হিজরী বর্ষের ৯ম মাস রামাযান আমাদের দুয়ারে সমাগত। বছরে একবার রামাযান তার মাসব্যাপী অফুরন্ত রহমতের পশরা নিয়ে আমাদের নিকটে হাযির হয়। যারা একে চিনেন ও বুঝেন, তারা একে সম্মান করেন, মর্যাদা দেন, নিজের গোনাহ মাফের জন্য তওবা করেন, আল্লাহর নিকট থেকে বিশেষ পুরস্কার নেবার আশায় সার্বিক প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন। আর যারা একে চিনেন না, চিনতে চান না, বুঝতে চান না, তাদের উদ্দেশ্যেই আমাদের আজকের নিবেদন।
ছিয়ামের উদ্দেশ্য : ছিয়ামের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হ’ল মানুষের মধ্যে আল্লাহভীরুতা সৃষ্টি করা। এর সরলার্থ এটাই যে, আল্লাহভীরুতার মধ্যেই মানবতার কল্যাণ ও মুক্তি নিহিত। এর বিপরীতটার মধ্যে তার অকল্যাণ ও ধ্বংস অনিবার্য। আল্লাহভীরুতার মাধ্যমেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত জান্নাত লাভ অসম্ভব। উপরোক্ত বিষয়ে দৃঢ় ঈমান ও আল্লাহর নিকট থেকে পারিতোষিক লাভের দৃঢ় প্রত্যাশা নিয়ে যদি কেউ ছিয়াম পালন করেন, প্রতি রাত্রিতে ও বিশেষ করে ক্বদরের রাত্রিগুলিতে নফল ইবাদত ও ছালাত আদায় করেন, তার বিগত জীবনের সকল গোনাহ মাফ করা হবে’ বলে ওয়াদা করা হয়েছে।[1] মূলতঃ জান্নাত লাভের স্থির লক্ষ্য নিয়ে যিনি ছিয়াম পালন করেন, জান্নাত লাভে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সকল বিষয় তিনি পরিহার করেন বা করতে সাধ্যমত চেষ্টা করেন। একদিনেই সেটা অর্জিত হওয়া সম্ভব নয়, তাই পূর্ণ একমাস তাকে সময় দেওয়া হয়। যাতে আল্লাহভীরুতা তার অভ্যাসে পরিণত হয় এবং তার চরিত্রে স্থিতিশীলতা আসে।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য : জীবন যুদ্ধে ক্ষুৎপিপাসার কষ্টকে জয় করা এবং ক্ষুধার্ত মানবতার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। ‘ক্ষুধার রাজ্যে জীবন গদ্যময়’ কথাটি কিছুটা বাস্তব হ’লেও প্রকৃত মানবতা কখনোই ক্ষুধার কাছে হার মানেনা। ক্ষুধার জ্বালায় সে তার বিবেককে, তার মানবতাকে বিসর্জন দিতে পারে না। একজন মুমিন পুরা একমাস দৈনিক ১২/১৩ ঘণ্টা ক্ষুৎ-পিপাসার তীব্র দহনজ্বালা হাসিমুখে সহ্য করে এবং যাবতীয় হারাম ও মিথ্যার কালিমা হ’তে মুক্ত থেকে নিজেকে দৃষ্টান্ত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে যে, ষড়রিপুর তীব্র আবেগের কাছে সে পরাজিত হয়নি। বস্ত্তবাদীদের লোভনীয় চক্রজাল তাকে মানবতার উচ্চতম শিখর হ’তে সামান্যতম নীচে নামাতে পারেনি। এভাবে সবকিছুকে জয় করেই সে এগিয়ে চলে সম্মুখ পানে জান্নাত লাভের তীব্র আকাংখা নিয়ে। ধনী-গরীবের পার্থক্য তার কাছে কোন পার্থক্যই নয়; বরং মনুষ্যত্বের তারতম্যই তার কাছে বড়। ছবর, ছালাত ও সহমর্মিতার সাথে মাসব্যাপী ছিয়াম সাধনা তাই আল্লাহর নৈকট্যশীলতার অবিরত প্রশিক্ষণের মাস হিসাবে গণ্য হয়।
তৃতীয় উদ্দেশ্য : বান্দার স্বাস্থ্যগত উন্নতি। অধিক ভোজনের ফলে শরীরে যে বাড়তি মেদ বা কোলেস্টেরল (Cholesterol) জমা হয়, তা শিরা-উপশিরায় ও হৃৎপিন্ডে রক্ত প্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এমনকি রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে হঠাৎ মানুষের মৃত্যু ঘটে। নদী-নালায় পলি জমলে যেমন পানির স্রোত বাধাগ্রস্ত হয় ও এক সময় নদী মরে যায়। অনুরূপভাবে দেহের শিরা-উপশিরা ও ধমনীগুলিতে মেদ জমলে রক্ত স্রোত বাধাগ্রস্ত হয় ও রক্তচাপ (Blood pressure) সৃষ্টি করে এবং যেকোন সময় রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে মানুষ মারা যায়। রামাযানের মাসব্যাপী ছিয়ামের ফলে শরীরে বাড়তি মেদ জমতে পারে না। বরং জমা মেদ গলে যায় ও বহুলাংশে হ্রাস পায়। ড্রেজিং করার ফলে নদীর স্রোত যেমন বৃদ্ধি পায়। ছিয়ামের ফলে তেমনি শিরায় ও হৃৎপিন্ডে রক্ত প্রবাহে অধিক গতি সঞ্চারিত হয়। এতদ্ব্যতীত যাদের পেটের দোষ, অজীর্ণ, গ্যাস্ট্রিক আলসার ইত্যাদি রয়েছে, ছিয়াম তাদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। ছিয়ামের ফলে সারা দিন পাকস্থলী বিশ্রাম পায়। তাতে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা কমে যায় ও রোগীর উপকার হয়। ‘ধূমপান বিষপান’ কথাটি সর্বাংশে সত্য। বরং সিগারেটের ধোঁয়া একজন অধূমপায়ী ব্যক্তির স্বাস্থ্যের বেশী ক্ষতি করে। যদিও অন্যের ক্ষতি করার কোন অধিকার কারো নেই, তথাপি ধূমপায়ী লোকেরা বাসে-ট্রেনে, লঞ্চে-স্টীমারে, অফিসে-ক্লাবে একাজটিই করে থাকেন সর্বদা মহা স্বস্তিতে বঙ্কিম ভঙ্গিতে ধোঁয়া উড়িয়ে। ভদ্রলোক নিজে বিষপান করেন ও অন্যের দেহে বিষপ্রয়োগ করেন। এতে নিঃসন্দেহে তিনি হত্যাযোগ্য অপরাধী হন। কিন্তু চেতনার ঐ উচ্চমার্গে এখনো আমরা পৌঁছতে পারিনি। তাই পোষাকী ভদ্রতার আড়ালে সবকিছু ঢেকে যায়। রামাযানুল মুবারকে বাধ্যতামূলকভাবে সারাদিন ধূমপান না করায় ফুসফুস দীর্ঘ সময় ধরে নিকোটিনের বিষক্রিয়া হ’তে মুক্ত থাকে। যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী হয়। তাছাড়া যারা ধূমপান ত্যাগ করতে চান, তাদের জন্য রামাযান একটি মোক্ষম সুযোগ এনে দেয়। ছিয়াম অবস্থায় কিছু লোক ঘন ঘন থুথু ফেলে। তাদের ধারণা থুথু গিললে ছিয়াম ভঙ্গ হয়। এটা নিতান্তই ভুল ধারণা। ঘন ঘন থুথু ফেলা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। থুথুর সাথে দেহের অনেক মূল্যবান পদার্থ যেমন ‘টায়ালিন’ (Ptyalin) বেরিয়ে যাওয়ায় শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই এ বদভ্যাস অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
রামাযানের একমাস ছিয়াম শেষে পুনরায় পূর্ণোদ্যমে চালু হওয়া পাকস্থলী হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়া স্বাভাবিক। তাই পরবর্তী মাসে তাকে আবার ছয়টি সুন্নাত ছিয়াম পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে অর্থাৎ পূর্ণিমার আগে-পিছে আইয়ামে বীয-এর তিনটি নিয়মিত নফল ছিয়াম এবং প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবারের নিয়মিত নফল ছিয়াম পালনের নির্দেশ। এভাবে সারা বছর মানুষের সুষম স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার শারঈ ব্যবস্থা প্রদান করা হয়েছে।
রামাযানের আরেকটিগুরুত্বপূর্ণ দিক হ’ল এই যে, এমাসেই বিশ্ব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নে‘মত হিসাবে পবিত্র কুরআন নাযিলের সূচনা হয়। যা দীর্ঘ ২৩ বছরে সমাপ্ত হয়। কুরআনের বৈশিষ্ট্য হিসাবে বলা হয়েছে ‘হুদা’ ও ‘ফুরক্বান’ অর্থাৎ সত্যের পথনির্দেশ এবং সত্য-মিথ্যা ও হালাল-হারামের পার্থক্যকারী (বাক্বারাহ ২/১৮৫)। নুযূলে কুরআনের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষের জন্য সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ হ’তে সর্বশেষ পথনির্দেশ প্রেরিত হয়েছে এবং বিগত সকল এলাহী গ্রন্থের হুকুম রহিত হয়ে গেছে। অতএব যারা পৃথিবীতে সত্যিকারের শান্তি ও কল্যাণ পিয়াসী, তাদের জন্য ফুরক্বানের অনুসরণ ও তার বাহক শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সুন্নাতের পূর্ণ অনুগমন ব্যতীত অন্য কোন পথ খোলা নেই। কুরআন নাযিলের মাস হিসাবে রামাযান যেভাবে আল্লাহর নিকটে সম্মানিত, তেমনিভাবে কুরআনের যথার্থ অনুসারীরাও আল্লাহর নিকটে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি (আলে ইমরান ৩/১১০)। অতএব আসুন! আমরা আমাদের সেই শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার চেষ্টা করি এবং ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করে রামাযানে তাক্বওয়ার সাধনা ও আল্লাহভীরুতার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!
[1]. বুখারী হা/২০১৪; মুসলিম হা/৭৬০; মিশকাত হা/১৯৫৮।