গ্রীক দার্শনিক ডিয়োজেনিস (Diogenes) ভরদুপুরে জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে কি যেন সন্ধান করছেন। লোকেরা জমা হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল- এই দুপুর বেলা রোদের মধ্যে আপনি মোমবাতি জ্বালিয়ে কি খুঁজছেন। ব্যাকুল দার্শনিক উদাস নেত্রে লোকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, to search man ‘মানুষ খুঁজছি’।

হিটলার-মুসোলিনীর উত্তরসুরী বুশ-ব্লেয়ার-শ্যারণ চক্রের পশুসুলভ আস্ফালন দেখে প্রত্যেক জ্ঞানবান মানুষের মধ্যে যখন ক্ষুব্ধ বিবেক ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে, গত এক যুগের অধিককাল ধরে ‘বিশ্ব সংস্থা’ কর্তৃক আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধের ফলে ক্ষুধায় ও অপুষ্টিতে মৃত্যুবরণকারী ইরাকের প্রায় ১৫ লক্ষ বনু আদমের মৃত্যু ছাড়াও রোগজর্জর ইরাকীরা যখন জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত, তখন মড়ার উপরে খাড়ার ঘায়ের মত মানবাধিকারের বিশ্বমোড়ল বুশ-ব্লেয়ার গোষ্ঠী হিংস্র নেকড়ের মত অর্ধমৃত ইরাকীদের উপরে হামলে পড়ার জন্য লেজ পাকাচ্ছে। নিজ দেশের ও অন্য দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের বিশাল বিশাল যুদ্ধ বিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশের গগণবিদারী শ্লোগানমুখর জোরালো দাবীসমূহ এইসব তথাকথিত গণতন্ত্রী ও মানবাধিকার বাদীদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। আতংকিত বিশ্ববাসীর দৃষ্টি যখন ইরাকের দিকে, ঠিক সেই মুহূর্তে মুসলিম উম্মাহর আরেক জাত দুশমন আদভানী-বাজপেয়ী চক্র বাংলাদেশ সীমান্ত জুড়ে সর্বত্র ‘পুশইন’ বর্বরতা শুরু করেছে। ‘পুশইন’ অর্থ ধাক্কা দিয়ে ঢুকাও আর ‘পুশব্যাক’ অর্থ ধাক্কা দিয়ে ফিরিয়ে দাও। ১৯৯৪-৯৫ সালে বিএনপি সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন একবার এই মরণ খেলা শুরু করেছিল ভারত। সেদেশের বাংলাভাষী মুসলমানদেরকে বিনা অপরাধে গরু-ছাগলের মত ধরে এনে সীমান্তে জড়ো করে মেরে-পিটিয়ে-ধাক্কিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দিয়ে এই ছোট্ট দেশটিকে আরও সমস্যা ভারাক্রান্ত করা এবং ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে ভারতের নতজানু হ’তে বাধ্য করাই ছিল সেই নোংরা কূটনীতির লক্ষ্য। এবারও আমাদের সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে ঘোষণা দিয়েই তারা এই বর্বরতা শুরু করেছে।

১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার নায়ক বর্তমানে ভারতীয় স্বরাষ্ট্র ও উপ-প্রধানমন্ত্রী এল. কে. আদভানী কিছুদিন পূর্বে সেদেশে ‘২ কোটি বাংলাদেশী অবৈধভাবে বসবাস করছে’ বলে হুমকি দিয়েছিলেন। তার পরেই গত ২২শে জানুয়ারী’০৩ থেকে তাদের এই জঘন্য ‘পুশইন’ তৎপরতা শুরু হয়। দিল্লী, বোম্বে, মহারাষ্ট্র ও অন্যান্য প্রদেশ থেকে বাংলাভাষী মুসলিম নাগরিকদের ধরে প্রচন্ড শীতের মধ্যে সীমান্তে এনে খোলা আকাশের নীচে এমনকি কাদাপানির মধ্যে নামিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। আসতে না চাইলে বন্দুকের বাঁট ও লাঠি দিয়ে গরুপেটা করা হচ্ছে। ভারতের সীমান্তরক্ষী বিএসএফ দস্যুদের নির্যাতন সইতে না পেরে জনৈকা মহিলা আয়েশা খাতুনের গর্ভ খালাস হয়ে গেছে। নির্যাতিতা যায়েদা খাতুন দু’শিশু সন্তান নিয়ে চলন্ত বাসের নীচে ঝাঁপ দিয়ে জীবনের জ্বালা নিবারণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। জানিনা আজকে পর্যন্ত ঐ অভুক্ত ও তৃষ্ণার্ত বেদনাহত বোনটি বেঁচে আছে কি-না। ত্রিশোর্ধ পেয়ারা খাতুন ২ ছেলে ও ২ মেয়ে নিয়ে কয়দিন অভুক্ত থাকার পর একটু খাবার পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলেন, ‘আল্লাহ বাঁচাও’। তার অবুঝ শিশুরা ক্রন্দনরতা মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে ফ্যাল ফ্যাল করে। ওরা জানেনা তাদের অপরাধ কি? দিল্লীর সীমাপুর বাঙ্গালী পল্লীর বাসিন্দা তারা। তাদের নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট ও রেশন কার্ড আছে। পুলিশ তাদের সবকিছু কেড়ে নিয়ে বেঁধে এনেছে সীমান্তে পুশইন করার জন। স্বামী মনছূর আলী ঐসময় ছিলেন মৃত্যুশয্যায়। পিয়ারা বেগম জানেনা তার স্বামীর অবস্থা এখন কি। ভারতীয় পুলিশেরা তাদের প্রতি হুংকার ছেড়ে বলছে ‘কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি, আমরা বাংলাদেশী। নইলে গুলি করে মেরে ফেলব’। তাদের মারের চোটে কারো মাথা ফেটেছে, কারো মাজা ভেঙ্গেছে, কারু হাত-পা ভেঙ্গেছে। পিছনে বিএসএফ সম্মুখে বিডিআর। পিছনে গুলি সম্মুখে গুলি। অথচ তারা জানেনা কি তাদের অপরাধ। এই হ’ল ভারতীয় দানবদের পুশইন তৎপরতার বাস্তব চিত্র। অর্ধ মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও তথাকথিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধ্বজাধারীরা নিশ্চুপ।

বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত ধর্মনিরপেক্ষতার পৈতা গলায় ঝুলিয়ে মুসলিম নিধনযঞ্জ চালিয়ে যাচ্ছে দেশের সর্বত্র। জাতিসংঘের এই সদস্য রাষ্ট্রটি জাতিসংঘের ২৫৬ নং প্রস্তাব মেনে নেওয়া সত্ত্বেও বিগত ৫৪ বছর যাবত তা অমান্য করে চলেছে এবং আজও কাশ্মীরী মুসলমানদের উপরে তারা অবর্ণনীয় যুলুম-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ বিশ্বমানবতা নিশ্চুপ। এবার তারা বাংলাদেশ-এর দিকে মুখ ফিরিয়েছে। শান্তিবাহিনী, বঙ্গসেনা ইত্যাদি বাহিনী তাদেরই সৃষ্টি। পুশইন-এর ন্যায় অমানবিক ক্রিয়াকর্মে সম্ভবতঃ ভারতই বিশ্বে প্রথম পথিকৃৎ। নিজ দেশের নিরীহ নাগরিকদেরকে মানবঢাল হিসাবে বন্দুকের নলের দিকে ঠেলে দেওয়ার এই মর্মভেদী আচরণ এযাবত বিশ্বের কোন দেশ করেছে কি-না আমাদের জানা নেই।

বুশ-ব্লেয়ার চক্র ইরাকে ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র খুঁজতে জাতিসংঘকে ব্যবহার করছে। অথচ পাশেই ইসরাঈলে যে ভুরি ভুরি বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের ডিপো রয়েছে, সেগুলির ব্যাপারে কারু কোন মাথাব্যথা নেই। ঐ দুষ্টচক্রের উদ্দেশ্য ইরাকের তথা মধ্যপ্রাচ্যের বিপুল তৈল সম্পদ দখল করা। প্রতিবেশী ভারতেরও প্রধান লক্ষ্য বাংলাদেশের বাজার দখল করার সাথে সাথে তার মাটির নীচে লুকিয়ে থাকা অফুরন্ত তৈলের ভান্ডার করায়ত্ত করা। ইতিমধ্যেই সুন্দরবন সীমান্তে তৈলকূপ খনন করে সে আমাদের তৈল সম্পদ শোষণ করতে শুরু করেছে। দক্ষিণ তালপট্টির প্রায় সিকি বাংলাদেশ এলাকা সে দখল করে নিয়েছে। যেমন নিয়েছে ইতিপূর্বে বেরুবাড়ী এলাকাটি। ভাতে মেরে, পানিতে মেরে সে বাংলাদেশকে করায়ত্ত করতে চায়। আর সেজন্যেই সিরাজুদ্দৌলাদের হটিয়ে সে এখানে তার তল্পীবাহক মীরজাফরদের ক্ষমতায় বসাতে চায়। এদেশের সাধারণ মানুষ তাদের প্রকৃত দুশমন রাষ্ট্রটিকে ইতিমধ্যেই চিনে ফেলেছে। তাই ভারত একদিকে এদেশের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের হাত করার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে উজানে পানি আটকিয়ে, শুকিয়ে-ডুবিয়ে এবং সর্বশেষ পুশইন অপতৎপরতার মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে ভীত-সন্ত্রস্ত্র করার নোংরা পথ বেছে নিয়েছে। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ আজ তাদের হিংস্র লালসার শিকার। যে মানুষের কল্যাণের জন্য রাষ্ট্রের সৃষ্টি, সেই মানুষই আজ নিজ হাতে গড়া রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলি হচ্ছে। আর যেসব নেতারা এগুলো করছে, তারা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও জনকল্যাণের কথা বলেই এগুলো করছেন। জনগণের ভোটে নেতা হয়ে ভোটারদের রক্তে হাত রাঙাতে এদের একটুও বিবেকে বাঁধে না। তুলনাহীন মিথ্যাচার ও মুনাফেকীর মধ্যে তলিয়ে গেছে বিশ্ব রাজনীতির শীর্ষ অঙ্গন। গণতন্ত্রের নামে জনগণকে বিভক্ত করে ফায়েদা লোটার স্বার্থান্ধ ফেরাঊনী রাজনীতি সারা বিশ্বকে আজ গ্রাস করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘(তথাপি) লোকেরা ফেরাঊনের নীতির অনুসরণ করছে। যদিও ফেরাঊনের নীতি সঠিক পথে পরিচালিত ছিল না’ (হূদ ১১/৯৭)। নিকটতম প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘ওদেরকে বের করে দেবই। কোনরূপ আপোষ করব না’। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, দিল্লী-কলিকাতা কূটনীতি একই ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। মনুষ্যত্ব, বিবেক, বিচারবোধ, ন্যায়-অন্যায় পার্থক্যবোধ সবই আজ স্বার্থান্ধ রাজনীতির সামনে গৌণ হয়ে গেছে।

সীমান্তে পুশইন চলছে। এরই মধ্যে বৃহত্তর খুলনা, যশোর ৬টি যেলাকে নিয়ে স্বাধীন ‘বঙ্গভূমি’ আন্দোলনের নেতারা হুমকি দিয়েছে, আগামী ১৮ই ফেব্রুয়ারী তারা বিশাল সশস্ত্র ব্রিগেড নিয়ে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকবে। তারা দিল্লীকে অনুরোধ করেছে শীঘ্র বাংলাদেশ দখল করে নেওয়ার জন্য। ভারত গুজরাটে সম্পূর্ণ ঠান্ডা মাথায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে হাযার হাযার মুসলমানকে হত্যা করল, তাদেরকে গৃহহারা করল, নিজ মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করল, এত কিছুর পরেও সে গণতন্ত্রী এবং মানবাধিকারবাদী আমেরিকার বন্ধু। বাংলাদেশের ৫৪টি নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে ১৫ কোটি বাংলাদেশীকে পানিতে ডুবিয়ে ও শুকিয়ে মারার মরণ ফাঁদ বানিয়ে রেখেও সে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র নয়, বরং বিশ্বের সেরা গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ উদারনৈতিক রাষ্ট্র। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, স্বাধীনতা ও স্বাধিকারবাদীরা তোমরা আজ কোথায়?

হযরত লূত্ব (আঃ) নিজের কওমকে উপদেশ দিয়ে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে শ্লেষভরে বলেছিলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কি কোন ভাল মানুষ নেই’? (হূদ ১১/৭৮)। আজও তাই ভারতীয় নেতাদের বলতে ইচ্ছা করে ‘তোমাদের মধ্যে কি কোন মানুষ নেই’?[1]


[1]. ৬ষ্ঠ বর্ষ, ৫ম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী ২০০৩।






বিষয়সমূহ: বিবিধ
শিশু আয়লানের আহবান : বিশ্বনেতারা সাবধান! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পতিতাবৃত্তি বন্ধ করুন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শেষ হ’ল পালাবদল - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বানরবাদ ও ট্রান্সজেন্ডার, এরপর কি? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
স্কুল-মাদ্রাসা থেকে প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা কোর্স বাতিল করুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নমরূদী হুংকার! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রসঙ্গ : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইসলামী শিক্ষার বিকাশ চাই - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিজয়ের মাস ও পার্বত্য চুক্তি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
স্বাধীনতা রক্ষার শপথ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জবাবদিহিতার অনুভূতি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দেশের তরুণ সমাজ বিদেশমুখী হচ্ছে কেন? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.