বাংলাদেশে, বিশেষভাবে ঢাকা শহরের মত বড় বড় শহরগুলোতে দূষণ অভিশাপে পরিণত হয়েছে। ঢাকা বাসীর কাছে দূষণ এক আতঙ্কের নাম। বর্তমানে যেই নামটি আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ধূলা-বালি, যানবাহনের ধোঁয়া, হাইড্রোলিক হর্ন, গৃহের আবর্জনা, ছোট-বড় কলকারখানার বর্জ্য, মানুষের বর্জ্য, পুরাতন কাপড়, পরিত্যক্ত কাগজ ও প্লাস্টিক এ সবকিছুই যেন অভিশাপে পরিণত হয়েছে। এক জরিপে জানা যায়, ঢাকা শহরে বাতাসে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে সালফার-ডাই-অক্সাইড পাওয়া গেছে। এই ভয়ঙ্কর উপাদানটির জন্য দায়ী করা হয়েছে যানবহনের কালো ধোঁয়াকে! প্রতিদিন বাংলাদেশে ২২.৮ মিলিয়ন টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়ে থাকে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে দেখা হেছে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৬১১০ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়ে থাকে। ঢাকা শহরে গড়ে প্রতিদিন জনপ্রতি ৫৬০ গ্রাম বর্জ্য উৎপন্ন হয়। আর বাংলাদেশের আবর্জনার ৩৭ শতাংশ বর্জ্য ঢাকা শহরে উৎপন্ন হয়। গৃহে খাদ্যদ্রব্য হ’তে ৮০%, গ­াসের টুকরা হ’তে ১০%, কাগজ ও পলিথিন হ’তে ৭ শতাংশ, পুরাতন কাপড় চোপড় হ’তে ১.৫ শতাংশ বর্জ্য উৎপন্ন হয়।

বিশ্ব ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৮% মানুষ শুধুমাত্র দূষণে মারা যায়। প্রতিবছর ক্ষতি হয় ৬৫০ কোটি মার্কিন ডলার। রিপোর্টে তারা আরো বলেছে, শুধুমাত্র বাংলাদেশের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো প্রতিবছর ২৮ লাখ টন বর্জ্য উৎপন্ন করে।

ঢাকা শহরে ১০ লাখ মানুষ চরম সীসা দূষণের ঝুঁকিতে বাস করে। ঢাকা শহরে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১০০০ টি শিল্প-কলকারখানা আছে। ঢাকার হাযারীবাগে ১৪৯টি চামড়া কারখানা আছে, সেখানে প্রতিদিন ১৮ হাযার লিটার তরল বর্জ্য ও ১১৫ টন শক্ত বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন হয়। যার মধ্যে ক্রোমিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্লোরাইড, সালফেট-এর মত ভয়ংকর উপাদান বিদ্যমান।

হোটেল ও রেস্টুরেন্ট-এর আবর্জনা, শিল্প কারখানা হ’তে উৎপাদিত আবর্জনা, মেডিকেল বর্জ্য, রান্নাঘরের পরিত্যক্ত আবর্জনা, হাট-বাজারের পচনশীল শাকসবজি, কসাইখানার রক্ত, ছাপাখানার রঙ ইত্যাদি বর্জ্যের অন্যতম উৎস। বর্জ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মেডিকেল বর্জ্য।

আমাদের দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়। বেহাল দশা রয়েছে, আমাদের দেশে এখনো অবৈজ্ঞানিক ও অপরিকল্পিতভাবে বর্জ্য অপসারণ ও ডাম্পিং করা হয়ে থাকে। সাধারণত বিভিন্ন ডোবা, পুকুর, রাস্তার পাশে বর্জ্য ফেলা হয়। যে সকল নির্ধারিত বর্জ্য ফেলার ডাস্টবিনগুলো আছে তার আশেপাশে পরিবেশ অত্যন্ত ভয়াবহ। এতটাই দুর্গন্ধ যে, পথচারীরা নিরুপায় না হ’লে ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে যেতে চায় না।

২০১৮ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ২০টি শহরের মধ্যে লাহোর, দিল্লি এবং ঢাকার স্থান যথাক্রমে ১০, ১১ এবং ১৭। ঐ রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৭ সালের চেয়ে ২০১৮ সালে চীনে বায়ু দূষণের পরিমাণ কমেছে ১২ শতাংশ। বায়ু দূষণে চীন উন্নতি করলেও প্রতিবেশী ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশেই বায়ু দূষণের তীব্রতা বেড়েই চলেছে।

বিভিন্ন দূষণের পরিসংখ্যান :

১. বায়ুদূষণ :

বায়ুদূষণের ভয়াবহতা ও তীব্রতা সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি-এনভায়রনমেন্টাল অ্যানালাইসিস (সিইএ) ২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৪৬ হাযার মানুষের। পরিবেশ অধিদফতরের জরিপে, ৫৮% বায়ুদূষণের উৎস ঢাকার আশেপাশে গড়ে ওঠা প্রায় সাড়ে ৪ হাযারের অধিক ইটের ভাটায় কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের ফলে। শিল্প-কারখানা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, ঘনঘন রাস্তা খনন, ড্রেনের ময়লা রাস্তার পাশে উঠিয়ে রাখা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, ধূলিকণা, সীসা, কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ এবং কার্বনডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়তই বায়ু চরমভাবে দূষিত করছে।

২. শব্দ দূষণ :

যানবাহনের হাইড্রলিক হর্ন, সড়কে যানবাহন, রেল ও নৌযানের হর্ন,  ত্রুটিপূর্ণ যানবাহবনের শব্দ, যত্রতত্র মাইকের ব্যবহার, রাজনৈতিক সমাবেশ, ওপেন কনসার্ট, ভবন নির্মাণ, জেনারেটর, কারখানা থেকে নির্গত উচ্চ শব্দ দূষণের জন্য দায়ী। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্রান্সপোর্ট ও এনভায়রনমেন্ট-এর গবেষণার তথ্যানুসারে, ২০০৮ সালে ৫ লক্ষ লোক রেল এবং সড়ক পরিবহন থেকে শব্দ দূষণের ফলে মারাত্মক হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় এবং ২ লক্ষ লোক কার্ডিও-ভাস্কুলার রোগের শিকার হয়।

৩. প্লাস্টিক দূষণ :

এক সময় প্লাস্টিক বলতে শুধু পলিথিন ব্যাগ, বোতল ইত্যাদিকে ধরা হ’ত। কিন্তু এখন প্ল­াস্টিকের ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে প্লাস্টিকের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর হ’ল মাইক্রোপ্লাস্টিক। ফেইসওয়াস, ডিটারজেন্ট, সাবান, বডিওয়াস, টুথপেস্ট ইত্যাদিতে প্রচুর মাইক্রোবিড পাওয়া যায়। এর ফলে মানুষ থাইরয়েড, হরমোনের অতিরিক্ত ক্ষরণ, কিডনি রোগ, চর্মরোগ ইত্যাদি সমস্যাতে ভোগে। প্লাষ্টিক দূষণের ফলে নদী তার নাব্যতা হারায়, ভূ-গর্ভস্থ পানি দূষিত হয়, মাটির উর্বরতা হ্রাস পায়।

৪. নদী দূষণ :

৭০-৮০ ভাগ শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। কর্তৃপক্ষের পরিশোধন ছাড়া পয়ঃপ্রণালীর বর্জ্য নদীতে ফেলার ফলে নদী দূষিত হচ্ছে। নদী পথে চলাচলকারী জাহাজ, লঞ্চ, স্টিমার, ডকইয়ার্ডের বর্জ্য, ট্রলারের লিকেজের ফলে কয়লা ও তেল, কঠিন বর্জ্য, কৃষিকার্যক্রমের ফলে আগত রাসায়নিক এবং নদীর পাশে গড়ে ওঠা অপরিকল্পিত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও গৃহস্থালী বর্জ্য, গবাদি পশুর বাসস্থান নির্মাণ ইত্যাদি নদী দূষণের জন্য দায়ী।

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন যে, কার্বন নিঃসরণের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ১২ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে দাবানল, খরা, বন্যা ও ভয়াবহ তাপপ্রবাহের মতো মহাবিপর্যয় নেমে আসতে পারে। জাতিসংঘের আবহাওয়া পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেল এক বিশেষ প্রতিবেদনে এমন সতর্কবাণী দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়ে, এখনই পদক্ষেপ না নিলে ২০৩০ থেকে ২০৫২ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করবে। উষ্ণতা বৃদ্ধির বিপর্যয়পূর্ণ এ মাত্রা এড়াতে সমাজের সর্বক্ষেত্রে দ্রুত, সুদূর প্রসারী ও নযীরবিহীন পরিবর্তনের অপরিহার্যতা তুলে ধরেছেন বিজ্ঞানীরা।

দূষণের জন্য মূলতঃ শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলো প্রধান দায়ী। তারা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পরিবেশ দূষণের বর্জ্য উৎপন্ন করে থাকে। জরিপ পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, চীন যেখানে দূষণের শীর্ষে, সেখানে ভুটানে দূষণের পরিমাণ খুবই কম এবং দূষণের সম্পর্কে খুব সচেতন ও আইন মান্যকারী নমনীয় জাতি। সমগ্র প্রাণীকুল দূষণমুক্ত বিশ্ব চায়। এজন্য সকলকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে। উল্লিখিত দূষণ রোধে নীতিমালা মেনে চলা, বর্জ্য পুঁতে ফেলা এবং সবুজ বনায়ন সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালানো অতি যরূরী। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। সেই সাথে জনগণকে সার্বিক সহযোগিতা করতে হবে। তাহ’লেই এ দূষণ রোধ সম্ভব হবে।







পবিত্র রামাযান : আল্লাহর সান্নিধ্যে ফিরে আসার মাস - ড. মুহাম্মাদ নযরুল ইসলাম খান, আমেরিকা
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাক্বলীদ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
ঈদায়নের কতিপয় মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
নফসের উপর যুলুম - ইহসান ইলাহী যহীর
জান্নাত লাভের কতিপয় উপায় (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ঈদে মীলাদুন্নবী - আত-তাহরীক ডেস্ক
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ঈমান (৩য় কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
হজ্জকে কবুলযোগ্য করার উপায় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
শবেবরাত - আত-তাহরীক ডেস্ক
কুরবানীর মাসায়েল
মুহাররম মাসের সুন্নাত ও বিদ‘আত - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
মানবাধিকার ও ইসলাম (১৪তম কিস্তি) - শামসুল আলম
আরও
আরও
.