চেতনার সংকট
জ্ঞান ও শুদ্ধ চেতনার কারণে মানুষ হ’ল সৃষ্টির সেরা। এই চেতনা বিনষ্ট হ’লে মানুষ হয় নিকৃষ্টতম জীব। কিন্তু এই চেতনা একসাথে এক দিনে বিকশিত হয় না। এজন্য প্রয়োজন হয় জ্ঞান বিকাশের সুষ্ঠু পরিবেশ, সুষ্ঠু শিক্ষা এবং সুষ্ঠু কর্মসংস্থান ও কর্মস্থলের। প্রথমটির জন্য প্রয়োজন যোগ্য পিতা-মাতা, স্নেহশীল পরিবার ও সৎ সংসর্গ। দ্বিতীয়টির জন্য সুন্দর শিক্ষা ব্যবস্থা, তৃতীয়টির জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। আর পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য চাই সুস্থ চেতনার অধিকারী একদল যোগ্য মানুষ। কিন্তু একটা সদ্য চোখ ফোটা শিশু যখন তার সামনে উদ্ভট সব ছবি দেখে, লারে লাপ্পার গান শোনে ও নাচ-গানের আসর দেখে, তখন তার মানসিকতায় কিসের দাগ কাটে? একটা তরুণ যখন স্কুলে গিয়ে সরকারী ও বিরোধী দলীয় হিংসা-প্রতিহিংসা, মিছিল-মিটিং ও গালিগালাজের সবক নেয়, তখন সে কি শিখে? যখন সে পরীক্ষার খাতায় হিজি-বিজি লিখেও শিক্ষকের কাছে আশানুরূপ নম্বর পায়, তখন সে কি বার্তা পায়? এবার কর্মসংস্থানের ও কর্মস্থলের পালা। সেখানে শিক্ষার সনদটা সাইনবোর্ড মাত্র। আসল যোগ্যতা হ’ল টাকা ও দলীয় লোক হওয়া। সেই সাথে লাগবে নেতা-নেত্রীর ফোন ও তদবীর। এর দ্বারা সে কি ইঙ্গিত পেল? এরপর কর্মস্থল? সেটা তো পরিচয়ের একটা ক্ষেত্র মাত্র। যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের বিষয়টি সেখানে অপাংক্তেয়। কারণ সে তো দলের লোক। ভোটের রাজনীতিতে একটা বড় ফ্যাক্টর। অতএব তার সাত খুন মাফ। অন্যেরা যখন খুশী চলে যান। এমনকি মাসে একদিন এলেও বেতন পান। এছাড়াও মূল বেতনের তিনগুণ ওভারটাইম। ফলে দেখা যায় সরকারী যেকোন সেক্টরে দুর্নীতি ও স্থবিরতা। কিছু ধার্মিক ও আল্লাহভীরু কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণেই এখনও প্রতিষ্ঠানগুলি দাঁড়িয়ে আছে। ইতিমধ্যে বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকগুলি খুঁড়িয়ে চলছে বা বন্ধ হওয়ার পথে। অথচ বর্তমান পরিবেশে এই সৎ মানুষগুলিই প্রশাসনের সন্দেহ ও ঘৃণার তালিকায়। কারণ ওদের দাড়ি-টুপী আছে বা ওরা বোরকা পরে। যদিও দেশের সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের স্ব স্ব ধর্ম পালন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। তবুও ওদের উপরেই যত আইনের খড়গ। এমতাবস্থায় সদ্য চাকুরী পাওয়া ঐ যুবকটির চেতনা কোন দিকে যাবে? সে তো দেশ ও সমাজের প্রতি বিরূপ হবেই। এভাবে সুষ্ঠু চেতনার বিকাশ ও তার স্থিতি ব্যাহত হচ্ছে দেশের নষ্ট রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রশাসনের কারণে। অথচ তারাই হরহামেশা অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেরা আত্মপ্রসাদ লাভের ঢেকুর তুলছেন। অন্যদিকে বিরোধী দল সর্বদা সরকারের তিক্ত সমালোচনায় লিপ্ত ও তাদের পতনের স্বপ্নে বিভোর। এভাবে সরকারী ও বিরোধী দলীয় হিংসান্ধ সমাজ ব্যবস্থায় কারুরই চেতনা যখন সুস্থ নয়, তখন তরুণ বংশধররা কোন পথে যাবে? চেতনার সুষ্ঠু বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে বা বেকারত্বের অভিশাপে কিংবা অনৈতিক প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে জীবনযুদ্ধে যখন সে হতাশ হয়ে পড়ে, তখনই সে দেশী-বিদেশী মতলববাজদের খপ্পরে পড়ে যায়। ফলে সে এক সময় অন্ধকার জগতে পা বাড়ায়। যেখান থেকে সে আর ফিরে আসতে পারে না। প্রশাসন ও মিডিয়া এদেরকে নানা বাজে নামে আখ্যায়িত করে। ফলে এরা বন্দুকযুদ্ধের নামে পুলিশের হাতে বেঘোরে প্রাণ দেয়। অথবা ফাঁসিতে ঝুলে মরে কিংবা সারা জীবন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বাস করে। ওরা তওবা করে ফিরে আসতে চাইলেও সরকার ও সমাজ তাদের গ্রহণ করে না। এমনকি পরিবার তার লাশ পর্যন্ত নেয় না। এটা বুঝেই তারা হিংস্র ও বিধ্বংসী হয় এবং যা খুশী তাই করে, এমনকি আত্মঘাতী হয়।
চেতনার সংকট দেখি ঐসব ব্যক্তির মধ্যে যারা ‘ধর্মনেতা’ বলে খ্যাত। পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকে যাদের অনেকের চোখ অনেকটাই বন্ধ। তাদের সন্তানেরা ঐভাবেই গড়ে ওঠে তাদের পরিবারে। ফলে যখনই সে বাইরে যায়, তখনই তার মধ্যে চেতনার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সুষ্ঠু জবাব না পেলে সে হয়তবা এক সময় ধর্মান্ধ হয় অথবা ধর্মচ্যুত হয়। একইভাবে সংকটে ভুগছেন কথিত ‘মুক্তমনা’রা। তাদের চেতনার খোলা জানালা দিয়ে দুষিত হাওয়া এত বেশী প্রবেশ করে যে, ঐ কুঠরীতে নির্মল বায়ু প্রবেশ করতে পারে না। জীবনের ধাক্কায় কখনো প্রবেশ করলেও তা পরক্ষণে বেরিয়ে যায় নৈরাশ্যের দমকা হাওয়ায়। হৃদয়ের স্বাভাবিক আকুতি ডানা মেলতে চাইলেও তা ব্যাহত হয় তার উপরে পড়া অন্ধ আবরণের কারণে। ফলে এরা দিশাহারা পথিকের মত জীবনভর কেবল গবেষণার ঘুর্ণিপাকে পথ হাতড়ে ফেরে। সরল পথের দিশা পায় না।
উপরে বর্ণিত দ্বিবিধ চেতনার বদ্ধ দুয়ারে যখন এলাহী প্রত্যাদেশের আলোক সম্পাত হয়, তখন তারা চমকে ওঠে। কেউ তাকে সাহসের সাথে গ্রহণ করে। কিন্তু অধিকাংশ তা থেকে পালায় ও দিনের আলোয় চামচিকার মত নিজেদের লালিত রীতির আড়ালে মুখ লুকায়। এরা সকল প্রকার সংস্কার ও শুদ্ধতার বিরোধী হয় এবং নিজেদের অশুদ্ধতাকেই শুদ্ধ বলে সাফাই গায়। বিগত যুগের ন্যায় এযুগেও সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব চলছে। পথভ্রষ্ট সমাজনেতারা যা খুশী তাই করছেন। অন্যদিকে নীতিভ্রষ্ট আলেমরা দুনিয়াবী স্বার্থে কুরআন ও সুন্নাহর অপব্যাখ্যা করছেন। উদ্ভট সব যুক্তি দিয়ে মানুষকে সত্য গ্রহণ থেকে বিরত রাখছেন। হাদীছ সবই রাসূলের। এতে কোন ছহীহ-যঈফ নেই ইত্যাদি বলে মানুষকে হক কবুল করা থেকে পিছিয়ে রাখছেন। ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক সংস্কার আন্দোলনকে তারা ফিৎনা বলেন এবং সামাজিকভাবে বাধা সৃষ্টি করেন। সাথে সাথে প্রশাসনকে মিসগাইড করে এই মহান আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের উপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতন চালানোর পাঁয়তারা করে থাকেন। মূলতঃ এসবই চেতনার সংকট। কে না জানে যে, শয়তান প্রতি মুহূর্তে তার চাকচিক্যপূর্ণ যুক্তি দিয়ে মানুষকে প্রতারিত করছে। অতএব যতদিন শয়তান থাকবে, ততদিন তার বিপরীতে শুদ্ধতাবাদী আন্দোলন থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যাদের চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে গেছে বা বৈকল্যতাড়িত হয়ে গেছে, তারা জোর করে এই আন্দোলনকে দাবিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু তা কি সম্ভব? ক্বিয়ামতের প্রাক্কাল অবধি এ আন্দোলন চলবে, এটাই শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী। যারা সত্যের অনুসারী হবে এবং এ আন্দোলনের সাথী হবে, তারাই মাত্র সফলকাম। এটাই হ’ল চূড়ান্ত কথা। বস্ত্ততঃ আখেরাতে মুক্তির লক্ষ্যে চেতনার বাঁশি বাজিয়ে মৃত সমাজকে জাগৃতির সরল পথে জমায়েত করার মধ্যেই রয়েছে মানবতার প্রকৃত কল্যাণ। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)।
বর্ষশেষের নিবেদন : ১৯তম বর্ষ শেষে ২০তম বর্ষের প্রাক্কালে এবং আসন্ন ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে আমাদের সকল পাঠক-পাঠিকা, লেখক-লেখিকা, এজেন্ট ও গ্রাহক এবং দেশী ও প্রবাসী সকল শুভানুধ্যায়ীকে আন্তরিক মুবারকবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ শুদ্ধ চেতনার অধিকারী দ্বীনদার ভাই-বোনদের হৃদয় সমূহকে এ মহান আন্দোলন-এর প্রতি রুজূ করে দিন- আমীন! [সম্পাদক]