‘আহলেহাদীছ’ অর্থ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত অনুসারী। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে যারা জীবন সমস্যার সমাধান তালাশ করেন, তাদেরকে ‘আহলেহাদীছ’ বলা হয়। আর দুনিয়ার মানুষকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মর্মমূলে জমায়েত করার জন্য ছাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে চলে আসা যে নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলনকে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ বলা হয়।

প্রচলিত অর্থে আহলেহাদীছ কোন ফের্কা বা মতবাদের নাম নয়, এটি একটি পথের নাম। এ পথ আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ অহি-র পথ। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পথ। এ পথের শেষ ঠিকানা হ’ল জান্নাত। ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে এযাম এবং সালাফে ছালেহীন সর্বদা এ পথেরই দাওয়াত দিয়ে গেছেন। মানুষের ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবনের যাবতীয় হেদায়াত এ পথেই মওজুদ রয়েছে। আহলেহাদীছের সর্বাপেক্ষা বড় নিদর্শন হ’ল এই যে, তারা আক্বীদার ক্ষেত্রে শিরকের বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে তাওহীদবাদী এবং আমলের ক্ষেত্রে বিদ‘আতের বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে সুন্নাতপন্থী। তারা মানুষ হিসাবে ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে সকলের প্রতি বিনয়ী ও সহনশীল। কিন্তু দুনিয়াবী সফলতা ও পরকালীন মুক্তির পথ হিসাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুসরণের প্রতি নিরাপোষভাবে একনিষ্ঠ। 

উৎপত্তি : মুসলমানদের মধ্যে যখন থেকে বিদ‘আতের সূচনা হয়েছে, তখন থেকেই তার বিপরীতে আহলেহাদীছ আন্দোলনের উৎপত্তি হয়েছে। তৃতীয় খলীফা হযরত ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতের (২৩-৩৫ খৃঃ) শেষদিকে জনৈকা নিগ্রো মাতার গর্ভজাত ইহুদী সন্তান আব্দুল্লাহ বিন সাবা-র মাধ্যমে যে রাজনৈতিক বিভক্তির সূচনা হয়, তার সূত্র ধরে পরবর্তী খলীফা আলী (রাঃ)-এর সময়ে ৩৭ হিজরী থেকে শী‘আ ও খারেজী চরমপন্থী দলের উদ্ভব হয় এবং পরবর্তীতে অন্যান্য বিদ‘আতী দল সমূহের উত্থান ঘটে। তারা সবাই স্ব স্ব মাযহাবের পক্ষে কুরআন ও হাদীছের অপব্যাখ্যা করতে থাকে। তখন ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে এযাম এইসব বিদ‘আতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং বিদ‘আতীদের বিপরীতে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে তাঁরা নিজেদেরকে আহলুল হাদীছ ও আহলুস সুন্নাহ নামে অভিহিত করেন। তাঁদের মাধ্যমেই আহলেহাদীছ আন্দোলনের উৎপত্তি হয়।

ক্রমবিকাশ : বিদ‘আতীদের প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথে সাথে আহলেহাদীছ আন্দোলনের ক্রমবিকাশ সাধিত হতে থাকে। আহলেহাদীছ আন্দোলন তার সূচনা থেকেই প্রচারমূলক ও প্রতিরোধ মূলক দু’পদ্ধতিতে এগিয়ে চলেছে। ক্রমবিকাশের এই গতিধারা বা ইতিহাসকে মোটামুটি ছয়টি ভাগে বিভক্ত করা যায়। (১) স্বর্ণযুগ : যা অব্যাহত ছিল ৩৭ হিজরী পর্যন্ত। যে সময়ে মানুষ জীবন পরিচালনার জন্য পবিত্র কুরআন ও হাদীছকেই একমাত্র নির্দেশিকা হিসাবে গ্রহণ করেছিল। (২) বিদ‘আতীদের উত্থান যুগ : ৩৭ হিজরী থেকে শুরু হয়ে মোটামুটি ১০০ হিজরী পর্যন্ত। এ সময় মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ও উছূলী বিতর্ক ব্যাপকভাবে দানা বেঁধে উঠে। উত্থান ঘটে শী‘আ, খারেজীসহ নানা পথভ্রষ্ট দল ও উপদলের। ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে এযাম এসব ভ্রান্ত মতবাদ ও বিদ‘আতী আক্বীদা-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ব্যাপক দাওয়াতী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এই যুগে বিদ‘আতী দলগুলোর বিপরীতে আহলেহাদীছগণের নামীয় ও দলীয় স্বাতন্ত্র্য ফুটে উঠে। (৩) সংকট ও সংস্কার যুগ (১০০-১৯৮ হিঃ) : এই যুগে আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে প্রধানতঃ চারজন বিদ্বানের মাধ্যমে জাহমিয়া, মু‘তাযিলা, মুশাবিবহা প্রভৃতি ভ্রান্ত দলের উদ্ভব ঘটে। যদিও আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরামের দাওয়াতী তৎপরতা এবং উমাইয়াদের প্রশাসনিক কঠোরতার কারণে এদের ফিৎনা খুব বিকাশ লাভ করেনি। (৪) সুন্নাত দলনের যুগ (১৯৮-২৩২ হিঃ) : ১৫০ হিজরীর পরে গ্রীক দর্শন সঞ্জাত যুক্তিবাদের প্ররোচনায় একদল কালাম শাস্ত্রবিদের আর্বিভাব ঘটে। এইসব মুতাকাল্লিমীন ও মু‘তাযিলাদের কুটতর্কে মুসলমানদের সহজ-সরল হাদীছ ভিত্তিক জীবন ধারায় ব্যত্যয় ঘটে এবং বহু মানুষ আক্বীদাগত বিভ্রান্তিতে পতিত হন। আববাসীয় খলীফাদের কেউ কেউ মু‘তাযিলা মতবাদ গ্রহণ করায় এবং এ মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করায় আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের উপর নেমে আসে মহা পরীক্ষা। যার মর্মান্তিক শিকার হতে হয় আহলেহাদীছগণের নেতা ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে (১৬৪-২৪১ হিঃ)। তবুও সকল প্রকার নির্যাতন সহ্য করে হাদীছপন্থী বিদ্বানগণ ছাহাবা যুগের আক্বীদা ও আমল অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টায় ব্রতী থাকেন। (৫) সংকট পরবর্তী যুগ (২৩২-৪র্থ শতাব্দী হিজরী) : এই যুগের প্রথমার্ধ্ব ছিল আহলেহাদীছ আন্দোলনের রেনেসাঁ যুগ। এ সময় মু‘তাযিলাগণ রাজনৈতিক ক্ষমতা হারায় এবং হাদীছ সংকলনের স্বর্ণ যুগ শুরু হয়। ৩য় শতাব্দী হিজরী ‘হাদীছ সংগ্রহ ও সংকলনের স্বর্ণযুগ’ হিসাবে অভিহিত হয়। কুতুবে সিত্তাহ এ যুগেই সংকলিত হয়। অসংখ্য আহলেহাদীছ বিদ্বান এ যুগে হাদীছ সংকলনের কাজে লিপ্ত হন এবং তাদের মূল্যবান লেখনী পরিচালনা করেন। (৬) তাক্বলীদী যুগ (৪র্থ শতাব্দী হিজরী-পরবর্তী যুগ) : এই সময় মুতাযিলাগণ রাজনৈতিক ক্ষমতা হারালেও উছূলী বিতর্ক শেষ হয়নি। কুরআন ও হাদীছের বাহ্যিক অর্থের অনুসরণ এবং ছাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত পথ ছেড়ে বিদ্বানগণ স্ব স্ব লৌকিক জ্ঞানের মাধ্যমে সবকিছুর সমাধান তালাশ করতে শুরু করেন। ফলে কালাম ও দর্শন শাস্ত্রের কুটতর্ক, বিভিন্ন মুজতাহিদ ইমামের ফিক্বহী মতপার্থক্য, ছূফীবাদের প্রসার ইত্যাদি কারণে মুসলমানদের সামাজিক ঐক্য ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। যা অবধারিতভাবে মানুষকে মাযহাবী তাক্বলীদের অন্ধ গুহায় নিক্ষেপ করে। ফলে ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পর থেকে মুসলমানরা নিজেদেরকে বিভিন্ন মাযহাবী নামে পরিচিত করতে শুরু করে। মাযহাবী তাক্বলীদের অন্যায় যিদ ও হঠকারিতা অবশেষে ৬৫৬ হিজরীতে আববাসীয় খেলাফত ধ্বংসের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ৬৬৫ হিজরী থেকে ইসলামী জগতের সর্বত্র চার মাযহাবের লোকদের জন্য পৃথক পৃথক ক্বাযী নিযুক্ত হয়। ৮০১ হিজরীতে মুসলিম ঐক্যের প্রাণকেন্দ্র কা‘বা গৃহের চার পার্শ্বে চার মাযহাবের জন্য চারটি পৃথক মুছাল্লা কায়েম করা হয়। অবশেষে ১৩৪৩ হিজরীতে (১৯২৬ খৃঃ) সঊদী বাদশাহ আব্দুল আযীয উক্ত বিদ‘আত উৎখাত করেন ও মুসলিম উম্মাহ্কে ঐক্যবদ্ধ জামা‘আতে ফিরিয়ে আনেন। যা আজও অব্যাহত আছে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।

বর্তমানে আমরা তাক্বলীদী অন্ধকারের যুগে বাস করছি। এর বিরুদ্ধে আহলেহাদীছ আন্দোলন পূর্বের ন্যায় আজও প্রচার ও প্রতিরোধ দু’ভাবে এগিয়ে চলেছে। শত নির্যাতন ও জেল-যুলুম সহ্য করেও কথা, কলম ও সংগঠনের মাধ্যমে এ আন্দোলন আজ বিশ্বের প্রায় সর্বত্র সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ এ দেশে যার নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে এবং সত্য-সন্ধানী মানুষ ক্রমেই এ আন্দোলনের প্রতি ধাবিত হচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ

অন্যান্যদের সাথে পার্থক্য : আহলেহাদীছ আন্দোলন ও অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হল দু’ধরনের : (১) আদর্শগত ও (২) কর্মগত। আদর্শগত পার্থক্য বলতে ইত্তেবা ও তাক্বলীদকে বুঝায়। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ ইত্তেবায় বিশ্বাসী এবং অন্যেরা তাক্বলীদে বিশ্বাসী। কর্মগত পার্থক্য বলতে সমাজ পরিবর্তন ও সরকার পরিবর্তন বুঝায়। অন্যেরা সরকার পরিবর্তনকে অগ্রাধিকার দেন। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সমাজ পরিবর্তনকে অগ্রাধিকার দেয়। আক্বীদা ও আমলের সংস্কার সাধনের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক সংস্কার সাধনই এ আন্দোলনের সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য। এ আন্দোলনের কর্মীরা রাষ্ট্রীয় সংস্কারের জন্য অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় কাজ করে এবং সর্বদা সরকারকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে পথ প্রদর্শন করে থাকে।  তারা সাংগঠনিক মযবুতির মাধ্যমে সরকারের নিকট থেকে জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে। সরকার কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোন পদক্ষেপ নিলে আমরা সকল প্রকার বৈধ পন্থায় তার প্রতিবাদ করি। আমরা আমাদের কর্মীদের রাজনীতি সচেতন করে গড়ে তুলি এবং দেশ যাতে কোন আগ্রাসী শক্তির পদানত না হয়, সেজন্য জনমত গড়ে তুলি। কিন্তু ‘সরকার হটাও’ আন্দোলনের নামে হরতাল, গাড়ী ভাংচুর ও হিংসা-হানাহানির মাধ্যমে সমাজে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা এবং এক অন্যায় হটাতে গিয়ে আরেক অন্যায় করাকে আমরা গুরুতর অন্যায় মনে করি। আমরা নেতৃত্ব নির্বাচনের বর্তমান প্রতারণাপূর্ণ পদ্ধতির পরিবর্তে সহজ-সরল ইসলামী পদ্ধতির প্রতি মানুষকে আহবান জানাই। সরকার অন্যায় থেকে বিরত না হ’লে আমরা আল্লাহর নিকটে দো‘আ করি। যেমন ফেরাঊনের বিরুদ্ধে মূসা (আঃ) ও তাঁর সাথীগণ দো‘আ করেছিলেন। ফলাফল সবারই জানা। অন্যান্য ইসলামী সংগঠনগুলির ‘এটাও ঠিক ওটাও ঠিক’ আন্দোলনের ফলে মানুষ হক ও বাতিলের পার্থক্য করতে পারে না। এসবের বিপরীতে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ ইসলামের স্বচ্ছতা পুনরুদ্ধার ও তা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য জান বাজি রেখে আন্দোলন করে থাকে। এটাই তাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। পরিশেষে বলব, যতদিন পৃথিবীতে বিদ‘আতী আন্দোলন থাকবে, ততদিন তার বিপরীতে আহলেহাদীছ আন্দোলন থাকবে। হকপন্থী মুসলিমগণ সর্বদা এ আন্দোলনের সাথী থাকবেন এবং এভাবেই ক্বিয়ামত এসে যাবে। আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদেরকে এ আন্দোলনের নিষ্ঠাবান কর্মী হিসাবে কবুল করে নিন এবং এর মাধ্যমে আমাদের পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করুন-আমীন!! (স.স.)






বিষয়সমূহ: সংগঠন
‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ব্যবসার নামে প্রতারণার ফাঁদ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জশনে জুলূস ও আমরা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সত্যের সন্ধানী - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আত-তাহরীক : যাত্রা হ’ল শুরু (৩য় সংখ্যা)
চরিত্রবান মানুষ কাম্য - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আহলেহাদীছের বৈশিষ্ট্য - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জবাবদিহিতার অনুভূতি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বন্দী ফিলিস্তীন : জবাব সশস্ত্র জিহাদ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শেষ হ’ল পালাবদল - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নারীর উপর সহিংসতা : কারণ ও প্রতিকার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল-কুরআনের আলোকে ক্বিয়ামত
আরও
আরও
.