পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । শেষ পর্ব ।
ঈমান বৃদ্ধির উপায় সমূহ :
(১) মানব জীবনে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা : তাওহীদ তিন প্রকার। যথা- (ক) তাওহীদে রুবূবিয়্যাহ (খ) তাওহীদে উলূহিয়্যাহ (গ) তাওহীদে আসমা ওয়াছ ছিফাত।
(ক) তাওহীদে রুবূবিয়্যাহ :
তাওহীদে রুবূবিয়্যাহ হল প্রতিপালক হিসাবে আল্লাহকে একক গণ্য করা। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা সকল সৃষ্টির পালনকর্তা, সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, জীবন ও মৃত্যুদাতা, কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক। অতএব সকল বিপদাপদে তাঁর নিকটেই প্রার্থনা করতে হবে। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি বিশ্বজাহানের প্রতিপালক। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, اَلْحَمْدُ للّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক’ (ফাতেহা ১)। মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেন, قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ ‘বল, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি মানুষের প্রতিপালকের নিকট’ (নাস ১)। আল্লাহ তা‘আলা সকলের সৃষ্টিকর্তা। তিনি বলেন, ‘তারা কি স্রষ্টা ব্যতীতই সৃষ্ট হয়েছে, না তারা নিজেরাই (নিজেদের) স্রষ্টা’ (তূর ৩৫)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, وَلَئِنْ سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ الْعَزِيْزُ الْعَلِيْمُ ‘তুমি যদি তাদেরকে (মুশরিকদেরকে) জিজ্ঞেস কর, কে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে, এগুলো তো সৃষ্টি করেছেন পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহ’ (যুখরুফ ৯)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
خَلَقَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا وَأَلْقَى فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَن تَمِيدَ بِكُمْ وَبَثَّ فِيهَا مِن كُلِّ دَابَّةٍ وَأَنزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَنبَتْنَا فِيهَا مِن كُلِّ زَوْجٍ كَرِيمٍ- هَذَا خَلْقُ اللَّهِ فَأَرُونِي مَاذَا خَلَقَ الَّذِينَ مِن دُونِهِ بَلِ الظَّالِمُونَ فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ-
‘তিনি আকাশমন্ডলী নির্মাণ করেছেন স্তম্ভ ব্যতীত, তোমরা এটা দেখছ। তিনি পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন পর্বতমালা যাতে এটা তোমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে এবং এতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বপ্রকার জীব-জন্তু এবং আমরাই আকাশ হ’তে বৃষ্টি বর্ষণ করে এতে উদগত করি সর্বপ্রকার কল্যাণকর উদ্ভিদরাজি। এটা আল্লাহর সৃষ্টি! তিনি ছাড়া অন্যেরা কি সৃষ্টি করেছে তা আমাকে দেখাও; বরং সীমালংঘনকারীরা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে’ (লোকমান ১০-১১)। মহান আল্লাহই সকল সৃষ্টির রিযিকদাতা। তিনি বলেন, وَمَا مِنْ دَآبَّةٍ فِي الأَرْضِ إِلاَّ عَلَى اللهِ رِزْقُهَا ‘আর ভূ-পৃষ্ঠে যত প্রাণী বিচরণ করে তাদের সকলেরই রিযিক আল্লাহ দিয়ে থাকেন’ (হূদ ৬)। আল্লাহই মানুষের জীবনদাতা ও মৃত্যুদাতা। মহান আল্লাহ বলেন,كَيْفَ تَكْفُرُوْنَ بِاللهِ وَكُنتُمْ أَمْوَاتاً فَأَحْيَاكُمْ ثُمَّ يُمِْيتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيْكُمْ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ ‘কিরূপে তোমরা আল্লাহকে অবিশ্বাস করছ? অথচ তোমরা নির্জীব ছিলে, পরে তিনিই তোমাদেরকে জীবিত করেছেন, পুনরায় তিনি তোমাদেরকে নির্জীব করবেন, পরে আবার জীবন্ত করবেন। অবশেষে তোমাদেরকে তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে’ (বাক্বারাহ ২/২৮)।
উপরে বর্ণিত বিষয় সমূহে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না। কারণ আমরা সবাই রূহের জগতে মহান আল্লাহকে প্রতিপালক হিসাবে স্বীকৃতি দান করেছি। মহান আল্লাহ বলেন,وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِيْ آدَمَ مِنْ ظُهُوْرِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوْا بَلَى شَهِدْنَا أَنْ تَقُوْلُوْا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِيْنَ ‘হে নবী! যখন তোমার প্রতিপালক বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ হ’তে তাদের সন্তানদেরকে বের করলেন এবং তাদেরকেই তাদের উপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলল, হ্যাঁ! আমরা সাক্ষী থাকলাম। (এই স্বীকৃতি এজন্য যে), যাতে তোমরা ক্বিয়ামতের দিন বলতে না পার আমরা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অনবহিত ছিলাম’ (আ‘রাফ ১৭২)।
প্রত্যেক আদম সন্তানই ইসলামের উপর তথা তাওহীদের উপর জন্মলাভ করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَا مِنْ مَوْلُودٍ إِلاَّ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ، كَمَا تُنْتَجُ الْبَهِيمَةُ بَهِيمَةً جَمْعَاءَ، هَلْ تُحِسُّونَ فِيهَا مِنْ جَدْعَاءَ. ثُمَّ يَقُولُ أَبُو هُرَيْرَةَ رضى الله عنه (فِطْرَةَ اللهِ الَّتِى فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لاَ تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ). ‘প্রত্যেক নবজাতকই ফিৎরাতের উপর (তাওহীদের উপর) জন্মলাভ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহূদী, নাছারা বা অগ্নিপূজক রূপে গড়ে তোলে। যেমন চতুষ্পদ প্রাণী একটা পূর্ণাঙ্গ বাচ্চা জন্ম দেয়। তোমরা কি তাকে কোন (জন্মগত) কানকাটা দেখতে পাও? অতঃপর আবু হুরায়রা (রাঃ) তিলাওয়াত করলেন, তাঁর (আল্লাহর) দেয়া ফিৎরাতের অনুসরণ কর, যে ফিৎরাতের উপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই, এটাই সরল সুদৃঢ় দ্বীন’ (রূম ৩০)।[1] অতএব যে ফিৎরাতের উপর মানুষ সৃষ্টি হয়েছে তার উপর অটল থাকলে সে সরল-সঠিক সুদৃঢ় পথে টিকে থাকবে। এতে তার ঈমান বাড়বে এবং পরকালে সুখময় স্থান জান্নাত লাভ করবে ইনশাআল্লাহ। পক্ষান্তরে ফিৎরাতের পরিবর্তন করলেই সঠিক পথ হারিয়ে বিভ্রান্ত হবে।
(খ) তাওহীদে উলূহিয়্যাহ বা তাওহীদে ইবাদত :
সকল প্রকার ইবাদতে আল্লাহকে একক গণ্য করা। যেমন ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত, যবেহ-কুরবানী, নযর-নিয়াজ, রুকূ-সিজদা, ভয়-ভীতি, আশা-ভরসা ইত্যাদি সকল কিছু আল্লাহর জন্যই হ’তে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,إِيَّاكَ نَعْبُدُ وإِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ ‘আমরা শুধুমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং আপনারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি’ (ফাতেহা ৪)। অতএব আমরা আমাদের প্রকৃত মা‘বূদের নিকটেই সকল বিপদ-আপদ থেকে আশ্রয় চাইব। একমাত্র তাঁরই ইবাদত করব। মহান আল্লাহ আরো বলেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُوْلاً أَنِ اعْبُدُواْ اللهَ وَاجْتَنِبُواْ الطَّاغُوْتَ ‘আমরা প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাগূত হ’তে নিরাপদ থাকবে’ (নাহল ৩৬)। অতএব শুধু আল্লাহরই ইবাদত করতে হবে, অন্য কারো নয়। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِن رَّسُوْلٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُوْنِ ‘আমরা তোমার পূর্বে কোন রাসূল প্রেরণ করিনি এই অহী ব্যতীত যে, আমি ছাড়া অন্য কোন (হক্ব) মা‘বূদ নেই। সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত কর’ (আম্বিয়া ২৫)। তিনি আরো বলেন, لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحاً إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُواْ اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـهٍ غَيْرُهُ ‘নূহকে তার কওমের নিকট পাঠিয়েছিলাম। সে বলল, হে আমার কওম! তোমরা শুধু আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন সত্য মা‘বূদ নেই’ (আ‘রাফ ৫৯)। তিনি অন্যত্র বলেন,وَاعْبُدُواْ اللهَ وَلاَ تُشْرِكُواْ بِهِ شَيْئاً ‘আর তোমরা আল্লাহরই ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না’ (নিসা ৩৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْنِ ‘আমি জিন ও মানুষকে কেবল মাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি’ (যারিয়াত ৫৬)।
অতএব বুঝা যাচ্ছে যে, মহান আল্লাহ জিন ও মানুষকে শুধুমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছেন। ইবাদতের মধ্যে শিরক মিশ্রিত হ’লে ইবাদত বাতিল হয়ে যায়, যেমন পবিত্রতার মধ্যে অপবিত্র মিশ্রিত হ’লে সেটি বাতিল বলে গণ্য হয়। আর শিরককারী চিরস্থায়ী জাহান্নামী হয়ে যায়। এজন্য শিরক থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে অংশী স্থাপনকারীকে ক্ষমা করবেন না, তবে এতদ্ব্যতীত তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন’ (নিসা ১১৬)। আল্লাহ আরো বলেন, إِنَّهُ مَن يُشْرِكْ بِاللّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللّهُ عَلَيهِ الْجَنَّةَ ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে (অন্য কাউকে) শরীক করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন’ (মায়েদাহ ৭২)। অতএব শুধু আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইবাদত করলে ঈমান বাড়বে। পক্ষান্তরে শিরক মিশ্রিত ইবাদত করলে ঈমানে ঘাটতি পড়বে।
(গ) তাওহীদে আসমা ওয়াছ ছিফাত : কুরআন ও হাদীছে আল্লাহর নাম ও ছিফাত (গুণাবলী) সমূহ যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই বর্ণনা করা এবং সেগুলোর প্রতি ঈমান আনা হচ্ছে তাওহীদে আসমা ওয়াছ ছিফাত। কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন না করে, অস্বীকার না করে, অবস্থা বর্ণনা না করে এবং কারো সাথে সাদৃশ্য প্রদান না করে আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর উপর ঈমান আনতে হবে।[2] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلِلّهِ الأَسْمَاء الْحُسْنَى فَادْعُوْهُ بِهَا وَذَرُواْ الَّذِيْنَ يُلْحِدُوْنَ فِيْ أَسْمَآئِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُواْ يَعْمَلُوْنَ ‘আর আল্লাহর সুন্দর নাম সমূহ রয়েছে। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেসব নামে ডাকো, আর তাদেরকে বর্জন করো যারা তাঁর নাম সমূহ বিকৃত করে, সত্বরই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে’ (আ‘রাফ ১৮০)। সুতরাং আল্লাহর নাম ও গুণাবলী যেভাবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই বর্ণনা করতে হবে। কারো সাথে তার সাদৃশ্য করা যাবে না। তিনি বলেন, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيْعُ البَصِيْرُ ‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা (শূরা ১১)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَلاَ تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ ‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই সে বিষয়ের পিছনে পড়ো না’ (বনী ইসরাঈল ৩৬)। আয়াতটিতে আল্লাহর অবস্থা কেমন তা বর্ণনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন এবং ছহীহ হাদীছে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই বর্ণনা করতে বলা হয়েছে।[3] মানব জীবনে তিন প্রকার তাওহীদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঈমান মযবূত হবে ও ইহকাল-পরকাল সুখময় হবে।
আল্লাহ
তা‘আলার নামগুলো যেভাবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই
বর্ণনা করতঃ অর্থ বুঝে মুখস্থ করে আমলের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করলে ঈমান বাড়বে
এবং জান্নাত লাভ করা যাবে ইনশাআল্লাহ। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলার এক কম একশটি অর্থাৎ নিরানববইটি
নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি এগুলো মুখস্থ করবে (অর্থ বুঝে আমল করবে) সে জান্নাতে
প্রবেশ করবে’।[4] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আল্লাহ তা‘আলার নিরানববইটি নাম
রয়েছে, যে ব্যক্তি এগুলোর হিফাযত করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহ
বেজোড়। তিনি বেজোড় পসন্দ করেন’।[5] হাদীছটির ব্যাখ্যা হচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর নিরানববইটি নাম হেফাযত করবে এবং মর্মার্থ বুঝে আমল করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।[6]
(২) ইবাদত কবুলের শর্তদ্বয় মানব জীবনে বাস্তবায়ন করা : ইবাদত কবুলের মৌলিক দু’টি শর্ত হ’ল- (ক) ইখলাছ বা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত করা (খ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুসরণ করা। এ দু’টি শর্তের প্রতি খেয়াল রেখে ইবাদত করলে তা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে এবং এতে ঈমানও বৃদ্ধি হবে। সকল প্রকার ইবাদত শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই সম্পাদন করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا أُمِرُوْا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ حُنَفَاء وَيُقِيْمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِيْنُ الْقَيِّمَةِ ‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁরই ইবাদত করতে এবং ছালাত কায়েম করতে ও যাকাত প্রদান করতে, এটাই সু-প্রতিষ্ঠিত সঠিক দ্বীন’ (বাইয়িনাহ ৫)। মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেন, ‘হে নবী! বল, আমি একমাত্র আল্লাহর জন্যই ইবাদত করি তাঁর প্রতি আমার আনুগত্যকে একনিষ্ঠ রেখে’ (যুমার ১৪)। সকল প্রকার ইবাদত যেমন ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত, যবেহ-কুরবানী, নযর-নিয়াজ, রুকূ-সিজদা, দো‘আ-প্রার্থনা, ভয়-ভীতি, আশা-ভরসা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই করতে হবে। কোন পীর, অলী-আওলিয়ার নামে বা মাযার-কবরের নিকট নয়। ইবাদত অন্যের জন্য করলেই শিরক হয়ে যাবে এবং পরকালীন জীবনে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হ’তে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ أُوْحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ ‘নিশ্চয়ই তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি এ মর্মে ওহী হয়েছে যে, যদি তুমি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক কর তবে নিঃসন্দেহে তোমার সকল আমল বাতিল হয়ে যাবে এবং অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (যুমার ৬৫)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاء رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلاً صَالِحاً وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَداً ‘সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎকর্ম করে ও তার প্রতিপালকের ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করে’ (কাহফ ১১০)।
প্রতিটি কাজের জন্য সর্বপ্রথম নিয়ত ঠিক করতে হবে এবং সর্বপ্রকার ইবাদত আললাহর সন্তুষ্টির জন্য করতে হবে।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা সৎ আমল করেছে তাদের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট বস্ত্ত (জান্নাত) রয়েছে এবং আরো রয়েছে অতিরিক্ত উৎকৃষ্ট জিনিস (আল্লাহর সাক্ষাৎ) (ইউনুস ২৬)। তিনি আরো বলেন,وَعَدَ اللهُ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِيْ جَنَّاتِ عَدْنٍ وَرِضْوَانٌ مِّنَ اللهِ أَكْبَرُ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ ‘আল্লাহ তা‘আলা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে এমন জান্নাত সমূহের ওয়াদা করেছেন যার পাদদেশে নহর সমূহ প্রবাহিত রয়েছে। সেখানে তারা অনন্তকাল বসবাস করবে। আরও (ওয়াদা করেছেন) ঐ উত্তম বাসস্থান সমূহের, যা আদন নামক জান্নাতের মাঝে অবস্থিত। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড়। এটা হচ্ছে অতি বড় সফলতা’ (তওবা ৭২)।
অতএব
পরকালে সুখময় স্থান লাভ করার জন্য সকল সৎকর্ম আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে
করতে হবে এবং নিয়ত খালেছ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘সকল কাজ
নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে। তাই যার
হিজরত আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে হবে, তার হিজরত আল্লাহ এবং তাঁর
রাসূলের উদ্দেশ্যেই গন্য হবে। আর যার হিজরত হবে ইহকাল লাভের জন্য অথবা কোন
মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে, তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই গণ্য হবে, যে জন্য
সে হিজরত করেছে’।[7]
ওমর বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) তাঁর দো‘আয় বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমার সকল আমল কবুল কর (রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ী করার তাওফীক দাও), সেটি শুধুমাত্র তোমার সন্তুষ্টির জন্য করার তাওফীক দাও এবং সেটি যেন কারো উদ্দেশ্যে না হয়।
ফুযাইল বিন ইয়ায
বলেন, আমল হ’তে হবে ইখলাছের সাথে ও সঠিক পদ্ধতিতে। বলা হ’ল হে আবু আলী!
ইখলাছ ও সঠিক পদ্ধতিটা কি? তিনি বললেন, আমলটি যদি খালেছ হয়, সঠিক পদ্ধতিতে
না হয় তাহ’লে কবুল হবে না। আর যদি সেটি সঠিক পদ্ধতিতে হয় কিন্তু খালেছ
নিয়তে না হয়, তাহ’লেও কবুল হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত খালেছ নিয়তে ও সঠিক
পদ্ধতিতে না হবে। আর খালেছ নিয়ত হ’ল শুধুমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইবাদত করা
ও সঠিক পদ্ধতি হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর ছহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী করা।[8]
(খ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুসরণ করা : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ إِنْ كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللهََ فَاتَّبِعُوْنِيْ يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ ‘হে নবী! বল, যদি তোমরা আল্লাহর ভালবাসা পেতে চাও, তবে আমার অনুসরণ কর, তাহ’লে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন ও তোমাদের অপরাধ সমূহ মার্জনা করে দিবেন, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়’ (আলে ইমরান ৩১)।
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) আমাদেরকে যা দিয়েছেন তার অনুসরণ করতে হবে আর যা থেকে নিষেধ করেছেন
তা বর্জন করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ
فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا وَاتَّقُوْا اللهَ إِنَّ
اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা তোমরা গ্রহণ কর
এবং যা থেকে নিষেধ করেছেন তা হ’তে বিরত থাকো, আর আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই
আল্লাহর শাস্তি খুবই কঠিন’ (হাশর ৭)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে কেউ এমন কোন আমল করল, যে ব্যাপারে আমাদের অনুমোদন নেই তা প্রত্যাখ্যাত’।[9] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে নেই এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, তা প্রত্যাখ্যাত’।[10]
ইবাদত কবুলের দু’টি শর্তের সাথে আরেকটি শর্ত : আমলটি বিশুদ্ধ আক্বীদার ভিত্তিতে সম্পন্ন হ’তে হবে, নচেৎ তা কবুল হবে না। মহান আল্লাহ বলেন, مَنْ عَمِلَ صَالِحاً مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُم بِأَحْسَنِ مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ ‘মুমিন পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎ কর্ম করবে, তাকে আমরা নিশ্চয়ই আনন্দময় জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার প্রদান করব’ (নাহল ৯৭)। আয়াতটিতে শর্তযুক্ত হয়েছে যে, আমল কবুলের জন্য বিশুদ্ধ আক্বীদায় বিশ্বাসী হ’তে হবে এবং মুমিন হ’তে হবে। কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আমল করলে আল্লাহর নিকট কশ্মিনকালেও তা কবুল হবে না। মহান আল্লাহ বলেন, وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوْا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاء مَّنثُوْراً ‘আমরা তাদের কৃতকর্মগুলোর দিকে অগ্রসর হব, অতঃপর সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’ (ফুরক্বান ২৩)। ক্বিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ বান্দার ভাল-মন্দের বিচার করবেন। ঐ সময় মুশরিকরা তাদের আমল থেকে কোন ফায়দা পাবে না এবং সেগুলো তাদেরকে নাজাত দিতে পারবে না। কেননা তাদের আমল শরী‘আত অনুযায়ী হয়নি এবং তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়নি। সুতরাং সেটা বাতিল হবে।[11] মহান আল্লাহ বলেন, أُوْلَـئِكَ الَّذِيْنَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الآخِرَةِ إِلاَّ النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُواْ فِيْهَا وَبَاطِلٌ مَّا كَانُواْ يَعْمَلُوْنَ ‘তারা এমন লোক যে, তাদের জন্য আখেরাতে জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নেই। আর তারা যা কিছু করেছিল তাও বিফল হবে এবং তারা যা করে তা বাতিল হবে’ (হূদ ১৬)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا أَعْمَالُهُمْ كَسَرَابٍ بِقِيْعَةٍ يَحْسَبُهُ الظَّمْآنُ مَاءً حَتَّى إِذَا جَاءهُ لَمْ يَجِدْهُ شَيْئاً وَوَجَدَ اللهَ عِنْدَهُ فَوَفَّاهُ حِسَابَهُ وَاللهُ سَرِيْعُ الْحِسَابِ ‘যারা কুফরী করে তাদের কর্ম মরুভূমির মরীচিকা সদৃশ, পিপাসার্ত যাকে পানি মনে করে থাকে; কিন্তু সে ওর নিকট উপস্থিত হ’লে দেখবে ওটা কিছু নয় এবং সে তার নিকট পাবে আল্লাহকে। অতঃপর তিনি তার কর্মফল পূর্ণ মাত্রায় দিবেন। আল্লাহ হিসাব গ্রহণে তৎপর’ (নূর ৩৯)। তিনি আরো বলেন,مَّثَلُ الَّذِيْنَ كَفَرُواْ بِرَبِّهِمْ أَعْمَالُهُمْ كَرَمَادٍ اشْتَدَّتْ بِهِ الرِّيْحُ فِيْ يَوْمٍ عَاصِفٍ لاَّ يَقْدِرُوْنَ مِمَّا كَسَبُواْ عَلَى شَيْءٍ ذَلِكَ هُوَ الضَّلاَلُ الْبَعِيْدُ ‘যারা তাদের প্রতিপালককে অস্বীকার করে তাদের উপমা তাদের কর্মসমূহ ভস্ম সদৃশ যা ঝড়ের দিনে বাতাস প্রচন্ড বেগে উড়িয়ে নিয়ে যায়; যা তারা উপার্জন করে তার কিছুই তারা তাদের কাজে লাগাতে পারে না; এটা তো ঘোর বিভ্রান্তি’ (ইবরাহীম ১৮)।
(৩) কল্যাণকর ইলম শিক্ষা করা : মানুষ যখন শরী‘আতের জ্ঞান অর্জন করবে, কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর জ্ঞানার্জন করে নিজের ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে বাস্তবায়ন করবে তখনই তার ঈমান বাড়বে। এটি ঈমান বৃদ্ধির অন্যতম উপায়। মহান আল্লাহ বলেন, شَهِدَ اللهُ أَنَّهُ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ وَالْمَلاَئِكَةُ وَأُوْلُواْ الْعِلْمِ قَآئِمَاً بِالْقِسْطِ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ ‘আল্লাহ সাক্ষ্য প্রদান করেন যে, নিশ্চয়ই তিনি ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই এবং ফেরেশতাগণ, ন্যায়নিষ্ঠ বিদ্বানগণও (সাক্ষ্য প্রদান করেন) তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য মা‘বূদ নেই, তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (আলে ইমরান ১৮)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, لَّـكِنِ الرَّاسِخُوْنَ فِيْ الْعِلْمِ مِنْهُمْ وَالْمُؤْمِنُوْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِمَا أُنزِلَ إِلَيكَ وَمَا أُنزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَالْمُقِيْمِيْنَ الصَّلاَةَ وَالْمُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَالْمُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ أُوْلَـئِكَ سَنُؤْتِيْهِمْ أَجْراً عَظِيْماً ‘কিন্তু তাদের মধ্যে যারা জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বিশ্বাসীগণের মধ্যে যারা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছিল তৎপ্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং যারা ছালাত প্রতিষ্ঠাকারী ও যাকাত প্রদানকারী এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী, তাদেরকেই আমি মহা পুরস্কার দেব’ (নিসা ১৬২)। কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানার্জন করে আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে ঈমান বাড়ে। মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ آمِنُواْ بِهِ أَوْ لاَ تُؤْمِنُواْ إِنَّ الَّذِيْنَ أُوتُواْ الْعِلْمَ مِن قَبْلِهِ إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّوْنَ لِلأَذْقَانِ سُجَّداً، وَيَقُوْلُوْنَ سُبْحَانَ رَبِّنَا إِن كَانَ وَعْدُ رَبِّنَا لَمَفْعُوْلاً، وَيَخِرُّوْنَ لِلأَذْقَانِ يَبْكُوْنَ وَيَزِيْدُهُمْ خُشُوْعاً- ‘তুমি বল, তোমরা কুরআনে বিশ্বাস কর অথবা বিশ্বাস না কর, যাদেরকে এর পূর্বে জ্ঞান দেয়া হয়েছে তাদের নিকট যখন এটা পাঠ করা হয় তখনই তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং বলে, আমাদের প্রতিপালক পবিত্র। আমাদের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি কার্যকরী হয়েই থাকে। আর তারা কাঁদতে কাঁদতে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে’ (বানী ইসরাঈল ১০৭-১০৯)।
বিদ্বানগণ কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানার্জন করে নিজেরা তদনুযায়ী আমল করেন এবং অন্যদের নিকট প্রচার করে থাকেন। এতে একে অপরের ঈমান বাড়ে এবং ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন,وَلِيَعْلَمَ الَّذِيْنَ أُوْتُوْا الْعِلْمَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَيُؤْمِنُوْا بِهِ فَتُخْبِتَ لَهُ قُلُوْبُهُمْ وَإِنَّ اللهَ لَهَادِ الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ ‘আর এজন্যও যে, যাদের জ্ঞান দেয়া হয়েছে তারা যেন জানতে পারে যে, এটা তোমার প্রতিপালকের নিকট হ’তে প্রেরিত সত্য। অতঃপর তারা যেন বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর যেন ওর প্রতি অনুগত হয়। যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আল্লাহ সরল পথে পরিচালিত করেন’ (হজ্জ ৫৪)। মানুষ কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানার্জন দ্বারাই সঠিক পথ প্রাপ্ত হয়। মহান আল্লাহ বলেন,وَيَرَى الَّذِيْنَ أُوتُوا الْعِلْمَ الَّذِيْ أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَ هُوَ الْحَقَّ وَيَهْدِيْ إِلَى صِرَاطِ الْعَزِيْزِ الْحَمِيْدِ ‘যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে তারা বিশ্বাস করে যে, তোমার প্রতিপালকের নিকট হ’তে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা সত্য। এটা মানুষকে পরাক্রমশালী ও মহা প্রশংসিত আল্লাহর পথ নির্দেশ করে’ (সাবা ৬)। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ غَفُورٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মধ্য যারা আলেম তারা তাঁকে ভয় করে। আল্লাহ পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল’ (ফাতির ২৮)।
কল্যাণকর
ইলম শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ থেকে অন্ধকার দূর করা এবং ঈমান বৃদ্ধি করা
সম্ভব। মহান আল্লাহ বলেন,قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِيْنَ يَعْلَمُوْنَ
وَالَّذِيْنَ لَا يَعْلَمُوْنَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُوْلُوْا
الْأَلْبَابِ ‘বল, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?
বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে’ (যুমার ৯)। অতএব কুরআন-সুন্নাহর ইলম অর্জন করা ফরয। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের উপর (শরী‘আতের) জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরয’।[12] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকেই দ্বীনের ইলম দান করেন’।[13]
ইলম শিক্ষা করলে জান্নাতে যাবার পথ সহজ হয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি ইলম
শিক্ষার জন্য পথ চলে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন।[14]
ইলম অর্জনের মাধ্যমে নবীগণের উত্তরাধিকারী হওয়া যায়। নবী করীম (ছাঃ) বলেন,
‘আলেমগণই হ’লেন নবীগণের উত্তরাধিকারী। নবীগণ দীনার বা দিরহামের
উত্তরাধিকারী করেন না। নিশ্চয়ই তাঁরা ইলমের উত্তরাধিকারী করেন। সুতরাং যে
ব্যক্তি তা গ্রহণ করল, সে বৃহদাংশ গ্রহণ করল’।[15] ইলম অর্জন করে অপরকে
শিক্ষা দিলে, সে অনুযায়ী আমলকারী যে নেকী পাবে, শিক্ষাদাতাও অনুরূপ নেকী
পাবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি দ্বীনী ইলম শিক্ষা দিবে সে ঐ
ব্যক্তির ন্যায় ছওয়াব পাবে, যে তার উপর আমল করল। কিন্তু আমলকারীর ছওয়াব
থেকে একটুকুও কমানো হবে না’।[16]
কল্যাণকর
জ্ঞান অর্জনকারীর উপর আল্লাহ রহম করেন। আর ফেরেশতাগণ, আসমান-যমীনের
অধিবাসীগণ, পিপীলিকা এমনকি সমুদ্রের মাছও তার জন্য দো‘আ করতে থাকে। আবু
উমামা বাহেলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সামনে
দু’জন লোকের কথা উল্লেখ করা হ’ল। তাদের একজন আলেম, অপর জন আবেদ। তখন তিনি
বলেন, আলেমের মর্যাদা আবেদের উপর ঐরূপ, যেরূপ আমার মর্যাদা তোমাদের
সাধারণের উপর। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ রহমত করেন
এবং তাঁর ফেরেশতামন্ডলী, আসমান-যমীনের অধিবাসী এমনকি পিপীলিকা তার গর্তে
থেকে এবং মাছও কল্যাণের শিক্ষা দানকারীর জন্য দো‘আ করে’।[17] দ্বীনী ইলম
শিক্ষা দিয়ে গেলে মৃত্যুর পরেও তার ছওয়াব পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বলেন, ‘যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তিনটি ব্যতীত তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়।
ঐ তিনটি আমল হ’ল প্রবাহমান দান-ছাদাক্বা, এমন ইলম যার দ্বারা উপকৃত হওয়া
যায় এবং এমন নেক সন্তান যে তার জন্য দো‘আ করে’।[18]
অতএব
ঈমান বাড়াতে হ’লে ও ইহলোক-পারলোক সুখময় জীবন-যাপন করতে হ’লে সবার উপর
আবশ্যক হবে সন্তান-সন্ততিক ছোট থেকেই দ্বীনের সঠিক জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া।
দ্বীনী ইলম শিক্ষা লাভ না করলে পৃথিবী অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। ফলে
মানুষ দ্বীনী বিষয়ে অজ্ঞদের নিকট থেকে ফৎওয়া নিয়ে গোমরাহ হবে। আব্দুল্লাহ
ইবনু আমর ইবনুল আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল
(ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের থেকে ইলম ছিনিয়ে নেন না। বরং
দ্বীনের আলেমদের উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইলমকে উঠিয়ে নিবেন। তখন কোন আলেম
অবশিষ্ট থাকবে না। ফলে লোকেরা মূর্খদেরকেই নেতা বানিয়ে নিবে, তাদের জিজ্ঞেস
করা হ’লে তারা না জেনে ফৎওয়া প্রদান করবে, এতে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে
এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে’।[19]
[চলবে]
আব্দুল মতীন
লিসান্স ও এম.এ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।
[1]. বুখারী হা/১৩৫৯।
[2]. ইবনু তায়মিয়া, শারহুল আক্বীদা আল-ওয়াসিতিয়্যাহ, পৃঃ ১৩।
[3]. মুহাম্মাদ ছালেহ আল-ওছায়মীন, ফাৎহু রাবিবল বারিয়্যাহ, পৃঃ ১৫।
[4]. বুখারী হা/৭৩৯২, ‘তাওহীদ’ অধ্যায়।
[5]. বুখারী হা/৬৪১০ ‘দু‘আসমূহ’ অধ্যায়।
[6]. ইবনে তায়মিয়া, মাজমূউ ফাতাওয়া, ৬/৩৮০-৩৮১; মুহাম্মাদ ছালেহ আল-উছায়মীন, আল-কাওয়ায়েদুল মুছলা, পৃঃ ১৫।
[7]. বুখারী হা/১; মুসলিম হা/৪৯২৭, ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[8]. ইবনে তায়মিয়াহ, শারহু রিসালাহ তাদামুরিয়্যাহ (দারু কুনূয ইশবিলিয়া, প্রথম সংস্করণ ১৪২৫ হিঃ), পৃঃ ৫৩৫।
[9]. মুসলিম হা/৪৪৯৩, ‘বিচার-ফায়ছালা’ অধ্যায়।
[10]. মুসলিম হা/৪৪৯২।
[11]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৬/১১৪।
[12]. ইবনু মাজাহ হা/২২৪ সনদ ছহীহ।
[13]. বুখারী হা/৭১।
[14]. বুখারী ‘ইলম’ অধ্যায়, পৃঃ ১৬।
[15]. আবু দাঊদ হা/৩১৫৭; ইবনু মাজাহ হা/২২৩; তিরমিযী হা/২৬০৬; সনদ ছহীহ।
[16]. ইবনু মাজাহ হা/২৪০, সনদ হাসান।
[17]. ছহীহ তারগীব হা/৭৭; মিশকাত হা/২১৩; ইবনু মাজাহ হা/২২৩, সনদ ছহীহ।
[18]. মুসলিম হা/১৬৩১।
[19]. বুখারী হা/১০০; মুসলিম হা/২৬৭৩।