পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ ।
ওমর (রাঃ) বিচারপতি শুরাইহ-এর নিকট লেখা পত্রে বলেছিলেন, اقْضِ بِمَا
فِي كِتَابِ اللهِ، فَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِي كِتَابِ اللهِ فَبِسُنَّةِ
رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِي
سُنَّةِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاقْضِ بِمَا
قَضَى بِهِ الصَّالِحُون ‘আল্লাহর কিতাব (কুরআন) মোতাবেক বিচার করবে।
আল্লাহর কিতাবে না পেলে রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ী বিচার করবে। রাসূলের
সুন্নাতে না পেলে সৎলোকদের নীতি অনুযায়ী বিচার করবে’।[1] ওমর (রাঃ) উম্মুল ওয়ালাদদের (মনিবদের ঔরসে যেসব দাসী সন্তান জন্ম দেয় তাদের উম্মুল ওয়ালাদ বলে) বিক্রি করতে নিষেধ করেছিলেন।[2] ছাহাবীগণ এ বিষয়ে তার অনুসরণ করেছিলেন। তিনি একত্রে প্রদত্ত তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন।[3]
ছাহাবীগণ তা মেনে নিয়েছিলেন। একবার তার স্বপণদোষ হয়েছিল। তখন আমর ইবনুল আছ
(রাঃ) তাকে বলেছিলেন, خُذْ ثَوْبًا غَيْرَ ثَوْبِك ‘আপনার কাপড় বদলে অন্য
কাপড় নিন’। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, لَوْ فَعَلْتُهَا صَارَتْ سُنَّةً ‘আমি
তা করলে সেটা সুন্নাতে পরিণত হয়ে যাবে’।[4] উবাই ইবনু কা‘ব ও আরও অনেক
ছাহাবী বলেছেন, مَا اسْتَبَانَ لَك فَاعْمَلْ بِهِ، وَمَا اشْتَبَهَ
عَلَيْك فَكِلْهُ إلَى عَالِمِه ‘যা তোমার নিকট স্পষ্ট হবে তদনুযায়ী আমল
করবে। আর যা তোমার কাছে অস্পষ্ট লাগবে তা জানার জন্য আলেমের দ্বারস্থ হবে’।[5]
ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় ফৎওয়া দিতেন। এটা নিশ্চিতই তাক্বলীদ। কেননা রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় তাদের কথা দলীল হ’তে পারে না। এদিকে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلاَ نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ- ‘আর মুমিনদের এটা সঙ্গত নয় যে, সবাই একত্রে (জিহাদে) বের হবে। অতএব তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে এবং ফিরে এসে নিজ কওমকে (আল্লাহর নাফরমানী হ’তে) ভয় প্রদর্শন করে, যাতে তারা সাবধান হয়’ (তওবা ৯/১২২)। এখানে আল্লাহ ফিরে আসা লোকেরা যে বিষয়ে সতর্ক করবে তা মেনে নেওয়া তাদের উপর ফরয করে দিয়েছেন। এটাই তো তাদের পক্ষ থেকে আলেমদের তাক্বলীদ।
ইবনু যুবায়ের (রাঃ) থেকে ছহীহ সূত্রে বর্ণিত আছে, তাকে দাদা ও ভাইদের মীরাছ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। উত্তরে তিনি তার নানা আবুবকরের প্রসঙ্গ তুলে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَوْ كُنْت مُتَّخِذًا مِنْ أَهْلِ الْأَرْضِ خَلِيلاً ‘ধরাপৃষ্ঠের অধিবাসীদের মধ্য থেকে যদি কাউকে আমি বন্ধু বানাতাম তবে তাকে (আবুবকরকে) বন্ধু বানাতাম’।[6] আবুবকর (রাঃ) দাদাকে মীরাছে পিতার স্থলাভিষিক্ত গণ্য করতেন। এতে স্পষ্টতই তিনি তার তাক্বলীদ করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করতে আদেশ দিয়েছেন। এভাবে সাক্ষীর সাক্ষ্য মানা তার তাক্বলীদ। শরী‘আত কায়েফ (পায়ের চিহ্ন দেখে যে মানুষ শনাক্ত করে। আবার ভাই কিংবা পিতার সাদৃশ্য থেকে ব্যক্তির পরিচয় চিহ্নিত করে), খারেছ (যে গাছে ঝুলে থাকা খেজুর কিংবা আঙ্গুর অনুমান করে পরিমাণ নির্ণয় করে থাকে), কাসেম (অনুমানে বণ্টনকারী), মুকাওবিম (জমি পরিমাপকারী) এবং মুহরিম অবস্থায় শিকারকারীর শিকারের সাদৃশ্য বিচারকারীদ্বয়ের কথা মেনে নেওয়ার কথা বলেছে। আর এটাতো নীরেট তাক্বলীদ।
মুসলিম
উম্মাহ অনুবাদকের অনুবাদ, দূতের বার্তা, পরিচয়দাতার করা পরিচয় এবং সাক্ষীর
ছাফাইদাতার কথা গ্রহণ করার উপর ইজমা করেছেন, যদিও তারা একজনের কথা যথেষ্ট
হবে কিনা তা নিয়ে মতানৈক্য করেছেন। এটাও তাদের নীরেট তাক্বলীদ।[7]
তারা গোশত, কাপড়, খাদ্যবস্ত্ত ইত্যাদি হালাল না হারাম তা জিজ্ঞেস না করেই শুধু মালিকদের কথার উপর ভরসা করে কেনার বৈধতার উপর ইজমা করেছে। আলিম ও মুজতাহিদ হতে গিয়ে সকলকেই যদি ইজতিহাদ করতে এবং জ্ঞানচর্চা করতে বাধ্য করা হয় তাহ’লে মানুষের মৌলিক প্রয়োজনগুলোই নস্যাৎ হয়ে যাবে এবং ক্ষেত-খামার, কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যাবে। শারঈভাবে এ পন্থা কখনই বিধেয় হ’তে পারে না। আর বাস্তবেও এ কথা মেনে নেওয়ার মত নয়।
বিয়ের পর কিছু মহিলা নববধুকে স্বামীর কাছে সপে দিয়ে যায়। এখন ঐ মহিলাই যে তার স্ত্রী এবং স্ত্রী হিসাবে তার সাথে সে যে মেলামেশা করে তা সবই কিন্তু সে করে উক্ত মহিলাদের তাক্বলীদ সূত্রে। এই তাক্বলীদের উপরও লোকদের ইজমা রয়েছে।
তারা এসব
বিষয়েও ইজমা করেছেন যে, অন্ধ ব্যক্তি কিবলার ক্ষেত্রে চোখওয়ালার তাক্বলীদ
করবে; ছালাতে ইমামদের পবিত্রতা, ফাতিহা পাঠ ও যাতে ইক্তিদা শুদ্ধ হয় সেসবে
মুক্তাদীরা ইমামদের তাক্বলীদ করবে; স্ত্রী চাই মুসলিম হৌক কিংবা যিম্মী
হৌক, মাসিক পার হওয়ার বিষয়ে স্বামীকে স্ত্রীর কথার তাক্বলীদ করতে হবে এবং
তদনুযায়ীই তার সাথে মেলামেশা বৈধ হবে; কোন মহিলার ইদ্দত পার হয়েছে কিনা সে
বিষয়ে তার কথার উপর তাক্বলীদ করে তার অভিভাবকদের জন্য বিয়ের ব্যবস্থা করা
সিদ্ধ হবে এবং ছালাতের ওয়াক্ত হয়েছে কিনা সে বিষয়ে মুওয়াযযিনদের তাক্বলীদ
করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে যেমন ইজতিহাদ আবশ্যিক নয়, তেমনি দলীল-প্রমাণ যোগে
এসব জানাও যরূরী নয়।[8]
এক নিগ্রো দাসী উকবা
বিন হারিছ (রাঃ)-কে বলেছিলেন, أَرْضَعْتُك وَأَرْضَعْت امْرَأَتَك ‘আমি
তোমাকে ও তোমার স্ত্রীকে দুধ পান করিয়েছি’। এ কথা জেনে নবী (ছাঃ) তাদের
বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে আদেশ দিয়েছিলেন। এতে ঐ মহিলার কথার তাক্বলীদ করা হয়েছে।[9]
ইমামগণও
সুস্পষ্ট ভাষায় তাক্বলীদের বৈধতার ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন হাফছ বিন গিয়াছ
বলেছেন, আমি সুফয়ান ছাওরীকে বলতে শুনেছি,إذَا رَأَيْت الرَّجُلَ يَعْمَلُ
الْعَمَلَ الَّذِي قَدْ اُخْتُلِفَ فِيهِ وَأَنْتَ تَرَى تَحْرِيمَهُ فَلَا
تَنْهَه ‘যখন তুমি কোন মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে কাউকে আমল করতে দেখ এবং ঐ
বিষয়টি যদি তোমার মতে হারাম হয় তাহ’লেও তুমি তাকে নিষেধ করবে না’।
মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান বলেছেন, يَجُوزُ لِلْعَالِمِ تَقْلِيدُ مَنْ هُوَ
أَعْلَمُ مِنْهُ، وَلاَ يَجُوزُ لَهُ تَقْلِيدُ مَنْ هُوَ مِثْلُهُ ‘একজন
আলেমের জন্য তার থেকে বেশী জাননেওয়ালার তাক্বলীদ করা জায়েয আছে, কিন্তু তার
সমপর্যায়ের কারও তাক্বলীদ করা জায়েয নয়’।[10]
শাফেঈ সুস্পষ্ট ভাষায় তাক্বলীদ করার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, فِي الضِّلْعِ بَعِيرٌ، قُلْته تَقْلِيدًا لِعُمَر ‘পাঁজর (ভাঙার দিয়ত) একটি উট, এ কথাটি আমি ওমরের তাক্বলীদ করে বলছি’। তিনি দোষমুক্ত পশু বিক্রয়ের মাসআলায় বলেছেন, قُلْته تَقْلِيدًا لِعُثْمَانَ ‘কথাটি আমি উছমানের তাক্বলীদ করে বলছি’। তিনি ভাইদের সাথে দাদার মীরাছ সম্পর্কে বলেছেন, দাদা তাদের সাথে অংশীদার হবে। তারপর তিনি বলেছেন, وَإِنَّمَا قُلْت بِقَوْلِ زَيْدٍ، وَعَنْهُ قَبِلْنَا أَكْثَرَ الْفَرَائِضِ ‘কথাটি আমি যায়েদ বিন ছাবিতের তাক্বলীদ করে বলছি। আর তার থেকেই আমরা ফারায়েযের অধিকাংশ মাসআলা পেয়েছি’। অন্যত্র তিনি তার মতের উপর রচিত নতুন গ্রন্থে বলেছেন, قُلْته تَقْلِيدًا لِعَطَاء ‘কথাটি আমি আতা-র তাক্বলীদ করে বলছি। আবু হানীফা (রহঃ)-কে দেখুন। কূয়ার মাসআলা-মাসায়েলের ক্ষেত্রে তার নিকট পূর্বেকার তাবেঈদের এতদসংক্রান্ত মাসায়েলের তাক্বলীদ ছাড়া অন্য কিছুই নাই। ইমাম মালিক তো মদীনাবাসীদের আমলের বাইরে যেতেনই না। তিনি তার রচিত মুওয়াত্ত্বায় স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, আমাদের শহরের আলেমদের আমরা এই আমল, সেই আমলের উপর পেয়েছি। তিনি একাধিক জায়গায় বলেছেন, مَا رَأَيْت أَحَدًا أَقْتَدِي بِهِ يَفْعَلُه ‘আমি যাদের অনুসরণ করি তাদের কাউকেই আমি এটি করতে দেখিনি’। আমরা যদি তার কথা একত্রিত করি তাহলে তা অনেক দীর্ঘ হবে।
ছাহাবীদের প্রসঙ্গে ইমাম শাফেঈ বলেছেন, رَأْيُهُمْ لَنَا خَيْرٌ مِنْ رَأْيِنَا لِأَنْفُسِنَا ‘আমাদের জন্য তাদের মতামত আমাদের নিজেদের মতামত থেকে অনেক শ্রেয়’। আমরা তাক্বলীদকারীরাও বলি ও বিশ্বাস করি যে, শাফেঈ ও অন্যান্যদের মতামত আমাদের জন্য আমাদের নিজেদের মতামত অপেক্ষা অনেক শ্রেয়।
আল্লাহ তা‘আলা মানুষের স্বভাব এমনই করে বানিয়েছেন যে, শিক্ষার্থীরা স্ব স্ব শিক্ষকের তাক্বলীদ করে থাকে। মানুষের নানাবিধ প্রয়োজন এ নিয়মেই মিটে থাকে। প্রতিটি বিদ্যা ও শিল্পের ক্ষেত্রে এ কথা সমভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহ তা‘আলা যেমন মানুষের শারীরিক গঠনে পার্থক্য করেছেন, তেমনি তাদের মেধাতেও তারতম্য করেছেন। সুতরাং তার প্রজ্ঞা, ইনছাফ ও মেহেরবানী অনুসারে তিনি তার সমগ্র সৃষ্টির উপর দ্বীনের ছোট-বড় যাবতীয় মাসআলা-মাসায়েল দলীল-প্রমাণসহ জানা এবং বিরুদ্ধ বাদীর দলীল খন্ডন করা ফরয করতে পারেন না। যদি তাই হত, তাহ’লে তো সব মানুষই আলেম হিসাবে সমান হয়ে যেত। আল্লাহ তা‘আলা তো তা না করে কাউকে আলেম উস্তাদ বানিয়েছেন, কাউকে ছাত্র বানিয়েছেন, কাউকে বা আলেমের অনুসারী বানিয়েছেন। এটা ইমাম-মুক্তাদী ও অনুসারী-অনুসরণীয়ের মত। আর কোথায় আল্লাহ জাহিল-মূর্খকে বিদ্বানের তাকলীদ, অনুসরণ ও ইকতিদা করা হারাম ঘোষণা করেছেন? আল্লাহর তো প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টির কোথায় কোন সমস্যা, আপদ-বিপদ নেমে আসবে তা সবই জানা। তিনি কি তাই প্রত্যেকের উপর উদ্ভূত সমস্যার বিধান শর্তাবলীসহ শারঈ দলীল যোগে জানা ফরযে আইন করেছেন? এটা কি কারও পক্ষে সম্ভব, এটা শারঈ বিধান হওয়া তো দূরে থাকুক? রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর ছাহাবীরা দেশ-বিদেশ জয় করেছেন; যারা তখন সবে ইসলামে প্রবেশ করেছে তারা তাদের কাছে ফৎওয়া জিজ্ঞেস করতেন। তারা তাদের বলতেন না, আমাদের এই ফৎওয়ায় সত্য কোনটা তা তোমাদেরকে দলীল-প্রমাণসহ জানতে হবে। এমন কথা নিশ্চিতভাবেই তারা কেউ বলেননি। তাক্বলীদ তো দায়িত্বশীলতার ও অস্তিত্বের অপরিহার্য অংশ। সুতরাং তা শরী‘আহ ও তাক্বদীরেরই একটি অংশ। তাক্বলীদ অস্বীকারকারীরাও তো তাক্বলীদ করতে বাধ্য। ইতোপূর্বে আমরা এ সম্পর্কে অনেক উদাহরণ দিয়েছি।
যারা তাক্বলীদ বাতিলের পক্ষে দলীল দেন আমরা তাদের বলব, আপনারা হাদীছের যে দলীল দেন তাতে তো আপনারাও রাবী বা বর্ণনাকারীদের তাক্বলীদ করেন। কারণ তাদের সত্যতার স্বপক্ষেও তো অকাট্য কোন প্রমাণ নেই। সুতরাং আপনাদের হাতেও তো তাদের তাক্বলীদ ছাড়া কোন পথ নেই। যেমন বিচারকের জন্য সাক্ষীর তাক্বলীদ ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই, তেমনি অজ্ঞ লোকদের জন্য আলেমদের তাক্বলীদ ছাড়া কোন উপায় নেই। এখন কিসে আপনাদের জন্য রাবী ও সাক্ষীর তাক্বলীদ করা বৈধ করল আর আমাদের জন্য আলেমের তাক্বলীদ হারাম করল? রাবী যা বর্ণনা করছে তা নিজ কানে শুনেছে, আর মুজতাহিদ যা শুনেছে তা নিজ বুদ্ধিতে বুঝেছে। রাবী তার শোনাটা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন, আর মুজতাহিদও তার বোঝাটা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। রাবীর দায়িত্ব শোনা কথা পৌঁছানো এবং মুজতাহিদের দায়িত্ব তার বোধগম্য বিষয় পৌঁছানো, আর যারা এই দু’জনের পর্যায়ে উন্নীত হ’তে পারেনি তাদের কর্তব্য দু’জনের কথা মান্য করা।
তাক্বলীদ নিষেধকারীদের আরও বলব, আপনারা তো এই ভয়ে তাক্বলীদ করতে নিষেধ করছেন যে, মুক্বাল্লিদ যার তাক্বলীদ করছে তিনি তার ফৎওয়ায় ভুল করলে মুক্বাল্লিদও ভুলে নিপতিত হতে পারে। তারপর আপনারা সত্য উদঘাটনার্থে তার উপর যুক্তি-বুদ্ধি ও দলীল-প্রমাণ তালাশ করা আবশ্যিক করতে চাচ্ছেন। অথচ এতে কোন সন্দেহ নেই যে, মুক্বাল্লিদের স্বপরিচালিত ইজতিহাদ-গবেষণা যতটা না সঠিক হবে, সে একজন আলেমের তাক্বলীদ করলে তার থেকেও বেশী সঠিক হবে। এটা ঐ ক্রেতার মত, যে কোন পণ্য কিনতে চাচ্ছে কিন্তু তার সম্পর্কে সে কোনই ধারণা রাখে না। এক্ষেত্রে সে যখন ঐ পণ্য সম্পর্কে অভিজ্ঞ, নির্ভরযোগ্য ও হিতাকাঙ্ক্ষী কোন ব্যক্তির তাক্বলীদ করবে তখন তার নিজের তুলনায় ঐ ব্যক্তিকে দিয়ে তার উদ্দেশ্য বেশী মাত্রায় পূরণ হবে। এ বিষয়ে সকল জ্ঞানী একমত।
তাক্বলীদপন্থীদের প্রমাণাদির জবাব :
প্রমাণপন্থীগণ বলেন, বড়ই তাজ্জব কথা, হে ঐ সব তাক্বলীদকারীরা, যারা নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে থাক যে, তোমরা বিদ্বান নও এবং বিদ্বানদের কাতারেও শামিল নও। বিদ্বানগণও একই সাক্ষ্য দিয়ে থাকেন। এখন আবার তোমরাই দলীল প্রমাণ দিয়ে বিদ্বানদের কাতারভুক্ত হয়ে কিভাবে নিজেরাই নিজেদের মাযহাব বাতিল করছ? মুক্বাল্লিদের দলীল আসে কোত্থেকে? কোথায় দলীলদাতার আসন, আর কোথায় মুক্বাল্লিদের আসন? তোমরা দলীল উল্লেখ করার মাধ্যমে কি দলীলদাতাদের কাপড় ধার করে নিজেদের অঙ্গে ধারণ করে মানুষের মাঝে নামছ না? এতে কি তোমরা যা তোমাদের নছিবে জোটেনি তা লাভের দাবী করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছ না? বিদ্যা জানার কথা বলে তোমরা যা লাভ করনি তা করেছ বলে দাবী করা হ’ল। এতে তোমরা কি নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছ না? এতে তো তোমরা মিথ্যার লেবাস পরলে এবং মুজতাহিদের যে পদের তোমরা যোগ্য নও তা ছিনিয়ে নিলে। এখন তোমরা আমাদের বল, তোমরা কি তাক্বলীদের পথে চলতে এমন কোন দলীল পেয়েছ, যা তোমাদেরকে তাক্বলীদের পথে চালিত করছে? এমন কোন প্রমাণ পেয়েছ যা তোমাদেরকে তাক্বলীদের পথ দেখাচ্ছে? ফলে তোমরা এখন দলীল প্রদানের নিকটবর্তী হচ্ছ এবং তাক্বলীদ থেকে দূরে সরে যাচ্ছ; নাকি তোমরা কোন দলীল অনুসন্ধান ছাড়াই সকলে একাট্টা হয়ে তাক্বলীদ করতে লেগে গেছ? এই দু’প্রকার রাস্তার বাইরে তোমাদের যাওয়ার অন্য কোন পথ নেই। যে রাস্তাই ধর না কেন তা তাক্বলীদ বাতিলের পক্ষে যাবে এবং প্রমাণের পথে ফেরা আবশ্যিক করবে। আমরা যদি প্রমাণের ভাষায় কথা বলি, তোমরা বলবে, আমরা প্রমাণ দানের যোগ্যতা রাখি না। আর যদি তোমাদের তাক্বলীদ মেনে কথা হয়, তাহ’লে তোমাদের খাড়া করা দলীলের কোন মানেই হয় না।
আজব ব্যাপার এই যে, ছোট-বড় প্রতিটি দল দাবী করে যে, তারা সত্যের উপর রয়েছে। কিন্তু তাক্বলীদকারী কোন দলের এমন দাবী শোভা পায় না। আর দাবী করলেও তা বাতিল গণ্য হবে। কেননা তারা তো নিজেদের বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দেয় যে, দলীল-প্রমাণের বুনিয়াদে চলার যোগ্যতা তাদের নেই। তাদের কাজ শুধুই তাক্বলীদ করা। মুক্বাল্লিদের তো হক-বাতিল, আভরণ-নিরাভরণ কোনটাই চেনার কথা না।
তার থেকেও বড় কথা, তাদের ইমামগণ তাদের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন। অথচ আজ তারা তাদের কথা অমান্য করে তাদের নাফরমানী করে চলেছে। তারা বলে, نَحْنُ عَلَى مَذَاهِبِهِمْ ‘আমরা ইমামদের মাযহাবের উপর আছি’। অথচ মাযহাবের যে মূল ভিত্তি ইমামগণ রচনা করেছেন, তারা তারই বিরোধিতা করে। কেননা তারা প্রমাণের উপর মাযহাবের ভিত্তি গড়েছেন এবং তাক্বলীদ করতে নিষেধ করে গেছেন। তারা তাদের অনুসারীদের এই অছিয়ত করে গেছেন যে, দলীল-প্রমাণ যাহির হ’লে তারা যেন তা মেনে চলে এবং তাদের কথা বাদ দেয়। কিন্তু মুক্বাল্লিদরা এখন তা সর্বতোভাবে অমান্য করে চলছে। তারা বলে, نَحْنُ مِنْ أَتْبَاعِهِم ‘আমরা তাদের অনুসারী’। এটা তাদের আরজু বটে, কিন্তু তাদের অনুসারী তো তারাই, যারা তাদের পথে চলে এবং মূল ও প্রশাখাগত বিধি-বিধানে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে।
তার থেকেও বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, ইমামগণ তাদের বইতে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, তাক্বলীদ বাতিল ও হারাম। আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে তাক্বলীদ করার কথা বলা বৈধ নয়। কোন শাসক যদি একজন বিচারককে একটি নির্দিষ্ট মাযহাব অনুযায়ী বিচার করার শর্তে নিয়োগ দেয় তাহ’লে তার সে শর্ত ও নিয়োগ দু’টোই অকার্যকর হবে। অনেকে শর্ত বাতিল এবং নিয়োগ সঠিক হওয়ার কথা বলেছেন। অনুরূপভাবে কোন মুফতী যে বিষয়ের ছহীহ-শুদ্ধ রূপ জানে না তার যে সে বিষয়ে ফৎওয়া দেওয়ার অধিকার নেই, সে সম্পর্কে সকল মানুষ একমত। মুক্বাল্লিদের তো ইজতিহাদের রাস্তা বন্ধ থাকায় কোন্ কথা সঠিক, আর কোন্ কথা বেঠিক তার খবরই নেই। তাছাড়া প্রত্যেক মুক্বাল্লিদই আপনা থেকে স্বীকার করে যে, সে তার ইমামের মুক্বাল্লিদ; সে তার কথার অন্যথা করতে পারবে না এবং তার খাতিরে সে তার কথার পরিপন্থী কুরআন, সুন্নাহ, ছাহাবীর উক্তি, তার ইমাম থেকে বেশী কিংবা তার সমকক্ষ জ্ঞানীর কথা অকপটে বর্জন করবে। এটা সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা!
আমরা তো একথা স্বতঃসিদ্ধভাবে জানি যে, ছাহাবীদের যুগে তাদের মাঝে এমন একজন লোকও ছিলেন না যিনি তাক্বলীদের জন্য তাদের একজনকে নির্বাচিত করে তার তামাম কথা মান্য করেছেন, কিছুই ছাড় দেননি এবং অন্যদের কথা সবই বাতিল করে দিয়েছেন, তার বিন্দুবিসর্গও গ্রহণ করেননি। একইভাবে তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈদের যুগেও এরূপ কেউ ছিলেন না। মুক্বাল্লিদরা আমাদেরকে ভুল করেই একজনের নাম বলুক, যে রাসূল (ছাঃ)-এর যবানে প্রশংসিত তিন যুগে তাদের তাক্বলীদী ধারার কুপথে দ্বীন চর্চা করেছিল। এ বিদ‘আত তো রাসূল (ছাঃ)-এর যবানে নিন্দিত হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে জন্মলাভ করেছে (وإنسا حرثت هزه البرعة فى القرن الرابع المذموم على لان رسرل الله)। মুক্বাল্লিদরা তো তাদের অনুসরণীয় ইমামের কথা অনুযায়ী জান, মাল, ইযযতকে হালাল কিংবা হারাম মানে। তারা জানে না যে, তা সঠিক না ভুল। এ এক মহাবিপজ্জনক কথা। তাদের একদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। সে স্থান বড়ই কঠিন। সেখানে যে আল্লাহর নামে না জেনে কথা বলে, সে যে ভিত্তিহীন আদর্শের উপর ছিল তা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
যারাই মানবকুলে মাত্র একজনের তাক্বলীদ করে অন্য কারও নয়, তাদের প্রত্যেককে আমরা বলব, কী সে কারণ, যার জন্য তোমার ইমাম অন্যদের থেকে তাক্বলীদের বেশী যোগ্য হয়ে গেল? যদি সে বলে, কারণ তিনি তার যুগের শ্রেষ্ঠ বিদ্বান। অনেক সময় তারা তাকে পূর্বেকার লোকদের থেকে শ্রেষ্ঠ দাবী করে এবং তার পরবর্তীকালে তার থেকে বেশী জাননেওয়ালা কেউ ধরাধামে আসেনি বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে। যদিও এ বিশ্বাস একান্তই বাতিল। তার নিকট জিজ্ঞাস্য, তুমি কোন বিদ্বান নও বলে তো তুমি নিজেই নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছ; তাহ’লে কিভাবে তুমি জানলে যে, তিনি তার যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্বান ছিলেন? এতো কেবল তার পক্ষেই সম্ভব, যে মাযহাবগুলো দলীল-প্রমাণসহ জানে এবং কোন দলীল থেকে কোন দলীল অগ্রগণ্য তা নির্ণয় করতে পারে। অন্ধ কিভাবে মুদ্রা যাচাই করতে পারবে? এটাও আল্লাহর নামে না জেনে কথা বলার আরেকটি রাস্তা।
(২) আবুবকর ছিদ্দীক্ব, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব, উছমান, আলী, ইবনু মাসউদ, উবাই ইবনু কা‘ব, মু‘আয বিন জাবাল, আয়েশা, ইবনু আববাস, ইবনু ওমর (রাঃ) তো নিঃসন্দেহে তোমার ইমাম থেকে বেশী বিদ্বান। তাহ’লে তুমি কেন তাদের তাক্বলীদ করে ইমামের তাক্বলীদ ত্যাগ করছ না? এমনকি সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব, শা‘বী, আতা, তাউস ও তাদের মত যারা তারাও নিসঃন্দেহে তার থেকে বেশী বিদ্বান ও শ্রেয়। তাহ’লে তুমি কেন যারা বিজ্ঞতা, শ্রেষ্ঠত্ব, কল্যাণধর্মিতা, বিদ্যাবত্তা ও দ্বীন-ধার্মিকতায় বেশীমাত্রায় এগিয়ে তাদের তাক্বলীদ ছেড়ে দিচ্ছ? কেন তাদের কথা ও মাযহাবের প্রতি অনাগ্রহ দেখিয়ে তাদের থেকে নিম্নমানের একজনের তাক্বলীদে আগ্রহী হয়ে উঠছ? যদি সে বলে, তার কারণ, আমার ছাহেব, আমি যার তাক্বলীদ করি তিনিই এ বিষয়ে আমার থেকে বেশী জানেন। আমার অনুসরণীয় ইমামের উত্তরই এক্ষেত্রে আমাকে তাদের কথার বিরোধিতা করতে প্রেরণা যুগিয়েছে। কেননা তার বিদ্যা ও দ্বীনদারির মাত্রাধিক্য হেতু তিনি কখনই তার থেকে উপরের ও বেশী বিদ্বানের বিরোধিতা করতে পারেন না। তা সত্ত্বেও যখন তিনি বিরোধিতা করেছেন তখন নিশ্চয়ই উল্লিখিত মহাজনদের প্রত্যেকের মতের বিপরীতে শ্রেয়তর কোন দলীল তার নিকট ছিল। তাকে বলব, তুমি কোত্থেকে জানলে যে, তোমার ছাহেব যে দলীল অবলম্বন করেছেন তা তার থেকেও বেশী বিদ্বান ও শ্রেষ্ঠ কিংবা তার সমতুল্য জনের থেকে শ্রেয়তর? দু’টি পরস্পর বিরোধী কথা কখনই একই সাথে সঠিক হ’তে পারে না, বরং তাদের একটিমাত্র সঠিক হ’তে পারে। আর এটা তো জানা কথা যে, বেশী বিদ্বান ও বেশী মহৎ যে সে তার তুলনায় কম বিদ্বান ও কম মহৎ থেকে বেশী সাফল্য অর্জন করবে। (সে হিসাবে তোমার ইমাম থেকে উল্লিখিত বিদ্বানদের মতই সঠিক হওয়া বেশী স্বাভাবিক)। আর যদি তুমি বল, আমি নিজেই দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে তা জেনেছি, তাহ’লে সেক্ষেত্রে তো তুমি তাক্বলীদের পদ থেকে দলীলদাতার পদে উঠে এলে এবং নিজেই তাক্বলীদ বাতিল করে দিলে।
[চলবে]
[1]. নাসাঈ ৮/২৩১; দারেমী ১/৬০; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা ৭/২৪১; যিয়া, আল মুখতারাহ ক্রমিক ১৩৪। বিস্তারিত টীকা নং ২, পৃ. ৪৭৯।
[2]. আবুদাঊদ হা/৩৯৫৪, ‘দাস মুক্তকরণ’ অধ্যায়; ইবন হিববান হা/৪৩২৪; হাকেম ২/১৮-১৯; বায়হাক্বী ১০/৩৪৭।
[3]. মুসলিম হা/১৪৭২, ‘তালাক’ অধ্যায়। এটি ছিল ওমর (রাঃ)-এর ইজতিহাদ ও সাময়িক ব্যবস্থা মাত্র। তা দ্বারা রাজ‘ঈ তালাক-এর চিরন্তন কুরআনী পদ্ধতিকে বাতিল করা যায় না। ওমর (রাঃ) এটি করেছিলেন লোকদের ভীত করার জন্য সাময়িক কঠোরতা হিসাবে। কিন্তু এতে তাঁর উদ্দেশ্য মোটেই সফল হয়নি। সেকারণ মৃত্যুর পূর্বে তিনি অনুতপ্ত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন (ইবনুল ক্বাইয়িম, ইগাছাতুল লাহফান ১/২৭৬; বিস্তারিত দ্রঃ তালাক ও তাহলীল পৃ. ৪৬)। -সম্পাদক।
[4]. মুওয়াত্ত্বা মালেক ১/৫০, হা/১৩৭।
[5]. ইবনু আবী শায়বা ১০/৪৮৯; বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর ২/৩৯-৪০; ইবনু হাযম, আল-ইহকাম ৬/৯৩।
[6]. আহমাদ ৪/৪-৫; বুখারী, ‘ফাযায়েলুছ ছাহাবা’ অধ্যায় হা/৩৬৫৮।
[7]. বিস্তারিত দেখুন : কাযী আব্দুল ওয়াহ্হাব, আল-ইশরাযা ৫/২২-২৩, মাসআলা নং ১৬৯৫।
[8]. ইবনু আব্দিল বার্র, ইজমা‘আত ১/৪৮৪; জামেউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, পৃঃ ৪৪১-৪৪২।
[9]. বুখারী হা/৮৮, ‘ইলম’ অধ্যায়; ‘বেচা-কেনা’ অধ্যায় হা/২০৫২; বিস্তারিত দেখুন : টীকা নং ৪, পৃষ্ঠা ৪৮১।
[10]. আবু ইয়ালা, আল-উদ্দাহ ৪/১২৩১; মুসাল্লামুছ ছুবূত ২/২৯৩।