ইংরেজীতে একটা প্রবাদ আছে, ‘কাট ইওর কোট অ্যাকোরডিং টু ইওর ক্লোথ’। অর্থাৎ আয় বুঝে ব্যয় কর। যারা আয় বুঝে ব্যয় করে না তাদের বিপদ আসন্ন। যেমন অতিরিক্ত  অর্থ ব্যয় করা ঠিক নয়, তেমন কৃপণতাও কাম্য নয়। আয় বুঝে ব্যয় না করলে নিস্ব হ’তে হয়, এরূপ একটা গল্প উপস্থাপন করব।

জনৈক ব্যক্তি অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিল। সে আরাম আয়েশপূর্ণ জীবন-যাপন করত। একদা তার জীবনের ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে সে তার জীবনী এভাবে শোনাল।-

আমি পৈত্রিক সূত্রে অনেক ধন-সম্পদের মালিক হয়েছিলাম এবং আমি তা বেহিসাব খরচ করতে থাকলাম। অল্পদিনের মধ্যেই সমস্ত সম্পদ নিঃশেষ হয়ে গেল। অবস্থা এমন হ’ল যে, আমার বাড়ি-ঘর সব বিক্রি করে দিলাম। আমার হাতে তেমন কিছু আর অবশিষ্ট ছিল না, যা আমি বিক্রি করে পরিবারের খরচ বহণ করব। এমন কোন কৌশলও অবলম্বন করতে পারলাম না, যার মাধ্যমে সম্পদ সঞ্চয় করা যায়। দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমার মা ও আমার স্ত্রী সুতা কেটে আমাদের পরিবারের খরচ চালান। কিন্তু তাদের উপার্জনে আমাদের জীবন পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। কারণ আমরা অভিজাত জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলাম।

আমি একজন যুবক ছিলাম। বেকারত্বের কারণে আমি খুব কোনঠাসা হয়ে পড়লাম। আমি এক রাতে স্বপ্নে দেখলাম যে, এক ব্যক্তি আমাকে বলছে, তুমি মিশর যাচ্ছ না কেন? সেখানে গিয়ে তোমার ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখ। হ’তে পারে সেখানে তোমার জন্য রিযিকের দরজা খুলে যাবে। সকালে উঠে আমি স্বপ্নের বিষয়টি চিন্তা করে সেটিকে গায়েবী পরামর্শ মনে করে মিসর যাওয়ার প্রস্ত্ততি নিতে লাগলাম। আমার কাছে কোন পরিচয় পত্র থাকা আমি ভাল মনে করলাম। যার মাধ্যমে ঐ অপরিচিত স্থানে আমি পরিচিত হ’তে পারব। তাই আমি কাযী আবু ওমর নামে এক ব্যক্তির নিকট  গেলাম এবং তাকে স্বীয় পিতার বন্ধুত্বের পরিচয় তুলে  ধরে বললাম, মিসরের কাযীর নিকট আমার জন্য একটি পত্র লিখে দিন যার মাধ্যমে আমি মিসর পৌঁছতে পারি।

পত্রটা নিয়ে মিসর রওয়ানা হ’লাম। সেখানে পৌঁছে আমি পত্রটি প্রশাসনকে দেখালাম। কিন্তু এতে কোন ফায়েদা হ’ল না। কেউ আমাকে পাত্তা দিল না। আমি অত্যন্ত পেরেশান হ’লাম। তার উপর এ দীর্ঘ সফর। এরও কোন ফায়েদা হ’ল না। এ থেকে নিজের দেশ কতই না উত্তম ছিল। সময় খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছিল। আমার সাথে যতটুকু সম্বল ছিল তাও শেষ হয়ে গেল। ভিক্ষা করার পারিস্থিতি দেখা দিল। ভাবলাম ভিক্ষা চাইতে শুরু করি। কিন্তু এ কাজ করতে মন চাচ্ছিল না। এদিকে পেটে ভীষণ ক্ষুধা। আমি অপারগ হয়ে গেলাম। ভাবলাম যে, ঠিক আছে রাতে ভিক্ষা করব, রাতে বের হ’লাম। কিন্তু ভিক্ষা করার পদ্ধতিও আমার জানা ছিল না। তবে চেহারায় এবং পোশাক-পরিচ্ছদে ফকীরের ছাপ ছিল। কেউ আমার প্রতি অনুগ্রহ পরায়ণ হ’ল না।

রাত গভীর হয়ে গেল, রাস্তায় কিছু কিছু লোক তখনও চলাচল করছিল। হঠাৎ করে আমি পুলিশের দৃষ্টিতে পড়ে গেলাম। তারা আমাকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। আমি ভিনদেশি হওয়ায় তাদের সন্দেহ আরো গভীর হ’ল। পুলিশ আমাকে মারতে শুরু করল। আমি যন্ত্রণায় চিৎকার শুরু করলাম। কিন্তু পুলিশকে কে বাঁধা দিবে? আমি পুলিশকে বললাম, স্যার আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনাদের সকল সত্য কথা বলছি। পুলিশ আমাকে সব কথা বলার অনুমতি দিল। আমি তখন তাদেরকে বাগদাদ থেকে মিসর আসার ঘটনা শোনালাম। আমি আমার স্বপ্নের কথা বললাম এবং তার কারণে এসেছি এটাও জানালাম। কিন্তু এখানে কিছু পেলাম না।

পুলিশ অফিসার বললেন, আমি তোমার চেয়ে বড় আহমক কখনও দেখি না। আল্লাহর কসম! আমি অমুক বছর স্বপ্নে দেখেছিলাম যে, এক ব্যক্তি আমাকে বলছে, বাগদাদের অমুক রাস্তার অমুক মহল্লায় এক ব্যক্তির বাড়ি আছে। সেখানে পূর্ব পুরুষেরা অনেক সম্পদ পুঁতে রেখেছে। পুলিশ অফিসার আমার বাড়ির কথা এবং আমার দাদার নাম উলে­খ করলেন। তিনি আরো বললেন, সেখানে একটি বাগিচা ও একটি বরই গাছ ছিল। ঐ বরই গাছের নীচে তেত্রিশ হাযার দীনার পুঁতে রাখা আছে। তুমি গিয়ে তা নিয়ে আস। আমি এ স্বপ্নের প্রতি মোটেও  কর্ণপাত করিনি। না এ ব্যাপারে কোন চিন্তা-ভাবনা করেছি। কিন্তু হে আহমক! তুমি কত বড় গাধা, একটি স্বপ্নের উপর ভিত্তি করে নিজের দেশ ছেড়ে মিসর চলে এসেছ?

আমি তাকে বললাম না যে, যে বাড়ি এবং বরই গাছের স্বপ্ন আপনি দেখেছেন, তা আমারই বাড়ি। আমি তার কথা স্মরণ রাখলাম, আমাকে দেখে তার দয়া হ’ল, তাই সে আমাকে ছেড়ে ছিল। পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আমি সোজা এক মসজিদে গিয়ে উঠলাম। ওখানে রাত কাটিয়ে প্রভাতে  স্বদেশ যাওয়ার জন্য প্রস্ত্ততি নিলাম।

ঘটনাচক্রে ওখান থেকে এক কাফেলা বাগদাদে যাচ্ছিল, আমি তাদের সাথে মিলিত হ’লাম। পথিমধ্যে আমি কাফেলার লোকদের খেদমত করে বাগদাদে পৌঁছে গেলাম, বাড়িতে পৌঁছে আমি মিসরী পুলিশের স্বপ্নকে বাস্তবে পেলাম। আমি ঐ সম্পদকে গণীমত মনে করে খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে তা থেকে খরচ করতে থাকলাম। ব্যবসা করলাম। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যথেষ্ট বরকত দান করেছেন। এসবই ঐ ব্যবসার ফল।

* আব্দুর রহীম

গবেষণা সহকারী, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।






আরও
আরও
.