যে কোন আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার শর্ত হ’ল তিনটি : (১) আক্বীদা বিশুদ্ধ হওয়া (২) তরীকা সঠিক হওয়া এবং (৩) ইখলাছে আমল অর্থাৎ কাজটি নিঃস্বার্থভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তে হওয়া (যুমার ৩৯/২)

সৎ কাজের মধ্যে লৌকিকতা আসলে সেটি আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। এজন্য হাদীছে রিয়া বা লোক দেখানো আমলকে ছোট শিরক বলা হয়েছে (আহমাদ হা/১৯৬২২; ছহীহ তারগীব হা/৩৬)। এ মর্মে নিম্নে একটি গল্প পেশ করা হ’ল-

পুত্র : আপনি দাতা সংস্থায় যে অর্থ দান করেছেন, তা থেকে আমরা জনগণকে দান-ছাদাক্বা করেছি। যখন তারা আমাকে দাতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল, তখন আমি আপনার নাম বলেছি।

পিতা : বেটা, আমি কি তোমাকে এ নির্দেশ দেইনি যে, মানুষকে অর্থ দিয়ে দানকারীকে কেউ চিনে ফেলার পূর্বেই সেখান থেকে প্রস্থান করবে?

পুত্র : আববা, আমি ভাবলাম দাতা ও পরহেযগার ব্যক্তি হিসাবে সমাজে আপনার নামটা ছড়িয়ে পড়ুক। আর লোকজন আপনার কাছ থেকে বদান্যতা ও দানশীলতার তা‘লীম গ্রহণ করুক।

পিতা : বৎস, যে রিয়া (লৌকিকতা) সমস্ত নেকী ও সৎ আমলকে নস্যাৎ করে দেয়, সে রিয়াকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিতে পারি না।

পুত্র : আপনাকে কে বলেছে যে, আল্লাহর দেয়া মাল থেকে আপনি দান-ছাদাক্বা করবেন আর তা রিয়া বা লোক দেখানো হবে? বরং আমি তো মনে করি আপনার দানশীলতা জনগণের মাঝে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। আর সেখান থেকে জনগণ উৎসাহিত হয়ে আরো বেশী বেশী দান করবে। জাতির খেদমতে আপনার দরাজদিল মানসিকতা আরও প্রতিফলিত হবে। মানবতার কল্যাণে সদাজাগ্রত পেŠরুষ, সুখ্যাতি ও আপনার হৃদয়ে লুক্কায়িত ও লালায়িত স্বপ্নের মডেল হয়ে জাতির মাঝে আপনি সদা-সর্বদা সম্মানিত ও বরিত হবেন।

পিতা : আল্লাহর কসম করে বলছি, এটাই তো আসল রিয়া! তুমি আমাকে ধ্বংস করে দিয়েছ, তুমি আমাকে শেষ করে দিয়েছ। মহান আল্লাহর কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আল্লাহ! তুমি আমাকে মাফ কর। আমি তো এমনটি চাইনি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর।

পুত্র : আববা, আমি কিভাবে আপনার ক্ষতি করে ফেললাম? আমি তো শুধু আপনার কল্যাণই চেয়েছি। যদি নিয়ত ঠিক থাকে আর দুনিয়ার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কিছু থেকেই থাকে তাহ’লে সেটা আবার আল্লাহর ক্রোধের কারণ হ’তে যাবে কেন?

পিতা : যদি বান্দার কোন কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও খুলূছিয়াত না থাকে, তাহ’লে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার কোন কিছুই কবুল করেন না। কেন, তুমি কি শহীদ, আলেম ও দাতার হাদীছ শোননি, যাদেরকে তাদের অহংকারের কারণে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে?

পুত্র : আমি আশা করি, আপনার শিক্ষা ও পথনির্দেশ আমাকে ধন্য করবে। কেননা আপনার নছীহত ও পথর্নিদেশই পিপাসা নিবারণের সুমিষ্ট পানির চেয়েও অতীব প্রয়োজনীয় প্রেসক্রিপশন স্বরূপ, যা আমার জ্ঞানহীন তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের পিপাসা মিটাবে।

পিতা : একদিন রাসূল (ছাঃ)-এর চতুষ্পার্শ্বে বসা ছাহাবীগণ তাঁর হাস্যোজ্জ্বল সকালের শুভ্র চেহারার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাঁর জ্ঞানের প্রস্রবণ থেকে নিজেদের পিপাসার্ত অন্তরগুলোকে সিক্ত করছিলেন। এ সময়ে তিনি বলেন, ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম একজন শহীদকে দিয়ে বিচারকার্য শুরু করা হবে। একজন বললেন, শহীদের মাধ্যমে বিচারকার্য শুরু হবে কেন হে আল্লাহর রাসূল? আমরা আপনার কাছ থেকেই তো শহীদের সুউচ্চ মর্যাদার কথা শুনেছি, আর আপনি তো আমাদেরকে অনুরূপ শিক্ষাই দিয়েছেন।

রাসূল (ছাঃ) বলেন, হ্যাঁ তাকে দিয়েই...। মহান আল্লাহর কাছে একজন শহীদকে আনা হবে। অতঃপর তাকে আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মতসমূহ স্মরণ করানো হবে। জিজ্ঞাস করা হবে, দুনিয়াতে তুমি কি আমল করেছিলে? লোকটি বলবে, হে প্রতিপালক! আমি তোমার পথে লড়াই করেছি, জানবাজি রেখে হক্বের পতাকাকে উড্ডীন করেছি, বাতিল মত ও পক্ষকে প্রতিহত করে তোমার দ্বীনকে সমুন্নত করতে গিয়ে শহীদ হয়েছি।

তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। কিন্তু তুমি তো জিহাদ করেছ শুধুমাত্র এজন্য যে, মানুষ তোমাকে বীর বলবে। আর তোমার প্রাপ্য দুনিয়াতেই তুমি পেয়ে গেছ। আমার কাছে আগুন ছাড়া তোমাকে দেওয়ার মত কিছুই নেই। তুমি জান না বান্দার কোন কাজে খুলূছিয়াত ও আমার সন্তুষ্টি ছাড়া আমি তা কবুল করি না। (আল্লাহ বলবেন,) অপরাধীকে ধর। অতঃপর লোকটিকে টেনে-হেঁচড়ে অপমানিত-লাঞ্ছিত অবস্থায় উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

অতঃপর তিনি একজন আলেমের উদাহরণ পেশ করেন, যিনি নিজে ইলম শিখেছিলেন ও মানুষকে ইলম শিক্ষা দিয়েছিলেন। লোকজন তাঁর প্রশংসায় ছিল পঞ্চমুখ। তিনি তাদের মাঝে উঁচু দরের মানুষ বনে গেলেন। তিনি সুললিত কণ্ঠে উচ্চৈঃস্বরে তারতীল সহকারে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। আর মানুষ তার কণ্ঠে বিমুগ্ধ-বিমোহিত হয়ে যেত। জনগণ তাদের প্রিয় পাত্রকে বার বার পেতে চাইল। আর তিনিও তাদের ডাকে বার বার সাড়া দিতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেললেন। তবুও তিনি এ বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘনে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন, যা তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। মানুষ তার থেকে উপকৃত হ’ল। কিন্তু নিজে বিদ্যা শিক্ষা দেয়া-নেয়ার বদলে সুনাম-যশ, প্রতিপত্তি ও অঢেল সম্পদের দোলাচলে পড়ে আমলে ছালেহের সামান্যতম গুরুত্ব তার নিকটে আর বাকী রইল না।

আলেম ব্যক্তিকে ফেরেশতারা ক্বিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তা‘আলার নিকট দাঁড় করাবেন। তাকে আল্লাহ ছোট-বড় যাবতীয় নে‘মতের কথা স্মরণ করাবেন। লোকটি অকপটে আল্লাহ প্রদত্ত যাবতীয় নে‘মতের কথা স্বীকার করে নিবে। আল্লাহ তা‘আলা মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময় হওয়া সত্ত্বেও তাকে প্রশ্ন করবেন যে, তুমি দুনিয়ায় থাকতে আমার জন্য কি পাঠিয়েছ? তুমি দুনিয়ায় কি আমল করেছ? লোকটি বলবে, আমি ইলম অর্জন করেছি এবং তা অপরকে শিক্ষা দিয়েছি। তারতীলসহ সুললিত কণ্ঠে কুরআনও পড়েছি, এ সবই করেছি একমাত্র তোমাকে রাযী-খুশি করার জন্য, তোমার জান্নাত পাওয়ার জন্য। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি ইলম অর্জন করেছ মানুষ তোমাকে আলেম বলবে, সুমিষ্ট কণ্ঠে কুরআন পড়েছ, মানুষ ক্বারী বলবে এ জন্য। তুমি সুখ্যাতি অর্জন করেছিলে। মানুষের প্রশংসা তোমার চাওয়া ছিল। তারা তোমার সে আশা পূর্ণ করেছে। (তখন আল্লাহ ফেরেশতাদের বলবেন,) একে ধর, পাওড়াও কর। তাকে টেনে হেঁচড়ে মুখের উপর ভর দিয়ে অপমানিত-লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। অবশেষে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবীগণের সামনে একজন সম্পদশালী ব্যক্তির উদাহরণ পেশ করলেন। যাকে আল্লাহ অঢেল সম্পদ দিয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা তাকে অঢেল টাকা, দীনার, দিরহাম, সুউচ্চ প্রাসাদ, জমি-জমা, পশু সম্পদ সহ সর্বপ্রকার সম্পদের মালিক বানিয়েছিলেন। সে গরীব-দুঃখীদের প্রচুর দান করত। মানুষের মাঝে পরহেযগার দানবীর হিসাবে তার সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। পরহেযগার দানবীর পদবী তার আনন্দের কারণ হয়ে দাঁড়াল। সে আরো বেশী দান-খয়রাত করতে শুরু করল। কিন্তু সে তার অনুগত ব্যক্তিদের খোঁটাও দিত। প্রতিটি মজলিসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রত্যেকটি দানের সুনাম-সুখ্যাতি ও গুণকীর্তনের কোন কমতি ছিল না।

দানবীরকে মহান আল্লাহর নিকটে ফেরেশতারা নিয়ে আসবেন। তাকে আল্লাহ তা‘আলা ধন-সম্পদের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। সে আল্লাহর অনুগ্রহের স্বীকৃতি দিবে।

তাকে বলা হবে, আমি তোমাকে ধন-সম্পদ দিয়েছিলাম, তা থেকে তুমি কি পরিমাণ দান-খয়রাত করেছ? লোকটি বলবে, হে প্রতিপালক! তোমার পসন্দনীয় এমন কোন পথ বা ক্ষেত্র নেই, যেখানে আমি দান করিনি। আর আমি যাবতীয় সম্পদ ব্যয় করেছি শুধুমাত্র তোমার সন্তুষ্টির জন্য। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ।

বরং তুমি এজন্যই ধন-সম্পদ ব্যয় করেছ যে, লোকেরা তোমাকে বলুক ‘সম্মানিত দানবীর’। সে উপাধিতো তুমি পেয়েই গেছ। আমার নিকট তোমার কিছু প্রাপ্য বাকী আছে কি? যে ব্যক্তি প্রশংসা, সুখ্যাতি-সুনাম শুনতে চায়, তাকে আল্লাহ তা‘আলা তা শুনিয়ে দেন এবং যে রিয়ার পথ অন্বেষণ করে অবশেষে সে তাই-ই পায়, যার জন্য সে অপেক্ষমাণ। (আল্লাহ বলবেন) তাকে ধর এবং জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাও।

শাস্তির ফেরেশতা তাকে টানতে টানতে মুখের উপর ভর দিয়ে লাঞ্ছিত, অপদস্থ অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। (মুসলিম হা/১৯০৫; মিশকাত হা/২০৫-এর আলোকে)

হাদীছটি শুনানোর পর পিতা কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। দেখতে লাগলেন পুত্রের প্রতিক্রিয়া। তিনি তার পুত্রকে চিন্তিত ও শংকিত, হতবিহবল ও নিশ্চুপ দেখলেন; তার মাথায় যেন পাখি বসে আছে।

অতঃপর তাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে বৎস! এতক্ষণে বুঝলে তো আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার জন্য কেমন রিয়ামুক্ত বিশুদ্ধ আমল হওয়া চাই? শুনলে তো লোক দেখানো আমলকারীদের পরিণতি? বিজ্ঞ পিতার প্রজ্ঞাপূর্ণ দিক নির্দেশনামূলক উত্তরে ছেলে নিশ্চুপ, নির্বাক...।







বিষয়সমূহ: আমল
আরও
আরও
.