পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । পর্ব ৮ । পর্ব ৯ ।

ছালাতের ফযীলত

পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মধ্যে ছালাতের ফযীলত সংক্রান্ত অনেক বর্ণনা রয়েছে। যার মাধ্যমে আল্লাহর বান্দা ছালাতের প্রতি মনোযোগী হ’তে পারে এবং বিশুদ্ধতা ও একাগ্রতার সাথে একনিষ্ঠচিত্তে ছালাত সম্পাদন করতে পারে। এক কথায় ছালাতের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর অমীয় বাণীই যথেষ্ট। কিন্তু বর্তমানে সেই অভ্রান্ত বাণী ছেড়ে যঈফ ও জাল হাদীছ এবং মিথ্যা, উদ্ভট, কাল্পনিক কাহিনীই শুনানো হচ্ছে। বই-পুস্তক লিখে ও বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। এগুলো মানুষের হৃদয়ে কোন প্রভাব ফেলে না। আমরা এই অধ্যায়ে সেগুলো উল্লেখ করার পাশাপাশি ছহীহ দলীলগুলোও উল্লেখ করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

(১) ছালাত জান্নাতের চাবি :

উক্ত মর্মে যে হাদীছ সমাজে চালু আছে তা যঈফ।

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِفْتَاحُ الْجَنَّةِ الصَّلاَةُ وَمِفْتَاحُ الصَّلاَةِ الطُّهُوْرُ-

জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, জান্নাতের চাবি হ’ল ছালাত। আর ছালাতের চাবি হ’ল পবিত্রতা।[1]

তাহক্বীক্ব: হাদীছটির প্রথম অংশ যঈফ।[2] আর দ্বিতীয় অংশ সম্পর্কে পৃথক সনদে ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[3]

প্রথম অংশ যঈফ হওয়ার কারণ হ’ল- উক্ত সনদে দু’জন দুর্বল রাবী আছে। (ক) সুলায়মান বিন করম ও (খ) আবূ ইয়াহইয়া আল-ক্বাত্তাত।[4]

জ্ঞাতব্য : জান্নাতের চাবি সম্পর্কে ইমাম বুখারী (রহঃ) একটি অনুচ্ছেদের বিষয়বস্ত্ত আলোচনা করতে গিয়ে ওহাব ইবনু মুনাবিবহ (রহঃ) থেকে যে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন তা হ’ল- তাঁকে একদিন জিজ্ঞেস করা হ’ল-

أَلَيْسَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ مِفْتَاحُ الْجَنَّةِ قَالَ بَلَى وَلَكِنْ لَيْسَ مِفْتَاحٌ إِلاَّ لَهُ أَسْنَانٌ فَإِنْ جِئْتَ بِمِفْتَاحٍ لَهُ أَسْنَانٌ فُتِحَ لَكَ وَإِلاَّ لَمْ يُفْتَحْ لَكَ-

‘লা ইলা-হা ইল্লাহ’ কি জান্নাতের চাবি নয়? তখন তিনি বললেন, হ্যাঁ। তবে প্রত্যেক চাবির দাঁত রয়েছে। তুমি যদি এমন চাবি নিয়ে আস যার দাঁত রয়েছে তাহ’লে তোমার জন্য জান্নাত খোলা হবে। অন্যথা খোলা হবে না’।[5] এছাড়াও আরো অন্যান্য হাদীছ দ্বারাও এটা প্রমাণিত হয়।[6] বুঝা যাচ্ছে যে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’ জান্নাতের চাবি আর শরী‘আতের অন্যান্য আমল-আহকাম অর্থাৎ ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ঐ চাবির দাঁত।

(২) এক ওয়াক্ত ছালাত ছুটে গেলে এক হুকবা বা দুই কোটি অষ্টাশি লক্ষ বছর জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে।

قَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنَ تَرَكَ صَلاَةً حَتىَّ مَضَى وَقْتُهَا ثُمَّ قَضَى عُذِّبَ فِى النَّارِ حُقْبًا وَالْحُقْبُ ثَمَانُوْنَ سَنَةً كُلُّ سَنَةٍ ثَلاَثمائة وَسِتُّوْنَ يَوْمًا كُلُّ يَوْمٍ اَلْفُ سَنَةٍ مِمَّا تَعُدُّوْنَ-

নবী (ছাঃ) বলেন, যদি কোন ব্যক্তি এক ওয়াক্ত ছালাত ছেড়ে দেয় আর ইতিমধ্যে ঐ ছালাতের ওয়াক্ত পার হয়ে যায় এবং ছালাত আদায় করে নেয় তবুও তাকে এক হুকবা জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে। এক হুকবা হ’ল ৮০ বছর। আর প্রত্যেক বছর ৩৬০ তিন। আর প্রত্যেক দিন এক হাযার বছর, যেভাবে গণনা করা হয়। উল্লেখ্য, উক্ত হিসাব অনুযায়ী সর্বমোট দুই কোটি অষ্টাশি লক্ষ বছর হয়।[7]

তাহক্বীক্ব : উক্ত বক্তব্যটি তাবলীগ জামা‘আতের অনুসরণীয় গ্রন্থ ফাযায়েলে আমল-এর ফাযায়েলে নামায অংশে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে কোন প্রমাণ পেশ করা হয়নি। বরং বলা হয়েছে,

 كَذَا فِىْ مَجَالِسِ الْأَبْرَارِ قُلْتُ لَمْ أَجِدْهُ فِيْمَا عِنْدِىْ مِنْ كُتُبِ الْحَدِيْثِ-

‘এভাবেই মাজালিসুল আবরারে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আমার নিকটে হাদীছের যে সমস্ত গ্রন্থ রয়েছে তার মধ্যে আমি উহা পাইনি’।[8] লেখক নিজেই যেহেতু স্বীকার করেছেন, সেহেতু আর মন্তব্যের প্রয়োজন নেই। দুঃখজনক হ’ল এরপরও তা রাসূল (ছাঃ) নামে বর্ণনা করা হয়েছে, যা তাঁর নামে মিথ্যা অপবাদের শামিল।

জ্ঞাতব্য : ছহীহ হাদীছের দৃষ্টিকোণ থেকেও কথাটি সঠিক নয়। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেন, ঘুম বা ভুলের কারণে যে ব্যক্তির ছালাত ছুটে যাবে তার কাফফারা হ’ল যখন স্মরণ হবে তখন তা পড়ে নিবে’।[9] এছাড়া রাসূল (ছাঃ) এবং ছাহাবায়ে কেরাম খন্দকের যুদ্ধের দিন সূর্য ডুবার পর আছরের ছালাত আদায় করেন অতঃপর মাগরিবের ছালাত আদায় করেন।[10] তাছাড়া ফজর ছালাতও একদিন তাঁরা সূর্য্যের তাপ বাড়ার পরে পড়েছেন।[11] তাহলে তাঁদের শাস্তি কত বছর হবে? (নাঊযুবিল্লাহ)।

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو بن العاص عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ ذَكَرَ الصَّلَاةَ يَوْمًا فَقَالَ مَنْ حَافَظَ عَلَيْهَا كَانَتْ لَهُ نُورًا وَبُرْهَانًا وَنَجَاةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمَنْ لَمْ يُحَافِظْ عَلَيْهَا لَمْ تَكُنْ لَهُ نُورٌ وَلَا بُرْهَانٌ وَلَا نَجَاةٌ وَكَانَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَعَ قَارُوْنَ وَفِرْعَوْنَ وَهَامَانَ وَأُبَيِّ بْنِ خَلَفٍ-

আব্দুল্লাহ্ ইবনু আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) একদিন ছালাতের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, যে ব্যক্তি ছালাতের সংরক্ষণ করবে ক্বিয়ামতের দিন তা তার জন্য জ্যোতি, প্রমাণ ও মুক্তির উপায় হবে। আর যে তার হেফাযত করবে না তার জন্য তা জ্যোতি, প্রমাণ ও মুক্তির উপায় হবে না। ক্বিয়ামতের দিন সে কারূন, ফেরআউন, হামান ও উবাই ইবনু খালাফের সাথী হবে।[12]

তাহক্বীক্ব : হাদীছটি যঈফ।[13] উক্ত হাদীছের সনদে ঈসা ইবনু হে’লাল ছাদাফী নামক একজন দুর্বল রাবী আছে।[14] উল্লেখ্য, উক্ত হাদীছকে মিশকাতে ছহীহ বলা হ’লেও চূড়ান্ত তাহক্বীক্বে যঈফ প্রমাণিত হয়েছে।[15]

عَنْ أَنَسٍ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنَ تَرَكَ الصَّلاَةَ مُتَعَمِّدًا فَقَدْ كَفَرَ جِهَارًا-

আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ছালাত ছেড়ে দিল সে যেন প্রকাশ্য কুফুরী করল।[16]

তাহক্বীকব : হাদীছটি যঈফ।[17] ইমাম তাবারাণী হাদীছটি যঈফ হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, আবূ জাফর রাযী থেকে হাশেম বিন কাসেম ছাড়া কেউ হাদীছটি বর্ণনা করেননি। মুহাম্মাদ ইবনু আবূদাঊদ তার থেকে এককভাবে বর্ণনা করেছে।[18]

الصَّلاَةُ عِمَادُ الدِّيْنِ فَمَنْ أَقَامَهَا فَقَدْ أَقَامَ الدِّيْنَ وَمَنْ هَدَمَهَا فَقَدْ هَدَمَ الدِّيْنَ-

‘ছালাত হ’ল দ্বীনের খুঁটি। সুতরাং যে ব্যক্তি ছালাত কায়েম করল সে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করল। আর যে ব্যক্তি ছালাত ছেড়ে দিল দ্বীনকে ধ্বংস করল’।[19]

তাহক্বীক্ব : সমাজে হাদীছটির সমধিক প্রচার থাকলেও হাদীছটি গ্রহণযোগ্য নয়। ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, এটি বাতিল ও মুনকার।[20]

ছালাত পরিত্যাগকারীর হুকুম :

ছালাত পরিত্যাগকারীর জন্য ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করছে। কারণ আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য। আর শ্রেষ্ঠ ও প্রধান ইবাদত হ’ল ছালাত। ছালাত পরিত্যাগকারীর জন্য আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূল (ছাঃ) কঠোর হঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَإِنْ تَابُوْا وَأَقَامُوا الصَّلاَةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّيْنِ-

‘সুতরাং তারা যদি তওবা করে, ছালাত কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে তবেই তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই (তওবা ১১)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,

فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلاَةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا-

‘তাদের পর আসল অপদার্থ পরবর্তীরা। তারা ছালাত নষ্ট করল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং তারা অচিরেই ধ্বংসে (জাহান্নামের গভীরে) পতিত হবে (মারইয়াম ৫৯)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘অপরাধীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমাদের কিসে সাক্বার জাহান্নামে নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে, আমরা ছালাত আদায়কারী ছিলাম না’ (মুদ্দাছি্ছর ৪১-৪৩)

উক্ত আলোচনা প্রমাণ করে ছালাত পরিত্যাগকারী ব্যক্তি মুসলিম ভাই হ’তে পারে না; বরং ছালাত ত্যাগ করার কারণে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। রাসূল (ছাঃ) আরো স্পষ্ট করে বলেন,

عَنْ جَابِرٍ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلاَةِ-

জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছা)-কে বলতে শুনেছি, ‘নিশ্চয়ই কোন ব্যক্তি আর মুশরিক ও কাফেরের মাঝে পার্থক্য হ’ল ছালাত পরিত্যাগ করা’।[21]

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ بُرَيْدَةَ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَلْعَهْدُ الَّذِيْ بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمْ الصَّلاَةُ فَمَنْ تَرَكَهَا فَقَدْ كَفَرَ-

আব্দুল্লাহ ইবনু বুরায়দা (রাঃ) তার পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমাদের ও তাদের (কাফের, মুশরিক ও মুনাফিক) মধ্যে যে অঙ্গীকার রয়েছে তা হ’ল ছালাত। সুতরাং যে ব্যক্তি ছালাত ছেড়ে দিবে সে কুফুরী করবে’।[22]

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ شَقِيْقِ الْعُقَيْلِيِّ قَالَ كَانَ أَصْحَابُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ يَرَوْنَ شَيْئًا مِنَ الْأَعْمَالِ تَرْكَهُ كُفْرٌ غَيْرَ الصَّلاَةِ-

আব্দুল্লাহ ইবনু শাক্বীক্ব উকায়লী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ আমল সমূহের মধ্যে কোন আমল ছেড়ে দেওয়াকে কুফুরী বলতেন না, ছালাত ব্যতীত।[23]

অতএব যে ব্যক্তি ছালাত আদায় করবে না সে নিঃসন্দেহে কুফুরী করবে। ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ ছালাত ছেড়ে দিলে বা অস্বীকার করলে সে ইসলাম থেকে যে বের হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।[24]

(৩) ছালাত মুমিনের জন্য মি‘রাজ বা নূর।

قَالَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ الصَّلاَةُ مِعْرَاجُ الْمُؤْمِنِ-

‘রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ছালাত মুমিনের মি‘রাজ’।[25]

তাহক্বীক্ব : উক্ত কথার পক্ষে কোন সনদ নেই। এটি ভিত্তিহীন ও বানাওয়াট।

عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصَّلاَةُ نُوْرُ الْمُؤْمِنِ-

আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘ছালাত মুমিনের নূর’।[26]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ। মুহাদ্দিছ হুসাইন সালীম আসাদ বলেন, উক্ত হাদীছের সনদ অত্যন্ত দুর্বল।[27] উক্ত সনদে ঈসা ইবনু মায়সারা নামে একজন দুর্বল রাবী আছে।[28] উল্লেখ্য, ছালাত নূর, ছাদাক্বা দলীল মর্মে ছহীহ মুসলিমে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা সঠিক।[29]

مَنْ صَلَّى صَلاَةَ الصُّبْحِ فِي الْجَمَاعَةِ فَكَأَنَّمَا حَجَّ مَعَ آدَمَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ خَمْسِيْنَ حَجَّةً وَمَنْ صَلَّى صَلاَةَ الظُّهْرِ فِي الْجَمَاعَةِ فَكَأَنَّمَا حَجَّ مَعَ نُوْحٍ عَلَيْهِ السَّلاَمُ أَرْبَعِيْنَ حَجَّةً أَوْ ثَلاَثِيْنَ إِلَى آخِرِهِ-

‘যে ব্যক্তি জামা‘আতের সাথে ফজরের ছালাত আদায় করে সে যেন আদম (আঃ)-এর সাথে ৫০ বার হজ্জ করে এবং যে ব্যক্তি যোহরের ছালাত জামা‘আতের সাথে পড়ে সে যেন নূহ (আঃ)-এর সাথে ৪০ কিংবা ৩০ বার হজ্জ করে। এভাবেই অন্যান্য ওয়াক্ত সে আদায় করে’।[30]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল বা মিথ্যা।[31]

عَنْ سَلْمَانَ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ مَنْ غَدَا إِلَى صَلَاةِ الصُّبْحِ غَدَا بِرَايَةِ الْإِيْمَانِ وَمَنْ غَدَا

إِلَى السُّوْقِ غَدَا بِرَايَةِ إِبْلِيْسَ-

সালমান ফারেসী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি ভোরে ফজরের ছালাতের দিকে গেল, সে ঈমানের পতাকা নিয়ে গেল। আর যে ভোরে (ছালাত আদায় না করে) বাজারের দিকে গেল, সে শয়তানের পতাকা নিয়ে গেল।[32]

তাহক্বীক্ব: উক্ত হাদীছের সনদ অত্যন্ত দুর্বল।[33] এর সনদে উবাইস ইবনু মাইমুন নামক রাবী রয়েছে। ইমাম বুখারীসহ অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ তাকে মুনকার রাবী বলে অভিযোগ করেছেন। ইবনু হিববান বলেন, সে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির নাম দিয়ে ধারণা পূর্বক বহু জাল হাদীছ বর্ণনা করেছে।[34]

عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ قَالَ سُئِلَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِنْ قَوْلِ اللهِ إِنَّ الصَّلاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ قال مَنْ لَمْ تَنْهَهُ صَلاَتُهُ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ فَلاَ صَلاَةَ لَهُ-

ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-কে একদা জিজ্ঞেস করা হ’ল আল্লাহর এই বাণী সম্পর্কে- ‘নিশ্চয়ই ছালাত অশ্লীলতা ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে’। তখন তিনি বললেন, যাকে তার ছালাত অশ্লীলতা ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে না, তার ছালাত হয় না।[35]

তাহক্বীক্ব : হাদীছটি যঈফ। উক্ত বর্ণনার সনদে ইবনু জুনাইদ নামে একজন মিথ্যুক রাবী রয়েছে। মুহাদ্দিছগণ বর্ণনাটিকে মুনকার বলেছেন।[36]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِي اللهُ تَعَالَى عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ لَمْ تَنْهَهُ صَلاَتُهُ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ لَمْ يَزْدَدْ مِنَ اللهِ إِلاَ بُعْدًا.

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যার ছালাত তাকে অশ্লীলতা ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে না তাকে উহা ইসলাম থেকে দূরে সরে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করে না না।[37]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি বাতিল বা মিথ্যা। এর সনদে লাইছ ইবনু আবী সালীম নামক ত্রুটিপূর্ণ রাবী রয়েছে।[38]

জ্ঞাতব্য : উক্ত বর্ণনাগুলো প্রমাণ করে ত্রুটিপূর্ণ কোন ব্যক্তি ছালাত আদায় করলে ছালাত কবুল হয় না। সুতরাং ছালাত আদায় করে কোন লাভ নেই। কিন্তু উক্ত ধারণা সঠিক নয়। বরং ছালাত আদায়ের মাধ্যমে এক সময় সে আল্লাহর অনুগ্রহে পাপ কাজ ছেড়ে দিবে। ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ إِنَّ فُلاَنًا يُصَلِّي بِاللَّيْلِ فَإِذَا أَصْبَحَ سَرَقَ قَالَ إِنَّهُ سَيَنْهَاهُ مَا يَقُوْلُ-

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বললেন, অমুক ব্যক্তি রাত্রিতে ছালাত আদায় করে আর সকাল হ’লে চুরি করে। তিনি উত্তরে বললেন, ছালাত তাকে অচিরেই তা থেকে বিরত রাখবে।[39]

[চলবে]


[1]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৪৭০৩; তিরমিযী হা/৪; মিশকাত হা/২৯৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৭৪, ২/৪৩; ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ৮৮।

[2]. যঈফুল জামে‘ হা/৫২৬৫; সিলসিলা যঈফাহ হা/৩৬০৯; যঈফ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২১২।

[3]. আবূদাঊদ হা/৬১; তিরমিযী হা/৩; মিশকাত হা/৩১২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৯১, ১/৫১।

[4]. سنده ضعيف فيه سليمن بن قرم عن أبى يحيى القتات وهما ضعيفان لسوء حفظهما -আলবানী, মিশকাত হা/২৯৪-এর টীকা দ্রঃ ১/৯৭ পৃঃ; শু‘আইব আরনাঊত্ব, তাহক্বীক্ব মুসনাদে আহমাদ হা/১৪৭০৩-এর আলোচনা দ্রঃ।

[5]. ছহীহ বুখারী ১/১৬৫ পৃঃ; হা/১২৩৭-এর পূর্বের আলোচনা দ্রঃ।

[6]. ছহীহ বুখারী হা/৫৮২৭, ২/৮৬৭ পৃঃ, ‘পোষাক’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৩; ছহীহ মুসলিম হা/২৮৩, ১/৬৬ পৃঃ, ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪২; মিশকাত হা/২৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৪, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৯; ছহীহ মুসলিম হা/১৫৬, ১/৪৫ পৃঃ, ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১২; মিশকাত হা/৩৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৫।

[7]. ফাযায়েলে আমল (উর্দূ), পৃঃ ৩৯; বাংলা, পৃঃ ১১৬।

[8]. ফাযায়েলে আমল (উর্দূ), পৃঃ ৩৯; বাংলা, পৃঃ ১১৬।

[9]. ছহীহ বুখারী হা/৫৯৭, ‘ছালাতের ওয়াক্ত সমূহ’ অধ্যায়, ‘যে ব্যক্তি ছালাত ভুল করে’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ মুসলিম হা/১৫৯২, ১৫৯৮, ১৬০০, ‘সমজিদ সমূহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫৬; মিশকাত হা/৬০৩, ৬৮৪।

[10]. ছহীহ বুখারী হা/৫৯৬ ও ৫৯৮, ‘ছালাতের সময়’ অধ্যায়, ‘ওয়াক্ত পার হয়ে যাওয়ার পর রাসূল (ছাঃ) জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায় করেছেন’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ মুসলিম হা/১৪৬২, ‘মসজিদ সমূহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩৭।

[11]. ছহীহ মুসলিম হা/১৫৯২, ১/২৩৮ পৃঃ, ‘মসজিদ সমূহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫৬; মিশকাত হা/৬৮৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৬৩৩, ২/২০৮ পৃঃ।

[12]. আহমাদ হা/৬৫৭৬; মিশকাত হা/৫৭৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫৩১, ২/১৬৪ পৃঃ।

[13]. যঈফ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৩১২; তারাজুউল আলবানী হা/২৯।

[14]. মিশকাত হা/৫৭৮, ১/১৮৩ পৃঃ।

[15]. তারাজুউল আলবানী হা/২৯।

[16]. তাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত হা/৩৩৪৮।

[17]. সিলসিলা যঈফাহ হা/২৫০৮ ও ৫১৮০; যঈফুল জামে‘ হা/৫৫২১; যঈফ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৩০৪।

[18].لم يروه عن أبي جعفر الرازي إلا هاشم بن القاسم تفرد به محمد بن أبي داود-আল-মু‘জামুল আওসাত হা/৩৩৪৮; সিলসিলা যঈফাহ হা/২৫০৮।

[19]. কাশফুল খাফা ২/৩২ পৃঃ; তাযকিরাতুল মাওযূ‘আত, পৃঃ ৩৮; ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ২৯।

[20]. কাশফুল খাফা ২/৩১ পৃঃ।

[21]. ছহীহ মুসলিম হা/২৫৬ ও ২৫৭, ১/৬১ পৃঃ, ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩৭; মিশকাত হা/৫৬৯।

[22]. তিরমিযী হা/২৬২১, ২/৯০ পৃঃ, ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘ছালাত ত্যাগ করা’ অনুচ্ছেদ; নাসাঈ হা/৪৬৩; ইবনু মাজাহ হা/১০৭৯; মিশকাত হা/৫৭৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫২৭, ২/১৬২ পৃঃ, সনদ ছহীহ।

[23]. তিরমিযী হা/২৬২২, ২/৯০ পৃঃ, ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘ছালাত’ পরিত্যাগ করা’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/৫৭৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫৩২, ২/১৬৪ পৃঃ, সনদ ছহীহ।

[24]. দেখুন: শায়খ আলবানী, হুকমু তারিকিছ ছালাহ, পৃঃ ৬।

[25]. তাফসীরে রাযী ১/২১৪ পৃঃ; তাফসীরে হাক্কী ৮/৪৫৩ পৃঃ; মিরক্বাতুল মাফাতীহ ১/১৩৪ পৃঃ, ‘ঈমান’ অধ্যায়।

[26]. মুসনাদের আবী ইয়ালা হা/৩৬৫৫; ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ২৯।

[27]. তাহক্বীক্ব মুসনাদে আবী ইয়ালা হা/৩৬৫৫।

[28]. সিলসিলা যঈফাহ হা/১৬৬০।

[29]. ছহীহ মুসলিম হা/৫৫৬, ১/১১৮ পৃঃ; মিশকাত হা/২৮১।

[30]. হাসান ইবনু মুহাম্মাদ আছ-ছাগানী, আল-মাওযূ‘আত হা/৪৮, পৃঃ ৪২।

[31]. আল-মাওযূ‘আত হা/৪৮, পৃঃ ৪২।

[32]. ইবনু মাজাহ হা/২২৩৪, ‘ব্যবসা’ অধ্যায়, ‘বাজার সমূহ’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/৬৪০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫৮৯, ২/১৮৯ পৃঃ।

[33]. যঈফ ইবনে মাজাহ হা/২২৩৪।

[34]. মিশকাত হা/৬৪০-এর টীকা দ্রঃ।

[35]. তাফসীরে ইবনে কাছীর; সিলসিলা যঈফাহ হা/৯৮৫; ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৭২।

[36]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৯৮৫।

[37]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৭৩; তাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/১০৮৬২।

[38]. সিলসিলা যঈফাহ হা/২, ১/৫৪ পৃঃ।

[39]. আহমাদ হা/৯৭৭৭; মিশকাত হা/১২৩৭, সনদ ছহীহ।






দাঈদের পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমাজে তার প্রভাব - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আশূরায়ে মুহাররম - আত-তাহরীক ডেস্ক
ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
অশ্লীলতার পরিণাম ঘাতক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব - লিলবর আল-বারাদী - যশপুর, তানোর, রাজশাহী
নেতৃত্বের মোহ - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
গীবত : পরিণাম ও প্রতিকার (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
প্রাক-মাদ্রাসা যুগে ইসলামী শিক্ষা - আসাদুল্লাহ আল-গালিব (শিক্ষার্থী, ইংরেজী বিভাগ, ২য় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
দাওয়াত ও সংগঠন (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আল্লাহর প্রতি ঈমানের স্বরূপ (তৃতীয় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
মানুষকে কষ্ট দেওয়ার পরিণতি - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
নববী চিকিৎসা পদ্ধতি (৪র্থ কিস্তি) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আরও
আরও
.