গত ১৭-১৮ই মার্চ’১৮ শনি ও রবিবার সংগঠনের ‘শিক্ষা সফর’ উপলক্ষে কাপ্তাই লেক, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পরিদর্শনে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হ’ল তার একটি অংশ ছিল শেষ দিন রবিবার রাঙ্গামাটি থেকে খাগড়াছড়ি সফর। বেলা ১২-টার দিকে হঠাৎ আটকে গেলাম মানিকছড়ি উপযেলার বুড়ীর ঘাট বাজার জামে মসজিদের সামনে। যানবাহন অল্প যা কিছু আছে, সবই এক ঠায় দাঁড়িয়ে। কারণ কি কেউ জানে না। কেউ কেউ বলল, অবরোধ। ঘণ্টা দেড়েক পরে আর্মির গাড়ী এল। আমরা পিছে পিছে চললাম। এক সময় আমাদের কিছু না বলেই গাড়ীটি চলে গেল। ফলে কিছু দূর গিয়ে নানিয়ারচর উপযেলার ১৮ মাইল বাজারে আবার আটকে গেলাম। এবার দেখা গেল রাস্তায় আড়াআড়ি পড়ে আছে একটি গাছের সরু লম্বা ডাল। জনা পাঁচেক পুলিশ দাঁড়িয়ে। দু’পাশে গাড়ী ও হোন্ডা-সিএনজির লাইন। সবাই চুপচাপ। কারু কণ্ঠে উঁচু শব্দ নেই। সবার চেহারায় যেন একটা আতঙ্কের ছাপ। ঐ ডালটি সরানোর ক্ষমতা পুলিশের নেই। প্রায় আধা ঘণ্টা পর পুলিশ চলে গেল। পাহাড় থেকে নেমে এল তিনটা ছোট ছোট ছোকরা। সবাই ভয় পেয়ে গেল। কারণ এরাই হ’ল আসল হোতা। যাদের কারণে রাস্তা বন্ধ। কিছুক্ষণ পরে আর্মির গাড়ী এল। আবার সব গাড়ী চলল। এভাবে মহালছড়ির আগ পর্যন্ত পাঁচ বার পাঁচটি বাঁধা আর্মির মাধ্যমে দূর হ’ল। অতঃপর আমরা পুরা আতংকের মধ্যে আছরের পরে খাগড়াছড়ি পৌঁছলাম। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। পরের দিন পত্রিকায় দেখলাম, এ অবস্থা ছিল সকাল ১০-টা থেকে সন্ধ্যা ৬-টা পর্যন্ত। হ্যাঁ এটাই হ’ল পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২০ বছর পরের অশান্ত ফলাফল। এই শিক্ষা সফরে এটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে কষ্টদায়ক শিক্ষা অর্জন। আর এতেই বুঝলাম, কেন পার্বত্য সন্ত্রাসী নেতারা আর্মি ক্যাম্পগুলি পুরোপুরি তুলে দেওয়ার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছে? ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত ৫৫২টি নিরাপত্তা ক্যাম্পের মধ্যে এযাবত ১টি ব্রিগ্রেড সহ ২৩৮টি নিরাপত্তা ক্যাম্প উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর সেজন্যই তো প্রকাশ্য দিনমানে এরূপ সন্ত্রাস সৃষ্টির সুযোগ তারা পেয়েছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মাত্র ৫টি নিরাপত্তা ক্যাম্প ছাড়া বাকী সব নিরাপত্তা ক্যাম্প তুলে নিতে হবে।

১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর যখন শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তখন উক্ত চুক্তির ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে ‘বিজয়ের মাস ও পার্বত্য চুক্তি’ শিরোনামে আমরা সম্পাদকীয় লিখেছিলাম (১/৪ সংখ্যা, ডিসেম্বর ১৯৯৭; দিগদর্শন-১, ৬০ পৃ.)। চুক্তির পর তৎকালীন সরকার প্রায় সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় থেকে বিদায় নেয়ার সময় বলেছিল যে, তারা চুক্তির ৯৮ শতাংশই বাস্তবায়ন করেছে। যদিও জেএসএস নেতা সন্তু লারমা তা আজও স্বীকার করেন না। একই সরকার এখন ক্ষমতায়। সম্ভবতঃ তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে সরকার বুঝেছেন যে, উক্ত শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব নয়। কেননা তাতে বাংলাদেশের এক দশমাংশ ভূমি অবশ্যই হারাতে হবে। যা কেউ মেনে নিবে না। এবারে আসুন আমরা কিছুটা গভীরে চলে যাই।-

বৃটিশ আমলে চট্টগ্রাম যেলার অন্তর্ভুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম ৮০-এর দশকে এসে মাঝখানে রাঙ্গামাটি, দক্ষিণে বান্দরবান ও উত্তরে খাগড়াছড়ি ৩টি পৃথক যেলায় বিভক্ত হয়। রাঙ্গামাটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যেলা। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত অঞ্চল হিসাবে পরিগণিত। অঞ্চলটি বিশ্বের তিনটি খুবই গুরুত্ববহ ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলের সংযোগস্থলে অবস্থিত। (১) দক্ষিণ এশিয়া বা সার্ক অঞ্চল। (২) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা আসিয়ান অঞ্চল। (৩) উত্তর-পূর্বের বিশাল চীন অঞ্চল। চীন ইতিমধ্যে পরাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং ভারত নিকট ভবিষ্যতে পরাশক্তি হ’তে যাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার ঊর্ধ্বে এরা কেউ নয়। বিশেষ করে ভারতের কোন প্রতিবেশী তার সম্পর্কে নিশ্চিন্ত নয়। ফলে তাদের কারু সাথে তার সদ্ভাব নেই। চীন ও ভারতের মধ্যকার বৈরিতা সুস্পষ্ট। ভারত মহাসাগরে প্রভাব বলয় বিস্তারের দূরভিসন্ধির কারণে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র চট্টগ্রামকে এতদঞ্চলে অতীব প্রয়োজনীয় ভূ-কৌশলগত এলাকা হিসাবে বিবেচনা করে। চট্টগ্রামের পশ্চিমে ভারতের ত্রিপুরা, উত্তর ও পূর্বে মিজোরাম এবং দক্ষিণে মায়ানমারের আরাকান প্রদেশ। পার্বত্য চট্টগ্রামে জনবসতি অত্যন্ত কম। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, পাংখু, বোম ইত্যাদি ১৩টি উপজাতি মিলে ৫ লক্ষ এবং বাঙালী মুসলমান ৭ লক্ষ; সর্বমোট প্রায় ১২ লক্ষ।

জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত কোন প্রকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। অর্থাৎ তিনি কখনই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নন। পার্বত্যবাসী ৭ লক্ষ বাঙ্গালীকে উৎখাত করাই তার লক্ষ্য বিধায় তাদের প্রতিনিধিও তিনি নন। অন্যদিকে শুধুমাত্র চাকমা সম্প্রদায়ভুক্ত হবার কারণে অন্য ১২টি উপজাতিরও তিনি প্রতিনিধি নন। অধিকন্তু চাকমাদের মধ্যে ইউপিডিএফ, জেএসএস (এম এন লারমা) ইত্যাদি বেশ কিছু দল সন্তু লারমার নেতৃত্ব মানেনা বিধায় সন্তু লারমা চাকমা সম্প্রদায়েরও একক প্রতিনিধি নন। এমনকি তিনি এখনও বাংলাদেশের ভোটার হননি বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ রয়েছে। অথচ এযাবত প্রায় ৩৫০০০ মানুষকে হত্যাকারী জেএসএস-এর এই সন্ত্রাসী নেতার সাথেই কথিত শান্তিচুক্তি করা হয়েছে। মূলতঃ ভারতের প্রশিক্ষিত শান্তি বাহিনীর নেতা হওয়া ছাড়া কোন যৌক্তিক বিচারেই তাকে চুক্তির পক্ষ হিসাবে মেনে নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। আর এখন তাকেই প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনকর্তা হিসেবে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। অথচ শান্তিচুক্তির পরেও সেখানে চলছে আগের মত গুম, খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজিসহ সকল প্রকার রাষ্ট্রঘাতি কাজকর্ম।

১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমার ভাষায় ‘শান্তিচুক্তি কোনো একক ব্যক্তি বা একক সরকারের কৃতিত্ব নয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সর্বপ্রথম পার্বত্য অঞ্চলের বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিরসনে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সংলাপের সূচনা করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে এরশাদ আমলে ৬টি, বেগম খালেদা জিয়া সরকারের প্রথম আমলে ১৩টি ও শেখ হাসিনা সরকারের সাথে ৭টি মিলে মোট ২৬টি সংলাপের মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত  হয়েছে।’ জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া শান্তিচুক্তির চেষ্টা চালালেও ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় বিরোধী জোট। তারা এটিকে দেশ বিক্রির চুক্তি আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এবং তারা ক্ষমতায় গেলে এ চুক্তি বাতিল করা হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন। যদিও ক্ষমতায় গিয়ে খালেদা জিয়া এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করেননি। বরং নীরবে শান্তিচুক্তির উল্লেখযোগ্য ধারাগুলি বাস্তবায়ন করেছিলেন।

একাত্তরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন জেএসএস নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘তোরা সব বাঙালী হয়ে যা’। তারা স্বায়ত্ব শাসন দাবি করলে তিনি সেটাও মানেননি। শুধু তাই নয়, তিনিই সর্বপ্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী সেটেল করানোর কথা বলেছিলেন। তাঁর সেই কথার বাস্তবায়ন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। কিন্তু শান্তিচুক্তি করার সময় তৎকালীন সরকার সেই বাঙালী জনগোষ্ঠীর জাতিসত্তাকে অস্বীকার করে তাদের ‘অ-উপজাতি’ আখ্যা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করে। শুধু তাই নয় চুক্তির ‘ক’ খন্ডের ১ নং ধারায় ‘উভয়পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৫২% বাঙালীর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। ফলে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুবিধায় পার্বত্য উপজাতিদের নানা অগ্রাধিকার শর্তযুক্ত করে বাঙালীদের প্রতি বৈষম্য করা হয়। ভূমি ব্যবস্থাপনায় প্রথাগত রীতি অনুসরণের বিধান যুক্ত করায় সেখানে বসবাসরত বাঙালীরা ভূমিহীন ও বাস্ত্তচ্যুত হবার আশঙ্কায় এখন দিন গুনছে।

জেএসএস বাস্তবে শান্তিচুক্তি পালন করেনি। কেননা শান্তিচুক্তির আবশ্যিক শর্ত ছিল, তাদের সশস্ত্র শাখা ‘শান্তিবাহিনী’ সকল অস্ত্র ত্যাগ করবে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। কিন্তু শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর অস্ত্র সমর্পণের দিনই তাদের একটি গ্রুপ শান্তিচুক্তিকে প্রহসন আখ্যা দিয়ে অস্ত্র সমর্পণের বিরোধিতা করে। পরে এ গ্রুপটি ‘ইউপিডিএফ’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। এদিকে শান্তিবাহিনীর মূল গ্রুপটিরও একাংশ অস্ত্র সমর্পণ না করে ভেতরে রয়ে যায় এ সন্দেহে যে, সরকার প্রতারণা করতে পারে। এ বাহিনী পরে ভেঙে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে আরেকটি নতুন গ্রুপের জন্ম হয় জনসংহতি সমিতি (সংস্কার) নামে। শান্তিচুক্তির দুই দশক এই তিন গ্রুপের সশস্ত্র লড়াইয়ের দশক। এই তিন গ্রুপের হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, অপহরণ, নির্যাতন, দখল, পাল্টা দখল ও আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম এক বিভীষিকাময় অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ইউপিডিএফ ভেঙে নতুন আরেকটি গ্রুপের জন্ম হয়েছে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের নিকটবর্তী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হ’ল বাংলাদেশের আমদানী-রফতানীর লাইফ লাইন। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পেলে চট্টগ্রাম বন্দরকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের নীচে রয়েছে অফুরন্ত তৈল ও গ্যাসের অমূল্য খনি। যা উঠানো সম্ভব হ’লে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় আমেরিকার চেয়ে বহুগুণ বেশী হবে। এই কৌশলগত অবস্থানের বিবেচনাতেই ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে ‘সশস্ত্র শান্তিবাহিনী’ গঠন করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক অঘোষিত প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকাতেই স্থাপিত হয় কয়েক ডজন শান্তিবাহিনী ক্যাম্প। ভারতীয় লেখক অশোক রায়নার ‘ইনসাইড র’ বইতে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। মনে রাখা আবশ্যক যে, র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭-য়ে ভারত বিভক্ত হয়। সেই হিসাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব প্রদেশ এবং অখন্ড বাংলা ও আসাম প্রদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া আবশ্যক ছিল। কিন্তু কলিকাতা বন্দর রক্ষার অজুহাত দিয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও নদীয়া যেলাকে ভারতের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। অতঃপর চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষার স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর বিনিময়ে তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতাদেরকে পূর্ব পাঞ্জাব ছাড়তে হয়। সেই সাথে আসামের করিমগঞ্জ থানাসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলিও ভারতকে ছেড়ে দিতে হয়। অতএব পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। যদিও তৎকালীন কংগ্রেস নেতারা ভেবেছিলেন যে, বিভক্ত পাঞ্জাব ও বাংলা খুব বেশীর বেশী ২০ বছরের মধ্যে পুনরায় ভারতের দখলীভুক্ত হয়ে যাবে। সেই লক্ষ্যে তারা পাকিস্তানী নেতাদের যুলুমের সুযোগ নিয়ে ২৪ বছরের মাথায় পাকিস্তান ভেঙ্গেছে। গত ১৯শে মার্চ’১৮ ভারতের শাসকদল আসামের বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্য দেব বলেছেন, ১৯৭১-য়ে স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গীভূত করা উচিৎ ছিল (ইনকিলাব ২২.৩.১৮)

শান্তি চুক্তির কয়েকটি সংবিধান বিরোধী ধারা : (১)  এ চুক্তিতে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘উপজাতীয় এলাকা’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত প্রায় ৫২% বাঙালী মুসলিম জনসমষ্টির অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। (২) ৩টি যেলা পরিষদের ৩টি চেয়ারম্যান পদ এবং আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান পদ শুধুমাত্র উপজাতীয়দের জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে। এর ফলে উপজাতীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং বাঙালীদের মর্যাদা উপজাতীয়দের ‘প্রজার’ পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩টি যেলায় ‘স্থানীয় সরকার পরিষদ’ গঠনের উদ্দেশ্যে যে নির্বাচনের আয়োজন করে, সেখানে সর্বপ্রথম তারা এই আত্মঘাতি বিধান জারি করে (৩) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে স্বীকৃতি পাবার জন্য বাঙ্গালীদেরকে উপজাতীয় হেডম্যান, সার্কেল চীফ ও রিজিয়ন কাউন্সিলের সনদ প্রাপ্তির মুখাপেক্ষী করা হয়েছে। উপজাতিদের কাছ থেকে এসব সনদপত্র না পেলে কোন বাঙ্গালী পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা হ’তে পারবেনা বিধায় তারা সেখান থেকে উচ্ছেদ হ’তে বাধ্য হবে। (৪) বাংলাদেশের কোন নাগরিক উপজাতীয় রিজিয়ন কাউন্সিলের অনুমতি ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রামে জমি কিনতে, জমি বন্দোবস্ত নিতে বা বসতি স্থাপন করতে পারবেনা। অথচ বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকদেরকে দেশের যে কোন স্থানে ভূমি ক্রয় ও বন্দোবস্ত নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকার দিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের সরকারও উপজাতীয় রিজিয়ন কাউন্সিলের সম্মতি ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন ভূমি অধিগ্রহণ করতে পারবেনা। অর্থাৎ সরকারের সার্বভৌম অধিকারও চুক্তিতে অস্বীকার করা হয়েছে। (৫) মাত্র ৫টি নিরাপত্তা ক্যাম্প ছাড়া বাকী সব নিরাপত্তা ক্যাম্প তুলে নিতে হবে। অথচ নিরাপত্তা ক্যাম্প স্থাপন করা রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার ব্যাপার। কোন সশস্ত্র গ্রুপ বা দলের সাথে সরকার এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হ’তে পারে না। দেশের এক-দশমাংশ কৌশলগত এলাকা এভাবে সন্ত্রাসীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিরাপত্তা ক্যাম্প তুলে নিয়ে আসার পরিণাম যে কত ভয়াবহ হ’তে পারে তা দেশপ্রেমিক যে কোন নাগরিক বুঝতে পারেন। 

বলা বাহুল্য, পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে যেসব ধারা-উপধারা সন্নিবেশিত করা হয়েছে তার পূর্ণাংগ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হ’লে পার্বত্য চট্টগ্রামে যেতে আমাদের জন্য পাসপোর্ট ও ভিসার দরকার হবে। পরিতাপের বিষয় হ’ল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে ২৪ পদাতিক ডিভিশন চট্টগ্রাম অঞ্চলে মোতায়েন রয়েছে, তাদেরকে প্রধান দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ‘পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা’। অন্যদিকে বিএনপি পার্বত্য চুক্তি বাতিলের দাবীতে লং মার্চ করলেও ২০০১ সালে ক্ষমতায় গিয়ে চুক্তির অনেক ধারাই যেগুলি আওয়ামী সরকার বাস্তবায়ন করে যায়নি, সেগুলি বাস্তবায়ন করে এবং পার্বত্যবাসীদের কাছ থেকে কর আদায়ের অধিকার সহ বহু বিষয় রিজিয়নাল কাউন্সিলের কাছে হস্তান্তর করে। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালীদেরকে যেসব খাস জমি লীজ দেয়া হয়েছে, সেগুলি প্রস্তাবিত ভূমি জরিপ কমিটির সুফারিশ অনুযায়ী উপজাতীয়দের দখলে ছেড়ে দিলে ঐসব বাঙালী নাগরিকদের উচ্ছেদ নিশ্চিত হবে এবং বাস্তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। শান্তিচুক্তির পর গত বিশ বছরে রাস্তা-ঘাট ইত্যাদির বহু উন্নতি হ’লেও তার উপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব না থাকলে সবই নিষ্ফল হবে।  

শান্তিচুক্তির অন্যায় ধারাসমূহের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত দু’টি মামলার চূড়ান্ত শুনানী শেষে ২০১০ সালের ১২ ও ১৩ই এপ্রিল প্রদত্ত এক ঐতিহাসিক রায়ে বাংলাদেশের হাইকোর্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ আইনকে এবং সেই সাথে পার্বত্য ৩টি যেলা পরিষদ আইনের বেশ কিছু ধারাকে বেআইনী ও অবৈধ ঘোষণা করে। ফলে সরকার দ্রুত সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে আঞ্চলিক পরিষদ ও সন্তু লারমার পদ আপাতত রক্ষা করেছে। যার রায় আজও পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য যে, আদালতের রায় বিপরীত হ’তে পারে ভেবেই শান্তিচুক্তির এক স্থানে বলা হয়েছে ‘অন্য কোথাও যাহাই লেখা থাকুক না কেন, চুক্তিতে বর্ণিত ধারাই বলবৎ হবে’। সেই সাথে কৌশলগতভাবে দু’টি মিথ্যা প্রচারণা শুরু করা হয়েছে : (১) ‘পার্বত্য উপজাতিরা সেখানকার আদিবাসী’। অথচ সেখানকার বাঙালীরাই মূলত আদিবাসী। আর চাকমারা বৃটিশ আমলে ভারতের চম্পক নগরী এবং মায়ানমারের আরাকান থেকে বহিষ্কৃত হয়ে এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। যা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। বস্ত্ততঃ কোন দেশের নাগরিক হওয়ার জন্য সেখানকার আদিবাসী হওয়া শর্ত নয়, বরং রাষ্ট্রের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যই শর্ত। (২) সেখানকার কোন উপজাতির উপর কোনরূপ অপরাধ সংঘটিত হলেই সাথে সাথে তার দায়ভার বাঙালীদের উপর চাপানো হয়। যাতে সেখান থেকে বাঙালী বিতাড়ন আন্দোলন দ্রুততর করা যায়।

সবশেষে বলব, কুচক্রী মহলসমূহের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাত করে যেকোন মূল্যে উপজাতি-বাঙালী সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে এবং অপার সম্ভাবনাময় পার্বত্য অঞ্চলের অখন্ডতা ও উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে। আল্লাহ দেশকে হেফাযত করুন- আমীন! (স.স.)






রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান কাম্য - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিপন্ন স্বাধীনতা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইসলামী শিক্ষার বিকাশ চাই - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উৎস হৌক যাকাত ও ছাদাক্বা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নেতৃত্ব দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
তবে কি বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
স্বাধীন ‘আরাকান রাষ্ট্র’ ঘোষণা করুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
স্বভাবধর্মের বিকাশ চাই! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আত্মহত্যা করবেন না - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষা করুন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ধর্মনিরপেক্ষতার ভয়াল রূপ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিশ্বকাপ না বিশ্বনাশ? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.