
‘ইসরা’ অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। ‘মি‘রাজ’ অর্থ ঊর্ধারোহণের বাহন। মক্কার মাসজিদুল হারাম থেকে ঈলিয়া বা যেরুযালেমের বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রাত্রিকালীন সফরকে ‘ইসরা’ বলে এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাস থেকে সপ্ত আসমান ভ্রমণ ও আল্লাহর দীদার লাভ পর্যন্ত ঘটনাকে ‘মি‘রাজ’ বলে। যেহেতু মি‘রাজের ঘটনাটিই মুখ্য, সেকারণ পুরা সফরটিই ‘মি‘রাজ’ নামে পরিচিত হয়েছে। সূরা বনু ইসরাঈলের ১ম আয়াতে ‘ইসরা’ এবং সূরা নাজমের ১৩ থেকে ১৮ পর্যন্ত ৬টি আয়াতে মি‘রাজের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এতদ্ব্যতীত ২৬-এর অধিক ছাহাবী কর্তৃক বুখারী ও মুসলিম সহ প্রায় সকল হাদীছ গ্রন্থে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ে মি‘রাজের ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। অতএব মি‘রাজ অকাট্যভাবে প্রমাণিত সত্য ঘটনা। ইসরা ও মি‘রাজ মাত্র একবার হয়েছিল এবং এটি হিজরতের এক বছর পূর্বে জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে ও সজ্ঞানে হয়েছিল, ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নের মাধ্যমে নয়। যদিও নবীদের স্বপ্ন সত্য হয়ে থাকে। স্বপ্নে হ’লে এটি কোন বড় বিষয় হ’ত না। সশরীরে ও জাগ্রত অবস্থায় হয়েছিল বলেই মক্কার লোকেরা এটাকে অবিশ্বাস করেছিল এবং সর্বত্র বদনাম রটনার সুযোগ পেয়েছিল। আর একারণেই বহু মুসলমান তাঁকে মিথ্যা নবী মনে করে ‘মুরতাদ’ হয়ে পুনরায় কুফরীতে ফিরে গিয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ ‘আব্দ’ বা বান্দা বলতে দেহ ও আত্মা মিলিতভাবে বুঝায়, শুধুমাত্র আত্মাকে নয়। তৃতীয়তঃ তাঁকে বোরাকে আরোহণ করতে হয়েছিল। আরোহণ করার জন্য দেহ প্রয়োজন। আত্মা কখনো আরোহণ করে না।
মি‘রাজের ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে তো বটেই, বরং পুরা নবুঅতের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ব্যতীত কোন নবীই এই সৌভাগ্য লাভ করেননি। আর কোন উম্মতই এত বড় কঠিন ঈমানী সংকটে পতিত হয়নি, যতবড় সংকটে পতিত হয়েছিলেন প্রাথমিক যুগের মুমিনগণ। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, মি‘রাজের ঘটনাবলীকে অবিশ্বাস করে একদল মুসলমান ‘মুরতাদ’ হয়ে যায় এবং তারা পরবর্তীতে আবু জাহলের সাথে বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। অন্যদিকে লোকেরা যখন গিয়ে আবুবকর (রাঃ)-কে এই ঘটনা শুনায়, তখন তিনি নির্দ্বিধায় বলে ওঠেন, এর চাইতে অলৌকিক কোন আসমানী খবর যদি মুহাম্মাদ বলেন, আমি তা অবশ্যই বিশ্বাস করব। এদিন থেকেই আবুবকর পরিচিত হ’লেন আবুবকর ছিদ্দীক্ব রূপে। ছিদ্দীক্ব অর্থ সত্যায়নকারী। শুধু তাই নয় তিনি বরিত হ’লেন উম্মতের সেরা ব্যক্তিরূপে। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, মি‘রাজের ঘটনা অবিশ্বাস করার কারণে দুর্বল ঈমানদারগণ মুরতাদ হয়ে গেল। পক্ষান্তরে সবল ঈমানদারগণের ঈমান আরও বর্ধিত হয়ে সর্বোচ্চ শিখরে পেঁŠছে গেল।
ছহীহ, হাসান সকল প্রকার রেওয়ায়াতের ঐক্যমতে মি‘রাজের ঘটনাবলী সংক্ষেপে এই যে, একদা রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাসজিদুল হারামে ঘুমিয়ে ছিলেন। এমন সময় জিব্রীলের নেতৃত্বে কয়েকজন ফেরেশতা এসে তাঁকে উঠিয়ে যমযম কূয়ার পাশে নিয়ে গেল। সেখানে তারা তাঁর বুক চিরে ফেলে কলিজা বের করল। অতঃপর তা যমযম পানিতে ধুয়ে সেখানে ঈমান ও হিকমত পূর্ণ করে দিল। অতঃপর জিব্রীলের নির্দেশনামতে ধবধবে সাদা ‘বোরাক্ব’ নামীয় একটি পশুর পিঠে সওয়ার হয়ে মাসজিদুল হারাম থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে পেঁŠছে যান। সেখানে একটি পাথরে পশুটিকে বেঁধে রেখে তিনি মসজিদে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেন। অতঃপর তাঁর নিকটে মদ ও দুধের পাত্র পেশ করা হয়। কিন্তু কেবল দুধ পান করেন। তখন জিব্রীল বলল, আপনি স্বভাবধর্ম প্রাপ্ত হয়েছেন। অতঃপর মি‘রাজ বা ঊর্ধারোহণের বাহন আনা হয়, যা ছিল সিঁড়ির ন্যায়। অতঃপর ঐ বৈদ্যুতিক লিফটে চড়ে তিনি উর্ধারোহণ করেন। পথিমধ্যে প্রতি আসমানে অবস্থানরত বিশিষ্ট নবীদের সঙ্গে জিব্রীল তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন। যেমন প্রথম আসমানে হযরত আদম (আঃ), দ্বিতীয় আসমানে ইয়াহইয়া ও ঈসা (আঃ), তৃতীয় আসমানে ইউসুফ (আঃ), চতুর্থ আসমানে ইদরীস (আঃ), পঞ্চম আসমানে হারূণ (আঃ), ষষ্ঠ আসমানে মূসা (আঃ) ও সপ্তম আসমানে ইবরাহীম (আঃ)। তার উপরে দিগন্ত বিস্তৃত ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ বা প্রান্তস্থিত কুলগাছ অবস্থিত, যা অতীব সুন্দর ও সুসজ্জিত। ফেরেশতাদের গমনাগমনের এটাই হ’ল শেষ সীমানা। এর উপরে আল্লাহর আরশ অবস্থিত। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ সমূহ প্রথমে এখানে নাযিল করা হয়। তারপর এখান থেকে সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাগণের মাধ্যমে দুনিয়াতে প্রেরিত হয়। অনুরূপভাবে বান্দাদের আমলনামা সমূহ প্রথমে এখানে নিয়ে আসা হয়। অতঃপর এখান থেকে আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। ফেরেশতা বা নবী-রাসূলগণের কেউ এই স্থান অতিক্রম করতে পারেননি, শেষনবী (ছাঃ) ব্যতীত।
রাসূল (ছাঃ) সপ্তম আকাশে পৌঁছে জিব্রীলের সাথে বায়তুল মা‘মূর পৌঁছেন। এখানে তাঁকে মদ, দুধ ও মধুর পাত্র পেশ করা হয়। তিনি দুধ গ্রহণ করেন। জিব্রীল বলল, এটাই স্বভাবধর্ম। আপনি ও আপনার উম্মত এর উপরে থাকবে। অতঃপর তিনি জান্নাত ও জাহান্নাম পরিদর্শন করেন। অতঃপর সিদরাতুল মুনতাহা বৃক্ষের নিকটে পেঁŠছে গেলে জিব্রীল তাঁকে ছেড়ে যান ও তাঁর উপরে একটি মেঘ ছেয়ে যায়। তিনি সিজদায় পড়ে যান। এ সময় আল্লাহ তাঁর অতীব নিকটে এসে যান ও তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং উভয়ের মাঝে দূরত্ব দুই ধনুক বা দু’গজেরও কম হয়ে যায়। তখন আল্লাহপাক তাকে অহি করেন ও পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেন যা পঞ্চাশ ওয়াক্তের ফযীলতের সমান। অতঃপর মেঘমালা সরে গেলে জিবরীল ফিরে এসে তাঁকে নিয়ে দুনিয়ায় অবতরণ করেন এবং তিনি সমস্ত নবীদের সাথে নিয়ে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে দু’রাক‘আত ছালাতে ইমামতি করেন। অতঃপর বোরাকে সওয়ার হয়ে পুনরায় মক্কায় ফিরে আসেন। পরদিন সকালে তিনি অবিশ্বাসী কুরায়েশদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বায়তুল মুক্বাদ্দাস সম্পর্কে তাদের মধ্যকার অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমস্ত প্রশ্নের সঠিকভাবে জবাব দেন। এতে তারা বিস্মিত হয়ে যায়। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইতিপূর্বে কখনো বায়তুল মুক্বাদ্দাস সফর করেননি।[1]
হাফেয আবু নাঈমের একটি যঈফ বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াস যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সম্পর্কে জানার জন্য আবু সুফিয়ানকে তার দরবারে ডেকে নেন, তখন আবু সুফিয়ান রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মিথ্যা নবী প্রমাণ করার জন্য সম্রাটের নিকটে ইসরার উপরোক্ত ঘটনা শুনান। সম্রাট তখন বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দাররক্ষীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি সকল দরজা ভালভাবে বন্ধ না করা পর্যন্ত কোনদিন ঘুমাতে যাইনা। কিন্তু ঐদিন সব দরজা বন্ধ করার পর মূল দরজাটি সকলে মিলে চেষ্টা করেও নাড়াতে পারিনি। মিস্ত্রীদের ডাকলে তারা পরীক্ষা করে বলে যে, দরজাটিকে উপর থেকে ভারী দেওয়ালে চেপে ধরে রেখেছে। সকাল ব্যতীত আমরা কিছুই করতে পারব না। সকালে গিয়ে দেখি দরজা স্বাভাবিক। সামনে একটি পাথর দেখলাম ছিদ্র করা। মনে হ’ল সেখানে কিছু বাধা ছিল। তখন আমি আমার সাথীদের বলি, নিশ্চয়ই রাতে কোন নবী এখানে এসেছিলেন, যার সম্মানে দরজা খোলা রাখা হয়েছিল। ইবনু কাছীর বলেন, ঈলিয়া বা যেরুযালেম হ’ল ইবরাহীম বংশীয় নবীদের খনি। সেকারণ সমস্ত নবীকে এখানে ডেকে এনে ছালাতে ইমামতির মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া হ’ল যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) হ’লেন সকল নবীর সরদার। কুরতুবী বলেন, আল্লাহ তার রাসূলকে আব্দ বা দাস বলে সম্বোধন করেছেন। তার মর্ম এই যে, এর চাইতে সম্মানিত কোন নাম বান্দার জন্য নেই। থাকলে নিশ্চয়ই সেই নামে রাসূলকে সম্মানিত করা হ’ত।
মি‘রাজের শিক্ষা : মি‘রাজের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হ’ল, আল্লাহর অনুগত দাস হওয়ার চেষ্টা করা। সর্বাধিক দাসত্বের মধ্যেই সর্বাধিক সম্মান ও মর্যাদা নিহিত। আর এজন্যেই আল্লাহ জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন। দ্বিতীয়তঃ জগদ্বাসীর জন্য আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে বড় তোহফা হ’ল ছালাত। যা তিনি নিজ দরবারে ডেকে নিয়ে তাকে প্রদান করেছিলেন। কারণ ছালাতের মাধ্যমে মানুষের নৈতিক উন্নয়ন ঘটে। আর নৈতিক উন্নতিই হ’ল সকল উন্নতির মূল চাবিকাঠি। সেকারণ ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দাকে তার ছালাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। ছালাতের হিসাব সুষ্ঠু হ’লে সকল হিসাব সুষ্ঠু হবে। নইলে সবকিছু বরবাদ হবে। অতএব জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর দাসত্ব করা ও ছালাতের হেফাযত করাই হ’ল মি‘রাজের মূল শিক্ষা। অন্যান্য ধর্মের লোকেদের ন্যায় মুসলমানেরাও যাতে ধর্মের নামে অহেতুক আনুষ্ঠানিকতায় বন্দী না হয়ে পড়ে, সেকারণ রাসূলের জন্মদিন, শবেক্বদর ইত্যাদির ন্যায় শবে মে‘রাজের সঠিক তারিখকেও অজ্ঞাত রাখা হয়েছে। অতএব ২৭শে রজবকে শবে মে‘রাজ বলা বা পবিত্র মনে করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করা সবকিছু বিদ‘আতে পর্যবসিত হবে। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে এসবের কোন প্রমাণ নেই। আল্লাহ আমাদেরকে মি‘রাজের মূল শিক্ষা অনুধাবনের তাওফীক দিন এবং যাবতীয় বিদ‘আত থেকে দূরে থাকার শক্তি দিন- আমীন।[2]
[1]. বুখারী হা/৩৮৮৭; মুসলিম হা/১৬৪; মিশকাত হা/৫৮৬২-৬৭ ‘মি‘রাজ’ অনুচ্ছেদ; আহমাদ হা/১২৫২৭; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বনু ইসরাঈল ১ম আয়াত।
[2]. ৬ষ্ঠ বর্ষ, ১ম সংখ্যা, অক্টোবর ২০০২।