জনৈক ভদ্রলোক ভাগিনার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ভগিনীর বাড়ীতে গিয়েছেন সান্ত্বনা দেবার জন্য। শোকার্ত লোকজনে ভরপুর বাড়ীর বাইরে বিষণ্ণ ভগ্নিপতির সঙ্গে দেখা। যথারীতি সালাম বিনিময়ের পর অভ্যাসবশতঃ জিজ্ঞেস করলেন, ভাই কেমন আছেন? বোনাই জবাব দিলেন, ভালো আছি। যদিও ঘরে তখনও রয়েছে তার মৃত সন্তানের লাশ। প্রিয় পাঠক! আপনি যদি অনুরূপ জিজ্ঞেস করেন, তাহ’লে আমরাও বলব, ভাল আছি। কিন্তু আসলেই কি ভাল আছি? একবার কি তাকিয়ে দেখবেন আমাদের ঘরের মধ্যকার করুণ দশা! সভ্যতা-ভদ্রতা-মানবতা-ন্যায়বিচার সবকিছু মরে লাশ হয়ে আমাদের ঘরে পড়ে আছে। যা এখন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে দেশে ও বিদেশে।
প্রথমেই দেখা যাক দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে। সেখানে চলছে সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য। চলছে ঘুষ সন্ত্রাস, বখশিশ সন্ত্রাস, ভাউচার সন্ত্রাস, টেলিফোন সন্ত্রাস, টেন্ডার সন্ত্রাস, ইনকাম ট্যাক্স সন্ত্রাস, অপহরণ ও মুক্তিপণ সন্ত্রাস এবং সর্বোপরি রয়েছে সশস্ত্র সন্ত্রাস। অতঃপর রয়েছে চাঁদাবাজি। নিজের জমিতে নিজের হালাল টাকায় বাড়ী করবেন, সেখানেও দিতে হবে মাস্তানী চাঁদা ও তাদের নেপথ্য নায়ক এলাকার নেতারূপী গডফাদারদের অদৃশ্য চাঁদা ও সেই সাথে রয়েছে সাদা-খাকী-ব্লু পোষাকীদের নিয়মিত মাসোহারা ও এককালীন চাঁদা। নইলে মিথ্যা মামলায় কারাগারে। যাবেন রাজনৈতিক ময়দানে? সেখানে মাস্তান ও সন্ত্রাসীদের কদর বেশী। কারণ লোভ ও ভয় দেখিয়ে ভোট আদায় করা এযুগের ট্রাডিশন। ফলে শান্তিপ্রিয় জনগণ ভোটের ব্যাপারে হতাশ। প্রিজাইডিং অফিসার টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছেন এমন ছবি পত্রিকায় আসছে। অথচ পরে জানানো হচ্ছে ৭০/৮০ শতাংশ ভোটদাতা ভোট দিয়েছেন। অতএব বিষয়টি বুঝতেই পারছেন...। সবকিছুই ‘ওপেন সিক্রেট’।
চলুন ব্যবসা ক্ষেত্রে। সেখানে দেখবেন অব্যাহত চাঁদাবাজি আর সন্ত্রাসের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠেছে। ব্যবসায়ীরা অতিষ্ঠ হয়ে রাস্তায় মিছিলে নেমেছেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মালামালে দেশের বাজার সয়লাব। ফলে দেশের শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য এখন বন্ধের পথে।
চলুন সমাজ জীবনে। মানীর মান সেখানে নেই। গল্পে পড়া হবু-গবুর রাজ্যের ন্যায় আমাদের সমাজেও যেন তেলে-ঘিয়ে সমান দর। ফলে যথার্থ মূল্যায়ন না হওয়ায় মেধা পাচার শুরু হয়ে গেছে। জ্ঞানী-গুণী মেধাবী যারা, তারা দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন এবং আর যাতে দেশে না ফিরতে হয়, সেই চেষ্টা করেন। সংসারের মায়া ছেড়ে বিদেশে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দু’পয়সা রোযগার করে যেমনি কেউ বাড়ী ফেরেন, অমনি চাঁদাবাজ অথবা সন্ত্রাসীর খপ্পরে পড়ে সবকিছু এমনকি জীবনটাও তার খোওয়াতে হয়। দেশের বিমানবন্দর থেকেই হয়তবা সবকিছু লোপাট হয়ে যেতে পারে, এমন সম্ভাবনা এখন ক্রমেই প্রকট হচ্ছে।
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা! হায় শিক্ষা ব্যবস্থা! যদি তোমার সঙ্গে যুক্ত না থাকতাম, তাহ’লেই ভাল থাকতাম। নকল করতে না দিলে শিক্ষক ও ম্যাজিস্ট্রেটদের ছাত্র ও অভিভাবকদের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হ’তে হয়। তবুও মাধ্যমিক -উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্ররা যতটুকু শিখে আসে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তারা সেটুকুও হারায়। যদিও শেষ পর্যায়ে অনার্স ও মাস্টার্স কমপক্ষে সেকেন্ড ক্লাস নিয়ে প্রায় সবাই পার হয়ে যায়। ভাইভাতে কেবল এ্যাটেন্ড করলেই ছাত্রকে ৫০% মার্ক দিতে হয়। এটাই এখন ট্রাডিশন, এটাই নাকি কনভেনশন।
চলুন দ্বীনের বাজারে। সেখানে দেখবেন দ্বীনী শিক্ষায় বেদ্বীনী প্রবেশ করেছে। সরকারী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে অফিসার-কর্মকর্তা যারা আছেন, তাদের নামে শোনা যায় কচকচে নোটের রমরমা বাতেনী ব্যবসা। ঘুষ হারাম তাই তারা বখশিশ নেন। দ্বীনী শিক্ষার উন্নতি তাদের লক্ষ্য নয়। বরং লক্ষ্য অন্য কিছু। দেশের কলীজা বলে অভিহিত সচিবালয় পর্যন্ত একই রোগে আক্রান্ত। সেখানকার দরজার চৌকাঠ পর্যন্ত নাকি পয়সা না পেলে কথা বলে না। প্রবাদ আছে, ‘মাছের মাথায় আগে পচন ধরে’। এখন তাই-ই হচ্ছে।
বাক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিচারক ও বিচার প্রাপ্তির স্বাধীনতা- এসবই সংবিধানের কথা। বাস্তবতা বড়ই করুণ। গণতন্ত্রের নামে সরকারী ও বিরোধী দলীয় সমাজ ব্যবস্থার যুপকাষ্ঠে সমাজ জীবন বিপর্যস্ত। ভাল-মন্দ সবকিছুই এখন দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। শাসন বিভাগের অধীনস্থ বিচার বিভাগ লাঠির ভয়ে আতংকিত। ফলে নির্দলীয় শিক্ষক, সাংবাদিক ও বিচারকগণ এদেশের অসহায় প্রাণী। যারা মার খান, কিন্তু মার দিতে জানেন না। বিবেকের দংশনে তারা জর্জরিত হন, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেন না।
সবচেয়ে নাজুক অবস্থা ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের। ইসলাম এদেশের স্বাধীনতার ও স্বাধীনতা টিকে থাকার মূল চেতনা। ইসলাম বা ইসলামী চেতনা মুছে দিতে পারলেই দেশের সীমানা মুছে দেওয়া ও উভয় বাংলা এক হয়ে যাওয়া সহজ হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যারা দূরে বসে কলকাঠি নাড়ছেন, তারা ঠিকই টার্গেট করেছেন ও সে লক্ষ্য হাছিলের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও এনজিও-দের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সে কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করে চলেছেন। Offence is the best defence ‘আক্রমণ হ’ল সবচেয়ে বড় আত্মরক্ষা’ এই থিয়োরীর আলোকে গোয়েবল্সীয় কায়দায় দেশের নিরাপোষ ইসলামী চেতনা সম্পন্ন দেশপ্রেমিকদের ‘স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি’ বলে তার স্বরে চিৎকার দিয়ে তাদেরকে হামলার টার্গেট বানানো হচ্ছে। অন্যেরা দেশ বিক্রি করার ষড়যন্ত্র প্রকাশ্যভাবে করলেও সেটা দোষের নয়। পবিত্র কুরআনের (সূরা তীন-এর) প্যারোডী রচনাকারীরা, কুরআনকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপকারীরা, কুরআন-বিকৃতির দাবীদাররা, দেশের অভ্যন্তরে পৃথক ‘বঙ্গভূমি’ নামে হিন্দুরাষ্ট্র, ‘জুমল্যান্ড’ নামে পৃথক খ্রিষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবীদাররা বুক ফুলিয়ে রাজধানীতে মিছিল করছে। তারা সবাই দেশপ্রেমিক। আর দেশদ্রোহী কেবল তারাই যারা ওদের রাষ্ট্রবিরোধী চক্রজাল ছিন্ন করে ও ওদের মুখোশ উন্মোচন করে বক্তব্য রাখে ও কলম ধরে। ইসলামপন্থীরা নাকি দেশকে আবার পাকিস্তান বানাবে। অথচ একটা কচি শিশুও বুঝে যে, আড়াই হাযার মাইল দূরের একটা দেশের সঙ্গে মিলে যাওয়া আর কখনোই সম্ভব নয়। বরং ২৩ গুণ বড় ও তিন দিক দিয়ে বেষ্টনকারী দেশটির বিশাল মুখগহবরে নিমেষে হারিয়ে যাওয়াই সম্ভব। দুর্মুখরা বলে যে, নেতারা যা বলেন তার উল্টাটাই বুঝতে হয়। কেননা এদেশে অন্ধ ছেলের নাম ‘পদ্মলোচন’, আর ঘোলা পানির একটা নদীর নাম ‘কপোতাক্ষ’।
ঈদ চলে গেল। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৮ লাখ বন্যাদুর্গত বানভাসি ভাই-বোনদের ভাগ্যে কি ঈদ হয়েছে? দেড় লাখ বানভাসি আজও ঘরে ফিরতে পারেনি। রাস্তার ধারে পলিথিনের নীচে কোনরকমে মাথা গুঁজে পড়ে আছে। শেষ আশ্রয় নিজের ঘরটুকু হারিয়ে আজ তারা রাস্তার অধিবাসী। অথচ দু’দিন আগে তাদের সব ছিল। তাদের ও আরো যারা রাস্তার ও বস্তির বাসিন্দা, সেই সব অসহায় ভাই-বোনদের ভাষাহীন বোবা-কান্না কে শুনবে? কনকনে শীতে ঠকঠক করে কাঁপা ঐ হাড্ডিসার রোগজর্জর মানুষগুলির পাংশু মুখের দিকে মনের চোখ দিয়ে একবার তাকিয়ে দেখুন, আর জিজ্ঞেস করুন! আপনারা কেমন আছেন? হয়তবা অভ্যাস বশে তারাও বলবে, ভাল আছি। কিন্তু আসলেই কি তারা ভাল আছেন? জবাব দেবার দায়িত্ব যাদের তারা কুম্ভকর্ণ। তাই বুকফাটা আকুতি ছাড়া আর কিছুই করার নেই। তবুও বলি আমরা ভাল আছি। আগামী বছর আরো ভাল থাকার আশা রাখি। আল্লাহর রহমত থেকে মুমিন কখনোই নিরাশ হয় না। সোনালী ভবিষ্যতের আশায় তাই বুক বাঁধলাম। আল্লাহ তুমি আমাদের সহায় হও- আমীন!