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ। মানুষকে এরা সাধারণ পশুর ন্যায় মনে করে। তাই মানুষকে অপমান করতে ও অত্যাচার করতে এদের তৈরী করা আইনে ও বিবেকে বাঁধে না। ফলে মানুষকে পায়ের তলে পিষ্ট করতে ও যুলুম করতে এদের হৃদয় কাঁপে না।

উপরোক্ত কারণ দু’টি সামনে রেখে এর প্রতিষেধক হ’ল দু’টি। এক- মানুষের বিশ্বাসের জগতে পরিবর্তন আনতে হবে যে, ক্ষণিকের এ জীবনই শেষ নয়, চিরস্থায়ী পরকালীন জীবন সামনে অপেক্ষা করছে। মৃত্যুর পরেই যার সূচনা হবে। যেখানে এ জীবনের সকল কাজের হিসাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে। এ বিশ্বাস মযবুত না হওয়া পর্যন্ত বস্ত্তবাদী হিংস্রতা থেকে বিশ্ব কখনোই মুক্তি পাবে না। দুই- মানুষ হ’ল সৃষ্টির সেরা। সকল সৃষ্টিজগত মানুষের সেবায় নিয়োজিত। ধনী-গরীব সবাই এক আদমের সন্তান। আর আদম ছিলেন মাটির তৈরী। অতএব মানুষের উপর মানুষের কোন প্রাধান্য নেই, তাক্বওয়া ব্যতীত। অর্থাৎ যিনি যত বেশী আল্লাহভীরু ও আখেরাতমুখী হবেন, তিনি তত বেশী শয়তান থেকে দূরে থাকবেন। আর তার হাতেই মানবতা নিরাপদ থাকবে। একারণেই তিনি মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, আর একারণেই সবার উপরে তার প্রাধান্য।

আল্লাহর এ বিধান মেনে নিতে হবে যে, মানুষ মানুষের ভাই। তারা একে অপরকে যুলুম করবে না, লাঞ্ছিত করবে না, অপমান করবে না। তাদের পরস্পরের জন্য তিনটি বস্ত্ত হারাম। তার রক্ত, তার মাল ও তার সম্মান। সে তার অপর ভাইয়ের জন্য সেটাই ভালবাসবে, যেটা সে নিজের জন্য ভালবাসে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ কখনো ঐ ব্যক্তির উপর রহম করেন না, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি রহম করে না (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ)। তিনি বলেন, দয়াশীলদের প্রতি অসীম দয়ালু আল্লাহ রহম করে থাকেন। অতএব হে যমীনবাসীগণ! তোমরা পরস্পরের প্রতি দয়া কর, আসমানবাসী (আল্লাহ) তোমাদের প্রতি দয়া করবেন’ (আবুদাঊদ, তিরমিযী)। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি ছোটদের প্রতি দয়া করে না ও বড়দের অধিকার বুঝে না, সে ব্যক্তি মুসলমান নয়’ (আবুদাঊদ, তিরমিযী)। আল্লাহ বলেন, ‘আমরা আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি এবং আমরা তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দিয়েছি। তাদেরকে পবিত্র রূযী দান করেছি এবং আমাদের বহু সৃষ্টির উপর তাদেরকে প্রাধান্য দিয়েছি’। ‘যেদিন আমরা প্রত্যেক মানুষকে স্ব স্ব আমলনামা সহ আহবান করব। অতঃপর যে ব্যক্তি ডানহাতে আমলনামা নিয়ে হাযির হবে, তারা তাদের আমলনামা পাঠ করবে এবং তাদের উপর সামান্যতম যুলুম করা হবে না’। ‘কিন্তু যে ব্যক্তি দুনিয়াতে অন্ধ ছিল, সে ব্যক্তি আখেরাতেও অন্ধ হবে এবং অধিকতর পথভ্রষ্ট হবে’ (ইসরা ৭০-৭২)

অতএব সমাজনেতা, ধর্মনেতা, রাষ্ট্রনেতা যিনি যেখানেই থাকুন না কেন হিংসা ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার ঘৃণ্য মানসিকতা পরিহার করে সর্বত্র মানবতাকে সমুন্নত করার প্রত্যয় গ্রহণ করুন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিঃস্বার্থ মানবসেবার মাধ্যমে সমাজকে শান্তিময় করে গড়ে তোলার শপথ নিন! আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!! [স.স.]






বিষয়সমূহ: বিবিধ
বুটের তলায় পিষ্ট মানবতা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কারা সংস্কারে আমাদের প্রস্তাব সমূহ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দেশের তরুণ সমাজ বিদেশমুখী হচ্ছে কেন? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
যুলুমের পরিণাম ভয়াবহ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষা করুন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জেরুযালেম দখলে ট্রাম্প - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সংস্কৃতি দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
৮ বছর ৮ মাস ২৮ দিন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
চেতনার সংঘাত - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হানাহানি কাম্য নয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পশুত্বের পতন হৌক! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.