সম্প্রতি বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীর লেখায় এবং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতায় সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার শোনা যাচ্ছে। এর দ্বারা তারা ইসলাম মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পরোক্ষ ইঙ্গিত দিতে চান। তাঁদের বক্তৃতা ও লেখনী দৃষ্টে একথা খোলামেলা হয়ে গেছে যে, যেহেতু ইসলামী নৈতিকতা মানুষকে স্বেচ্ছাচারে বাধা দেয়, সেহেতু ইসলামকে ব্যক্তি ও বৈষয়িক জীবন থেকে বিদায় করতে পারলেই যা ইচ্ছা তাই করার অবাধ লাইসেন্স পাওয়া যায়। কিন্তু কে না জানে যে, নিয়ন্ত্রণহীন মোটরগাড়ী খাদে পড়ে এক্সিডেন্ট করতে বাধ্য। অনুরূপভাবে নিয়ন্ত্রণহীন জীবন নিশ্চিত ধ্বংস ও অশান্তির কারণ হ’তে বাধ্য। অবশ্য এখানে গিয়ে তারা মানবিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার কথা বলেছেন। যদিও ‘মানবিক মূল্যবোধ’ বলতে কি বুঝায়, তার যথার্থ মানদন্ড কি এবং এই মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখার জন্য চিরন্তন নীতিমালা কি- এসবের কোন জবাব তাদের কাছে নেই। সেজন্যই দেখা যায় এইসব কথিত অতি উদার ও অসাম্প্রদায়িক লোকেরা স্ব স্ব চিন্তা মতে কিংবা অপরের অনুকরণে নানাবিধ অযৌক্তিক কর্মকান্ড করে থাকেন। যার প্রায় সবটুকুই বিলাস কল্পনার ফসল ছাড়া কিছুই নয়। উদাহরণ স্বরূপ অতি পরিচিত কিছু বিষয় পেশ করা যেতে পারে। যেমন- বিগতদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নামে ও ভাস্কর্যের বা শিল্পের নাম করে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ, শিখা চিরন্তন, স্বাধীনতা সৌধ, অপরাজেয় বাংলা, ‘সাবাস বাংলাদেশ’ নির্মাণ, নেতা-নেত্রীদের ছবি ও চিত্র অংকন ও তা অফিসে-আদালতে, ঘরে-বৈঠকখানায় ও দর্শনীয় স্থানে টাঙ্গিয়ে রাখা, তাতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, তার সম্মানে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন, নগ্নপদ প্রভাত ফেরী, পহেলা বৈশাখে বানর-হনুমান, সাপ-হুতোম পেঁচার মুখোশ পরিধান, রাস্তায় বসে শানকিতে করে ইলিশ-পান্তা ভক্ষণ, প্রগতির নামে নারী-পুরুষের স্বাভাবিক লজ্জার বাঁধন ছিন্ন করার যাবতীয় কলা-কৌশল অবলম্বন, মেয়েদেরকে পুরুষের পাশাপাশি সকল কাজে অংশগ্রহণে প্ররোচনা দান, ক্ষমতায়নের নামে তাদেরকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ও শাসন বিভাগের বিভিন্ন স্তরে পুরুষের পাশাপাশি সংখ্যানুপাতিক সুযোগ দানের ব্যবস্থাকরণ, যেনা-ব্যভিচারের মত চিরন্তন ঘৃণ্য বিষয়টিকেও ‘ফ্রি সেক্স’ বা অবাধ যৌনাচারের নামে এবং দেহ ব্যবসায়ে নিয়োজিত পতিতাদেরকে ‘যৌনকর্মী’ আখ্যায়িত করে এটাকেও মর্যাদাকর বৈধ ব্যবসার সম্মান প্রদানের চেষ্টা, আধুনিক সাহিত্যের নামে যৌন সুড়সুড়িমূলক গান, নাটক, উপন্যাস ইত্যাদি পর্ণো ও কু-সাহিত্য রচনা, ছবি ও চলচ্চিত্র শিল্পের নামে সিনেমা-থিয়েটার ও টিভি পর্দায় নারী-পুরুষের ঢলাঢলি ও আদিম রসের ছড়াছড়ি, বাসে-ট্রেনে ও বৈঠকাদিতে বসে বিলাসভঙ্গিতে বিড়ি-সিগারেটের বঙ্কিম ধোঁয়া উদগীরণ, রাজধানীর ও বড় বড় শহরের বিশেষ হোটেলগুলিতে কিংবা তথাকথিত মডেল টাউনগুলির কারুকার্যখচিত প্রাসাদোপম অট্টালিকা সমূহের হল রুমের নিয়নবাতির আলো-আঁধারীর নীচে অনুষ্ঠিত ‘জংলী রাত’গুলিতে পারস্পরিক বধু বিনিময়, বলড্যান্স ও অবশেষে মদে চুর হয়ে অবাধ যৌনাচারে লিপ্ত হওয়া ছাড়াও রয়েছে বলতে না পারা বহু কিছু পশ্বাচরণ।

প্রশ্ন ওঠে সাম্প্রদায়িকতা বলতে কি বুঝায়? এর অর্থ যদি নির্দিষ্ট ধর্মীয় দলীয়তা হয়, তাহ’লে মুসলমান সহ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়কে বাংলাদেশ ছাড়তে হবে। অথবা তাদেরকে স্ব স্ব ধর্ম ত্যাগ করে ধর্মহীন হ’তে হবে। আর যদি সাম্প্রদায়িকতা বলতে রাজনৈতিক দলীয়তা বুঝানো হয়, তাহ’লে তো বন্ধুদের দিন-রাতের সাধনা তথাকথিত গণতন্ত্রের জয়গান বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ গণতন্ত্রের নামে সরকারী ও বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক সন্ত্রাসে সমাজ রসাতলে যেতে বসেছে। প্রচলিত দলতান্ত্রিক সাম্প্রদায়িকতার হিংস্র ছোবল থেকে বাঁচার জন্য মানুষ অন্যত্র পথ খুঁজছে। তাহ’লে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ কি কেবলই একটা শ্লোগান মাত্র? কেবলই ইউটোপিয়া? আসলে বন্ধুরা কি চান তারা নিজেরাই জানেন না। সাম্প্রদায়িকতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা ইত্যাকার শব্দগুলি কম্যুনিস্ট নামধারীরা এক সময় খুবই বলতেন। অথচ এটা যে স্রেফ ধোঁকাবাজি ছিল, সেকথা আজ প্রমাণিত সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে কম্যুনিজমের স্বর্গভূমি রাশিয়া, চীন ও তাদের সমগোত্রীয় রাষ্ট্রগুলিতে।

প্রত্যেক ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া আছে। আগুনে হাত দেওয়াটা ক্রিয়া, পুড়ে যাওয়াটা প্রতিক্রিয়া। পানিতে হাত দেওয়াটা ক্রিয়া, ভিজে যাওয়াটা প্রতিক্রিয়া। লোহার প্রতি চুম্বকের আকর্ষণ তার স্বাভাবিক ক্রিয়া, দু’য়ের মিলন হ’ল প্রতিক্রিয়া। নারী ও পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণ লোহা ও চুম্বকের ন্যায় স্বাভাবিক ক্রিয়া। দূরে রাখলে বা পর্দার মাধ্যমেই কেবল এর প্রতিক্রিয়া হ’তে মুক্ত থাকা সম্ভব। যেমন নেগেটিভ-পজেটিভ দু’টি ক্যাবলের একত্র ব্যবহার তখনই সম্ভব হয়, যখন উভয় ক্যাবলে লাল বা কালো নিরাপদ কভার দিয়ে মুড়ে রাখা হয়। নইলে উভয়ের স্পর্শের প্রতিক্রিয়ায় সাথে সাথে এক্সিডেন্ট সুনিশ্চিত।

তথাকথিত উদারতাবাদী অসাম্প্রদায়িক ভাইয়েরা উপরোক্ত স্বভাবজাত বিষয়গুলিকে বিশেষ করে নারী-পুরুষের পারস্পরিক লজ্জাবোধ ও পর্দা-পুশীদার বিষয়টিকে কঠিনভাবে অস্বীকার করতে চান এবং এটাকে দারুণ প্রতিক্রিয়াশীলতা বলতে চান। যদিও তাঁরা নিজেরাও পারেন না নিজের স্ত্রী ও যুবতী কন্যাকে এক করে দেখতে। স্বভাবজাত প্রতিক্রিয়া তাদের মধ্যেও হয়ে থাকে। কেননা চেতনাহীন বা প্রাণহীন লাশেরই কেবল প্রতিক্রিয়া হয় না। বাকী সবেরই মধ্যে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া থাকবে-এটাই স্বাভাবিক। জগত সংসারের এই স্বাভাবিক বিষয়টি অস্বীকার করে কোন মতবাদ চলতে পারে না। বিশ্বচরাচরের সৃষ্টিকর্তা হ’লেন আল্লাহ। বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যকার স্বভাবের ভিন্নতা সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। মানুষের মধ্যে চেতনা, জ্ঞান ও কর্মশক্তির দ্যোতনা সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। মানুষের সমাজ পরিচালনার বিশ্বজনীন বিধান প্রেরণ করেছেন আল্লাহ। ‘লওহে মাহফূযে’ সংরক্ষিত সর্বশেষ সেই বিশ্ববিধান নাযিল হয়েছে ‘কুরআন’ রূপে। যার বাস্তব ধর্মীয় ও সামাজিক রূপ হ’ল ‘ইসলাম’। ইসলামী শরী‘আত অনুযায়ী জীবন যাপন করার মধ্যেই রয়েছে মানুষের পারস্পরিক অধিকার রক্ষার গ্যারান্টি। রয়েছে সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি-সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। রয়েছে স্বাভাবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যকার সামঞ্জস্য বিধানের চিরন্তন মূলনীতি।

বিভিন্ন দল ও সম্প্রদায় আল্লাহরই সৃষ্টি। এই সৃষ্টির উদ্দেশ্য হ’ল পারস্পরিক পরিচিতি (হুজুরাত ৪৯/১৩)। মানুষ হিসাবে সকলের অধিকার সমান। সকলেই এক আদম ও হাওয়ার সন্তান। মর্যাদার মানদন্ড হ’ল স্রেফ তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি। কেননা আল্লাহভীতিই হ’ল প্রকৃত মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার একমাত্র হাতিয়ার। তাই অসাম্প্রদায়িক বলতে যদি সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল বনু আদমের প্রতি সমান ব্যবহার ও ন্যায়বিচার বুঝায়, তবে তা কেবল আল্লাহ প্রেরিত অহি-র বিধান নিঃশর্তভাবে মেনে চলার মাধ্যমেই সম্ভব। আল্লাহ সৃষ্ট আলো বাতাস যেমন সবার জন্য মঙ্গলময়, আল্লাহ প্রেরিত অহি-র বিধান তেমনি সবার জন্য কল্যাণকর। আল্লাহ সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিধান আমরা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মেনে চলতে বাধ্য হচ্ছি। কিন্তু ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকায় আমরা তাঁর প্রেরিত অহি-র বিধান আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মেনে চলতে ব্যর্থ হচ্ছি। আর সেকারণেই মানুষের জীবনে নেমে আসছে ক্রমাগত অশান্তির দাবদাহ। সৃষ্টি হয়েছে সাম্প্রদায়িক-অসাম্প্রদায়িকের অবান্তর বিতর্ক। আমরা কি আল্লাহর বান্দা হিসাবে সকল মানুষকে মানুষ হিসাবে ভাবতে পারি না? আমরা কি পারিনা নেককার বান্দাদেরকে ভাই হিসাবে বুকে টেনে নিতে? আল্লাহভীরু সৎ মানুষগুলোই কি সমাজের স্তম্ভ নয়? হৌক সে বাঙ্গালী, হৌক সে বিহারী-পাঞ্জাবী, হৌক সে আফগান বা আমেরিকান, আল্লাহভীরু হ’লে সে আমার ভাই। এই দর্শনই কেবল মানব সমাজের ভেদাভেদ দূর করতে পারে। তাই অসাম্প্রদায়িক নয়, চাই তাক্বওয়াশীল বাংলাদেশ। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!






শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার উপায় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নৈতিকতা ও উন্নয়ন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
২. পৃথিবী নামক গ্রহটিকে প্রাকৃতিকভাবে চলতে দিন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নিউজিল্যান্ড ট্রাজেডী : চরমপন্থার পরাজয় ও মানবতার বিজয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি ব্যঙ্গোক্তি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ক্রমবর্ধমান তালাক : প্রতিকারের উপায় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নৈতিক অবক্ষয় প্রতিরোধের উপায় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
চেতনার সংকট - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ট্রাম্পের বিজয় ও বিশ্বের কম্পন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দল ও প্রার্থী বিহীন নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সংবিধান প্রণয়ন প্রসঙ্গে - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নিহত আবরার নিহত দেশপ্রেম - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.