গল্পটি মিসরের বিখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক উসামা গরীবের। তিনি লিখেছেন, লন্ডনে থাকা অবস্থায় একদিন আমার জুতার হিল ভেঙে যায়। এমতাবস্থায় আমি হাঁটতে কষ্ট পাচ্ছিলাম। তখন আমার বন্ধু আমাকে একটি ছোট্ট দোকানে নিয়ে গেল, যেখানে একজন মুচি কাজ করছিল। আমি সেই যুবকের সাথে পরিচিত হ’লাম। তার নাম ছিল প্যাট্রিক। সে আমার দেশ মিসরকে খুব ভালোবাসত।
এর কিছুদিন পর আমি মিসরে ফিরে আসি। কয়েক বছর পর ঘটনাচক্রে একদিন আমার সেই মুচির সাথে এমন এক স্থানে দেখা হয়ে গেল, যা আমি কল্পনাও করিনি। আমার এক বন্ধুর ছেলে কায়রোর এক বিদেশী স্কুলে পড়াশোনা করত। আমি তার সাথে একদিন সেই স্কুলে গেলাম। স্কুলের প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখি একজন শিক্ষক এক কোণে দাঁড়িয়ে মনের আনন্দে ধূমপান করছেন। একজন শিক্ষক কিভাবে শিক্ষার্থীদের সামনে ধূমপান করতে পারেন! বিষয়টি আমাদের কাছে খুবই বিব্রতকর মনে হ’ল। আমরা তাকে তিরস্কার করার জন্য এগিয়ে গেলাম। কিন্তু লোকটির কাছে গিয়ে আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। কারণ লোকটি আর কেউ নয়। সেই লন্ডনের প্যাট্রিক, যে একদিন আমার জুতা ঠিক করেছিল।
আমি তার কাছে গিয়ে তিরস্কারের পরিবর্তে শুভেচ্ছা জানালাম। শুরুতে আমাকে চিনতে না পারলেও যখন আমি তাকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে আমার জুতা মেরামতের কথা স্মরণ করালাম, তখন সে আমাকে চিনল এবং জড়িয়ে ধরল। অতঃপর সে তার মিসর ভ্রমণের দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণের কাহিনী বলল। আর শিক্ষকতায় যোগ দিয়ে এখানে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার বিস্ময়কর ঘটনাও জানালো।
প্যাট্রিক নিজের অতীতকে অস্বীকার করেনি। সে অকপটে স্বীকার করল যে সে ‘মোজলি’ স্ট্রিটের পাশে সেই ছোট্ট দোকানের মুচি। সে মিসরে ভ্রমণের জন্য আসলে স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় স্কুল কর্তৃপক্ষ তার সাথে সাক্ষাৎ করে এবং তাকে শিক্ষক হিসাবে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। প্রথমে সে বিষয়টি অস্বীকার করে এবং বোঝায় যে, সে তার দেশে যথেষ্ট শিক্ষার্জন করেনি এবং শিক্ষাদানের জন্য কোন প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেনি। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে আশ্বস্ত করে যে, আরব দেশগুলোতে শিক্ষকতার জন্য এসব প্রয়োজন হয় না। বরং তার মাতৃভাষা ইংরেজী এটাই যথেষ্ট, এমনকি সে যদি মুচিও হয়।
শিক্ষকতার শুরুতে সে দ্বিধায় ছিল এবং নিজের ব্যর্থ হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত ছিল। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে উৎসাহিত করে। এমনকি অভিভাবকেরাও তার কাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। ধীরে ধীরে সেও নিজেকে একজন ভালো শিক্ষক বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে।
প্যাট্রিক আরও জানায়, মিসর এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর উচ্চবিত্ত স্কুলগুলো তার মতো মুচি, ট্যাক্সিচালক এবং দারোয়ানদের দিয়ে ভরে গেছে। তার স্ত্রীও কিছুদিন তার সঙ্গে একই স্কুলে কাজ করেছিল। পরবর্তীতে সে আরবের আরেকটি দেশে একটি আন্তর্জাতিক স্কুলে বিপুল বেতনে চাকুরী পায়।
আমি তাকে স্কুলের ভিতরের ধূমপান করার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। সে লজ্জিত হয়ে জানাল যে, শুরুতে সে স্কুলের ভিতরে ধূমপান এড়িয়ে চলত। কিন্তু পরে দেখে যে, স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ অন্য শিক্ষকরাও ধূমপান করেন। তখন সেও ধূমপান শুরু করে।
প্যাট্রিক মিসরের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে ভুলল না। সে বলল, তোমাদের এই দেশ প্রতিটি সোনালী চুলওয়ালা ইউরোপীয়কে একেকজন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মনে করে। এখানে তাদের কাজের কোন জবাবদিহিতা থাকে না। বরং তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য সবাই সচেষ্ট থাকে। তাদের নিকট থেকে একটি প্রশংসাপত্র পেলে মনে করে যে, সে একজন ভালো ছাত্র। আমি তাকে হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, একজন মুচি থেকে শিক্ষক হওয়া ব্যক্তির কাছ থেকেও সার্টিফিকেট চাওয়া হয়? সে হাসতে হাসতে উত্তর দিল, এই তো তোমার দেশ, বন্ধু!
শিক্ষা : গল্পের কাহিনীটি দু’টি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। (১) প্যাট্রিকের জীবনের বিস্ময়কর পরিবর্তন, যা সে কখনো কল্পনাও করেনি। কিন্তু পরিশ্রম ও ভাগ্য তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। (২) মিসরের জরাজীর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা, যা কেবল মিসর নয়। বরং আধুনিক বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়া পরনির্ভরশীল সকল মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে। আমরা অনেক সময় নিজেদের যোগ্য ও দক্ষ কর্মীদের তুলনায় বিদেশীদের অগ্রাধিকার দেই। নিজেদের মাতৃভাষাকে অবহেলা করি ও আধো আধো ইংরেজী বলাকেও স্মার্টনেস মনে করি। ইসলামের সুমহান আদর্শে অটল থাকার পরিবর্তে ইংরেজদের নগ্ন সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে চলাকে আধুনিকতা বলে বিশ্বাস করি। যা আমাদের দক্ষ জনশক্তি ও আত্মমর্যাদাশীল উন্নত রাষ্ট্র গঠনে প্রতিবন্ধক।
মূল : মুহসিন জববার
অনুবাদ : নাজমুন নাঈম