বাদশাহ মালিক শাহ সালজুকী* রাজধানী নিশাপুরে অবস্থান করছিলেন। তখন মহিমান্বিত রামাযান মাসের বিদায় নেবার পালা। রামাযান শেষে তিনি রাজ্যের সর্বত্র পরিদর্শনের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। তার ইচ্ছা ছিল যে, তিনি ঈদের পরেই সফরে বের হবেন। সুতরাং ২৯শে রামাযানে তিনি তার মন্ত্রীবর্গ ও সাথীদের নিয়ে চাঁদ দেখতে বের হ’লেন। কিছু আমলা হৈচৈ শুরু করে দিল- ‘চাঁদ উঠেছে, চাঁদ উঠেছে’ বলে। যদিও বাদশাহ ও তার দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ চাঁদ দেখেননি। কিন্তু বাদশাহর অভিপ্রায় জেনে সবাই আগামী কাল ঈদের ঘোষণা দিল।

ইমামুল হারামাইন আবুল মা‘আলী তদানীন্তন নিশাপুরের প্রধান মুফতী ও বিচারপতি ছিলেন। তিনি আগামীকালের ঈদের কথা জানতে পেরে সারা দেশে ঘোষণা করে দিলেন- আগামী কাল পর্যন্ত রামাযান মাস। সুতরাং যে রাসূলের সুন্নাতের অনুসরণ করতে চায় সে যেন অবশ্যই আগামীকাল ছিয়াম পালন করে।

ঈদের আনন্দে নিশাপুরবাসী যখন ফূর্তিতে মত্ত ছিল, ঠিক সেই সময় ইমামুল হারামাইনের ঘোষণায় তারা অভিভূত হ’ল। বাদশাহর নির্দেশমত আগামীকাল যদি ঈদ না হয়, তবে সেটা বাদশার জন্য অপমানজনক হবে। সুলতান বদমেজাযী ছিলেন না। তাই ইমামুল হারামাইনের ঘোষণায় দুঃখিত হওয়া সত্ত্বেও নির্দেশ দিলেন, তাকে সসম্মানে রাজদরবারে হাযির করা হোক। দুষ্ট প্রকৃতির মন্ত্রীরা বাদশাহকে ক্ষেপাবার জন্য বলল, যে ব্যক্তি বাদশাহর নির্দেশ অমান্য করে, সে কখনো সম্মানের পাত্র হ’তে পারে না।

বাদশাহ মুফতী ছাহেবের প্রতি রাগান্বিত হ’লেও ধৈর্যের সাথে রাগ দমন করে বললেন, আমি তাঁর সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে চাই। প্রকৃত বিষয় না জেনে কোন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিকে অসম্মান করা মোটেও সমীচীন নয়। বিচারপতির নিকট শাহী পয়গাম পাঠানো হ’ল। বিচারপতি পয়গাম পেয়ে মনে করলেন, দরবারী পোশাক পরতে গেলে হয়তবা দেরী হয়ে যাবে। তাই তিনি যে পোশাকে ছিলেন ঐ পোশাকেই রাজদরবারে রওনা হ’লেন।

দরবারের প্রধান ফটকে তাকে বাধা দেওয়া হ’ল। কারণ সাধারণ পোশাকে রাজসভায় প্রবেশ নিষেধ। ঐদিকে হিংসুটে লোকেরা বাদশাকে উসকে দিয়ে বলল, এ ব্যক্তি আপনার হুকুম অমান্য করেছে। আবার সাধারণ পোশাকে রাজদরবারে এসে আপনার সাথে বেয়াদবী করেছে। বাদশাহর মেজায আরো বিগড়ে গেল। তবুও তিনি বিচারপতিকে শাহীমহলে আসার অনুমতি দিলেন। বিচারপতি ভিতরে প্রবেশ করা মাত্রই তাকে প্রশ্নের বান নিক্ষেপ করে বললেন, এ অবস্থায় আপনি কেন আসলেন? দরবারী পোশাক পরেননি কেন?

এবার বিচারপতি আবুল মা‘আলী নিঃসঙ্কোচে উত্তর দিলেন, হে বাদশাহ! এখন আমি যে পোশাক পরে আছি, তাতেই আমি ছালাত আদায় করি, যা শরী‘আতে জায়েয। সুতরাং যে পোশাকে আমি বিশ্বচরাচরের রাজাধিরাজ মহান আল্লাহর দরবারে হাযির হ’তে পারি, সে পোশাকে আপনার দরবারে আসা কি অন্যায়? তবে হ্যাঁ! নিয়ম অনুযায়ী এ পোশাক দরবারী নয় বলে এটা শিষ্টাচারের বহির্ভূত নয়। কারণ আমি ভেবেছি, দেরীতে আসলে আমার দ্বারা মুসলিম বাদশাহর নির্দেশ লঙ্ঘন না হয়ে যায় এবং ফেরেশতারা যেন আমার নাম নাফরমানদের খাতায় না লিখে নেন। এজন্য আমি যে অবস্থায় ছিলাম সে অবস্থায় চলে এসেছি।

বাদশা বললেন, যদি ইসলামী বাদশার আনুগত্য করা অবশ্য কর্তব্য হয় তাহ’লে আমার নির্দেশের বিপরীতে ঘোষণা দেওয়া হ’ল কেন?

বিচারপতি বললেন, যেসব বিষয়ের নির্দেশ বাদশাহর উপর ন্যাস্ত, সেসব ব্যাপারে বাদশার আনুগত্য করা আবশ্যক। কিন্তু যেসব বিষয় ফৎওয়ার উপর নির্ভরশীল, তা অবশ্যই পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মানদন্ডে হ’তে হবে। সুতরাং বাদশাহ হোক বা অন্য কেউ হোক আমার কাছে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল এবং শাহী নির্দেশ শারঈ বিধান অনুযায়ী হওয়া আবশ্যক ছিল।

প্রধান বিচারপতি মুফতী আবুল মা‘আলীর বক্তব্য শুনে বাদশার রোষের অনল নিভে গেল। ইমাম ছাহেবের দৃঢ়চিত্ত্বতা ও সাহসিকতার পরশে বাদশার হৃদয় মালঞ্চে খুশি ও প্রীতির ফুল ফুটল। তিনি ইমাম ছাহেবের সাথে আলিঙ্গন করলেন এবং ঘোষণা দিলেন, আমি যে নির্দেশ দিয়েছিলাম, তা ভুল ছিল। প্রধান বিচারপতির ফায়ছালা সঠিক।

পরিশেষে বলা যায়, আলেম-ওলামা যদি সততা ও মুহাম্মাদী আদর্শের উপর অবিচল থাকেন, তাহ’লে সরকার তাকে সম্মান করতে বাধ্য হবে। এই ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হ’ল-

১. যিনি যত বড় দ্বায়িত্বশীল, তাকে তত বেশী ধৈর্যশীল হ’তে হয়। বিশেষ করে কোন রাষ্ট্রে ইনছাফ প্রতিষ্ঠা করতে হ’লে সরকারকে অবশ্যই ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে। ধৈর্যহীন ব্যক্তি রাষ্ট্রের বা দলের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য নয়।

২. সরকারের সাথে সব সময়  একদল ধূর্ত ও চাটুকার লোক থাকে, যারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নীতিবান মানুষের গলায় অপবাদের কৃপাণ চালাতেও কুণ্ঠাবোধ করে না।

৩. কোন বিষয়ে পরিষ্কারভাবে অবগত না হয়ে যে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া আদৌ কোন আদর্শ শাসকের পরিচয় নয়।

৪. দেশের আলেম-ওলামা সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী।

৫. সরকারের শরী‘আত বিরোধী কোন নির্দেশ মানতে জনগণ বাধ্য নয়।

* মালিক শাহ সুলতান আরসালান সালজুকীর পুত্র ছিলেন। তিনি ১০৭৩ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহন করেন। নিশাপুর এ রাজ্যের রাজধানী ছিল। বাগদাদ, হারামাইন শরীফাইন এমনকি বায়তুল মাক্বদিসেও তার নামে খুৎবা পড়া হ’ত। তিনি ১৫ শাওয়াল ৪৮৮ হিজরী মোতাবেক ১৮ নভেম্বর ১১০৯ খ্রীষ্টাব্দে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর মাধ্যমেই সালজুকী রাজত্বের অবসান ঘটে।

আব্দল্লাহ আল-মারূফ

আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।






সর্বস্ব হারিয়েও সতীত্ব রক্ষা
নিয়তি - মুহাম্মাদ আতাউর রহমান
মাদক মামলার এক আসামীর গল্প - মতীউর রহমান, মেহেরপুর।
মৃত্যু যাত্রায় কেউ আমাদের সাথী হবে কি? - আনাস বিন আমানুল্লাহ, নওদাপাড়া, রাজশাহী
দুরন্ত সাহসের এক অনন্য কাহিনী - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
নিঃসঙ্গ - আত-তাহরীক ডেস্ক
এক নির্ভীক স্কুল ছাত্রীর গল্প - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
পাপী ব্যক্তি তার পাপের শাস্তি পাবে - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ছাদাক্বার মাধ্যমে রোগের চিকিৎসা - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
বিপদের সময় আল্লাহর নিকট সুপারিশ - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
সময়ের কাজ সময়ে করতে হয় - আত-তাহরীক ডেস্ক
পর্দার বিধান পালন না করার পরিণতি - উম্মে হাবীবা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আরও
আরও
.