হিংসার আগুনে জ্বলছে পৃথিবী। মানুষে মানুষে ভালবাসা, মায়া-মমতা, সহমর্মিতা সবই যেন হারিয়ে গেছে। ‘কাক কাকের গোশত খায় না’ বলে একটা প্রবাদ আছে। কিন্তু এখন মানুষ মানুষের গোশত খাচ্ছে। যত মারণাস্ত্র তৈরী হচ্ছে সবই মানুষকে মারার জন্য। হিংসান্ধ ব্যক্তির হাতে যখন ক্ষমতা আসে, তখন তার মাধ্যমে দেশ জ্বলে। সেই সাথে জ্বলে পৃথিবী। সাধারণ অস্ত্রে সম্মুখ যুদ্ধে কেবল যুদ্ধরত ব্যক্তি মরে। কিন্তু এখনকার যুদ্ধে নিরপরাধ মানুষ বেশী মরে। বোমা হামলা, বিমান হামলা মানেই নির্দোষ মানুষের হত্যাযজ্ঞ। গত শতাব্দীতে ১৯১৪-১৮ সালে ১ম বিশ্বযুদ্ধে ৭৩ লক্ষ ৩৮ হাযার ও ১৯৪১-৪৫ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৩ কোটি মানুষ নিহত হওয়া ছাড়াও এর বিপুল ধ্বংসকারিতা মানুষের চোখের সামনে ভাসছে। ১৪৫৩-১৯২৪ প্রায় পৌনে পাঁচশ’ বছরের তুরস্কের ইসলামী খেলাফত ধ্বংস করেছে কারা? ১৯১৭ সালে রাশিয়ার কম্যুনিষ্ট বিপ্লবে ১ কোটি ১৭ লক্ষ মানুষ, ১৯৪৮ সালে চীনা কম্যুনিষ্ট বিপ্লবে ১ কোটি ৩৭ লক্ষ মানুষ, ১৯৫৫-৭৩ সালে ভিয়েৎনাম যুদ্ধে প্রায় ৩৭ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে কারা? ১৯৪৮-৬৭ সালে প্রায় ১২ লাখ স্থানীয় আরব ফিলিস্তীনীদের হত্যা করে ও হটিয়ে দিয়ে সেখানে বাহির থেকে ইহূদীদের এনে কারা বসিয়েছে এবং আজও অবরুদ্ধ গাযায় কারা রক্ত ঝরাচ্ছে? ১৯৮০-৮৮ ইরাক-ইরান যুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ মানুষকে হত্যা, ১৯৯২-৯৫ সালে বসনিয়াতে হাযার হাযার মুসলমানকে হত্যা, অতঃপর ২০০৩-১০ সালে ইরাক ও আফগানিস্তানে প্রায় ১৩ লাখ মানুষকে কারা হত্যা করেছে? আফ্রিকা মহাদেশের মুসলিম দেশগুলিতে লাগাতার যুদ্ধ কারা চালিয়ে যাচ্ছে? সাড়ে ছয়শো বছরের মুসলিম শাসন হটিয়ে ভারতবর্ষে প্রায় দু’শো বছর যাবৎ শোষণ-নির্যাতন চালিয়েছে কারা? এতো কেবল বিগত একশ’ বছরের হিসাব। আরও পিছনে তাকালে দেখা যাবে যে, ১৪৯২ সালে স্পেনের প্রায় আটশ’ বছরের মুসলিম শাসনকে প্রতারণার মাধ্যমে ও মসজিদে ভরে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করেছিল কারা? এ যুগে মিয়ানমারে ও চীনে মুসলিম নিধনের নায়ক কারা? অন্য দেশগুলির কথা নাই বা বললাম। এভাবে ইসলাম-পূর্ব যুগ থেকে এযাবৎ পৃথিবীর তাবৎ বিশৃংখলা ও রক্তস্রোত বইয়ে দেওয়ার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী হ’ল ইহূদী-নাছারা চক্র ও তাদের বশংবদ অপশক্তি। এজন্য আল্লাহ কর্তৃক এরা মাগযূব (অভিশপ্ত) ও যাল্লীন (পথভ্রষ্ট) বলে অভিহিত হয়েছে। তাই এদের কাছে শান্তির ললিতবাণী শোনার কোন প্রয়োজন মানবজাতির নেই। এখনও তারা অস্ত্র প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে কেবল অন্যকে ভয় দেখিয়ে স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। একই হিংসার উত্তাপ চলছে দেশে দেশে সরকারে ও সমাজে। কোনমতে একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে কল্পিত প্রতিপক্ষকে নির্মূল করাই হয় তাদের প্রধান লক্ষ্য। সুশাসন কেবল মুখের কথা। ভিন্ন মত পোষণ বা সত্য ভাষণের সব পথ রুদ্ধ করা হয়। ফলে ভয়ে ও আতংকে দেশে একপ্রকার কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। প্যারালাইসিসের রোগীর মত দেশ বেঁচে থাকে অনুভূতিহীন অবস্থায়। আসলে এটা কি কোন সুস্থ সমাজের লক্ষণ?
ইংরেজীতে একটা প্রবাদ আছে Tit for tat ‘আঘাতের বদলে আঘাত’। এটি মানুষের স্বাভাবিক মন্দ প্রবণতা। এর বিপরীত হ’ল Mercy for tat ‘আঘাতের বদলে ক্ষমা’। প্রথমটির পরিণতিতে বিশ্বযুদ্ধগুলি ছাড়াও অন্যান্য বড় বড় যুদ্ধগুলি হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আর দ্বিতীয়টির দৃষ্টান্ত রয়েছে মক্কা বিজয়ের দিন বিরোধী শক্তিকে ক্ষমা ঘোষণার মধ্যে এবং পরের বড় দৃষ্টান্ত হ’ল ক্রুসেড যুদ্ধে সম্মিলিত খ্রিষ্টান শক্তির সেনাপতি রিচার্ডের প্রতি মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি ছালাহুদ্দীনের বিস্ময়কর মহানুভবতার মধ্যে। অথচ পরবর্তীতে ১৯১৮ সালে বৃটিশ সেনাপতি এলেনবী এসে ছালাহুদ্দীনের কবরে লাথি মেরে বলেছিলেন We came back Saladin! একইভাবে ১৯২০ সালে ফরাসী সেনাপতি গুরাউড এসে তাঁর কবরে লাথি মেরে বলেছিলেন Awake, Saladin! We have returned.
হিংসা ও প্রতিহিংসার পশু প্রবৃত্তিকে উসকিয়ে দিয়ে শয়তান মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে পৃথিবীকে অগ্নিকুন্ডে পরিণত করে। পক্ষান্তরে আল্লাহ চান মানুষে মানুষে ভালবাসার মাধ্যমে পৃথিবীকে সুন্দরভাবে আবাদ করতে। কেননা ইতিপূর্বে জিনেরা এ পৃথিবীতে বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছিল ও এখানে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিল। পরে তাদের হটিয়ে আল্লাহ আদমকে পাঠান এবং পৃথিবী পরিচালনার জন্য যুগে যুগে নবীগণের মাধ্যমে বিধান সমূহ পাঠিয়ে দেন (বাক্বারাহ ২/৩০, ৩৯)। সর্বশেষ চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসাবে যা ইসলামী শরী‘আত আকারে আমাদের নিকট মওজূদ রয়েছে (মায়েদাহ ৫/৩)। মানুষ যতদিন তা মেনে চলবে, ততদিন শান্তিতে থাকবে (মুওয়াত্ত্বা হা/৩৩৩৮)। না মানলে দুনিয়া জাহান্নামে পরিণত হবে। এক সময় কিয়ামত হয়ে সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে (ইবরাহীম ১৪/৪৮)।
ইসলাম মানবতার ধর্ম। যা মানুষকে ক্ষমা করতে শেখায়। পক্ষান্তরে কুফর হ’ল শয়তানের ধর্ম। যা সমাজ ও সভ্যতাকে প্রতিশোধের আগুনে ধ্বংস করে। যার প্রধান টার্গেট হ’ল ‘ইসলাম’। আদর্শ দিয়ে মুকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে তাবৎ কুফরী শক্তি এখন হিংসা-প্রতিহিংসা ও প্রতারণার রাজনীতি এবং শোষণের অর্থনীতি চালু করেছে। কোনরূপ চরমপন্থা ও অন্যায় হত্যাকান্ডকে ইসলাম সমর্থন করে না। কিন্তু ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে মিথ্যাচার ও যুলুম অত্যাচারকে কেউ সমর্থন করবে না। ইসলামের পক্ষে বললে তিনি সাম্প্রদায়িক। আর বিপক্ষে বললে তিনি মুক্তমনা, এরূপ একচোখা নীতি ছাড়তে হবে। মনে রাখতে হবে যে, এক হাতে তালি বাজে না। ইসলামের আবেদন মানুষের হৃদয়ে। যাকে বোমা মেরে স্তব্ধ করা যাবে না। যুলুমের প্রতিফল যালেমকে ভোগ করতেই হবে ইহকালে ও পরকালে। পক্ষান্তরে মযলূম মুমিন ইহকালে নির্যাতিত হ’লেও পরকালে সম্মানিত হবে। মুসলমান আদর্শ দিয়ে কুফরীকে মুকাবিলা করে, হিংসা বা অস্ত্র দিয়ে নয়। ইহূদী গোলাম নবীকে সেবা করেছে। কিন্তু তিনি কখনো তাকে ইসলাম কবুলের জন্য চাপ দেননি (বুখারী হা/১৩৫৬)। কারণ ইসলামের সত্য এবং কুফরীর মিথ্যা স্পষ্ট হয়ে গেছে। এক্ষণে তা কবুল করা বা না করা মানুষের এখতিয়ার। এতে কোন যবরদস্তি নেই (বাক্বারাহ ২/২৫৬)। অতএব যেকোন মুসলিম নাগরিক ও সরকারের দায়িত্ব হবে ইসলামের যথার্থ অনুসারী হওয়া এবং অন্যের নিকট ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা। না করলে তিনি আল্লাহর নিকট দায়ী হবেন। যারা সমাজের সত্যিকারের কল্যাণকামী, তাদেরকে অবশ্যই ইসলামের মহান আদর্শ মেনে পথ চলতে হবে। নইলে সরল পথ ছেড়ে বাঁকা পথে কখনো শান্তি আসবে না। আর আল্লাহর দেখানো পথই সরল পথ। এর বাইরে সবই বাঁকা পথ। যার প্রত্যেকটির মাথায় বসে আছে শয়তান (আহমাদ হা/৪১৪২)।
পৃথিবীতে যুগে যুগে সকল অশান্তির মূলে ছিল পথভ্রষ্ট শাসকরা। আজও সেটাই আছে। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এ বিষয়ে তাঁর উম্মতকে সাবধান করে গেছেন’ (আবুদাঊদ হা/৪২৫২)। অতএব বিভিন্ন দেশে জঙ্গী জঙ্গী বলে ইসলাম ও মুসলমানকে যে দায়ী করা হচ্ছে, তার পিছনে নেপথ্য শক্তিগুলির ভূমিকা কতটুকু, তা খতিয়ে দেখা আবশ্যক। নইলে বিশ্বের সবচেয়ে সন্ত্রাসের শিকার মুসলমানেরা কেন? এ পৃথিবী আল্লাহর। অধিকার এখানে সবার। অতএব সর্বাগ্রে হিংসা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করুন। পারস্পরিক ক্ষমার মাধ্যমে আস্থা ও ভালোবাসার পরিবেশ সৃষ্টি করুন। সর্বোপরি তাকদীরে বিশ্বাস রাখুন ও আল্লাহর উপর ভরসা করুন। পৃথিবীতে শান্তি ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ (স.স.)।